১৩০৯ জ্যৈষ্ঠ
বঙ্গভাষা বনাম বাবু–বাংলা ওরফে সাধুভাষা
শ্ৰীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতী পত্রিকাতে প্রকাশিত বাল্যকথা, ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলনএর মতে অপ্রকাশিত থাকাই উচিত ছিল। লেখক যে কথা বলেছেন এবং যে ধরনে বলেছেন, দুয়ের কোনোটিই সম্পাদক মহাশয়ের মতে ‘সুযোগ্য লেখক এবং সুপ্রসিদ্ধ মাসিকের উপযোগী নয়। শ্ৰীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সম্বন্ধে ভালোমন্দ কোনো কথাই আমার মুখে শোভা পায় না। তার কারণ এ স্থলে উল্লেখ করবার কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা তা শুধু ‘ঘরওয়ালা ধরনে’র নয়, একেবারে পুরোপুরি ঘরাও কথা। আমি যদি প্রকাশ্যে; সে লেখার নিন্দা করি, তা হলে আমার কুটুম্বসমাজ সে কার্যের প্রশংসা করবে না; অপর পক্ষে যদি প্রশংসা করি, তাহলে সাহিত্যসমাজ নিশ্চয়ই তার নিন্দা করবে। তবে ঢাকা রিভিউএর সম্পাদক মহাশয় উক্ত লেখকের ভাষা সম্বন্ধে যে মত প্রকাশ করেছেন, সে সম্বন্ধে আমার কিছু বক্তব্য আছে।
প্রথমত, সম্পাদক মহাশয় বলেছেন যে, সে রচনার নমুনা যে প্রকারের ঘরওয়ালা ধরনের, ভাষাও তদ্রুপ। ভাষা যদি বক্তব্য বিষয়ের অনুরূপ হয়, তাহলে অলংকারশাস্ত্রের মতে সেটা যে দোষ বলে গণ্য, এ জ্ঞান আমার পূর্বে ছিল না। আত্মজীবনী লেখবার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ঘরের কথা পরকে বলা। ঘরাও ভাষাই ঘরাও কথার বিশেষ উপযোগী মনে করেই লেখক, লোকে যেভাবে গল্প বলে, সেই ভাবেই তার বাল্যকথা বলেছেন। স্বর্গীয় কালী সিংহ যে হুতোম পাচার নকশার ভাষায় তাঁর মহাভারত লেখেন নি, এবং মহাভারতের ভাষায় যে হুতোম প্যাচার নক্শা লেখেন নি, তাতে তিনি কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেন নি। সে যাই হোক, শ্ৰীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পক্ষ হয়ে কোনোরূপ ওকালতি করা আমার অভিপ্রায় নয়, কারণ এ বিষয়ে বাংলার সাহিত্যআদালতে তার কোনোরূপ জবাবদিহি করবার দরকারই নেই। আমি এবং ঢাকা রিভিউএর সম্পাদক যেকালে, পূর্ববঙ্গের নয় কিন্তু পূর্বজন্মের ভাষায় বাক্যালাপ করতুম, সেই দূর অতীত কালেই ঠাকুর মহাশয় সুযোগ্য লেখক’ বলে বাংলাদেশে খ্যাতি এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন।
যে ধরনের লেখা ঢাকা-রিভিউএর নিতান্ত অপছন্দ, সেই ধরনের লেখারই আমি পক্ষপাতী। আমাদের বাঙালি জাতির একটা বদনাম আছে যে, আমাদের কাজে ও কথায় মিল নেই। এ অপবাদ কতদূর সত্য তা আমি বলতে পারি নে। তবে এ কথা নিশ্চিত যে, আমাদের কথায় ও লেখায় যত অধিক অমিল হয়, তত আমরা সেটি অহংকারের এবং গৌরবের বিষয় বলে মনে করি। বাঙালি লেখকদের কৃপায় বাংলা ভাষায় চক্ষুকর্ণের বিবাদ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। সেই বিবাদ ভঞ্জন করবার চেষ্টাটা আমি উচিত কার্য বলে মনে করি। সেই কারণেই এদেশের বিদ্যাদিগজের ‘হুলহস্তাবলেপ’ হতে মাতৃভাষাকে উদ্ধার করবার জন্য আমরা সাহিত্যকে সেই মুক্তপথ অবলম্বন করতে বলি, যে পথের। দিকে আমাদের সিদ্ধাঙ্গনারা উৎসুক নেত্রে চেয়ে আছেন। ঢাকা রিভিউএর সমালোচনা অবলম্বন করে আমার নিজের মত সমর্থন করাই এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
অভিযোগ
সম্পাদক মহাশয়ের কথা হচ্ছে এই–
মুদ্রিত সাহিত্যে আমরা ‘করতুম’ ‘শোনাচ্ছিলুম ‘ডাকতুম’ ‘মেশবার’ (‘খেনু’ ‘গেনু’-ই বা বাদ যায় কেন?) প্রভৃতি প্রাদেশিক শব্দ ব্যবহারের পক্ষপাতী নহি। অন্য ভাষাভাষী বাঙালির অপরিজ্ঞাত ভাষা প্রয়োগে সাহিত্যিক সংকীর্ণতা প্রকাশ পায় বলিয়; আমাদের বিশ্বাস।
উপরোক্ত পদটি যদি সাধুভাষার নমুনা হয়, এবং ঐরূপ লেখাতে যদি ‘সাহিত্যিক’ উদারতা প্রকাশ পায়, তাহলে লেখায় সাধুতা এবং উদারতা আমরা যে কেন বর্জন করতে চাই তা ভাষাজ্ঞ এবং রসজ্ঞ পাঠকেরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। এরূপ ভাষা সাধুও নয়, শুদ্ধও নয়, শুধু ‘যা-খুশি-তা’ ভাষা। কোনো লেখকবিশেষের লেখা নিয়ে তার দোষ দেখিয়ে দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার বিশ্বাস, ওরূপ করাতে সাহিত্যের কোনো লাভ নেই। মশা মেরে ম্যালেরিয়া দূর করবার চেষ্টা বৃথা, কারণ সে কাজের আর অন্ত নেই। সাহিত্যক্ষেত্রে কতকটা আলো এবং হাওয়া এনে দেওয়াই সে স্থানকে স্বাস্থ্যকর করবার প্রকৃষ্ট উপায়। তা সত্ত্বেও ঢাকা রিভিউ হতে সংগৃহীত উপরোক্ত পদটি অনায়াসলব্ধ পদ নিয়ে অযত্নসুলভ বাক্যরচনার এমন খাঁটি নমুনা যে, তার রচনাপদ্ধতির দোষ বাঙালি পাঠকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার লোভ আমি সংবরণ করতে পারছি নে। শুনতে পাই, কোনো-একটি ভদ্রলোক তিন অক্ষরের একটি পদ বানান করতে চারটি ভুল করেছিলেন। ঔষধ’ এই পদটি তাঁর হাতে ‘অউস এই রূপ ধারণ করেছিল। সম্পাদক মহাশয়ও একটি, বাক্য রচনায় অন্ততঃ পাঁচ-ছ’টি ভুল করেছেন–
১) সাহিত্যের পুর্বে ‘মুদ্রিত এই বিশেষণটি জুড়ে দেবার সার্থকতা কি? অমুদ্রিত সাহিত্য জিনিসটি কি? ওর অর্থ কি সেই লেখা, যা এখন হস্তাক্ষরেই আবদ্ধ হয়ে আছে, এবং ছাপা হয় নি। তাই যদি হয়, তাহলে সম্পাদক মহাশয়ের বক্তব্য কি এই যে, ছাপা হবার পূর্বে লেখায় যে ভাষা চলে, ছাপা হবার পরে আর তা চলে না? আমাদের ধারণা, মুদ্রিত লেখামাত্রই এক সময়ে অমুদ্রিত অবস্থায় থাকে, এবং মুদ্রাযত্নের ভিতর দিয়ে তা রূপান্তরিত হয়ে আসে না। বরং কোনরূপ রূপান্তরিত হলেই আমরা আপত্তি করে থাকি, এবং যে ব্যক্তির সাহায্যে তা হয়, তাকে আমরা মুদ্রাকরের শয়তান বলে অভিহিত করি। এইরূপ বিশেষণের প্রয়োগ শুধু অযথা নয়, একেবারেই অনর্থক।