ভারতবর্ষ যে একটি প্রকাণ্ড মহাদেশ, এ সত্য আবিষ্কার করবার জন্য পায়ে হেঁটে তীর্থ পর্যটন করবার দরকার নেই। একবার এ দেশের মানচিত্রখানির উপর চোখ বুলিয়ে গেলেই আমাদের শ্রান্তি বোধ হয়, এবং শরীর না হোক মা অবসন্ন হয়ে পড়ে। এবং ভারতবর্ষের জনসংখ্যা যে অগণ্য, আর এই কোটি কোটি লোক যে জাতি ধর্ম ও ভাষায় শত শত ভাগে বিভক্ত, এ সত্য আবিষ্কার করবার জন্যও সেন্সস রিপোর্ট গড়বার আবশ্যক নেই; চোখ-কান খোলা থাকলেই তা আমাদের কাছে নিত্যপ্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে।
আমাদের জীবনের যে ঐক্য নেই, এ কথাও যেমন সত্য–আমাদের মনে যে ঐক্যের আশা আছে, সে কথাও তেমনি সত্য। এক-ভারতবর্ষ হচ্ছে এ যুগের শিক্ষিত লোকের ইউটোপিয়া, সংস্কৃত ভাষায় যাকে বলে গন্ধর্বপুরী। সে পুরী আকাশে ঝোলে এবং সকলের নিকট তা প্রত্যক্ষ নয়। কিন্তু যিনি একবার সে পুরীর মর্মরপ্রাচীর মণিময়তেরণ রজতসৌধ ও কনকচড়ার সাক্ষাৎলাভ করেছেন, তিনি আকাশরাজ্য হতে আর চোখ ফেরাতে পারেন না। এক কথায় তিনি ভারতবর্ষের একতার দিবাস্বপ্ন দেখতে বাধ্য। অনেকের মতে দিবাঘন দেখাটা নিন্দনীয়, কেননা ও ব্যাপারে শুধু অলীকের সাধনা করা হয়। মানুষে কিন্তু বাস্তবজগতের অজ্ঞতাবশত নয়, তার প্রতি অসন্তোষবশতই, চোখ-চেয়ে ঘন দেখে; সে ঘরে মূল মানবহৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত। এবং ইতিহাস এ সত্যের সাক্ষ্য দেয় যে, আজকের কল্পনারাজ্য কখনো কখনো কালকের বাস্তবজগতে পরিণত হয়, অর্থাৎ দিবাধন কখনো কখনো ফলে। সুতরাং ভারতবর্ষের ঐক্যসাধন জাতীয় জীবনের লক্ষ্য কবে তোলা অনেকের পক্ষে স্বাভাবিক এবং সকলের পক্ষেই আবশাক। সমগ্র সমাজের বিশেষ-একটা-কোনো লক্ষ্য না থাকায় দিন দিন আমাদের সামাজিক জীবন নিজীব এবং ব্যক্তিগত জীবন সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। পূর্বে যে ঐক্যের কথা বলা গেল, তা অবশ্য আইডিয়াল ইউনিটি; এবং অধিকাংশ শিক্ষিত লোকের মনে এক ভারতবর্ষ একটি বিরাট আইডিয়াল-রূপেই বিরাজ করছে। আমাদের বাঞ্ছিত ইউটোপিয়া ভবিষ্যতের অঙ্কস্থ রয়েছে।
কিন্তু এই আইডিয়ালকে দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে নিত্যই আক্রমণ সহ্য করতে হয়। এক দিকে ইংরেজি সংবাদপত্র, অপর দিকে বাংলা সংবাদপত্র এই আইডিয়ালটিকে নিতান্ত উপহাসের পদার্থ মনে করেন; উভয়েই শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উপর বিদ্রূপবাণ বর্ষণ করেন। কাগজওয়ালাদের মতে এই মনোভাবটি বিদেশী-শিক্ষালন্ধ, এবং সেইজন্যই স্বদেশী-ভিত্তিহীন; কেননা ভারতবর্ষের অতীতের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই। ইংরেজি সংবাদপত্রের মতে ভারতবর্ষের সভ্যতার মূল এক নয়, বহ; এবং যা গোঁড়া হতেই পৃথক, তার আর কোনোরূপ মিলন সম্ভব নয়। কুকুর আর বেড়াল নিয়ে এক-সমাজ গড়ে তোলা যায় না; ও দুই শ্রেণীর জীব শুধু গহস্বামীর চাবুকের ভয়ে একসঙ্গে ঘর করতে পারে। অপর পক্ষে বাংলা সংবাদপত্রের মতে হিন্দুসমাজের বিশেষত্বই এই যে, তা বিভক্ত। এ সমাজ শতরঞ্জের ঘরের মতো ছক-কাটা। এবং কার কোন ছক, তাও অতি সুনির্দিষ্ট। এই সমাজের ঘরে কে সিধে চলবে, কে কোনাকুনি চলবে, কে এক পা চলবে, আর কে আড়াই পা চলবে, তারও বাঁধাবাঁধি নিয়ম আছে। এর নাম হচ্ছে বর্ণশ্রমধর্ম। নিজের নিজের গণ্ডির ভিতর অবস্থিতি করে নিজের নিজের চাল রক্ষা করাই হচ্ছে ভারতবাসীর সনাতন ধর্ম। সুতরাং যাঁরা সেই দাবার ঘরের রেখাগুলি মুছে দিয়ে সমগ্র সমাজকে একঘরে করতে চান, তাঁরা দেশের শত্র। শিক্ষিত সম্প্রদায় যে ঐক্য চান তা ভারতবর্ষের ধাতে নেই, সুতরাং জাতির উন্নতির যে ব্যবস্থা তারা করতে চান, তাতে শুধু সামাজিক অরাজকতার সৃষ্টি করা হবে। সমাজের সুনির্দিষ্ট গণ্ডিগুলি তুলে দিলে সমাজতরী কোনাকুনি চ’লে তীরে আটকে যাবে, এবং সমাজের ঘোড়া আড়াই পা’র পরিবর্তে চার পা তুলে ছুটবে। এ অবশ্য মহা বিপদের কথা। সুতরাং ভারতবর্ষের অতীতে এই ঐক্যের আইডিয়ালের ভিত্তি আছে কি না, সেটা খুঁজে দেখা দরকার। এই কারণেই সম্ভবত রাধাকুমুদবাবু দু হাজার বৎসরের ইতিহাস খুড়ে সেই ভিত বার করবার চেষ্টা করেছেন, যার উপরে সেই কাম্যবস্তুকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। এ যে অতি, সাধু উদ্দেশ্য সে বিষয়ে বোধ হয় দ্বিমত নেই।
২.
রাধাকুমুদবাবু জাতীয় জীবনের ঐক্যের মূল যে প্রাচীন যুগের সামাজিক জীবনে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছেন, তার জন্য তিনি আমার নিকট বিশেষ ধন্যবাদার্হ। অনেকে, দেখতে পাই, এই ঐক্যের সন্ধান, ঐতিহাসিক সত্যে নয়, দার্শনিক তথ্যে লাভ করেন। এ শ্রেণীর লোকের মতে সমগ্র ভারতবর্ষ এক ব্রহ্মপুত্রে গ্রথিত; কেননা অদ্বৈতবাদে সকল অনৈক্য তিরস্কৃত হয়। কিন্তু যে সমস্যা নিয়ে আমরা নিজেদের বিব্রত করে তুলেছি, তার মীমাংসা বেদান্তদর্শনে করা হয় নি; বরং ঐ দর্শন থেকেই অনুমান করা অসংগত হবে না যে, প্রাচীন যুগে জাতীয় জীবনে কোনো ঐক্য ছিল না। মানবজীবনের সঙ্গে মানবমনের যোগ অতি ঘনিষ্ঠ। কাব্যের মতো দর্শনও জীবনবৃক্ষের ফল; তবে এ ফল এত সক্ষম বতে ভর করে এত উচ্চে ফুটে ওঠে যে, হঠাৎ দেখতে তা আকাশকুসুম বলে ভ্রম হয়। আমার বিশ্বাস, একটি ক্ষুদ্র দেশের এক রাজার শাসনাধীন জাতির মন একেশ্বরবাদের অনুকল। ঐরূপ জাতির পক্ষে বিশ্বকে একটি দেশ হিসেবে এবং ভগবানকে তার অদ্বিতীয় শাসনও পালনকর্তা হিসেবে দেখা স্বাভাবিক এবং সহজ। অপর পক্ষে যে মহাদেশ নানা রাজ্যে বিভক্ত এবং বহু রাজা-উপরাজার শাসনাধীন, সে দেশের লোকের পক্ষে আকাশদেশে বহু দেবতা এবং উপদেবতার অস্তিত্ব কল্পনা করাও তেমনি স্বাভাবিক। সাধারণত মানুষে মর্তের ভিত্তির উপরেই স্বর্গের প্রতিষ্ঠা করে। যে দেশের পূর্বপক্ষ একেশ্বরবাদী সে দেশের উত্তরপক্ষ নাস্তিক, এবং যে দেশের পূর্বপক্ষ বহুদেবতাবাদী সে দেশের উত্তরপক্ষ অদ্বৈতবাদী। অদ্বৈতবাদী বহুর ভিতর এক দেখেন না, কিন্তু বহুকে মায়া বলে তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। সুতরাং উত্তরমীমাংসার সার কথা— ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’–এই অর্ধ শ্লোকে যে বলা হয়েছে, তার আর সন্দেহ নেই। এই কারণেই বেদান্তদর্শন সাংখ্যদর্শনের প্রধান বিরোধী। অথচ এ কথা অস্বীকার করবার জো নেই যে, সংখ্যা বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে শুধু শূন্য। সুতরাং মায়াবাদ যে ভাষান্তরে শূন্যবাদ এবং শংকর যে প্রচ্ছন্নবৌদ্ধ–এই প্রাচীন অভিযোগের মূলে কতকটা সত্য আছে। যে একাত্মজ্ঞান কর্ম শূন্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত, সে জ্ঞানের চর্চায় আত্মার যতটা চর্চা করা হয়, বিশ্বমানবের সঙ্গে আত্মীয়তার চর্চা ততটা করা হয় না। আরণ্যক-ধর্ম যে সামাজিক, এ কথা শুধু ইংরেজি-শিক্ষিত নাগরিকেবাই বলতে পারেন। সমাজ ত্যাগ করাই যে সন্ন্যাসের প্রথম সাধনা, এ কথা বিস্মৃত হবার ভিতর যথেষ্ট আরাম আছে।