ভবিষ্যতে যা হবার সম্ভাবনা তা নাও হতে পারে; কিন্তু অতীতে যা হয়ে গেছে তা যে হয়ে গেছে তার আর সন্দেহ নেই। এবং প্রতি প্রাচীন সভ্যতার যে একটা বিশেষ রূপ ও বিশেষ ধর্ম আছে, সে কথাও অস্বীকার করা অসম্ভব। অথচ এ-সকল সভ্যতার সামাজিক ব্যবহার এবং মনোভাবের মিলও বড়ো কম নয়। পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতে গ্রীক রোমান এবং হিন্দু সভ্যতার ভিতর ঠিক ততখানি মিল আছে গ্রীক লাটিন ও সংস্কৃত ভাষার ভিতর যতখানি মিল আছে; এবং সে মিল প্রথমত কম নয়, দ্বিতীয়ত তা ধাতুগত। যদিচ আমি পণ্ডিত নই, তবও এ মত গ্রাহ্য করতে আমি কিছুমাত্র কুণ্ঠিত নই। তার কারণ, আমার বিশ্বাস, সকল সভ্যতারই ধাতু এক, প্রত্যয় শুধু; আলাদা। সে যাই হোক, যে-ক’টি প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, সে সবগুলিই, আমার মনে হয়, একজাতীয়, অর্থাৎ আমার কাছে তার প্রতিটি হচ্ছে এক-একখানি কাব্য। কাব্যে-কাব্যে যে প্রভেদ থাকে এদের পরস্পরের ভিতর সেই প্রভেদ মাত্র আছে। আমার মতে গ্রীক সভ্যতা হচ্ছে নাটক, রোমান সভ্যতা মহাকাব্য, ইহদি সভ্যতা লিরিক এবং অর্বাচীন যুগের ইতালীয় সভ্যতা সনেট; আর ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা হচ্ছে রূপকথা। সভ্যতার সঙ্গে কাব্যের তুলনা দেওয়ায় যদি কেউ আপত্তি করেন, তা হলে বলি, ও তুলনা একটা খামখেয়ালির ব্যাপার নয়। আমরা প্রাচীন সভ্যতার যে-সব মতি গড়ি-হয় পুজা করবার জন্য, নয় মনের ঘর সাজাবার জন্য-অতীত শুধু তার উপাদান জোগায়, তাও আবার অতি স্বল্পমাত্রায়; সেই উপাদানকে আমাদের কল্পনাশক্তি গড়ন ও রূপ দেয়, এবং সেই রূপকে আমরা আমাদের হৃদয়রাগে রঞ্জিত করি। কাব্যরচনার পদ্ধতিও ঐ।
সত্য কথা এই যে, সভ্যতা হচ্ছে একটা আর্ট এবং সম্ভবত সবচাইতে বড়ো আর্ট। কেননা এ হচ্ছে জীবনকে বরপ করে তোলবার আর্ট, আর বাদবাকি যত-কিছু, শিল্পকলা আছে, সে সবই এই মহা আর্ট হতে উদ্ভূত এবং তার কর্তৃকই পরিপুষ্ট।
এ কথা অবশ্য বৈজ্ঞানিকেরা এবং দার্শনিকেরা মানবেন না; কেননা বৈজ্ঞানিকের বিশ্বাস, সভ্যতা জন্মে মাটির গুণে; আর দার্শনিকের বিশ্বাস, ও-বস্তু পড়ে আকাশ থেকে। এদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, কাব্যের জন্মদাতা যেমন কবি, সভ্যতার জন্মদাতাও তেমনি মানুষ। এ বস্তুর তত্ত্ব বিজ্ঞান-দর্শন কখনো আবিষ্কার করতে পারবে না, কেননা ও হচ্ছে জীবনের একটি postulate, জ্ঞানের axiom নয়। অর্থাৎ মানুষের মন ছাড়া সভ্যতার অস্তিত্ব আর কোথাও নেই।
সে যাই হোক, এ ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের সভ্যতার বিশিষ্টতা প্রমাণ করবার কোনোই প্রয়োজন নেই। উইলিয়ম আর্চার প্রতি সে বিশিষ্টতা সম্পূর্ণ মানেন; আমাদের উপর তাঁদের রাগ এই যে, আমরা আমাদের প্রাচীনতা ত্যাগ করে নবীন হবার চেষ্টা করছি। ফলে আমাদের সমাজ এখন হয়েছে প্রবীণ-নবীন ওরফে সভ্যাসভ্য। East এবং West যে ভারতবর্ষে meet করেছে, এই হচ্ছে আমাদের অপরাধ; কেননা এই মিলনের ফলে কতকগুলি দুরন্ত সমস্যা জন্মলাভ করেছে। কিন্তু তার জন্য দায়ী কি আমরা?
পূর্বাপর সভ্যতার এই মিলন ও মিশ্রণ যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার নয়, তার প্রমাণ ইউরোপের বর্তমান সভ্যতাও তো প্রবীণ-নবীন, ইউরোপীয় পণ্ডিতমণ্ডলী যার নাম দিয়েছেন antico-modern। বর্তমান ইউরোপীয়েরা যে-অংশে ও যেপরিমাণে জ্ঞানে গ্রীক কর্মে রোমান ও ভক্তিতে ইহদি, সেই অংশে ও সেই পরিমাণে তারা সভ্য, এবং বাদবাকি অংশে তারা হচ্ছে শুধু সাদা মানুষ।
যদি বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতা অ্যান্টিকো-মডান হতে পারে, তো ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সভ্যতা কেন যে অ্যান্টিকো-মডার্ন হতে পারবে না, তা আমার বুদ্ধির অগম্য। তবে এ ক্ষেত্রে ইউরোপের সঙ্গে ভারতবর্ষের একটু প্রভেদ আছে। ইউরোপ তার নবীন সভ্যতার গায়ে প্রাচীন সভ্যতার কলম বসিয়েছে, অপর পক্ষে ভারতবর্ষ তার প্রাচীন সভ্যতার গায়ে নবীন সভ্যতার কলম বসাচ্ছে। ফল কোনটায় ভালো ফলবে, সে কথা বলতে পারে শুধু বৃক্ষায়ুর্বেদীরা। তবে সহজ বুদ্ধিতে তো মনে হয় যে, নূতনের ঘাড়ে পুরাতনকে ভর করতে দেওয়ার চাইতে নূতনকে পুরাতনের কোলে স্থান দেওয়াই বেশি স্বাভাবিক।
সুতরাং আমরা সভ্য কি অসভ্য, সে বিষয়ে আমাদের মাথা বকাবার দরকার নেই, কেননা এখন আমাদের মীমাংসা করতে হবে অন্য সমস্যার। প্রথমে যে-ক’টি সমস্যার উল্লেখ করেছি, তার মধ্যে যে তিনটি বিল-আকার ধারণ করেছে তাদের সম্বন্ধেও বেশি কিছু ভাববার নেই, কেননা এ কথা নিশ্চিত যে, রাউলাট-বিল পাস হবে প্যাটেল-বিল হবে না, এবং রিফর্ম-বিল পাস হবে ও হবে না। যে দুটি বাকি থাকল, শিক্ষা ও শিল্প, সে দুটিই হচ্ছে এ যুগের আসল সমস্যা; কারণ এ দুটির মীমাংসার ভার অনেকটা আমাদের হাতে, এবং এ দুটির আমরা যদি সুমীমাংসা করতে পারি তা হলে আমরা সভ্য কি না, সে প্রশ্ন আর উঠবে না।
ফাগুন ১৩২৫
ভারতবর্ষের ঐক্য
ভারতবর্ষের ঐক্য
শ্ৰীযুক্ত রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় উপরোক্ত নামে পুস্তিকা-আকারে ইংরেজি ভাষায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। যাঁরা দিবারাত্র জাতীয় ঐক্যের স্বপ্ন দেখেন তাঁদের পক্ষে, অর্থাৎ শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রেরই পক্ষে, এই ক্ষুদ্র পুস্তকের আলোচ্য বিষয়ের যথেষ্ট মূল্য আছে।
স্বদেশ কিংবা স্বজাতির নাম উল্লেখ করবামাত্রই এক দলের লোক আমাদের মুখ-ছোপ দিয়ে বলেন, ও-সব কথা উচ্চারণ করবার তোমাদের অধিকার নেই, কেননা ভারতবর্ষ বলে কোনো-একটা বিশেষ দেশ নেই এবং ভারতবাসী বলে কোনো-একটা বিশেষ জাতি নেই। ভারতবর্ষের অর্থ হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এবং পরপর-অসংযত নানা খণ্ড দেশ এবং ভারতবাসীর অর্থ হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরপর-সম্পর্কহীন নানা ভিন্ন জাতি।