.
২.
ঘটকালি করতে হলে ইনিয়ে-বিনিয়ে-বানিয়ে নানা কথা বলাই হচ্ছে মামুলি দস্তুর। সুতরাং নূতনের সঙ্গে পুরাতনের সম্বন্ধ করতে গিয়ে বিপিনবাবুও নানা কথার অবতারণা করতে বাধ্য হয়েছেন। তার অনেক ছোটোখাটো কথা সত্য, আর কতক বড়ো বড়ো কথা নতুন। তবে তাঁর কথার ভিতর যা সত্য তা নতুন নয়, আর যা নতুন তা সত্য কি না তা পরীক্ষা করে দেখা আবশ্যক।
বিপিনবাবু প্রথমে আমাদের সমাজে নূতন ও পুরাতনের বিরোধের কারণ নির্ণয় করে পরে তার সময়ের উপায়-নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে আমরা ইংরাজি শিখিয়া, য়ুরোপের সভ্যতা ও সাধনার বাহিরটা দেখিয়া…ঘর ছাড়িয়া বাহিরের দিকে ছুটিয়াছিলাম।
এই ছোটাটাই হচ্ছে নূতন এবং পুরাতনের সঙ্গে বিচ্ছেদের এইখানেই সূত্ৰপাত। আবার আমরা ঘরে ফিরে এসেছি। অতএব এখন মিলনের কাল উপস্থিত হয়েছে। গত-শতাব্দীতে দেশসুদ্ধ লোকের মন যে এক-লক্ষ্যে সমুদ্র লঙ্ঘন করে বিলাতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল এবং এ শতাব্দীতে সে মন যে আবার উলটো লাফে দেশে ফিরে এসেছে, এ কথা সম্পূর্ণ সত্য নয়। আমাদের মনের দিক থেকে দেখতে গেলে উনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীতে যে বিশেষ কোনো প্রভেদ আছে তা নয়, যদি থাকে তো সে উনিশ-বিশ। আজকালকার দিনে ইউরোপীয় শিক্ষা ও সভ্যতার প্রভাব ঢের বেশি লোকের মনে ঢের বেশি পরিমাণে স্থান লাভ করেছে। বরং এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বহু, ইউরোপীয় মনোভাব দেশের মনে এত বসে গেছে যে, সে ভাব দেশী কি বিদেশী তাও আমরা ঠাওর করতে পারি নে। উদাহরণস্বরূপে দেখানো যেতে পারে যে, একটি বিশেষজাতীয় মনোভাব, যার ক থেকে ক্ষ পর্যন্ত প্রতি অক্ষর বিদেশী, তাকে আমরা বলি স্বদেশী।
ইউরোপীয় সভ্যতার বাইরের দিকটা দেখে অবশ্য জনকতক সেদিকে ছুটেছিলেন, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা অতি সামান্য এবং তাঁদের ঘরে ফিরে না আসাতে দেশের কোনো ক্ষতি নেই, বরং তাঁদের ফেরাতে বিপদ আছে। বিপিনবাবু বলেন–
একদিন আমরা বেড়া ভাগিয়া ঘর ছাড়িয়া পলাইয়াছিলাম, আজ বাড়ি খাইয়া, ফিরিয়া আসিয়াছি। সত্য কথাটা তাহা নয়।
কিন্তু এ কথা সম্পূর্ণ সত্য। আমাদের মধ্যে যারা ইউরোপের সভ্যতার বাহ্যচাকচিক্যে অন্ধ হয়ে বেড়া ভেঙে ছুটেছিল তারাই আবার বাড়ি খেয়ে বাড়ি ফিরেছে। পাঁচনই তাদের পক্ষে জ্ঞানাঞ্জনশলাকার কাজ করেছে। কেননা, ও-জাতির অন্ধতা সারাবার সংগত বিধান এই—‘নেত্ররোগে সমুৎপন্নে কর্ণং ছিত্ত্বা’ দেগে দেওয়া।
বিপিনবাবু বলেন–
কেহ কেহ মনে করেন, একদিন যেমন আমরা স্বদেশের যাহা-কিছু, তাহাকেই হীনচক্ষে দেখিতাম, আজ বুঝি সেইরূপ বিচারবিবেচনা-বিরহিত হইয়াই, স্বদেশের যাহা-কিছু, তাহাকেই ভাল বলিয়া ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেছি।
বিপিনবাবুর মতে এরূপ মনে করা ভুল। কিন্তু এরূপ শ্রেণীর লোক আমাদের সমাজে যে মোটেই বিরল নয়, সে কথা নারায়ণ(২) পত্রে ডাক্তার ব্রজেন্দ্রনাথ শীল স্পষ্টাক্ষরে লিখে দিয়েছেন। তাঁর মতে—
য়ুরোপের জনসাধারণে যেমন আপনাদের অসাধারণ অভ্যুদয় দেখিয়া, য়ুরোপের বাহিরে যে প্রকৃত মানুষ বা শ্রেষ্ঠতর সভ্যতা আছে বা ছিল বলিয়া ভাবিতে পারে না; আমাদের এই অভ্যুদয় নাই বলিয়াই যেন আরও বেশী করিয়া কিয়ৎপরিমাণে এই প্রত্যক্ষ হীনতার অপমান ও বেদনার উপশম করিবার জন্যই, সেইরূপ আমরাও নিজেদের সনাতন সভ্যতা ও সাধনার অত্যধিক গৌরব করিয়া, জগতের অপরাপর সভ্যতা ও সাধনাকে হীনতর বলিয়া ভাবিয়া থাকি।
ডাক্তার শীল বলেন—
[এরূপ বিচার] স্বজাতিপক্ষপাতিত্ব-দোষে দুষ্ট, [অতএব] সত্যভ্রষ্ট।
আমাদের পক্ষে এরূপ মনোভাবের প্রশ্রয় দেওয়াতে যে সর্বনাশের পথ প্রশস্ত করা হয়, সে বিষয়ে তিলমাত্রও সন্দেহ নেই। কেননা, ইউরোপের জনসাধারণের জাতীয় অহংকার জাতীয় অভ্যুদয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত; আমাদের জাতীয় অহংকার জাতীয় হীনতার উপর প্রতিষ্ঠিত; ইউরোপের অহংকার তার কৃতিত্বের সহায়, আমাদের অহংকার আমাদের অকর্মণ্যতার পষ্ঠপোষক। সুতরাং এ শ্রেণীর লোকের বারা নতুন ও পুরাতনের বিরোধের যে সমবয় হবে, এরূপ আশা করা বাধ্য। যাঁরা মদ ছেড়ে আফিং ধরেন তাঁরা যদি কোনো-কিছুর সমন্বয় করতে পারেন তো সে হচ্ছে এই দুই নেশার। মদ আর আফিং এই দুটি জড়িতে চালাতে পারে সমাজে এমন লোকের অভাব নেই।
আসল কথা, নবশিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে হাজারে নশো নিরানব্বই জন কস্মিনকালে প্রাচীন সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেন নি। অদ্যাবধি তাঁরা কেবলমাত্র অশনে বসনে ব্যসনে ও ফ্যাশনে সামাজিক নিয়ম অতিক্রম করে আসছেন; কেননা, এ-সকল নিয়ম লঘন করবার দরুন তাঁদের কোনোরূপ সামাজিক শাস্তিভোগ করতে হয় না। পুরাতন সমাজধর্মের অবিরোধে নূতনকামের সেবা করাতে সমাজ কোনোরূপ বাধা দেয় না, কাজেই শিক্ষিত লোকেরা ঘরে ঘরে নিজের চরকায় বিলেতি তেল দেওয়াটাই তাঁদের জীবনের ব্রত করে তুলেছেন। এ শ্রেণীর লোকেরা দায়ে পড়ে সমাজের যে-সকল পরোনো নিয়ম মেনে চলেন, অপরের গায়ে পড়ে তারই নতুন ব্যাখ্যা দেন। এরা নতুন-পুরাতনের বিরোধভঞ্জন করেন নি; যদি কোনোকিছুর সমন্বয় করে থাকেন তো সে হচ্ছে সামাজিক সুবিধার সঙ্গে ব্যক্তিগত আরামের সময়।
পুরাতনের সঙ্গে নূতনের বিরোধের সৃষ্টি সেই দু-দশ জনে করেছেন, যাঁরা সমাজের মরচে-ধরা চরকায় কোনোরূপ তৈল প্রদান করবার চেষ্টা করেছেন—সে তেল দেশীই হোক, আর বিদেশীই হোক। এর প্রমাণ রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দয়ানন্দ স্বামী, কেশবচন্দ্র সেন ইত্যাদি। এর প্রথম তিনজন সমাজের দেহে যে স্নেহ প্রয়োগ করেছিলেন, সেটি খাঁটি দেশী এবং সংস্কৃত। অথচ এরা সকলেই সমাজদ্রোহী বলে গণ্য।