৬.
আহার সম্বন্ধে বেশি কিছু বলবার দরকার নেই। অপরের বেশ যত সহজে অবলম্বন করা যায়, অপরের খাদ্য তত শীঘ্র জীর্ণ করা যায় না। বিদেশীয় সভ্যতা আমাদের পিঠে যত সয়, পেটে তত সয় না। আমাদের সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা দেশে আহার্যদ্রব্য বিদেশ থেকে আমদানি করবার কোনোই দরকার নেই। তবে যদি কেহ এমন থাকেন যে, বিদেশী মাছ-তরকারি না খেলে তাঁর প্রাণ বাঁচে না, তা হলে তাঁর প্রাণ বাঁচাবার কোনো দরকার নেই; আর যদি বেচে থাকাটা নিতান্ত দরকার মনে করেন, তা হলে স্বদেশ ত্যাগ করে বিদেশে গিয়ে বাস করাটাই তাঁর পক্ষে শ্রেয়।
আহার সম্বন্ধে বিধিনিষেধ-সংবলিত পঞ্জিকাশাকে গঞ্জিকাশাস্য বলে গণ্য করে অমান্য করলেই যে তৎপরিবর্তে কেল নারের কাটালগের চর্চা করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বিদেশীয়তা প্রধানত আহারের পদ্ধতিতেই আমরা অবলম্বন করেছি। বিলাতি বসন পরে স্বদেশী আসনে বসা এবং স্বদেশী বাসনে খাওয়া চলে না।
ঐ পোশাকের টানেই চেয়ার আসে, সেইসঙ্গে টেবিল আসে, এবং সেইসঙ্গে চীনের কিংবা টিনের বাসন নিয়ে আসে। এর পর আর হাতে খাওয়া চলে না; কারণ হাতে খেলে হাত মুখ দুইই প্রক্ষালন করতে হয়, কিন্তু ছুরিকাটা ব্যবহার করলে শুধু আঙুলের ডগা ধুলেও চলে, না ধলেও চলে। এক কথায় বলতে গেলে, খানায় পোশাকে ‘অঙ্গ-অগী’র সম্বন্ধ বিরাজ করে। আহারের বিষয় উত্থাপন কবে পানের বিষয় নীরব থাকলে অনেকে মনে করতে পারেন যে, প্রবন্ধটি অঙ্গহীন হয়ে রইল; অতএব এ সম্বন্ধেও দু-এক কথা বলা আবশ্যক। পানের বিষয় হচ্ছে-হয় ধম নাহয় তেজ মরৎ এবং সলিলের সন্নিপাতে যে পদার্থের সৃষ্টি হয়, তাই। গাঁজা গলী এবং চরসের পরিবর্তে ভদ্রসমাজে যদি তামাকের প্রচলন বধিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে তো সে দুঃখের বিষয় নয়। সুরাপান বেদবিহিত এবং আয়ুর্বেদনিষিদ্ধ। ‘প্রবৃত্তিরেষা নরাণাং নিবৃত্তিস্তু মহাফলা’ এ মনুর বচন। এবং শাস্ত্রমতে যেখানে স্মৃতিতে এবং শ্রুতিতে বিরোধ দেখা যায়, সে খলে শ্ৰতি মান্য। রসিকতা ছেড়ে দিলেও সুরাপানের দোষগুণ বিচার করা এ প্রবন্ধে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। পানদোষ নীতির কথা, রীতির কথা নয়। সুরাপান একটি ব্যসন, ফ্যাশন নয়। পানাসক্ত লোক পানের প্রতিই আসক্ত, ইংরেজিয়ানার প্রতি নয়। মোহ এবং মদ দুটি স্বতন্ত্র রিপ। আমার উদ্দেশ্য ইউরোপের মোহ নষ্ট করা, তার বেশি কিছু নয়। মানবজাতিকে সুশীল সচ্চরিত্র করবার ভার সমাজনীতি এবং ধর্মপ্রচারকদের উপর ন্যস্ত রয়েছে।
৭.
আমার শেষ বক্তব্য এই, কেহ যেন মনে না করেন যে, কোনো সম্প্রদায়-বিশেষের নিন্দা করবার জন্যই আমি এ-সকল কথার অবতারণা করেছি। যে-সকল ইউরোপীয় হালচাল আমি এ দেশের পক্ষে অনাবশ্যক এবং অবাঞ্ছনীয় মনে করি, সে-সকল কম-বেশি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রবেশলাভ করেছে। আমি নিজে উপরোক্ত সকল দোষে দোষী। আমার সকল সমালোচনাই আমার নিজের গায়ে লাগে। দৈনিক জীবনে আমরা নকলেই অভ্যস্ত, আচার-ব্যবহারের অধীন। ভুল করেছি এই জ্ঞান জন্মানে মাত্র সেই ভুল তৎক্ষণাৎ সংশোধন করা যায় না। কিন্তু মনের স্বাধীনতা একবার লাভ করতে পারলে ব্যবহারের অনুরূপ পরিবর্তন শুধু সময়সাপেক্ষ।
ফাল্গুন ১৩১২
——
(১) জাপানের অভ্যুদয়ের কারণ যাঁরা জানতে চান তাঁদের আমি বক্ষ্যমাণ গ্রন্থগুলি পড়তে অনুরোধ করি : K. Okakura deals of the East এবং The Awakening of Japan; Y. Okakuraর Spirit of Japan; Nitobeর Bushido; Lafcadio Hearnএর Kokora প্ৰ্মুখ গ্রন্থবলী। যদি কারো এত বই পড়বার সময় এবং সুবিধা না থাকে এবং ফরাসি ভাষা জানা থাকে, তা হলে তাঁকে আমি Felicien Challayeর Au Japan নামক গ্রন্থ পড়তে অনুরোধ করি। লেখক গুটি পঞ্চাশ পাতায় আসল কথা অতি পরিষ্কার করে বর্ণনা এবং ব্যাখ্যা করেছেন।
নূতন ও পুরাতন
আমাদের সমাজে নূতন-পুরাতনের বিরোধটা সম্প্রতি যে বিশেষ টনটনে হয়ে উঠেছে, এরূপ ধারণা আমার নয়। আমার বিশ্বাস, জীবনে আমরা সকলেই একপথের পথিক, এবং সে পথ হচ্ছে নতুন পথ। আমাদের পরস্পরের মধ্যে প্রভেদ এই যে, কেউ-বা পুরাতনের কাছ থেকে বেশি সরে এসেছি, কেউ-বা কম। আমাদের মধ্যে আসল বিরোধ হচ্ছে মত নিয়ে। মনোজগতে আমরা নানা পন্থী। আমাদের মুখের কথায় ও কাজে যে সব সময়ে মিল থাকে, তাও নয়।
এমন-কি, অনেক সময়ে দেখা যায় যে যাদের সামাজিক ব্যবহারে সম্পূর্ণ ঐক্য আছে, তাদের মধ্যেও সামাজিক মতামতে সম্পূর্ণ অনৈক্য থাকে, অন্তত মুখে। সুতরাং নূতন-পুরাতনে যদি কোথায়ও বিবাদ থাকে তো সে সাহিত্যে, সমাজে নয়।
এ বাদানুবাদ ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে, তাই শ্রীযুক্ত বিপিনচন্দ্র পাল এই পরম্পরবিরোধী মতদ্বয়ের সামঞ্জস্য করে দিতে উদ্যত হয়েছেন।(১) তিনি নূতন ও পুরাতনের মধ্যে একটি মধ্যপথ আবিষ্কার করেছেন, যেটি অবলম্বন করলে নূতন ও পুরাতন হাত-ধরাধরি করে উন্নতির দিকে অগ্রসর হতে পারবে-যে পথে দাঁড়ালে নতুন ও পুরাতন পরস্পরের পাণিগ্রহণ করতে বাধ্য হবে এবং উভয়ে মনের মিলে সুখে থাকবে; সে পথের পরিচয় নেওয়াটা অবশ্য নিতান্ত আবশ্যক। যারা এ পথও জানে, ও পথও জানে কিন্তু দুঃখের বিষয় মরে আছে, তারা হয়তো একটা নিষ্কণ্টক মধ্যপথ পেলে বেঁচে উঠবে।