৪.
কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই দেখতে পাবেন ‘ যে, উক্ত লৌকিক ও সাহিত্যিক চুরি, উভয় ব্যাপারেরই মূলে আছে একই গরজ।
মুসলমানরা আমাদের দেশে যেসব নতুন কছমের আদালত-কাছারি আইন-কানুন এনেছে তাদের সঙ্গে তাদের বিদেশি নামও এসেছে। এবং সেই আইন-আদালত যেমন সমাজের উপর চেপে বসেছে, তাদের নামও তেমনি ভাষার ভিতর ঢুকে বসেছে।
ফিরিঙ্গিরা যেসব নতুন জিনিস এ দেশে নিয়ে এসেছে আর আমাদের ঘরে ঘরে যার স্থান হয়েছে, তাদের নামও আমাদের মুখে মুখে চলেছে। তাস হিন্দুরা খেলত না, তারা খেলত পাশা; মুসলমানরাও খেলত না, তারা খেলত হয় সতরঞ্চ নয় গঞ্জিফা। ফিরিঙ্গিরা যখন দেশে তাস আনলে তখন শুধু বিন্তি নয় প্রমরা খেলতেও আমরা শিখলুম, ফলে ফরাসি কথা জুয়ো বাংলা হয়ে গেল, আর সেই সঙ্গে জুয়ো-খেলিয়ে বাঙালিরা ফরাসিতে যাকে বলে জুয়াড়ি তাই হয়ে উঠল।
এ যুগে ইংরেজেরা আমাদের অনেক জিনিস দিয়েছে, যা আমাদের ভাষায় স্বনামে ও আমাদের ঘরে স্বরূপে আছে ও থেকেও যাবে। একটা সর্বলোকবিদিত। উদাহরণ দেওয়া যাক। বোতল গেলাস বাংলা ভাষা থেকে কখনও বেরিয়ে যাবে না, কেননা ও দুই চিজও বাংলাদেশ থেকেও কখনো বেরিয়ে যাবে না। বাংলা যদি একদম বেসুরা হয়ে যায়, তা হলেও বাঙালিরা ওষুধ খাবে, আর মাথা ঠাণ্ডা করবার জন্য তেল মাখবে। অতএব আমাদের কাচের পাত্র চাই। তার পর ইংরেজ-প্রবর্তিত নূতন কর্মজীবনও তৎসম অবস্থায় না থোক তভব। অবস্থায় থেকে যাবে। আর সে কারণ বাংলা ভাষায় সে জীবনের বিলেতি নাম সব, তৎসম-রূপে না থোক তদভব-রূপে বজায় থাকবে।
এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, ইংরেজি জ্ঞানের ভাষাও কতক পরিমাণে বাংলা ভাষার অন্তরঙ্গ হয়ে থাকবে। ইংরেজি শিক্ষার প্রসাদে অনেক নূতন জ্ঞান, অনেক নূতন ভাব আমাদের মনের ভিতর ঢুকে গিয়েছে, তাই তাদের বিলেতি নামও আমাদের মুখে মুখে চলেছে। যেহেতু দেশের জনগুণ ইংরেজি-শিক্ষিত নয়, সে কারণ ঐসব ইংরেজি কথা স্বল্পসংখ্যক লোকের মুখেই শোনা যায়; আর তাদের বিদেশি ধ্বনি আমাদের কানে সহজেই ধরা পড়ে। আর সেই কারণেই বাংলা ভাষা থেকে অনেকে চান ‘আইডিয়া’কে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিতে।
বাঙালির মুখ থেকে বিলেতি কথা কেউ খসাতে পারবেন না, অতএব সে চেষ্টা কেউ করেনও না। আমরা চাই শুধু লিখিত ভাষায় বিদেশি শব্দ বয়কট করতে। কিন্তু আমাদের এই সাত শ বছরের বর্ণসংকর ভাষাকে যদি আবার আর্য করতে হয়, তাহলে ভাষার আর্যসমাজীদের আগে সে ভাষাকে শুদ্ধ করতে হবে, তার পরে তার পৈতে দিতে হবে।
এ চেষ্টা বাংলায় ইতিপূর্বে একবার মহাবাক্যাড়ম্বরের সঙ্গে হয়ে গেছে। ফোর্ট উইলিয়মের পণ্ডিত মহাশয়েরা যে গদ্য রচনা করে গিয়েছেন তাতে ফারসিআরবির স্পর্শমাত্র নেই। তাদের ঐ তিরস্কবণী বুদ্ধির প্রতাপে বাংলা ভাষা থেকে শুধু যে আরবি-ফারসি বেরিয়ে গেল তাই নয়, সঙ্গেসঙ্গে অসংখ্য তদ্ভব কথাও সাহিত্য হতে বহিষ্কৃত হল। কিছুকাল পূর্বে বাংলা সাহিত্যে কারও বিয়ে করবার সাধ্য ছিল না, সকলেই বিবাহ করতে বাধ্য হত। আর বিবা, করেও কারও নিস্তার ছিল না, কেননা ও-সাহিত্যে স্ত্রীকে কেউ ভালোবাসতে পারত না, সকলকে তার সঙ্গে প্রণয় করতে হত। শুধু অসংখ্য কথা যে বেরিয়ে গেল তাই নয়, ভাষার কলকজাও সব বদলে গেল। দ্বারা সহিত কর্তৃক পরন্তু অপিচ যদ্যপিস্যাৎ প্রভৃতির সাহায্য ব্যতীত উক্ত সাধুভাষায় পদ.আর বাক্য হতে পারত না। ফলে বাঙালির মুখে যা ছিল active, বাঙালির লেখায় ত passive হয়ে পড়ল। বাংলা ভাষার উপর এই আর্য অত্যাচার বাঙালি যে বেশিদিন সহ্য করতে পারে নি, তার সাক্ষাৎপ্রমাণ স্বরূপ ষাট বৎসর আগে বাঙালির ওড়ানো বিদ্রোহের দুটি লাল পতাকা আজও আমাদের সাহিত্যগগনে জ্বলজ্বল করছে। আলালের ঘরের দুলাল আর হুতোম পঁাচার নক্শা যে বাংলা সাহিত্যে যুগান্তর এনেছিল তার সাক্ষী স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র।
পণ্ডিত মহাশয়েরা যখন বাংলা ভাষার যবন-দোষ ঘোচাতে পারেন নি তখন আমরাও তা পারব না, কেননা আমাদের আধুনিক সাহিত্যের সংস্কৃত বেশধারী বহু শব্দকে আঁচড়ালেই তার ভিতর থেকে আহেল বিলেতি ভাব বেরিয়ে পড়ে। ‘আইডিয়া’ বাদ দিয়ে বাংলা আজ আমরা কেউ লিখতে পারি নে। অতএব আমার নিবেদন এই যে, কোনো নতুন বিদেশি কথাকে বয়কট করা কিংবা পুরনো বিদেশি শব্দকে বাংলা ভাষা থেকে বহিষ্কৃত করবার চেষ্টা করা, শুধু বৃথা সময় নষ্ট করা। আমাদের ভাষায় অনেক নতুন কথা আপনা হতেই ঢুকবে আর অনেক পুরনো কথা আপনা হতেই বেরিয়ে যাবে, আর তা হবে তাদের জাতিবর্ণনির্বিচারে।
এ পত্রের যবনিকাপতনের পূর্বে আর-একটি কথা বলব। সত্যটা এখন ধরা পড়েছে যে, বাংলা ভাষা বাঙালির ভাষা নয়। বংশে বাঙালি হচ্ছে মঙ্গল-দ্রাবিড়, আর তার ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতের প্রপৌত্রী। ‘বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্নাতি নোহপরাণি’ বাংলার আদিম অধিবাসীরা তথা স্বভাষা ত্যাগ করে মাগধী প্রাকৃত গ্রহণ করেছিল। সেই দিন থেকে এ দেশের লোকের মনেরও পুনর্জন্ম হয়েছে, কেননা মন আর ভাষা একই জিনিস। আমরা যদি বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় ফিরে যেতে চাই তাহলে আমাদের ফিরতে হবে আদি-দ্রাবিড় + আদি-মঙ্গল ভাষায়; কিন্তু সে ভাষাও হবে সংকর।
বাঙালি যে দেহে সংকর, মনে সংকর, ভাষায় সংকর–এর জন্য দোষী আমরা নই, কেননা বাঙালি জাতি আমাদের সৃষ্টি করেছে, আমরা বাঙালি জাতিকে সৃষ্টি করি নি।