বিপিনবাবুর আবিষ্কৃত এই উন্নতিতত্ত্ব যে নূতন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই; কিন্তু সত্য কি না তাই হচ্ছে বিচার্য।
বিপিনবাবু বলেন যে, রজ্জুতে সর্পজ্ঞান সত্যজ্ঞান নয়, ভ্রম। এ কথা সৰ্ববাদীসম্মত। কিন্তু রজ্জুতে মতাজ্ঞান যে সত্যজ্ঞান, এরূপ বিশ্বাস করবার কারণ কি। রজ্জু জড়পদার্থ, এবং সতেজ ব্রততী সজীব পদার্থ। দড়ি বেচারার আপনার ‘গতিবেগ’ বলে কোনোরূপ গুণ কি দোষ নেই। ও-বস্তুকে ইচ্ছে করলে নীচে থেকে জড়িয়ে উপরে তুলতে পার, উপর থেকে জড়িয়ে নীচে নামাতে পার, লম্বা করে ফেলতে পার, তাল-পাকিয়ে রাখতে পার। রজ্জু উন্নতি অবনতি তির্যকগতি কি সরলগতি-কোনোরূপ গতির ধার ধারে না। বিপিনবাবু এ ক্ষেত্রে রজ্জুর যে ব্যবহার করেছেন তা জ্ঞানের গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।
তার পর বিপিনবাবু এ সত্যই-বা কোন বিজ্ঞান থেকে উদ্ধার করলেন যে, মানুষের মন ও মানবসমাজ উদ্ভিদজাতীয়? সাইকলজি এবং সোশিয়লজি যে বটানির অন্তর্ভূত, এ কথা তো কোনো কেতাবে-কোরানে লেখে না। তর্কের খাতিরে এই অদ্ভুত উদ্ভিদতত্ত্ব মেনে নিলেও সকল সন্দেহের নিরাকরণ হয় না। মনে স্বতই এই প্রশ্নের উদয় হয় যে, মানুষের মন ও মানবসমাজ উদ্ভিদ হলেও ঐ দুই পদার্থ যে লতাজাতীয়, এবং বক্ষজাতীয় নয়, তারই-বা প্রমাণ কোথায়। গাছের মতো সোজাভাবে সরলরেখায় মাথাঝাড়া দিয়ে ওঠা যে মানবধর্ম নয়, কোন যুক্তি কোন প্রমাণের বলে বিপিনবাবু এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন তা আমাদের জানানো উচিত ছিল; কেননা পালমহাশয়ের আন্তবাক, আমরা বৈজ্ঞানিক সত্য বলে গ্রাহ্য করতে বাধ্য নই। উকি যে যুক্তি নয়, এ জ্ঞান বিপিনবাবুর থাকা উচিত। উত্তরে হয়তো তিনি বলবেন যে, উগতিমাত্রেই তির্যকগতি-এই হচ্ছে জাগতিক নিয়ম। ঊর্ধ্বগতিমাত্ৰকেই যে কর আকার ধারণ করতে হবে, জড়জগতের এমন কোনো বিধিনির্দিষ্ট নিয়ম আছে কি না জানি নে। যদি থাকে তো মানুষের মতিগতি যে সেই একই নিয়মের অধীন এ কথা তিনিই বলতে পারেন, যিনি জীবে জড় এম করেন।
আপনার গতিবেগের অবিচ্ছিন্নতা রক্ষা করিয়া এক স্তর হইতে অন্য তর যাইতে হইলেই ঐ উদ্ধর্মখী তির্যকগতির পথ অনুসরণ করিতে হয়।
বিপিনবাবুর এই মত যে সম্পূর্ণ ভুল তা তাঁর প্রদর্শিত উদাহরণ থেকেই প্রমাণ করা যায়। ‘তালগাছ যে সরলরেখার ন্যায় ঊদ্ধদিকে উঠে’-তার থেকে এই প্রমাণ হয় যে, যে নিজের জোরে ওঠে সে সিধেভাবেই ওঠে; আর যে পরকে আশ্রয় করে ওঠে সেই পেঁচিয়ে ওঠে, যথা, তরুর আশ্রিত লতা।
দশ ছত্র রচনার ভিতর ডাইনামিকস বটানি সোশিয়লজি সাইকলজি প্রতি নানা শাস্ত্রের নানা সূত্রের এহেন জড়াপটকি বাধানো যে সম্ভব, এ জ্ঞান আমার ছিল না। সম্ভবত পালমহাশয় যে নূতন দৃষ্টি নিয়ে ঘরে ফিরেছেন, সেই দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে যে, স্বর্গের সিঁড়ি গোল সিঁড়ি। যদি তাই হয়, তা হলে এ কথাও মানতে হবে যে, পাতালের সিঁড়িও গোল; কারণ ওঠা-নামার জাগতিক নিয়ম অবশ্যই এক। সুতরাং ঘুরপাক খাওয়ার অর্থ ওঠাও হতে পারে, নামাও হতে পারে। এ অবস্থায় উন্নতিশীলের দল যদি কুটিল পথে না চলে সরল পথে চলতে চান, তা হলে তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না।
.
৫.
বিপিনবাবু যে তাঁর প্রবন্ধের বৈজ্ঞানিক পর্যায়ে নানারূপ পরস্পর-বিরোধী বাক্য একত্র করতে কুণ্ঠিত হন নি তার কারণ তিনি ইউরোপীয় দর্শন হতে এমন-এক সত্য উদ্ধার করেছেন, যার সাহায্যে সকল বিরোধের সমন্বয় হয়। হেগেলের থিসিস অ্যান্টিথিসিস এবং সিনথেসিস, এই বিপদের ভিতর যখন ত্রিলোক ধরা পড়ে, তখন তার অন্তর্ভূত সকল লোক যে ধরা পড়বে তার আর আশ্চর্য কি। হেগেলের মতে লজিকের নিয়ম এই যে, ‘ভাব’ (being) এবং ‘অভাব’ (non-being) এই দুটি পরস্পরবিরোধী-এবং এই দুয়ের সমন্বয়ে যা দাঁড়ায় তাই হচ্ছে ‘স্বভাব’ (beconting)। মানুষের মনের সকল ক্রিয়া এই নিয়মের অধীন, সুতরাং সৃষ্টিপ্রকরণও এই একই নিয়মের অধীন, কেননা এ জগৎ চৈতন্যের লীলা। অর্থাৎ তার লজিক এবং ভগবানের লজিক যে একই বস্তু, সে বিষয়ে হেগেলের মনে কোনোরূপ দ্বিধা ছিল না। তার কারণ হেগেলের বিশ্বাস ছিল যে, তিনি ভগবানের শুধু অবতার নন–স্বয়ং ভগবান। হেগেলের এই ঘরের খবর তাঁর সপ্রতিভ শিষ্য কবি হেনরি হাইনের (Henri Heine) গুরুমারাবিদ্যের গুণে ফাঁস হয়ে গেছে। বিপিনবাবুরও বোধ হয় বিশ্বাস যে, হেগেলের কথা হচ্ছে দর্শনের শেষকথা। সে যাই হোক, হেগেলের এই পশ্চিম-মীমাংসার বলে বিপিনবাবু, নুতন ও পুরাতনের সমন্বয় করতে চান। তিনি অবশ্য শুধু সূত্র পরিয়ে দিয়েছেন, তার প্রয়োগ করতে হবে আমাদের।
.
৬.
হেগেলের মত একে নতুন তার উপর বিদেশী; সুতরাং পাছে তা গ্রাহ্য করতে আমরা ইতস্তত করি এই আশঙ্কায় তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, হেগেলও যা, বেদান্তও তাই, সাংখ্যও তাই।
সমন্বয় অর্থে বিপিনবাবু কি বোঝেন, তার পরিচয় তিনি নিজেই দিয়েছেন। তাঁর মতে–
সমন্বয় মাত্রেই যে-বিরোধের নিষ্পত্তি করিতে যায়, তার বাদী প্রতিবাদী উভয় পক্ষেরই দাবী-দাওয়া কিছু কাটিয়া হাটিয়া, একটা মধ্যপথ ধরিয়া তাঁহার ন্যায্য মীমাংসা করিয়া দেয়।
অর্থাৎ থিসিসকে কিছু ছাড়তে এবং অ্যান্টিথিসিসকে কিছু ছাড়তে হবে, তবে সিনথেসিস ডিক্রি পাবে। তাঁর দর্শনের এ ব্যাখ্যা শুনে সম্ভবত হেগেলের চক্ষুস্থির হয়ে যেত; কেননা তাঁর সিনথেসিস, কোনোরূপ রফাছাড়ের ফল নয়। তাতে থিসিস এবং অ্যান্টিথিসিস দুটিই পুরামাত্রায় বিদ্যমান; কেবল দুয়ে মিলিত হয়ে একটি নূতন মূর্তি ধারণ করে। সিনথেসিসের বিশ্লেষণ করেই থিসিস এবং অ্যান্টিথিসিস পাওয়া যায়। এর আধখানা এবং ওর আধখানা জোড়া দিয়ে অর্ধনারীশ্বর গড়া হেগেলের পদ্ধতি নয়।