ঐ একই কারণে ‘করিয়া’ যে ‘ক’রে’ অপেক্ষা বেশি শুল্ক, তা নয়, শুধু বেশি প্রাচীন। ও-দুয়ের একটিও সংস্কৃত ব্যাকরণের বিভক্তি নয়, দু-ই খাঁটি বাংলা বিভক্তি। প্রভেদ এই মাত্র যে, পূর্বে মুখের ভাষায় ‘করিয়া’র চলন ছিল, এখন ‘ক’রে’র চলন হয়েছে। চণ্ডীদাস তার সানুনাসিক বীরভূমি সুরে মুখে বলতেন ‘করিঞা, তাই লিখেছেনও ‘করিঞা’। কৃত্তিবাস ভারতচন্দ্র প্রভৃতি নদিয়া জেলার গ্রন্থকারেরা মুখে বলতেন ‘কন্যা’ ‘ধরা, তাই তারা লেখাতেও যেভাবে উচ্চারণ করতেন সেই উচ্চারণ অবিকল বজায় রাখবার জন্য ‘ধরিয়া করিয়া আকারে লিখতেন। সম্ভবতঃ কৃত্তিবাসের সময়ে অক্ষরে আকার যুক্ত য-ফলা লেখবার সংকেত উদ্ভাবিত হয় নি বলেই সে যুগের লেখকেরা ঐ যুক্ত স্বরবর্ণের সন্ধিবিচ্ছেদ করে লিখেছেন। ভারতচন্দ্রের সময়ে সে সংকেত উদ্ভাবিত হয়েছিল, তাই তিনি যদিচ পূর্ববর্তী কবিদের লিখনপ্রণালী সাধারণতঃ অনুসরণ করেছিলেন, তবুও নমুনা স্বরূপ কতকগুলি কবিতাতে ‘বাঁধ্যা ‘ছদ্যা’ আকারেরও ব্যবহার করেছেন। অদ্যাবধি উত্তরবঙ্গে আমরা দক্ষিণবঙ্গের সেই পূর্ব প্রচলিত উচ্চারণভঙ্গিই মুখে মুখে রক্ষা করে আসছি। ‘ক’রের তুলনায় ‘করা’ শুধু শ্রুতিকটু নয়, দৃষ্টিকটুও বটে, কেননা ঐ আকারে শব্দটি মুখ থেকে বার করতে হলে মুখের কিঞ্চিৎ অধিক ব্যাদান করা দরকার। অথচ লিপিবদ্ধ বাক্যের এমনি একটি মোহিনী শক্তি আছে যে, মুখরোচক না হলেও তা আমাদের শিরোধার্য হয়ে ওঠে। ইতাম তেম’ এবং ‘তৃম -এর মধ্যেও ঐ একই রকমের প্রভেদ আছে। তবে ‘উম’-রূপ বিভক্তিটি। অদ্যাবধি কেবলমাত্র কলকাতা শহরে আবদ্ধ, সুতরাং সমগ্র বাংলাদেশে যে সেটি গ্রাহ্য হবে সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে, বিশেষতঃ যখন ‘হালুম’ ‘হুলুম’ প্রভৃতি শব্দের সঙ্গে অপর এক জীবের ভাষার সাদৃশ্য আছে। এই এক ‘উম বাদ দিয়ে কলকাতার বাদবাকি উচ্চারণের ভঙ্গিটি যে কথিত বঙ্গভাষার উপর আধিপত্য লাভ করবে, তার আর সন্দেহ নেই। আসলে হচ্ছেও তাই। আজকাল উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সকল প্রদেশেরই বাঙালি ভদ্রলোকের মুখের ভাষা প্রায় একই রকম হয়ে এসেছে। প্রভেদ যা আছে সে শুধু টানটুনের। লিখিত ভাষার রূপ যেমন কথিত অষার অনুকরণ করে, তেমনি শিক্ষিত লোকদের মুখের ভাষাও লিখিত ভাষার অনুসরণ করে। এই কারণেই দক্ষিণদেশি ভাষা, যা কালক্রমে সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠেছে, নিজ প্রভাবে শিক্ষিতসমাজেরও মুখের ভাষার ঐক্য সাধন করছে। আমি পূর্বেই বলেছি যে, আমার বিশ্বাস ভবিষ্যতে কলকাতার মৌখিক ভাষাই সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠবে। তার কারণ, কলকাতা রাজধানীতে বাংলাদেশের সকল প্রদেশের অসংখ্য শিক্ষিত ভদ্রলোক বাস করেন। ঐ একটি মাত্র শহরে সমগ্র বাংলাদেশ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এবং সকল প্রদেশের বাঙালি জাতির প্রতিনিধিরা একত্র হয়ে পরস্পরের কথার আদানপ্রদানে যে নব্যভাষা গড়ে তুলছেন, সে ভাষা সর্বাঙ্গীণ বঙ্গভাষা। সুতানুটি গ্রামের গ্রাম্যভাষা এখন কলকাতার অশিক্ষিত লোকদের মুখেই আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। আধুনিক কলকাতার ভাষা বাঙালি জাতির ভাষা, আর খাস-কলকাত্তাই বুলি শুধু শহুরে cockney ভাষা।
১৩১৯ পৌষ
সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা
সম্প্রতি ‘সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা’ নামক পুস্তিকাকারে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ আমার হস্তগত হয়েছে। লেখক শ্রীযুক্ত ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যার এম. এ. আমার সতীর্থ। একই যুগে একই বিদ্যালয়ে, একই শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকদের মধ্যে পরস্পরের মনোভাবে মিল থাকা কিছু আশ্চর্যের বিষয় নয়। বোধ হয় সেই কারণে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত বঙ্গভাষা-সম্বন্ধীয় আমার প্রবন্ধটির সঙ্গে উক্ত প্রবন্ধের যে শুধু নামের মিল আছে তা নয়, মতামতেরও অনেকটা মিল আছে। এমনকি স্থানে স্থানে আমরা উভয়ে একই যুক্তি প্রায় একই ভাষায় প্রকাশ করেছি। দৃষ্টান্তস্বরূপ ললিতবাবুর প্রবন্ধ হতে একটি প্যারা উদ্ধৃত করে দিচ্ছি—
যাঁহারা সাধুভাষার অতিমাত্র পক্ষপাতী, তাহারা যদি কখনো দায়ে ঠেকিয়া একটা চলিত শব্দ ব্যবহার করিতে বাধ্য হয়েন, তবে সেটা উদ্ধরণচিহ্নের মধ্যে লেখেন; যেন শব্দটা অপাঙক্তেয়, সাধুভাষার শব্দগুলি সংস্পর্শজনিত পাপে লিপ্ত না হয়, সেই জন্য এই সাবধানতা। ইহা কি জাতিভেদের দেশে অনাচরণীয় জাতিদিগের প্রতি সামাজিক ব্যবহারের অনুবৃত্তি?
বাংলা কথাকে সাহিত্যসমাজে জাতিচ্যুত করবার বিষয়ে আমার পূর্ব প্রবন্ধে যা বলেছি, তার সঙ্গে তুলনা করলে পাঠকমাত্রই দেখতে পাবেন যে, আমরা উভয়েই মাতৃভাষার উপর এরূপ অত্যাচারের বিরোধী। তবে ললিতবাবুর সঙ্গে আমার প্রধান তফাত এই যে, তিনি সাধুভাষার সপক্ষে এবং বিপক্ষে কি বলবার আছে, অথবা কি সচরাচর বলা হয়ে থাকে, সেইসকল কথা একত্র করে গুছিয়ে, পাশাপাশি সাজিয়ে, পাঠকদের চোখের সুমুখে ধরে দিয়েছেন; কিন্তু পূর্বপক্ষের মতামত বিচার করে কোনোরূপ মীমাংসা করে দেন নি। আর আমি উত্তরপক্ষের মুখপাত্র স্বরূপে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি যে, একটু পরীক্ষা করলেই দেখতে পাওয়া যায় যে, পূর্বপক্ষের তর্কযুক্তির ষোলো কড়াই কানা।
ললিতবাবু দেখাতে চান যে, সমস্যাটা কি। আমি দেখতে চাই যে, মীমাংসাটা কি হওয়া উচিত। ললিতবাবু বলেছেন যে, তাঁর উদ্দেশ্য যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষভাবে বিষয়টির আলোচনা করা। তাই, যদি তার মনের ঝোঁক আসলে বঙ্গভাষার দিকে, তবুও তিনি পদে পদে সে ঝোক সামলাতে চেষ্টা করেছেন। আমি অবশ্য সে ঝোঁকটি সামলানো মোটেই কর্তব্য বলে মনে করি। নে। কোনো পক্ষের হয়ে ওকালতি করা দূরে থাক, তিনি বিচারকের আসন অলংকৃত করতে অস্বীকৃত হয়েছেন। এমনকি, এই উভয় পক্ষের মধ্যস্থ হয়ে একটা আপোস-মীমাংসা করে দেওয়াটাও তিনি আবশ্যক মনে করেন নি।