প্রসিদ্ধ এবং অপ্রসিদ্ধার্থক শব্দ
দ্বিতীয় কথা এই যে, প্রতি ডায়ালেক্টেই এমন গুটিকতক কথা আছে যা অন্য প্রদেশের লোকদের নিকট অপরিচিত। যে ডায়ালেক্ট-এ এই শ্রেণীর কথা কম, এবং বাঙালি মাত্রেরই নিকট পরিচিত শব্দের ভাগ বেশি, সেই ডায়ালেক্টই লিখিত ভাষার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। আমার বিশ্বাস, দক্ষিণদেশি ভাষায় ঐরূপ সর্বজনবিদিত কথাগুলিই সাধারণতঃ মুখে মুখে প্রচলিত। উত্তরবঙ্গের ভাষার তুলনায় যে দক্ষিণবঙ্গের ভাষা বেশি প্রসিদ্ধার্থক, এ বিষয়ে আমি নিজে সাক্ষ্য দিতে পারি। উদাহরণস্বরূপ আমি দুই-চারটি শব্দের উল্লেখ করতে চাই। উত্তরবঙ্গে, অন্ততঃ রাজশাহী এবং পাবনা অঞ্চলে, আমরা সকলেই ‘পৈতা’ ‘চুপ করা’ ‘সকাল’ ‘শখ ফুল’ ‘পেয়ারা’ ‘তরকারি’ প্রভৃতি শব্দ নিত্য ব্যবহার করি নে, কিন্তু তার অর্থ বুঝি; অপর পক্ষে ‘নগুন’ ‘নক্ করা’ ‘বিয়ান’ ‘হাউস’ ‘বোর’ ‘আম-সরি’ আনাজ প্রভৃতি আমাদের চলতি কথাগুলির অর্থ দক্ষিণদেশবাসীদের নিকট একেবারেই দুর্বোধ্য। এই কারণেও দক্ষিণদেশের মুখের কথা লিখিত ভাষার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। খাস-কলকাত্তাই ভাষাতেও অপরের নিকট দুর্বোধ্য অনেক কথা আছে, এবং তা ছাড়া মুখে মুখে অনেক ইতর কথারও প্রচলন আছে, যা লেখা চলে না। ইতর কথার উদাহরণ দেওয়াটা অরুচিসংগত নয় বলে আমি খাস-কলকাত্তাই ভাষার ইতরতার বিশেষ পরিচয়। এখানে দিতে পারলুম না। কলকাতার লোকের আটহাত আটপৌরে ধুতির মত তাদের আটপৌরে ভাষাও বি-কচ্ছ, এবং সেই কারণেই তার সাহায্যে ভদ্রতা রক্ষা হয় না। স্ত্রীর প্রতি ম-কারাদি প্রয়োগ করা, যাদের জঙ্গল কেটে কলকাতায় বাস সেইসকল ভদ্রলোকেরই মুখে সাজে, বাঙালি ভদ্রলোকের মুখে সাজে না। এই কারণেই বাঙালে ভাষা কিংবা কলকাত্তাই ভাষা, এ উভয়ের কোনোটিই অবিকল লেখার ভাষা হতে পারে না। আমি যে-প্রাদেশিক ভাষাকে দক্ষিণদেশি ভাষা বলি, সেই ভাষাই সম্পূর্ণরূপে সাহিত্যের পক্ষে উপযোগী।
বিভক্তির কথা
আমি পূর্বে বলেছি যে, ঐ দক্ষিণদেশি ভাষাই তার আকার এবং বিভক্তি নিয়ে এখন সাধুভাষা বলে পরিচিত। অথচ আমি তার বন্ধন থেকে সাহিত্যকে কতকটা পরিমাণে মুক্ত করে এ যুগের মৌখিক ভাষার অনুরূপ করে নিয়ে আসবার পক্ষপাতী। এবং আমার মতে, খাস-কলকাত্তাই নয়, কিন্তু কলিকাতার ভদ্রসমাজের মুখের ভাষা অনুসরণ করেই আমাদের চলা কর্তব্য।
জীবনের ধর্ম ই হচ্ছে পরিবর্তন। জীবন্ত ভাষা চিরকাল এক রূপ ধারণ করে থাকে না, কালের সঙ্গেসঙ্গেই তার রূপান্তর হয়। চসারের ভাষায় আজকাল কোনো ইংরেজ লেখক কবিতা লেখেন না, শেক্সপীয়ারের ভাষাতেও লেখেন না। কালক্রমে মুখে মুখে ভাষার যে পরিবর্তন ঘটেছে তাই গ্রাহ করে নিয়ে তারা সাহিত্য রচনা করেন। আমাদেরও তাই করা উচিত। ভাষার গঠনের বদলের জন্য বহু যুগ আবশ্যক, শব্দের আকৃতি ও রূপ নিত্যই বদলে আসছে। ভাষা একবার লিপিবদ্ধ হলে অক্ষরে শব্দের রূপ অনেকটা ধরে রাখে, তার পরিবর্তনের পথে বাধা দেয়, কিন্তু একেবারে বন্ধ করতে পারে না। আর, যেসকল শব্দ লেখায় ব্যবহৃত হয় না, তাদের চেহারা মুখে মুখে চটপট বদলে যায়। আজকাল আমরা নিত্য যে ভাষা ব্যবহার করি, তা আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের ভাষা হতে অনেক পৃথক্। প্রথমত, সংস্কৃত ভাষার অনেক শব্দ আজকাল বাংলায় ব্যবহৃত হয় যা পূর্বে হত না; দ্বিতীয়ত, অনেক শব্দ যা পূর্বে ব্যবহার হত তা এখন ব্যবহার হয় না; তৃতীয়ত, যে কথার পুর্বে চলন ছিল তার আকার এবং বিভক্তি অনেকটা নতুন রূপ ধারণ করেছে। আমার মতে সাহিত্যের ভাষাকে সজীব করতে হলে তাকে এখনকার ভদ্রসমাজের প্রচলিত ভাষার অনুরূপ করা চাই। তার জন্য অনেক কথা যা পূর্বে প্রচলিত ছিল, কিন্তু সংস্কৃতের অত্যাচারে যা আজকাল আমাদের সাহিত্যের বহির্ভূত হয়ে পড়েছে, তা আবার লেখায় ফিরিয়ে আনতে হবে। তার পর মুখে মুখে প্রচলিত শব্দের আকারের এবং বিভক্তির যে পরিবর্তন ঘটেছে, সেটা মেনে নিয়ে তাদের বর্তমান আকারে ব্যবহার করাই শ্রেয়। আসিতেছি’ শব্দের এই রূপটি সাধু, এবং ‘আসছি’ এই রূপটি অসাধু বলে গণ্য। শেষোক্ত আকারে এই কথাটি ব্যবহার করতে গেলেই আমাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয় যে, আমরা বঙ্গসাহিত্যের মহাভারত অশুদ্ধ করে দিলুম। একটু মনোযোগ করে দেখলেই দেখা যায় যে ‘আসছি’ ‘আসিতেছি’র অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আকার। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে যে ‘আসিতেছি’র ব্যবহার আছে তার কারণ, তখন লোকের মুখে কথাটি ঐ আকারেই ব্যবহৃত হত। আজও উত্তর এবং পূর্ব বঙ্গে মুখে মুখে ঐ আকারই প্রচলিত। সমগ্র বাংলাদেশ ভাষা সম্বন্ধে পূর্বে যেখানে ছিল, উত্তর এবং পূর্ব বঙ্গ আজও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গ অনেক এগিয়ে এসেছে। ‘আসিতেছি’তে ‘আসিতে’ এবং ‘আছি’ এই দুটি ক্রিয়া গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে, দুয়ে মিলে একটি ক্রিয়া হয়ে ওঠে নি। কিন্তু শব্দটির ‘আসছি’ এই আকারে ‘আছি এই ক্রিয়াটি লুপ্ত হয়ে ‘ছি এই বিভক্তিতে পরিণত হয়েছে। সুতরাং ‘আসছি’র অপেক্ষা ‘আসিতেছি কোনো হিসেবেই অধিক শুদ্ধ নয়, শুধু বেশি সেকেলে, বেশি ভারি, এবং বেশি অচল আকার। সুতরাং আসিতেছি’ পরিহার করে ‘আসছি’ ব্যবহার করতে আমরা যে পিছপা হই নে, তার কারণ এ কার্য করাতে ভাষাজগতে পিছননা হয় না, বরং সর্বতোভাবে এগনোই হয়।