বাংলা ভাষার বিশেষত্ব
কেবলমাত্র পড়ে-পাওয়া-চৌদ্দ-আনা-গোছ সংস্কৃত শব্দ বর্জন করলেই যে আমাদের মোক্ষলাভ হবে, তা নয়। আমরা লেখায় স্বদেশি ভাষাকে যেরূপ বয়কট করে আসছি, সেই বয়কটও আমাদের ছাড়তে হবে। বহুসংখ্যক বাংলা শব্দকে ইতর বলে সাহিত্য হতে বহিষ্করণের কোনোই বৈধ কারণ নেই। মৌখিক ভাষার মধ্যেই সাধু এবং ইতর, উভয় প্রকারেরই শব্দ আছে। যে শব্দ ইতর বলে আমরা মুখে আনতে সংকুচিত হই, তা আমরা কলমের মুখ দিয়েও বার করতে পারি নে। কিন্তু যেসকল কথা আমরা ভদ্রসমাজে নিত্য ব্যবহার করি, যা কোনো হিসেবেই ইতর বলে গণ্য নয়, সেইসকল বাক্যকে সাহিত্য থেকে বহিভূত করে রাখায় ক্ষতি শুধু সাহিত্যের। কেন যে পদ-বিশেষ ইতরশ্রেণীভুক্ত হয়, সে আলোচনার স্থান এ প্রবন্ধে নেই। তবে এ কথা নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, ভদ্র এবং ইতরের প্রভেদ আমাদের সমাজে এবং সাহিত্যে যেরূপ প্রচলিত, পৃথিবীর অন্য কোনো সভ্যদেশে সেরূপ নয়। আমরা সমাজের যেমন অধিকাংশ লোককে শূদ্র করে রেখে দিয়েছি, ভাষারাজ্যেও আমরা সাধুতার দোহাই দিয়ে তারই অনুরূপ জাতিভেদ সৃষ্টি করবার চেষ্টা করছি, এবং অসংখ্য নির্দোষ বাংলা কথাকে শূদ্ৰশ্রেণিভুক্ত করে তাদের সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসতে দিতে আপত্তি করছি। সমাজে এবং সাহিত্যে আমরা একই সংকীর্ণ মনোভাবের পরিচয় দিই। বাংলা কথা সাহিত্যে অস্পৃশ্য করে রাখাটা শুধু লেখাতে বামনাই করা। আজকাল দেখতে পাই অনেকেরই চৈতন্য হয়েছে যে, আমাদেরই মত রক্তমাংসে গঠিত মানুষকে সমাজে পতিত করে রাখবার একমাত্র ফল, সমাজকে দুর্বল এবং প্রাণহীন করা। আশা করি, শীই আমাদের সাহিত্য-ব্রাহ্মণদের এ জ্ঞান জন্মাবে যে, অসংখ্য প্রাণবন্ত বাংলা শব্দকে পতিত করে রাখবার দরুন, আমাদের সাহিত্য দিন দিন শক্তিহীন এবং প্রাণহীন হয়ে পড়ছে। একালের ম্রিয়মাণ লেখার সঙ্গে তুলনা করে দেখলেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আলালের ঘরের দুলাল এবং হুতোম পাচার নক্শার ভাষাতে কত অধিক ওজঃ-ধাতু আছে। আমরা যে বাংলা শব্দমাত্ৰকেই জাতে তুলে নিতে চাচ্ছি, তাতে আমাদের সাহিত্যিক সংকীর্ণতা প্রকাশ পায় না, যদি কিছু প্রকাশ পায় তো উদারতা।
আর-একটি কথা। অন্যান্য জীবের মত ভাষারও একটা আকৃতি ও একটা গঠন আছে। বৈজ্ঞানিকদের মতে, জীবে জীবে প্রভেদ ঐ গঠনের পার্থক্যেরই উপর নির্ভর করে, আকৃতির উপর নয়। পাখা থাকা সত্ত্বেও আরশোল যে পোকা, পাখি নয়, এ জ্ঞান আমাদের দেশের নিরক্ষর লোকেরও আছে। এমন কি, কবিরাও বিহঙ্গকে পতঙ্গের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন না। অন্যান্য জীবের মত ভাষার বিশেষত্বও তার গঠন আশ্রয় করে থাকে, কিন্তু তা তার দেহাকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। ভাষার দেহের পরিচয় অভিধানে, এবং তার গঠনের পরিচয় ব্যাকরণে। সুতরাং বাংলায় এবং সংস্কৃতে আকৃতিগত, মিল থাকলেও জাতিগত কোনোরূপ মিল নেই। প্রথমটি হচ্ছে analytic, দ্বিতীয়টি infectional ভাষা। সুতরাং বাংলাকে সংস্কৃতের অনুরূপ করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে আমরা যে বঙ্গভাষার জাতি নষ্ট করি, শুধু তাই নয়, তার প্রাণ বধ করবার উপক্রম করি। এই কথাটি সপ্রমাণ করতে হলে এ বিষয়ে একটি বিস্তৃত প্রবন্ধ লিখতে হয়, সুতরাং এ স্থলে আমি শুধু কথাটার উল্লেখ মাত্র করে ক্ষান্ত হলুম।
বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়ে সহজ জ্ঞানেতেই জানা যায়, উক্ত দুই ভাষার চালের পার্থক্য ঢের। সংস্কৃতের হচ্ছে ‘কবিরাজবিনিন্দিত মন্দগতি’, কিন্তু বাংলা, গুণী লেখকের হাতে পড়লে, দুলকি কদম ছাতক সব চালেই চলে। শ্ৰীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যৌবনকালে লিখিত এবং সদ্য প্রকাশিত ছিন্নপত্র পড়লে সকলেই দেখতে পাবেন যে, সাহস করে একবার রাশ আলগা দিতে পারলে নিপুণ এবং শক্তিমান লেখকের হাতে বাংলা গদ্য কি বিচিত্র ভঙ্গিতে ও কি বিদ্যুবেগে চলতে পারে। আমরা সাহিত্যিক ভাবে কথা কই নে বলে আমাদের মুখের কথায় বাংলা ভাষার সেই সহজ ভঙ্গিটি রক্ষিত হয়। কিন্তু লিখতে বসলেই আমরা তার এমন-একটা কৃত্রিম গড়ন দেবার চেষ্টা পাই, যাতে তার চলৎশক্তি রহিত হয়ে আসে। ভাষার এই আড়ষ্ট ভাবটাই সাধুতার একটা লক্ষণ বলে পরিচিত। তাই বাংলা সাহিত্যে সাধারণ লেখকের গদ্য গদাই-শকরি ভাবে চলে, এবং কুলেখকদের হাতের লেখা একটা জড়পদার্থের ঊপমাত্র হয়ে থাকে। এই জড়তার বন্ধন থেকে মুক্ত হবার একমাত্র উপায় হচ্ছে, লেখাতেও মৌখিক ভাষার সহজ ভঙ্গিটি রক্ষা করা। কিন্তু যেই আমরা সে কাজ করি অমনি আমাদের বিরুদ্ধে সাধুভাষার কলের জল ঘোলা করে দেবার এবং বাংলা সাহিত্যের বাড়া-ভাতে ‘প্রাদেশিক শব্দে’র ছাই ঢেলে দেবার অভিযোগ উপস্থিত হয়।
ভাষামাত্রেরই তার আকৃতি ও গঠনের মত একটা বিশিষ্ট প্রকৃতি আছে, এবং প্রকৃতিস্থ থাকার উপরই তার শক্তি এবং সৌন্দর্য নির্ভর করে। বঙ্গভাষার সেই প্রকৃতির বিশেষ জ্ঞানের অভাববশতঃই আমরা সে ভাষাকে সংস্কৃত করতে গিয়ে বিকৃত করে ফেলি। তা ছাড়া প্রতি ভাষারই একটি স্বতন্ত্র সুর আছে। এমন অনেক সংস্কৃত শব্দ আছে যা বাংলার সুরে মেলে না এবং শোনবামাত্র কানে খট করে লাগে। যার সুরজ্ঞান নেই তাকে কোনোরূপ তর্কবিতর্ক দ্বারা সে জ্ঞান দেওয়া যায় না। সাহিত্যিক এই শব্দটি ব্যাকরণসিদ্ধ হলেও যে বাঙালির কানে নিতান্ত বেসুরো লাগে, এ কথা যার ভাষার জ্ঞান আছে তাকে বোঝানো অনাবশ্যক, আর যার নেই তাকে বোঝানো অসম্ভব।