৪.
বিলেতি জিনিসের আবশ্যকতা সম্বন্ধে বিচার শেষ করে, এখন তার সৌন্দর্য সম্বন্ধে দু-চার কথা বলা আবশ্যক। আমাদের দেশে যে ছেলের কিছু হবার নয় তাকে আর্টকুলে পাঠানো হয়; এবং ঐ একই কারণে যুক্তি যখন অন্য কোনো দাঁড়াবার স্থান না পায় তখন তা আর্টের নিকট গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। ধর্ম সম্বনে আলোচনায় ‘আমি বিশ্বাস করি’ এ কথার উপর যেমন আর কোনো কথা চলে না, আর্ট সম্বন্ধে আলোচনায় ‘আমার চোখে সুন্দর লাগে’ এ কথার উপরও তেমনি আর কোনো কথা চলে না। সৌন্দর্য অনুভূতির বিষয়, জ্ঞানের বিষয় নয়। ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে তার প্রমাণ দেওয়া যায় না। অতএব যিনি আট জিনিসটা অপরকে যত কম বোঝাতে পারেন, নিজে তিনি তত বেশি বোঝেন। ধর্ম সম্বন্ধে বিশ্বাস অথ হলেও সম্ভবত লোক ধর্মজ্ঞ হতে পারে, কিন্তু রূপ সম্বন্ধে অন্ধ হয়ে লোকে সৌন্দর্যজ্ঞ হতে পারে না। কারণ সৌন্দর্য প্রকাশ। সৌন্দর্যের পরিচয় এবং অস্তিত্ব উভয়ই কেবলমাত্র প্রকাশের উপর নির্ভর করে। সেই পদার্থকে আমরা সুন্দর বলি, যার স্বরূপ পর্ণেব্যক্ত হয়েছে। রূপ হচ্ছে বিশ্বেরভাষা এবং সৌন্দর্য সৃষ্টির শেষ কথা। প্রকৃতিও বোয় কিছু করেন না, মানুষেও বিনা উদ্দেশ্যে কোনো পদার্থে হাত দেয় না। যা মানবজীবনের পক্ষে আবশ্যকীয়, মানুষে তাই হাতে গড়ে; সেই গঠনকার্যের সার্থকতা এবং কৃতার্থতার নামই আর্ট। নিরর্থক দ্রব্য সুন্দর হয় না। আবশ্যকতার বিরহে সৌন্দর্য শুকিয়ে মারা যায়। সুতরাং যে জাতির পক্ষে যে-সকল জিনিস জীবনযাত্রার জন্যে আবশ্যকীয় নয়, সে জাতির পক্ষে সে-সকল জিনিসের সৌন্দর্য উপলব্ধি করা কঠিন। আর্ট একটি সৃষ্টিপ্রকরণ, একটি ক্রিয়া মাত্র, সুতরাং আর্টের প্রাণ কর্তার হাতে এবং মনে, ভোতার চোখে এবং কানে নয়। আর্টের সন্ধান তার স্রষ্টার কাছে মেলে, দর্শক কিংবা শ্রোতার কাছে নয়। সৌন্দর্য সৃষ্টি করবার ভিতর যেটকু আনন্দ প্রাণ ও ক্ষমতা আছে, সেইটক অনুভব করার নাম সৌন্দর্য ভোগ করা। এ কথা যদি সত্য হয়, তা হলে যে আর্টিস্টের সঙ্গে আমাদের চরিত্রের, ধর্ম এবং জ্ঞানের, রীতি এবং নীতির মিল আছে, আমরা অনেক পরিমাণে যার সখদুঃখের ভাগী, যার সঙ্গে আমরা একই বাহ্যপ্রকৃতির ভিতর একই সমাজের অন্তর্ভূত হয়ে বাস করি, তার আর্টই আমাদের পক্ষে যথার্থ আর্ট। বিদেশী এবং বিজাতীয় আর্টের আদর কেবল কাপনিক মাত্র। এই কারণেই আমাদের অনেকেরই পক্ষে বিদেশী আর্টের চর্চাটা লাঞ্ছনা মাত্র হয়ে পড়ে। আমরা প্রথমে বিদেশব দোকানদারের দ্বারা প্রবঞ্চিত হই, পরে নিজেদের মনকে প্রবঞ্চিত করি। আমাদের কাছে রূপের পরিচয় রপিয়া দিয়ে। আমরা ছবি চিনি নে, তব কিনি নাম দেখে এবং দাম দেখে। ইউরোপে যারা শিব গড়তে বাদর গড়ে, তাদেরই হস্তরচিত বিগ্রহ আমরা সংগ্রহ করে সখী না হই, খুশি থাকি। আট সম্বন্ধে ইউরোপের গোলামচোর হওয়ার লজ্জা পাওয়া দুরে যাক, আমাদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
আমার মতের বিরুদ্ধে সহজেই এই আপত্তি উত্থাপিত হতে পারে যে, আমরা যদি ইউরোপীয় আর্টের মর্যাদা না বুঝতে পারি, তা হলে ইউরোপীয় সাহিত্য ও বিজ্ঞানের মর্যাদা বোঝা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। সুতরাং ইউরোপীয় সাহিত্যবিজ্ঞান-চর্চাও আমাদের ত্যাগ করা কর্তব্য। এ আপত্তির উত্তরে আমার বক্তব্য এই যে, বিভিন্ন দেশের লোকের ভিতর পার্থক্য যতই থাকুক, মানুষে মানুষে প্রবৃত্তির বাসনার মনোভাবের মিলও যথেষ্ট আছে। সাহিত্যের বিষয় হচ্ছে প্রধানত মানবপ্রকৃতি; সুতরাং উচ্চশ্রেণীর সাহিত্য দেশকাল-অতিরিক্ত মানবহৃদয়ের চিরন্তন অথচ চিরনবীন ডাকসকল নিয়ে কারবার করে। এই হেতু সকল দেশের উচ্চ আগের সাহিত্যে বিমানবের সমান অধিকার আছে। কিন্তু ইউরোপীয় সাহিত্যে যে অংশটুকু আর্ট, সে অংশ আমরা ঠিক ধরতে পারি নে। বিদেশী লেখকের লেখনীর পরিচয় আমরা অনেকেই পাই না। সে যাই হোক, সাহিত্যে এবং আর্টে, কাব্যে এবং কলায় প্রধান পার্থক্য এই যে, কাব্যের উস্করণ অন্তর্জগৎ হতে আসে, কলার উপকরণ বাহ্যজগৎ হতে আসে। মনোজগতে দেশভেদ নেই, এশিয়া ইউরোপ নেই, এক কথায়, মনোজগতের ভূগোল নেই। কিন্তু বাহ্যজগতে ঠিক তার উলটো। এক দেশের ভৌতিক গঠন অপর দেশ হতে বিভিন্ন। দেশভেদে বর্ণ-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শরসের জাতিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। সেইজন্যই কাব্য অপেক্ষা কলার ক্ষেত্র সংকীর্ণ। এই উপকরণের বিশেষত্ব হতে প্রতি দেশের শিল্পকলার বিশেষত্ব জন্মলাভ করে। আর্ট সম্বন্ধে অতীন্দ্রিয়তা অসম্ভব; সুতরাং এ ক্ষেত্রে স্বদেশের অধীনতাপাশ মোচন করবার জো নেই। বিজ্ঞানের বিষয়ও কস্তুজগৎ; কিন্তু বিজ্ঞান বিশ্বজনীন, কেননা বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য বস্তুজগতের বিশেষত্ব বাদ দিয়ে তার সামান্য ক্রিয়াগুলির সন্ধান নেওয়া। আর্টের সম্পর্ক বসুজগতের শুধু বিশেষ্য ও বিশেষণের সঙ্গে। বিজ্ঞানের অভিপ্রায় বিশ্বকে এক করে আনা, আর্টের কার্য নিত্য বৈচিত্র্য সাধন। বিজ্ঞানের লক্ষ্য মূলের দিকে, আর্টের লক্ষ্য ফলের দিকে। বিজ্ঞানের দেশ নেই, আর্টের আছে। এই-সকল কারণে নিউটন এবং ডারউইন আমাদের জ্ঞাতি, শেকসপীয়ার এবং মিলটন আমাদের কুটুম্ব, কিন্তু রাফায়েল এবং বীঠোফেন আমাদের পর। এইজন্যই জাপান ইউরোপের বিজ্ঞান আয়ত্ত করেছে, কিন্তু নিজের আর্ট ছাড়ে নি। আমাদের মধ্যে যদি কেহ ইউরোপের উচ্চাঙ্গের আর্টের যথার্থ মর্ম গ্রহণ করতে পারেন, তিনি অবশ্য ভক্তির পাত্র। পৃথিবীর যে দেশের যা-কিছু শ্ৰেষ্ঠকাতি আছে, তার সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করা মানবের মুক্তির একটি প্রকৃষ্ট উপায়। কিন্তু যখন প্রায়ই দেখতে পাই যে, যিনি বরগ্রামের গা’ থেকে ‘পার প্রতে ধরতে পারেন না, তিনিই বীঠোফেনের প্রধান সমজদার; এবং যিনি রঙটা নীল কিংবা সবুজ বিশেষ ঠাওর করেও বলতে অপারগ তিনিই টিশিয়ানের চিত্রে মুখ, তখন যজাতির ভবিষ্যতের বিষয় একটু হতাশ হয়ে পড়তে হয়। সে যাই হোক, উপখিত প্রবধে যে-সকল বস্তুর আলোচনা করতে প্রবৃত্ত হয়েছি—যথা ছিটের পরদা, ব্রসলসের কারপেট, চীনের পুতুল, কাচের ফলদানি, কি স্বদেশী কি বিদেশী সকল প্রকার আর্টের অভাবেই তাদের বিশেষত্ব। বিলাতের সচরাচর গহ-ব্যহাব বস্তুগুলি প্রায়ই কদাকার এবং কুৎসিত। এর দুটি কারণ আছে। পূর্বেই বলেছি, বিজ্ঞানের ন্যায় আর্টেরও বিষয় বাহ্যজগৎ। যা ইন্দ্রিয়গোচর নয়, তা বিজ্ঞানের বিষয় হতে পারে না, আর্টেরও বিষয় হতে পারে না। ইন্দ্রিয় যে উপকরণ সংগ্রহ করে, মন তাই নিয়ে কারিগরি করে। এই বর্ণ-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শ-ময় জগতে যে ইন্দ্রিয়গোচর বিষয়ে মন সুখলাভ করে শুধু তাই আর্টের উপকরণ। কতুর সেই সখদায়ক গুণের নাম এসথেটিকাল কোয়ালিটি, অর্থাৎ ‘রুপ’; এবং মনের সেই সুখলাভ করবার ক্ষমতার নাম এসথেটিক ফাঁকালটি, অর্থাৎ ‘পজ্ঞান। ইংরেজ বিশেষ খোসাপুরু জাত। ভগবান, ইংরেজকে নিতান্ত স্থূলভাবে গড়েছেন; তার দেহ প্ৰল, প্রকৃতি স্কুল, ইন্দ্রিয়ও তাদৃশ সক্ষম নয়। বস্তুমাত্রেই ইংরেজের হাতে ধরা পড়ে, কিন্তু রূপমাত্রেই ইংরেজের চোখে কিংবা কানে ধরা পড়ে না। সচরাচর শিক্ষিত ইংরেজের চেয়ে আমাদের দেশের সচরাচর রগরেজের চোখ রঙ সম্বন্ধে অনেক বেশি পরিমার্জিত। এই কারণেই বিলাতের নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যজাতসকল নয়নের তৃপ্তিকর নয়। এই গোঁড়ায়গলদ থাকবার দরুন, ইংরেজের হাতগড়া জিনিস প্রায়ই আটিসটিক হয় না। ইউরোপের অন্যান্য জাতিসকল এ বিষয়ে ইংরেজের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হলেও অপর আর-একটি কারণে ইউরোপের আর্টের আজকাল হীনাবস্থা। ইউরোপে এখন বিজ্ঞানের যুগ। পূর্বেই বলেছি, বিজ্ঞান বিশ্বকে একভাবে দেখে, আর্ট আর-একভাবে দেখে। বিজ্ঞানের চেষ্টা সোনামঠোকে ধলোমঠো করা, আর্টের চেষ্টা ধলোমঠোকে সোনামঠো করা। বিজ্ঞান আজকাল ইউরোপীয় মানবের মনের উপর অযথা প্রতিপত্তিলাভ করেছে, কেননা বিজ্ঞান এখন মানুষের হাতে আলাদিনের প্রদীপ। সে প্রদীপের সাহায্যে যে শুধু অসীম ঐশ্বর্য লাভ করা যায় তাই নয়, আলোকও লাভ করা যায়। সে আলোকে শুধু প্রকাশ করে বিশ্বের কায়া, বাদবাকি সব ছায়ায় পড়ে যায়, যথা—মন প্রাণ ইত্যাদি। সেই বিজ্ঞানের আলোকে আমরা যদি একমাত্র আলোক বলে ভ্রম করি, তা হলে মানবজীবনের প্রকৃত অর্থ, চরম লক্ষ্য এবং অচ্যুত আনন্দ হতে আমরা বিচ্যুত হয়ে পড়ি। বিবকে শুধু জড়ভাবে দেখলে মনেরও জড়তা এসে পড়ে। কেবলমাত্র পরমাণুর স্পন্দনে হৃদয় স্পন্দিত হয় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ধর্মের সখী হয়েই কলাবিদ্যা পৃথিবীতে দেখা দেয়। সে সখ্যবধন ছিন্ন করে আর্টকে জীবন্ত রাখা কঠিন। বৈজ্ঞানিক জীবতত্ত্বের মতে মানবের আদিম চেষ্টা নিজের এবং জাতীয় জীবন রক্ষা করা। নিজে বেচে থাকা এবং সন্তান উৎপাদন করা, এই দুটি জীবজগতের মূল নিয়ম। এই দুটি আদিম দৈহিক প্রবত্তির চরিতার্থতা সাধন যদি জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে, তা হলে ‘আবশ্যকতা’র অর্থ অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। যা দেহের জন্য আবশ্যক তাই যথার্থ আবশ্যকীয় বলে গণ্য হয়, আর যা মনের জন্য আত্মার জন্য আবশ্যক, তা আবশ্যকীয় বলে মনে হয় না। ইউরোপে ইউটিলিটির এই সংকীর্ণ অর্থ গ্রাহ্য হবার দরুন ইউটিলিটি এবং বিউটির বিচ্ছেদ জমেছে। ইউরোপের আবশ্যকীয় জিনিস কদর্য এবং সুন্দর জিনিস অনাবশ্যক হয়ে পড়েছে। এই কারণে আর্ট এখন ইউরোপে ত্রিশঙ্কুর মতো শূন্যে ঝলছে। আহার বিহার এখন ইউরোপের প্রধান কাজ হয়ে ওঠার দরন, যে আর্টিস্ট আর্টকে জীবনের ভিতর নিয়ে আসতে চান তিনি আটকে পূর্বোক্ত প্রবত্তিদ্বয়ের দাসী করে তোলেন। এই কারণেই ইউরোপে এখন নগ্ন শ্রীমতির এত ছড়াছড়ি। শতকরা একজনে যদি ঐরূপ মুতিতে সৌন্দর্য খোঁজেন, অবশিষ্ট নিরানব্বই জনে তার নগ্নতা দেখেই খুশি থাকেন। এ অবস্থায় আট যে শুধু ভোগবিলাসের অঙ্গ হয়ে উঠবে, তার আর আশ্চর্য কি। ইউরোপের পক্ষে কি ভালো কি মন্দ, তা ইউরোপ স্থির করবে। কিন্তু এ কথা সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য যে, আমাদের জাতির পক্ষে বিলাসের প্রবত্তি আর বাড়ানো ইচ্ছনীয় নয়। ইউরোপের যথার্থ আর্ট আমাদের অধিকাংশ লোকের পক্ষে আয়ত্ত করা অসম্ভব, কিন্তু ইউরোপীয় সভ্যতার ভোগের অংশটা আমরা সহজেই অভ্যাস করতে পারি। আমার প্রথম কথাও যা, শেষ কথাও তাই। আর্টকে ভোন্তর দিক থেকে দেখা দুরবিনের উলটো দিক থেকে দেখার তুল্য, দুষ্টব্য পদার্থ আরো দুরে চলে যায়। কর্তার দিক থেকে দেখাটাই ঠিক দেখা। আমরা নিজে যা রচনা করেছি, তারই মর্ম তারই মর্যাদা আমরা প্রকৃষ্টপে বুঝতে পারি। আমাদের স্বদেশের কীর্তি থেকেই আমাদের স্বজাতির কৃতিত্বের পরিচয় পাই। আমরা জাতীয় আত্মসম্মানের চর্চা করব বলে চিৎকার করছি, কিন্তু জাতীয় কৃতিত্বের যদি জ্ঞান না থাকে, তবে জাতীয় আত্মসম্মান কিসের উপর দাঁড় করাব, বোঝা কঠিন। জাতীয় আর্ট যে শ্রেণীরই থোক, তার চর্চায় আমাদের জাতীয় কর্তৃত্ব-বুদ্ধি বিকশিত হয়ে উঠবে। এই পরম লাভ। সলভ এবং সহজপ্রাপ্য বিলাতি জিনিসের পক্ষে আবশ্যকতার দোহাই চলতে পারে, কিন্তু আর্টের দোহাই একেবারেই চলে না। বিলাতি-ছিটগ্রস্ত না হলে বিলাতি-ছিটভক্ত হওয়া যায় না। আর যিনি আদর করে দুয়োরে বিলাতি পর্দা ঝোলান তাঁর পর্দানশিন হওয়া উচিত।