এ বিষয়ে শাস্ত্রী মহাশয়ের বক্তব্য যদি ভুল না বুঝে থাকি, তাহলে তার মত সংক্ষেপে এই দাঁড়ায় যে বাংলাকে প্রায় সংস্কৃত করে আনলে আসামি হিন্দুস্থানি প্রভৃতি বিদেশি লোকদে পকে বঙ্গভাষা-শিক্ষাটা অতি সহজসাধ্য ব্যাপার হয়ে উঠবে। দ্বিতীয়ত, অন্য ভাষার যে সুবিধাটুকু নেই, বাংলার তা আছে–যে-কোনো সংস্কৃত কথা যেখানে হোক লেখায় বসিয়ে দিলে বাংলা ভাষার বাংলাত্ব নষ্ট হয় না অর্থাৎ যারা আমাদের ভাষা জানেন না তারা যাতে সহজে বুঝতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে সাধারণ বাঙালির পক্ষে আমাদের লিখিত ভাষা দুর্বোধ করে তুলতে হবে। কথাটা এতই অদ্ভুত যে, এর কি উত্তর দেব ভেবে পাওয়া যায় না। সুতরাং তার অপর মতটি ঠিক কি না দেখা যাক। আমাদের দেশে ছোট ছেলেদের বিশ্বাস যে, বাংলা কথার পিছনে অনুস্বর জুড়ে দিলেই সংস্কৃত হয়; আর প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের মত যে, সংস্কৃত কথার অনুস্বর-বিসর্গ ছেটে দিলেই বাংলা হয়। দুটো বিশ্বাসই সমান সত্য। বাঁদরের লেজ কেটে দিলেই কি মানুষ হয়?
যদি কারও এরূপ ধারণা থাকে যে, উক্ত ‘উপায়ে রাষ্ট্রীয় একতা সংস্থাপিত হইবার পথ প্রশস্ত হইবে, কালে ভারতের সর্বত্র এক ভাষা হইবে’ তাহলে সে ধারণা নিতান্ত অমূলক। ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সভ্যতা যে আকারই ধারণ করুক-না কেন, একাকার হয়ে যাবে না। যা পূর্বে কস্মিন্ কালেও হয় নি, তা পরে কস্মিন কালেও হবে না। ভারতবর্ষের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতি যেভাষা ভাব আচার এবং আকার সম্বন্ধে নিজেদের বিশেষত্ব হারিয়ে এক জাতি হয়ে উঠবে এ আশা করাও যা, আর কঁঠালগাছ ক্রমে আমগাছ হয়ে উঠবে এ আশা করাও তাই। পুরাকালেও এ দেশের দার্শনিকেরা যে সমস্যার মীমাংসা করবার চেষ্টা করেছিলেন, এ যুগের দার্শনিকদেরও সেই একই সমস্যার মীমাংসা করতে হবে। সে সমস্যা হচ্ছে, বহুর মধ্যে এক দেখা। রাষ্ট্ৰীয় ঐক্যস্থাপনের একমাত্র উপায় হচ্ছে, ভারতবর্ষের নানা জাতির বিশেষত্ব রক্ষা করেও সকলকে এক যোগসূত্রে বন্ধন করা। রাষ্ট্রীয় ভাবনাও যখন অতি ফলাও হয়ে ওঠে, এবং দেশে-বিদেশে চারিয়ে যায়, তখন সে ভাবনা দিগ্বিদিক্জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। বঙ্গসাহিত্যের যত শ্রীবৃদ্ধি হবে, তত তার স্বাতন্ত্র্য আরও ফুটে উঠবে, লোপ, পাবে না।
৩.
ললিতবাবু পণ্ডিতি বাংলার উপর বিশেষ নারাজ। আমি অবশ্য সেরকম রচনাপদ্ধতির পক্ষপাতী নই। তবে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত লেখকদের সপক্ষে এই কথা বলবার আছে যে, তারা সংস্কৃত শব্দ ভুল অর্থে ব্যবহার করেন নি। তাদের হাতে সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ মিষ্টপ্রয়োগ না হলেও দুষ্টপ্রয়োগ নয়। প্রবোধচন্দ্রিকা কিংবা পুরুষপরীক্ষা পড়লে বাংলা আমরা শিখতে না পারি, কিন্তু সংস্কৃত ভুলে যাই নে। প্রবোধচন্দ্রিকার রচয়িতা স্বর্গীয় মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের আমি বিশেষ পক্ষপাতী। কেননা তিনি সুপণ্ডিত এবং সুরসি। একাধারে এই উভয় গুণ আজকালকার লেখকদের মধ্যে নিতান্ত দুর্লভ হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের গল্প বলবার ক্ষমতা অসাধারণ। অল্প কথায় একটি গল্প কি করে সর্বাঙ্গসুন্দর করে বলতে হয়, তার সন্ধান তিনি জানতেন। পুরুষপরীক্ষার ভাষা ললিতবাবু যে কি কারণে শব্দাড়ম্বরময় জড়িমা-জড়িত ভাষা মনে করেন, তা আমি বুঝতে পারলুম না, কারণ সে ভাষা নদীর জলের ন্যায় স্বচ্ছ এবং স্রোতস্বতী। প্রবোধচলিকার পূর্বভাগের ভাষা কঠিন হলেও শুদ্ধ নয়। যিনি তাতে দাত বসাতে পারবেন, তিনিই তার রসাস্বাদ করতে পারবেন। আমাদের নব্যলেখকেরা যদি মনোযোগ দিয়ে প্রবোধচন্দ্রিকা পাঠ করেন, তাহলে রচনা সম্বন্ধে অনেক সদুপদেশ লাভ করতে পারবেন। যথা, ‘ঘট’কে ‘কম্বুগ্ৰীব বৃকোদর’ বলে বর্ণনা করলে তা আর্ট হয় না, এবং নর ও বিষাণ এই দুটি বাক্যকে একত্র করলে ‘নরবিষাণ’ রূপ পদ রচিত হলেও আর অনুরূপ মানুষের মাথায় শিং বেরোয় না; যদি কারও মাথায় বেরয় তো সে পদকর্তার।
রাজা রামমোহন রায় এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের লেখার দোষ ধরা সহজ কিন্তু আমরা যেন এ কথা ভুলে না যাই যে, এরাই হচ্ছেন বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম গদ্যলেখক। বাংলা গদ্যের রচনাপদ্ধতি এদেরই উদ্ভাবন করতে হয়েছিল। তাদের মুশকিল হয়েছিল শব্দ নিয়ে নয়, অন্বয় নিয়ে। রাজা রামমোহন রায়, তার রচনা পড়তে হলে পাঠককে কি উপায়ে তার অন্বয় করতে হবে, তার হিসেব বলে দিয়েছেন। রাজা রামমোহনের গদ্য যে আমাদের কাছে একটু অদ্ভুত লাগে, তার প্রধান কারণ হচ্ছে যে, তার বিচারপদ্ধতি ও তর্কের রীতি সম্পূর্ণরূপে সংস্কৃতশাস্ত্রের ভাষ্যকারদের অনুরূপ। সে পদ্ধতিতে আমরা গদ্য লিখি নে, আমরা ইংরেজি গদ্যের সহজ এবং স্বচ্ছন্দ গতিই অনুকরণ করতে চেষ্টা করি। রামমোহন রায়ের গদ্যে বাগাড়ম্বর নেই, সমাসের নামগন্ধও নেই, এবং সে ভাষা সংস্কৃতবহুলও নয়।
তার পর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গদ্য যে আমরা standard prose হিসাবে দেখি, তার কারণ, তিনিই সর্বপ্রথম প্রাঞ্জল গদ্য রচনা করেন। সে ভাষার মর্যাদা তার সংস্কৃতবহুলতার উপর নয়, তার syntaxএর উপর নির্ভর করে। রাজা রামমোহন রায়ের ভাষার সঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা তুলনা করে দেখলে পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন যে, অম্বয়ের গুণেই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে।