- বইয়ের নামঃ ভাষার কথা
- লেখকের নামঃ প্রমথ চৌধুরী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
আমাদের ভাষা-সংকট
শ্ৰীযুক্ত বারীন্দ্রকুমার ঘোষ সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন যে, আমার ভাষা সংকর; অর্থাৎ আমার বাংলার ভিতর থেকে ইংরেজি শব্দ স্বরূপে মাঝে মাঝে দেখা দেয়। এ অপবাদ সত্য। তবে বাংলার ভিতর ইংরেজি ঢুকলে ভাষা যদি সংকর হয়, তাহলে শুধু আমার নয়, দেশসুদ্ধ লোকের ভাষা সংকর হয়ে গেছে।
বাংলার ইংরেজিশিক্ষিত সম্প্রদায়ের কথোপকথনের দিকে কান দিলেই টের পাবেন যে, তাদের মৌখিক ভাষার বিশেষ বিশেষণ সব বেশির ভাগ ইংরেজি; তার ক্রিয়াপদ ও সর্বনামই শুধু বাংলা। তার পর জনগণের মুখেও যে কত ইংরেজি কথা তদ্ভব আকারে নিত্য চলেছে তা সে-শ্রেণীর বাঙালির সঙ্গে কার্যগতিকে যার নিত্য কথাবার্তা কইতে হয় তিনিই জানেন। রাজমিস্ত্রি-ছুতোরমিস্ত্রিদের অধিকাংশ যন্ত্রপাতির নামের যে বিলেতে জন্ম তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কেননা মিস্ত্রি কথাটাই বিলেতি। ‘বিলেতি’ শব্দের অর্থ বিদেশি; আমি তাই ও শব্দটা ইউরোপীয় এই অর্থেই এ পত্রে ব্যবহার করছি, ইংরেজির প্রতিশব্দ হিসেবে নয়।
ইংরেজি কথা যেমন হালে আমাদের ভাষার ভিতর প্রবেশ করেছে, ইংরেজ রাজা হবার পূর্বে অপর নানাজাতীয় বিলেতি কথা তেমনি আমাদের পূর্বপুরুষদের ভাষার ভিতর অবলীলাক্রমে ঢুকে গেছে, আর বাংলা ভাষার অঙ্গে সেসব এমনি বেমালুম ভাবে বসে গিয়েছে যে, সেগুলি যে আসলে বিলেতি তাও আমরা ভুলে গিয়েছি। পশ্চিম ইউরোপের ভাষাগুলিকে মোটামুটি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়, প্রথম Romance language, দ্বিতীয় Germanic। এখন দেখা যাক এ দুয়ের ভিতর কোন্ ভাষার কাছে আমাদের মুখের ভাষা বেশি ঋণী।।
নবাবি আমলে কবি ভারতচন্দ্রের মুখে শুনতে পাই যে তার কালে বাংলায় এইসব বিলেতি জাতি বাস করত, যথা ১. ফিরিঙ্গি, ২. ফরাসি, ৩. আলেমান, ৪. ওলন্দাজ, ৫. দিনেমার, ৬. ইংরেজ। ফরাসি অবশ্য French, আলেমান German, ওলন্দাজ Dutch, দিনেমার Dane, আর ইংরেজ English, তাহলে ফিরিঙ্গি হচ্ছে নিশ্চয়ই পোর্তুগিজ; French ফিরিঙ্গি না হয়ে পোর্তুগিজ যে কেন তা হল, সে রহস্যের সন্ধান আমি জানি নে। শব্দের রূপান্তরের আইনকানুন আমি জানি নে।
২.
ভারতচন্দ্রের সঙ্গে সব জাতের চাক্ষুষ পরিচয় ছিল; তিনি বহুকাল ফরাসডাঙায় বাস করেছিলেন, আর পোর্তুগিজদের আডডা ছিল হুগলি, ওলন্দাজদের চুচুড়া, দিনেমারদের শ্রীরামপুর, সব-শেষ ইংরেজদের কলকাতা। মধ্য থেকে আলেমান কোত্থেকে এসে জুটল আর তাদের বসতিই বা ছিল কোথায়, তা আমার অবিদিত। ফরাসডাঙায় যে জার্মানরা ছিল না, সেটা নিশ্চিত; আর কলকাতায়, যে ছিল সে বিষয়েও সন্দেহ আছে। তবে সেকালে কোন্ জাতের সঙ্গে অপরকার যে entenate cordiale ছিল সে কথা আমি বলতে পারি নে; যে হেতু আমি ঐতিহাসিক নই। আমার বিশ্বাস আলেমানরা তখন আসমানে বাস করত, অর্থাৎ তারা সর্বত্রই ছিল।
উল্লিখিত ছটি জাতের মধ্যে প্রথম দুটির ভাষা Romance, বাকি চারটির Germanic। এই Romance ভাষার দেদার কথা বাঙালির। অজ্ঞাতসারে বাংলা ভাষার অন্তভূত হয়ে গেছে। বহুকাল পূর্বে বঙ্গীয়-সাহিত্যপরিষৎ-পত্রিকায় বাংলার অঙ্গীভূত পোর্তুগিজ শব্দাবলীর একটি ফর্দ দেখে ‘আমার চক্ষু স্থির হয়ে যায়, কেননা সে ফর্দ ছিল দশপাতা লম্বা। তার পর আমাদের ভাষায় ফরাসি শব্দও বড় কম নেই। তাসখেলার ‘জুয়ো’ থেকে আরম্ভ করে প্রমারার ‘দুস’ ‘ত্রেস’ ‘তেরাস্তা কোরো’ ‘মাছ’ ‘কাতুর’ পর্যন্ত প্রায় সকল কথাই ফরাসি। ঐ সূত্রে দেখতে পাই জার্মানিক ভাষারও দু-চার কথা আমাদের ভাষায় ঢুকে গিয়েছে। শুনতে পাই ‘হরতন’ ‘রুইতন’ হচ্ছে খাসওলন্দাজি। এ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, নবাবের আমলে দু হাতে বিলেতি কথা আত্মসাৎ করে বাংলা ভাষা তার দেহ পুষ্ট করেছে। এতে আশ্চর্য হবার কিছুই ‘ নেই, বিদেশি শব্দকে স্বদেশি করা হচ্ছে আমাদের ভাষার চিরকেলে ধর্ম।
মুসলমান যুগে কত ফারসি ও আরবি শব্দ যে বাংলা হয়ে গেছে তা কি আর বলা প্রয়োজন? আমরা হচ্ছি কৃষিজীবী জাত, অথচ ‘জমি’ থেকে ‘ফসল পর্যন্ত কৃষি-সংক্রান্ত প্রায় সকল কথাই হয় ফারসি নয় আরবি। আর জমিদারি সংক্রান্ত সকল কথাই ঐ আরবি-ফারসির দান; ও-ভাষার ভিতর সংস্কৃতের লেশমাত্র নেই। আমাদের কর্মজীবনের যা ভিত্তি, অর্থাৎ দেশের মাটি, তারও নাম জমি। বাংলার মত মিশ্রভাষা এক উর্দু বাদ দিলে ভারতবর্ষে বোধ হয় আর দ্বিতীয় নেই। তার পর আমাদের কর্মজীবনের যা চূড়া, অর্থাৎ আইন-আদালত, তার ভাষাও আগাগোড়া আরবি-ফারসি। আরজি থেকে রায় ফয়সালা পর্যন্ত মামলার আদ্যোপান্ত সকল কথাই বাংলা ভাষাকে মুসলমানের দান। ইংরেজরা আজকাল ডিক্রি দেন বটে কিন্তু তা জারি করতে হলেই ইংরেজি ছেড়ে ফারসির শরণাপন্ন হতে হয়। এ কথা যে সত্য, তা যে-কোনো মোক্তারি সেরেস্তার আমলা হলপ করে বলবে।।
.৩.
পরের ধনে পোদ্দারি করা হচ্ছে যখন বাংলা ভাষার চিরকেলে বদ অভ্যাস, তখন এ যুগে যে অসংখ্য ইংরেজি শব্দ শুধু মুখস্থ নয় উদরস্থও করবে সে তো ধরা কথা। এতে বাংলা তত তার স্বধর্মই পালন করে চলেছে। তবে আমাদের ভাষার পরকে আপন করার স্বভাবের বিরুদ্ধে আজ কেন আপত্তি উঠেছে? এর একটি কারণ, পূর্বে বাংলা ভাষা বিদেশি শব্দ বেমালুম আত্মসাৎ করেছে; অপর পক্ষে আজ তার এই চুরি-বিদ্যেটা এক ক্ষেত্রে সহজেই ধরা পড়ে। সেকালে বাংলা মুসলমানদের কাছ থেকে কর্মের ভাষা নিয়েছিল, পোর্তুগিজ-ফরাসিদের কাছ থেকে নিয়েছিল শুধু জিনিসের নাম, আর আজ আমরা ইংরেজি থেকে ও দুই জাতীয় কথা তো নিচ্ছিই, উপরন্তু তার জ্ঞানের ভাষাও আত্মসাৎ করছি। প্রথম দুইটির ব্যবহার হচ্ছে লৌকিক, আর শেষটির সাহিত্যিক; লৌকিক কথার চুরিকে চুরি বলে ধরা যায় না, কেননা তার ভিতর অসংখ্য লোকের হাত আছে, ও হচ্ছে সামাজিক আত্মার কাজ, ওর জন্য ব্যক্তিবিশেষকে দায়ী করা চলে না। অপর পক্ষে সাহিত্যিক চৌর্য ব্যক্তিবিশেষের কাজ, অতএব সেটা ধরাও যায়, ও সে কথা-চোরকে শাসন করাও যায়।