সমাজসংস্কার, অর্থাৎ পুরাতনকে নূতন করে তোলবার চেষ্টাতেই এ দেশে নন-পতনে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে।
বিপিনবাবুর মুখের কথায় যদি এই বিরোধের সময় হয়ে যায়, তা হলে আমরা সকলেই আশীর্বাদ করব, যে তার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।
.
৩.
দুটি পরস্পরবিরোধী পক্ষের মধ্যস্থতা করতে হলে নিরপেক্ষ হওয়া দরকার, অথচ একপক্ষ-না-একপক্ষের প্রতি টান থাকা মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। বিপিনবাবুও এই সহজ মানবধর্ম অতিক্রম করতে পারেন নি। তার নানান উলটাপালটা কথার ভিতর থেকে তাঁর নূতনের বিরুদ্ধে নন ঝাঁজ ও পুরাতনের প্রতি নূতন ঝোঁক ঠেলে বেরিয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ তাঁর একটি কথার উল্লেখ করছি।
সকলেই জানেন যে, পুরাতন সংস্কারের নাম শুনতে পারে না; কারণ সুপ্তকে জাগ্রত করবার জন্য নূতনকে পতনের গায়ে হাত দিতে হয়–তাও আবার মোলায়েমভাবে নয়, কড়াভারে। বিপিনবাবু তাই সংস্কারকের উপর গায়ের বা ঝেড়ে নিজেকে ধরা দিয়েছেন। এর থেকেই বোঝা যায় যে, পালমহাশয়, যারা সমাজকে বদল করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে, আর যারা সমাজ অটল করতে চায় তাদের পক্ষে।
বিপিনবাবু বলেন–
দুনিয়াটা সংস্কারকের সৃষ্টিও নয়, আর সংস্কারকের হাত পাকাইবার জন্য সৃষ্টও হয় নাই।
দুনিয়াটা বে কি কারণে সৃষ্টি করা হয়েছে তা আমরা জানি নে, তার কারণ সৃষ্টিকর্তা আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে ও-কাজ করেন নি। তবে তিনি যে পাল মহাশয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে সৃষ্টি করেছেন, এমনও তো মনে হয় না। কারণ, দুনিয়া আর যে জন্যই সৃষ্ট হোক, বক্তৃতাকারের গলা-সাধবার জন্য হয় নি। সৃষ্টির পূর্বের খবর আমরাও জানি নে, বিপিনবাবুও জানেন না; কিন্তু জগতের সঙ্গে মানুষের কি সম্পর্ক তা আমরা সকলেই অল্পবিস্তর জানি। ম্লেচ্ছ ভাষায় যাকে দুনিয়া বলে, হিন্দুদর্শনের ভাষায় তার নাম ‘ইদং’। ডাক্তার ব্রজেন্দ্রনাথ শীল নারায়ণ পত্রে সেই ইদংএর নিম্নলিখিত পরিচয় দিয়েছেন–
ইদংকে যে জানে, যে ইদংএর জ্ঞাতা ও ভোক্তা, আপনার কর্মের দ্বারা যে ইদংকে পরিচালিত ও পরিবর্তিত করিতে পারে বলিয়া, যাহাকে এই ইদংএর সম্পর্কে কৰ্ত্তাও বলা যায়—সেই মানুষ অহং পদবাচ্য।
অর্থাৎ মানুষ দুনিয়ার জ্ঞাতা ও কর্তা। শুধু তাই নয়, মানুষ ইদংএর কতা বলেই তার জ্ঞাতা। মনোবিজ্ঞানের মূল সত্য এই যে, বহির্জগতের সঙ্গে মানুষের যদি ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার কারবার না থাকত তা হলে তার কোনোরূপ জ্ঞান আমাদের মনে জন্মাত না। মানুষের সঙ্গে দুনিয়ার মূলসম্পর্ক ক্রিয়াকর্ম নিয়ে। আমাদের ক্রিয়ার বিষয় না হলে দুনিয়া আমাদের জ্ঞানের বিষয়ও হত না, অর্থাৎ তার কোনো অস্তিত্ব থাকত না। এবং সে ক্রিয়াফল হচ্ছে ইদংএর পরিচালন ও পরিবর্তন, আজকালকার ভাষায় যাকে বলে সংস্কার। সৃষ্টির গূঢ়তত্ত্ব না জানলেও মানুষে এ কথা জানে যে, তার জীবনের নিত্য কাজ হচ্ছে সৃষ্টপদার্থের সংস্কার করা। মানুষ যখন লাঙলের সাহায্যে ঘাস তুলে ফেলে ধান বোনে তখন সে পৃথিবীর সংস্কার করে। মানুষের জীবনে এক কৃষি ব্যতীত অপর কোনো কাজ নেই। এই দুনিয়ার জমিতে সোনা ফলাবার চেষ্টাতেই মানুষ তার মনুষ্যত্বের পরিচয় দেয়। ঋষির কাজও কৃষিকাজ, শুধু সে কৃষির ক্ষেত্র ইদং নয় অহং। সুতরাং সংস্কারকদের উপর বক্র দৃষ্টিপাত করে বিপিনবাবু দৃষ্টির পরিচয় দেন নি, পরিচয় দিয়েছেন শুধু বক্রতার।
শাস্ত্রে বলে যে, ক্রিয়াফল চারপ্রকার–উৎপত্তি প্রাপ্তি বিকার ও সংস্কার। কি ধর্ম কি সমাজ, কি রাজ্য, যার সংস্কারে হাত দেন তারই বিকার ঘটান, এমন লোকের অভাব যে বাংলায় নেই, সম্প্রতি তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। একই উপাদান নিয়ে কেউ গড়েন শিব, কেউ-বা বাঁদর। এ অবশ্য মহা আক্ষেপের বিষয়; কিন্তু তার থেকে এ প্রমাণ হয় না যে, দেশসুদ্ধ লোকের মাটির সুমুখে হাতজোড় করে বসে থাকতে হবে।
.
৪.
বিপিনবার মতে নূতনে-পুরাতনে মিলনের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে নূতন; কারণ নূতনই হচ্ছে মূল বিবাদী। সুতরাং নূতনকে বাগ মানাতে হলে তাকে কিঞ্চিৎ আক্কেল দেওয়া দরকার।
নূতন তার গোঁ ছাড়তে চায় না, কেননা সে চায় উন্নতি। কিন্তু সে ভুলে যায় যে, জাগতিক নিয়মানুসারে উন্নতির পথ সিধে নয়, প্যাঁচালো। উন্নতি যে পদেপদে অবনতিসাপেক্ষ তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে। বিপিনবাবু এই বৈজ্ঞানিক সত্যটির বক্ষ্যমাণ রূপ ব্যাখ্যা করেছেন–
তালগাছের মতন মানুষের মন বা মানবসমাজ একটা সরলরেখার ন্যায় ঊর্ধ্বদিকে উন্নতির পথে চলে না। …কিন্তু ঐ তালগাছে কোন সতেজ ব্রততী যেমন তাহকে বেড়িয়া বেড়িয়া উপরের দিকে উঠে, সেইরুপই মানুষের মন ও মানবের সমাজ ক্রমোন্নতির পথে চলিয়া থাকে। একটা লম্বা সরল খুটীর গায়ে নীচ হইতে উপর পর্যন্ত একগাছা দড়ি জড়াইতে হইলে যেমন তাহাকে ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া নিতে হয়, মানুষের মনের ও মানবসমাজের ক্রমবিকাশের পশ্বও কতকটা তারই মতন। এই গতির ঝোঁকটা সর্বদাই উন্নতির দিকে থাকিলেও, প্রতি তরেই, উপরে উঠিবার জন্যই, একটু করিয়া নীচেও নামিয়া আসিতে হয়। ইংরাজিতে এরূপ তির্যকগতির একটা বিশিষ্ট নাম আছে, ইহাকে পাইরাল মোষ (spiral motion) বলে। সমাজবিকাশের ক্রমও এইরূপ স্পাইর্যাল, একান্ত সরল নহে। …আপনার গতি-বেগের অবিচ্ছিন্নতা রক্ষা করিয়া এক স্তর হইতে অন্য স্তরে যাইতে হইলেই ঐ উর্ধ্বমুখী তির্যকগতির পথ অনুসরণ করিতে হয়।