এইসব কারণেই পণ্ডিতি বাংলার সঙ্গে আমার কোনো ঝগড়া নেই। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা বঙ্গভাষার কোনো ক্ষতি করেন নি, বরং অনেক উপকার করেছেন। বিশেষতঃ সে ভাষা যখন কোনো নব্যলেখক অনুকরণ করেন না, তখন তার বিরুদ্ধে আমাদের খড়্গহস্ত হয়ে ওঠবার দরকার নেই। আসল সর্বনেশে ভাষা হচ্ছে ‘চন্দ্রাহত সাহিত্যিক’রা ইংরেজি বাক্য এবং পদকে যেমন-তেমন করে অনুবাদ করে যে খিচুড়ি-ভাষার সৃষ্টি করছেন, সেই ভাষা। সে ভাবার হাত থেকে উদ্ধার না পেলে বঙ্গসাহিত্য আঁতুড়েই মারা যাবে। এবং সেই কৃত্রিম ভাষার হাত এড়াতে হলে মৌখিক ভাষার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আমাদের উপায়ান্তর নেই। সুতরাং ‘আলালি’ ভাষাকে আমাদের শোধন করে নিতে হবে। বাবু-বাংলার কোনোরূপ সংস্কার করা অসম্ভব, কারণ সে ভাষা হচ্ছে পণ্ডিতি বাংলার বিকারমাত্র। দুধ একবার ছিড়ে গেলে তা আর কোনো কাজে লাগে না। ললিতবাবুর মতে পণ্ডিতি বাংলার ‘কঠোর অস্থিপঞ্জর পাঠ্যপুস্তক-নির্বাচন-সমিতির বায়ু-শূন্য টিনের কৌটায় রক্ষিত’। আমি বলি, তা নয়। স্কুলপাঠ্য-পুস্তকরূপ’ টিনের কৌটায় যা রক্ষিত হয়ে থাকে, তা শুধু সাধুভাষারূপ নটান গোরুর দুধ। সুতরাং সেই টিনের গোরুর দুধ খেয়ে যারা বড় হয়, মাতৃদুগ্ধ যে তাদের মুখরোচক হয় না, তা আর আশ্চর্যের বিষয় নয়।
৪.
আমাদের রচনায় কতদূর পর্যন্ত আরবি পারসি ইংরেজি প্রভৃতি বিদেশি শব্দের ব্যবহার সংগত, সে বিষয়ে ললিতবাবু এই সিদ্ধান্ত করেছেন যে–
এক সময়ে বাংলা ভাষায় আরবি পারসি শব্দের প্রবেশ ঘটিয়াছে, এবং আজকাল ইংরেজি শব্দের প্রবেশ ঘটিতেছে। ইহা প্রাকৃতিক নিয়ম। সকল ভাষাতেই যাহা ঘটিয়াছে বাংলা ভাষাতেও তাহাই ঘটিয়াছে ও ঘটিতেছে।
এক কথায়, প্রাকৃতিক নিয়মের বিপক্ষতাচরণ করায় কোনো লাভ নেই। যে সকল বিদেশি শব্দ বেমালুম বঙ্গভাষার অনুভূত হয়ে গেছে, সেসকল শব্দ অবশ্য কথার মত লেখাতেও নিত্যব্যবহার্য হওয়া উচিত।
কোনো শব্দের উৎপত্তি বিচার করে যে লেখক সেটিকে জোর করে সাহিত্য হতে বহিস্কৃত করে দেবেন তিনিই ঠকবেন, কারণ ও-উপায়ে শুধু অকারণে ভাষাকে সংকীর্ণ করে ফেলা হয়। আমি এ বিষয়ে ললিতবাবুর মতের সম্পূর্ণ পক্ষপাতী। কিন্তু একটি কথা আমাদের মনে রাখা কর্তব্য—বঙ্গভাষা বাঙালি হিন্দুর ভাষা; এ দেশে মুসলমান ধর্মের প্রাদুর্ভাবের বহুপূর্বে গৌড়ীয় ভাষা প্রায় বর্তমান আকারে গঠিত হয়ে উঠেছিল।
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের মতে–
অন্যান্য দেশীয় ভাষা হইতে গৌড়দেশীয় ভাষা উত্তম, সর্বোত্তমা সংস্কৃত ভাষা বাহুল্য-হেতুক।
গৌড়ীয় প্রাকৃত অপর-সকল প্রকৃত অপেক্ষা উত্তম কি অধম, সে বিচার আমি করতে চাই নে, কিন্তু সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে বঙ্গভাষার সম্বন্ধ যে অতি ঘনিষ্ঠ, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সংস্কৃত বৈয়াকরণিকদের মতে ভাষাশব্দ ত্রিবিধ–তজ্জ, তৎসম, দেশ্য। বঙ্গভাষায় তজ্জ এবং তৎসম শব্দের সংখ্যা অসংখ্য, দেশ শব্দের সংখ্যা অল্প, এবং বিদেশি শব্দের সংখ্যা অতি সামান্য।
এ বিষয়ে ফরাসি ভাষার সহিত বঙ্গভাষা একজাতীয় ভাষা। একজন ইংরেজি লেখক ফরাসি ভাষা সম্বন্ধে যা বলেছেন, সেই কথাগুলি আমি নীচে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি। তার থেকে পাঠকমাত্রই দেখতে পাবেন যে, ল্যাটিন ভাষার সহিত ফরাসি ভাষার যেরূপ সম্বন্ধ, সংস্কৃত ভাষার সহিত বঙ্গভাষারও ঠিক সেই একইরূপ সম্বন্ধ–
With a very few exceptions, every word in the French vocabulary comes straight from Latin. The influence of pre-Roman Celts is almost imperceptible; while the number of words introduced by the Frankish conquerors amounts to no more than a few hundreds.
উদ্ধত পদটিতে Frenchএর স্থানে বঙ্গভাষা, pre-Romanএর স্থানে বাংলার আদিম অনার্য জাতি, Latinএর স্থলে সংস্কৃত, এবং Frankishএর স্থলে মুসলমান, এই কথা ক’টি বদলে নিলে, উক্ত বাক্য ক’টি বঙ্গভাষার সঠিক বর্ণনা হয়ে ওঠে।
ঐরূপ হওয়াতে, ফরাসি সাহিত্যের যা বিশেষ গুণ, বঙ্গসাহিত্যেও সেই গুণ থাকা সম্ভব এবং উচিত। সে গুণ পূর্বোক্ত লেখকের মতে হচ্ছে এই–
French literature is absolutely homogeneous. The genius of the French langunge, descended from its single stock has triumphed most–in simplieity, in clarity, in clarityaid in restraint.
সুতরাং জোর করে যদি আমরা বাংলা ভাষায় এমন-সব আরবি কিংবা পারসি শব্দ ঢাকাতে চেষ্টা করি, যা ইতিপূর্বে আমাদের ভাষার অঙ্গীভূত হয়ে যায় নি, তাহলে ঐরূপ উপায়ে আমরা বঙ্গভাষাকে শুধু বিকৃত করে ফেলব।
সম্প্রতি বাংলা ভাষার উপর ঐরূপ জবরদস্তি করবার প্রস্তাব হয়েছে বলে এ বিষয়ে আমি বাঙালিমাত্রকেই সতর্ক থাকতে অনুরোধ করি। আগন্তুক ঢাকা-ইউনিভার্সিটির রিপোর্টে দেখতে পাই, একটু ঢাকা-চাপা দিয়ে ঐ প্রস্তাব করা হয়েছে। স্কুলপাঠ্য গ্রন্থাবলীর উপর আর্য আক্রমণের বিষয়ে আমি অনেকরূপ ঠাট্টাবিদ্রূপ করেছি; কিন্তু ঐ স্কুলপাঠ্য গ্রন্থাবলীর উপর এই মুসলমান আক্রমণের প্রস্তাবটি আরও ভয়ংকর, কেননা, বাংলা ভাষার তজ্জ শব্দকে রূপান্তরিত করে তৎসম করলেও বাংলা ভাষার ধর্ম নষ্ট হয় না, কিন্তু অপরিচিত এবং অগ্রাহ বিদেশি শব্দকে আমাদের সাহিত্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়াতে তার বিশেষত্ব নষ্ট করে তাকে কদর্য এবং বিকৃত করে ফেলা হয়। এই উভয়সংকট হতে উদ্ধার পাবার একটি খুব সহজ উপায় আছে। বাংলা ভাষা হতে বাংলা শব্দসকল বহিস্কৃত করে দিয়ে অর্ধেক সংস্কৃত এবং অর্ধেক আরবি-পারসি শব্দ দিয়ে ইস্কুলপাঠ্য গ্রন্থ রচনা করলে, দু কূল রক্ষে হয়!