আসল কথা এই যে, দর্শনবিজ্ঞানের মোটা কথার আশ্রয় নেওয়ার অর্থ হচ্ছে কোনো বিশেষ সমস্যার মীমাংসা করা নয়, তার কাছ থেকে পলায়ন করা। দর্শন কি বিজ্ঞান যে আজ পর্যন্ত এমন-কোনো সাধারণ নিয়ম আবিষ্কার করেন নি যার সাহায্যে কোনো বিশেষ বিষয়ের বিশেষ মীমাংসা করা যায়, তার কারণ সকল বিশেষ বস্তুর বিশেষত্ব বাদ দিয়েই সর্বসাধারণে গিয়ে পৌছোনা যায়। বিশ্বকে নিঃস্ব করেই দার্শনিকেরা বিশ্বতত্ত্ব লাভ করেন। সোনা ফেলে আঁচলে গিট দেওয়াই দার্শনিকদের চিরকেলে অভ্যাস। এ উপায়ে সম্ভবত ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভ হতে পারে, কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞান লাভ হয় না। সমাজের উন্নতি দেশকালপাত্র-সাপেক্ষ, সুতরাং দেশকালের অতীত কিংবা সর্বদেশে সর্বকালে সমান বলবৎ কোনো সত্যের দ্বারা সে উন্নতি সাধন করবার চেষ্টা বৃথা। ফিজিক্স কিংবা মেটাফিজিক্সএর তত্ত্ব সমাজতত্ত্ব নয়, এবং এ দুই তত্ত্ব যে পৃথক জাতীয় তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ বিপিনবাবুর আবিষ্কৃত ঊর্ধ্বগতির দৃষ্টান্ত থেকেই দেখানো যেতে পারে। এমন-কোনো জাগতিক নিয়ম নেই যে, মানুষের চেষ্টা ব্যতিরেকেও তার উন্নতি হবে। হ্রাস বৃদ্ধি ও বিপর্যয়, এ তিনই জীবনের ধর্ম; সুতরাং সমাজের উন্নতি ও অবনতি মানুষের দ্বারাই সাধিত হয়। মানবের ইচ্ছাশক্তিই মানবের উন্নতির মূল কারণ। তা ছাড়া মানবের উন্নতি যে ক্রমোন্নতি হতে বাধ্য, এমন-কোনো নিয়মের পরিচয় ইতিহাস দেয় না। বরং ইতিহাস এই সত্যের পরিচয় দেয় যে, বিপর্যয়ের ফলেই মানব অনেক সময়ে মহা উন্নতি লাভ করেছে। যে-সব মহাপুরুষকে আমরা ঈশ্বরের অবতার বলে মনে করি, যথা বুদ্ধদেব যিশুখৃস্ট মহম্মদ চৈতন্য প্রভুতি এরা মানুষের মনকে বিপর্যস্ত করেই মানবসমাজকে উন্নত করেছেন; এরা পাইরাল, মোশনএর ধার ধারতেন না কিংবা স্থিতি ও গতির মধ্যে দূতীগিরি করে তাদের মিলন ঘটানো নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করেন নি।
মানুষের মনকে যদি গেরোবাজের মতো আকাশে ডিগবাজি খেতে খেতে উঠতে হত, এবং মানবসমাজকে যদি লোটনের মতো মাটিতে লুটতে লুটতে এগোতে হত, তা হলে এ দুয়ের বেশিক্ষণ সে কাজ করতে হত না, দু দণ্ডেই তাদের ঘাড় লটকে পড়ত। সুতরাং কি মন কি সমাজ, কোনোটিকেই পাকচক্রের ভিতর ফেলবার আবশ্যকতা নেই। বিপিনবাবুর বক্তব্য যদি এই হয় যে, পৃথিবীতে অবাধগতি বলে কোনো জিনিস নেই, তা হলে আমরা বলি—এ সত্য শিশুতেও জানে যে পদে পদে বাধা অতিক্রম করেই অগ্রসর হতে হয়। তাই বলে স্থিতি-গতির সমন্বয় করে চলার অর্থ যে শুধু হামাগুড়ি দেওয়া, এ কথা শিশুতেও মানে না। অধোগতি অপেক্ষা উন্নতির পথে যে অধিকতর বাধা অতিক্রম করতে হয়, এ তো সর্বলোকবিদিত। কিন্তু এর থেকে এ প্রমাণ হয় না যে, স্থিতির বিরুদ্ধে গতি নামক ‘বিরোধটি জাগিয়ে’ রাখা মূর্খতা এবং সেটিকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়াটাই জ্ঞানীর কর্তব্য। জড়ের সঙ্গে যোঝাযুঝি করেই জীবন স্ফূর্তি লাভ করে। সুতরাং পুরাতন যে-পরিমাণে জড়, সেই পরিমাণে নবজীবনকে তার সঙ্গে লড়তে হবে। যে সমাজের যত অধিক জীবনীশক্তি আছে, সে সমাজে স্থিতিতে ও গতিতে জড়ে ও জীবে তত বেশি বিরোধের পরিচয় পাওয়া যাবে। নূতন-পুরাতনের এই বিরোধের ফলে যা ভেঙে পড়ে তার চাইতে যা গড়ে ওঠে, সমাজের পক্ষে তার মূল্য ঢের বেশি। কোনো নূতনের বরের ঘরের পিসি ও পুরাতনের কনের ঘরের মাসির মধ্যস্থতায় এ দুই পক্ষের ভিতর যে চিরশান্তি স্থাপিত হবে, এ আশা দুরাশা মাত্র।
আমি পূর্বে বলেছি যে, নূতন-পুরাতনে যদি কোথায়ও বিবাদ থাকে তো সে সাহিত্যে, সমাজে নয়। আমার বিশ্বাস যদি অন্যরূপ হত, তা হলে আমি বিপিনবাবুর কথার প্রতিবাদ করতুম না। তার কারণ, প্রথমত আমি সমাজসংস্কারব্যাপারে অব্যবসায়ী। অতএব এ ব্যাপারে কোন ক্ষেত্রে আক্রমণ করতে হয় এবং কোন ক্ষেত্রে পৃঠভঙ্গ দিতে হয় এবং কোনটি বিগ্রহের এবং কোনটি সন্ধির যুগ তা আমার জানা নেই। দ্বিতীয়ত, বিপিনবাবুর উদ্ভাবিত পদ্ধতি অনুসারে নূতন-পুরাতনের জমাখরচ করলে সামাজিক হিসাবে পাওয়া যায় শুধু শূন্য। সুতরাং কি নূতন, কি পুরাতন, কোনো পক্ষই ও-উপায়ে কোনো সামাজিক সমস্যার মীমাংসা করবার চেষ্টামাত্রও করবেন না। তৃতীয়ত, ডাক্তার শীলের মতে–
সহস্র বৎসরাবধি এই দেশ ঠিক সেই জায়গায়ই বসিয়া আছে; তার আর কোনও বিকাশ হয় নাই।
যে সমাজ হাজার বৎসর এক স্থানে এক ভাবে বসে আছে তার আসন টলাবার শক্তি আমাদের মতো সাহিত্যিকের শরীরে নেই। বিপিনবাবুর মতামত কর্মকাণ্ডের নয়, জ্ঞানকাণ্ডের বস্তু বলেই এ বিচারে প্রবৃত্ত হয়েছি। তাঁর বর্ণিত সময়ের কোনো সার্থকতা সমাজে থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সাহিত্যে নেই। সামাজিক ক্রিয়াকর্মে দুধের সঙ্গে জলের সমন্বয়-প্ৰচলন দেখা যায়। কিন্তু তাই বলে সাহিত্যে জলোদুধের আমদানি আমরা বিনা আপত্তিতে গ্রাহ্য করতে পারি নে। কারণ ও-বস্তু অন্তরাত্মার পখকে মুখরোচকও নয়, স্বাস্থ্যকরও নয়। অথচ সরস্বতীর মন্দিরে কিঞ্চিৎ আর কিঞ্চিৎ মদের সমন্বয় যে জ্ঞানামৃত বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে, তার প্রমাণ তো হাতে-হাতেই পাওয়া যাচ্ছে। সাহিত্যের এই পাঞ্চ্ পান করে আমাদের সমাজের আজ মাথা ঘুরছে। এই ঘুরুনির চোটে অনেকে চোখে এত ঝাপসা দেখেন যে, কোন বস্তু নূতন আর কোন বস্তু পুরাতন, কোনটি স্বদেশী আর কোনটি বিদেশী-তাও তারা চিনতে পারেন না। এ অবস্থায় বাঙালির প্রথম দরকার সমাজে নূতন-পুরাতনের সময় নয়, মনে নূতন-পুরাতনের বিচ্ছেদ ঘটানো। আমাদের শিক্ষা যাকে এক সঙ্গে গুলে ঘুলিয়ে দিচ্ছে, আমাদের সাহিত্যের কাজ হওয়া উচিত তাই বিশ্লেষণ করে পরিষ্কার করা।