তার পর মীমাংসা অর্থে যদি রফাছাড়ের নিষ্পত্তি হয় তা হলে বলতেই হবে যে, বিপিনবাবুর মীমাংসার সঙ্গে ব্যাস-জৈমিনির মীমাংসার কোনোই সম্পর্ক নেই। বেদান্তের মীমাংসা আর যাই হোক, আপস-মীমাংসা নয়। বেদান্তদর্শন নিজের দাবির এক-পয়সাও ছাড়ে নি, কোনো বিরোধী মতের দাবির এক-পয়সাও মানে নি। উত্তর-মীমাংসাতে অবশ্য সময়ের কথা আছে, কিন্তু সে সময়ের অর্থ যে কি, তা শংকর অতি পরিষ্কার ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন
এ সূত্ৰ বেদান্তবাক্যরূপ কুসুম গাঁথিবার সূত্র, অনুমান বা যুক্তি গাঁথিবার নহে ইহাতে নানাস্থানস্থ বেদান্তবাক্য-সকল আহৃত হইয়া মীমাংসিত হইবে।
এবং শংকরের মতে মীমাংসার অর্থ ‘অবিরোধী তর্কের সহিত বেদান্ত বাক্যসমূহের বিচার’। এ বিচারের উদ্দেশ্য এই প্রমাণ করা যে, বেদান্ত-বাক্যসমূহ পরস্পরবিরোধী নয়। হেগেলের পশ্চিম-মীমাংসার সহিত ব্যাসের উত্তর-মীমাংসার কোনো মিল নেই; না মতে, না পদ্ধতিতে। ব্রহ্মসূত্রের প্রতিপাদ্য বিষয় পরব্রহ্ম, হেগেলের প্রতিপাদ্য বিষয় অপরব্রহ্ম। নিরুক্তের মতে ভাববিকার ছয়প্রকার, যথা: সৃষ্টি স্থিতি হ্রাস বৃদ্ধি বিপর্যয় ও লয়। শংকর হ্রাস বৃদ্ধি ও বিপর্যয়কে গণনার মধ্যে আনেন নি, কেননা তাঁর মতে এ তিনটি হচ্ছে স্থিতিকালের ভাববিকার। অপর পক্ষে এই তিনটি ভাবই হচ্ছে হেগেলের অবলম্বন, কেননা তাঁর অ্যাবসলিউট হচ্ছে ইটর্নল্ বিকামিং। সুতরাং হেগেলের ব্রহ্ম শুধু অপরব্রহ্ম নন, তিনি ঐতিহাসিক ব্রহ্ম—অর্থাৎ ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ক্রমবিকাশ হচ্ছে। হেগেলের মতে তার সমসাময়িক ব্রহ্ম প্রুশিয়া-রাজ্যে বিগ্রহবান হয়েছিলেন। শংকর যে-জ্ঞানের উল্লেখ করেছেন, সে-জ্ঞান মানসিক ক্রিয়া নয়; অপর পক্ষে হেগেলের জ্ঞান ক্রিয়ারই যুগপৎ কর্তা ও কর্ম।
বেদান্তের মতে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করবার উপায় যুক্তি নয়; অপর পক্ষে হেগেলের মতে যুক্তির উপরেই ব্রহ্মের অস্তিত্ব নির্ভর করে। থিসিস এবং অ্যান্টিথিসিসের সুতোয় সততায় গেরো দিয়েই এক-একটি ব্রহ্মমহর্ত পাওয়া যায়। বেদান্তের ব্রহ্ম স্থির-বর্তমান, হেগেলের ব্রহ্ম চির-বর্ধমান-অর্থাৎ একটি স্ট্যাটিক অপরটি ডাইনামিক। আসল কথা এই যে, বেদান্ত যদি থিসিস হয়, তা হলে হেগেল তার অ্যান্টিথিসিস-এ দুই মতের অভেদ জ্ঞান শুধু অজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব।
.
৭.
বিপিনবাবুর হাতে পড়ে শুধু বাদরায়ণ নয়, কপিলও হেগেলে লীন হয়ে গেছেন।
বিপিনবাবু আবিষ্কার করেছেন যে, যার নাম থিসিস অ্যান্টিথিসিস এবং সিনথেসিস, তারই নাম তমঃ রজঃ ও সত্ত্ব। কেননা তার মতে থিসিসের বাংলা হচ্ছে স্থিতি, অ্যান্টিথিসিসের বাংলা বিরোধ, এবং সিনথেসিসের বাংলা সমন্বয়। এ অনুবাদ অবশ্য গায়ের জোরে করা। কেননা, থিসিস যদি স্থিতি হয় তা হলে অ্যান্টিথিসিস অ-স্থিতি (গতি) এবং সিনথেসিস সংস্থিতি। সে যাই হোক, সাংখ্যের ত্রিগুণের সঙ্গে অবশ্য হেগেলের ত্রিসূত্রের কোনো মিল নেই; কেননা সাংখ্যের মতে এই ত্রিগুণের সমন্বয়ে জগতের লয় হয়, সৃষ্টি হয় না। সত্ত্ব রজঃ তমের মিলন নয়, বিচ্ছেদই হচ্ছে সৃষ্টির কারণ; অপর পক্ষে হেগেলের মতে থিসিস এবং অ্যান্টিথিসিসের মিলনের ফলে জগৎ সৃষ্ট হয়। বিপিনবাবুর ন্যায় পর্ব পশ্চিম সকল দর্শনের সমন্বয়কারের কাছে অবশ্য এ-সকল পার্থক্য তুচ্ছ এবং অকিঞ্চিৎকর; অতএব সর্বথা উপেক্ষণীয়।
তমঃ ও রজের মিলনে যে বহু জন্মলাভ করে, তা হেগেলের সিনথেসিস হতে পারে, কিন্তু তা সাংখ্যের সত্ত্ব নয়। এ কথা দুটি-একটি উদাহরণের সাহায্যে সহজেই প্রমাণ করা যেতে পারে। আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মানুষের মন ও মানবসমাজের উন্নতির পদ্ধতি। বিপিনবাবুর উদভাবিত কপিল-হেগেল-দর্শন-অনুসারে ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়ায়–
তামসিক মন=সুপ্ত
রাজসিক মন =জাগ্রত
সাত্ত্বিক মন=ঝিমন্ত
তামসিক সমাজ=মৃত
রাজসিক সমাজ=জীবিত
সাত্ত্বিক সমাজ=জীবন্মৃত
অর্থাৎ সমন্বয়ের ফলে রজোগুণের উন্নতি নয়, অবনতি হয়। সগুণ যে তমোগ এবং রজোগণের মাঝামাঝি একটি পদার্থ এ কথা সাংখ্যাচার্যেরা অবগত নন, কেননা তারা হেগেল পড়েন নি। উক্ত দর্শনের মতে সত্ত্বগুণ রজোগুণের অতিরিক্ত, অন্তর্ভুত নয়। সাত্ত্বিক ভাব যে বিরোধের ভাব নয়, তার কারণ রজোগুণ যখন তমোগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয় তখনই তা সত্ত্বগণে পরিণত হয়। হেগেলের মত অবশ্য সাংখ্যমতের সম্পূর্ণ বিপরীত। সাংখ্যকে উলটে ফেললে যা হয়, তারই নাম হেগেল-দর্শন। সাংখ্যমতে সক্ষম অনলোমরুমে স্বল হয়, হেগেল-মতে ঐ একই পদ্ধতিতে প্রল সক্ষম হয়। সাংখ্যের প্রকৃতি হেগেলের পুষ। সাংখ্যের মতে সৃষ্টিতে প্রকৃতি বিকারগ্রস্ত হন, হেগেলের মতে পুরুষ সাকার হন।
বিপিনবাবু দেশী-বিলাতি-দর্শনের সমন্বয় করে যে মীমাংসা করেছেন সে হচ্ছে অপুর্ব মীমাংসা; কেননা, কি স্বদেশে, কি বিদেশে, ইতিপূর্বে এরূপ অন্তর্ভূত মীমাংসা আর কেউ করেন নি।
নূতন-পুরাতনের সমন্বয়ের এই যদি নমুনা হয় তা হলে নূতন ও পুরাতন উভয়েই সমন্বয়কারকে বলবে—ছেড়ে দে বাবা, লড়ে বাঁচি।
বিপিনবাবু, যাকে সমন্বয় বলেন, বাংলা ভাষায় তার নাম খিচুড়ি।
সমাজদেবতার নিকটে পালমহাশয় যে খিচুড়িভোগ নিবেদন করে দিয়েছেন, যিনি তার প্রসাদ পাবেন তার যে কৃষ্ণতি হবে, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই।