২) ‘ডাকতুম’ ‘করতুম’ প্রভৃতির ‘তুম’ এই অন্তভাগ প্রাদেশিক শব্দ নয়, কিন্তু বিভক্তি। এ স্থলে ‘শব্দ’ এই বিশেষ্যটি ভুল অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ সম্পাদক মহাশয় বোধ হয় এ কথা বলতে চান না যে, ‘ডাকা করা, ‘শোনা প্রভৃতি ক্রিয়া শব্দের অর্থ কলিকাতা প্রদেশের লোক ছাড়া আর কেউ জানেন না। এ কথা নির্ভয়ে বলা চলে যে, ‘ডাকা’ ‘ক’ ‘শোনা প্রভৃতি শব্দ, অন্য ভাষাভাষী বাঙালির নিকট অপরিজ্ঞাত হলেও বঙ্গ’ভাষাভাষী বাঙালি মাত্রেরই নিকট বিশেষ সুপরিচিত। সম্পাদক মহাশয়ের আপত্তি যখন ঐ বিভক্তি সম্বন্ধে, তখন ‘শব্দের পরিবর্তে বিভক্তি এই শব্দটিই ব্যবহার করা উচিত ছিল।
৩) ‘সাহিত্যিক’ এই বিশেষণটি বাংলা কিংবা সংস্কৃত কোনো ভাষাতেই পূর্বে ছিল না, এবং আমার বিশ্বাস, উক্ত দুই ভাষার কোনোটির ব্যাকরণ অনুসারে ‘সাহিত্য’ এই বিশেষ্য শব্দটি ‘সাহিত্যিক’-রূপ বিশেষণে পরিণত হতে পারে না। বাংলার নব্য সাহিত্যিকদের বিশ্বাস যে, বিশেষ্যের উপর অত্যাচার করলেই তা বিশেষণ হয়ে ওঠে। এইরূপ বিশেষণের সৃষ্টি আমার মতে অদ্ভুত সৃষ্টি। এই পদ্ধতিতে সাহিত্য রচিত হয় না, literature শুধু literatural হয়ে ওঠে।
৪) ‘ভাষাভাষী’ এই সমাসটি এতই অপূর্ব যে, ও কথা শুনে হাসাহাসি করা ছাড়া আর কিছু করা চলে না।
৫) ‘আমরা’ শব্দটি পদের পূর্বভাগে না থেকে শেষভাগে আসা উচিত ছিল। তা না হলে পদের অন্বয় ঠিক হয় না। করতুম’এর পূর্বে নয়, ব্যবহার এবং পক্ষপাতী এই দুই শব্দের মধ্যে এর যথার্থ স্থান।
অযথা অনর্থক বিশেষণের প্রয়োগ, ভুল অর্থে বিশেষ্যের প্রয়োগ, অদ্ভুত বিশেষণ এবং সমাসের সৃষ্টি, ‘উলটোপালটা’ রকম রচনার পদ্ধতি প্রভৃতি বর্জনীয় দোষ আজকালকার মুদ্রিত সাহিত্যের পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে দেখা যায়। সাধু ভাষার অবিরণে সেসকল দোষ, শুধু অন্যমনস্ক পাঠকদের নয়, অন্যমনস্ক লেখকদেরও চোখে পড়ে না।
মুদ্রিত সাহিত্য বলে কোনো জিনিস না থাকলেও মুদ্রিত ভাষা বলে যে একটা নতুন ভাষার সৃষ্টি হয়েছে, তা অস্বীকার করবার জো নেই। লেখার ভাষা শুধু মুখের ভাষার প্রতিনিধি মাত্র। অনিত্য শব্দকে নিত্য করবার ইচ্ছে থেকেই অক্ষরের সৃষ্টি। অক্ষর-সৃষ্টির পূর্বযুগে মানুষের মনে করে রাখবার মত বাক্যরাশি কণ্ঠস্থ করতে করতেই প্রাণ যেত। যে-অক্ষর আমরা প্রথমে হাতে লিখি, তাই পরে ছাপানো হয়। সুতরাং ছাপার অক্ষরে উঠলেই-যে কোনো কথার মর্যাদা বাড়ে, তা নয়। কিন্তু দেখতে পাই অনেকের বিশ্বাস তার উলটো। আজকাল ছাপার অক্ষরে যা বেরোয় তাই সাহিত্য বলে গণ্য হয়। এবং সেই একই কারণে মুদ্রিত ভাষা সাধুভাষা বলে সম্মান লাভ করে। গ্রামোফোনের উদরস্থ হয়ে সংগীতের মাহাত্ম শুধু এ দেশেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। আসলে সে ভাষার ঠিক নাম হচ্ছে বাবু-বাংলা। যে গুণে ইংলিশ বাবু-ইংলিশ হয়ে ওঠে, সেই গুণেই বঙ্গভাষা বাবু-বাংলা হয়ে উঠেছে। সে ভাষা আলাপের ভাষা নয়, শুধু প্রলাপের ভাষা। লেখার যা সর্বপ্রথম এবং সর্ব প্রধান গুণ–প্রসাদগুণ–সে গুণে বাবু-বাংলা একেবারেই বঞ্চিত। বিদ্যের মত, ভাষাও কেবলমাত্র পুঁথিগত হয়ে উঠলে তার ঊর্ধ্বগতি হয় কি না বলতে পারি নে, কিন্তু সদ্গতি যে হয় না সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। আসলে এই মুদ্রিত ভাষার মৃত্যুর প্রায় সকল লক্ষণই স্পষ্ট। শুধু আমাদের মাতৃভাষার নাড়িজ্ঞান লুপ্ত হয়ে রয়েছে বলে আমরা নব্যবঙ্গসাহিত্যের প্রাণ আছে কি নেই তার ঠাওর করে উঠতে পারি নে। মুখের ভাষা যে জীবন্ত ভাষা, এ বিষয়ে দু মত নেই। একমাত্র সেই ভাষা অবলম্বন করেই আমরা সাহিত্যিকে সজীব করে তুলতে পারব। যেমন একটি প্রদীপ থেকে অপর-একটি প্রদীপ ধরাতে হলে পরস্পরে স্পর্শ ব্যতিরেকে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না, তেমনি লেখার ভাষাতেও প্রাণ সঞ্চার করতে হলে মুখের ভাষার সম্পর্ক ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না; আমি সংস্কৃত শব্দের ব্যবহারের বিরোধী নই, শুধু নূন অর্থে, অধিক অর্থে কিংবা অনর্থে বাক্য প্রয়োগের বিরোধী। আয়ুর্বেদ-মতে ওরূপ বাক্য প্রয়োগ একটা রোগবিশেষ, এবং চরকসংহিতায় ও-বরাগের নাম বাক্যদোষ। পাছে কেউ মনে করেন যে, আমি এই কথাটা নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করছি, সেই কারণে এক শত বৎসর পূর্বে ‘অভিনব যুবক সাহেবজাতের শিক্ষার্থে’ মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার যে উপদেশ লিপিবদ্ধ করে গেছেন, সেটি এখানে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি–
শাস্ত্রে বাক্যকে গো শব্দে যে কহিয়াছেন তাঁহার কারণ এই ভাষা যদি সম্যকরূপে প্রয়োগ করা যায় তবে স্বয়ং কামদুঘা বেনু হন, যদি দুষ্টরূপে প্রয়োগ করা যায় তবে সেই দুষ্টভাষা সন্নিষ্ঠগোত্ব ধর্মকে স্বপ্ৰয়োগকর্তাকে অর্পণ করিয়া স্ববক্তাকে গোরূপে পণ্ডিতেরদের নিকটে বিখ্যাত করেন।…আর বাক্য কহা বড় কঠিন, সকল হইতে কহা যায় না কেননা কেহ বাক্যেতে হতি পায়, কেহ বা বাক্যেতে হাতির পায়। অতএব বাক্যেতে অত্যল্প দোষও কোন প্রকারে উপেক্ষণীয় নহে, কেননা যদ্যপি অতিবড় সুন্দরও শরীর হয় তথাপি যৎকিঞ্চিৎ এক শিত্ৰ বোগ দোষেতে নিন্দনীয় হয়। (প্রবোধচন্দ্রিকা)
বিদ্যালংকার মহাশয়ের মতে ‘বাক্য কহা বড় কঠিন’। কহার চাইতে লেখা যে অনেক বেশি কঠিন, এ সত্য বোধ হয় অভিনব যুবক’ বঙ্গলেখক ছাড়া আর কেউ অস্বীকার করবেন না। Art এবং artlessnessএর মধ্যে আসমানজমীন ব্যবধান আছে, লিখিত এবং কথিত ভাষার মধ্যেও সেই ব্যবধান থাকা আবশ্যক। কিন্তু সে পার্থক্য ভাষাগত নয়, স্টাইল-গত। লিখিত ভাষার কথাগুলি শুদ্ধ, সুনির্বাচিত এবং সুবিন্যস্ত হওয়া চাই, এবং রচনা সংক্ষিপ্ত ও সংহত হওয়া চাই। লেখায় কথা ওলটানো চলে না, বদলানো চলে না, পুনরুক্তি চলে না, এবং এলোমেলো ভাবে সাজানো চলে না। ঢাকা রিভিউএর সম্পাদক মহাশয়ের মতে যে ভাষা প্রশস্ত, সে ভাষায় মুখের ভাষার যা-যা দোষ সেসব পূর্ণমাত্রায় দেখা দেয়, কেবলমাত্র আলাপের ভাষার যেসকল গুণ আছে— অর্থাৎ সরলতা, গতি ও প্রাণ–সেই গুণগুলিই তাতে নেই। কোনো দরিদ্র লোকের যদি কোনো ধনী লোকের সহিত দূরসম্পর্কও থাকে, তাহলে প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় যে, সে গরিব বেচারা সেই দুরসম্পর্ককে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তাতে পরিণত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু সে চেষ্টার ফল কিরূপ হয়ে থাকে তা তো সকলেরই নিকট প্রত্যক্ষ। আমরা পাঁচজনে মিলে আমাদের মাতৃভাষার বংশমর্যাদা, বাড়াবার জন্যই সংস্কৃত ভাষার আশ্রয় গ্রহণ করতে উৎসুক হয়েছি। তার ফলে শুধু আমাদের ভাষার স্বীয় মর্যাদা রক্ষা হচ্ছে না। সাধুভাষার লেখকদের তাই দেখতে পাওয়া যায় যে, পদে পদে বিপদ ঘটে থাকে। আমার বিশ্বাস যে, আমরা যদি সংস্কৃত ভাষার দ্বারস্থ হয়ে ঘরের ভাষার উপরই নির্ভর করি, তাহলে আমাদের লেখার চাল স্বচ্ছন্দ হবে, এবং আমাদের ঘরের লোকের সঙ্গে মনোভাবের আদানপ্রদানটাও সহজ হয়ে আসবে। যদি আমাদের বক্তব্য কথা কিছু থাকে, তাহলে নিজের ভাষাতে তা যত স্পষ্ট করে বলা যায়, কোনো কৃত্রিম ভাষাতে তত স্পষ্ট করে বলা যাবে না।