এর কারণও খুঁজে বার করতে হবে না। নানা মত পরস্পরের সঙ্গে কাটাকাটি গিয়ে বাকি থাকে শুধু শন্য, আর শনন্য শন্যে যোগ দিলে দাঁড়ায় গিয়ে বিরাট একে। এই সত্যই যে সার সত্য, তার প্রমাণ দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক, দরকম অদ্বৈতবাদের মধ্যে সমান পাওয়া যায়।
২.
উপরে যে-সব সমস্যার ফদ দেওয়া গেছে, তার উপর সম্প্রতি আর-একটি সমস্যা এসে জটেছে, যার বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, তার কোনো মীমাংসা নেই অথচ অনেক তর্ক আছে।
সমস্যাটা হচ্ছে এই যে, ভারতবর্ষ সভ্য কি না। দেখতে পাচ্ছেন সমস্যাটা কত ঘোরতর, কত গুরতর। এ সমস্যা অবশ্য রাজনৈতিকও নয়, সামাজিকও নয়, কিন্তু সকলপ্রকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা ওরই অন্তর্ভূত।
যদি জিজ্ঞাসা করেন, যার মীমাংসা নেই, এমন সমস্যা ওঠে কেন। তার উত্তর একজনে এর পর্বমীমাংসা করে দিয়েছেন বলেই আর পাঁচজনে তার উত্তরমীমাংসা করতে বদ্ধপরিকর হয়েছে। ফলে, ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে একটা বিষম তর্কে।
উইলিয়ম আর্চার নামক জনৈক ধনধর ইংরেজি লেখক এবং প্রবীণ ভাবক, ভারতের নানা দেশ পর্যটন করে অবশেষে উপনীত হয়েছেন এই সিদ্ধান্তে যে, ভারতবাসীরা হচ্ছে অসভ্য জাতিদের মধ্যে সবচাইতে সভ্য এবং সভ্য জাতিদের মধ্যে সবচাইতে অসভ্য।
অমনি আমরা অস্থির হয়ে উঠেছি।
এ কথায় কিন্তু বিচলিত হবার কোনো কারণ আমি দেখতে পাই নে। উইলিয়ম আচারের মত যদি সত্য বলেই ধরে নেওয়া যায়, তাতেই বা ক্ষতি কি। আমরা যদি সভ্যতার মধ্যপথ অবলম্বন করে থাকি, তা হলে তো আমরা আরিস্টটলের মতে ঠিক পথই ধরেছি, বৌদ্ধ মতেও তাই। আর সেকেলে দর্শন যদি বাতিল হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে বলি হেগেলের মতেও দাঁড়ায় এই যে, সভ্যতা (thesis) + অসভ্যতা (antithesis) = সভ্যাসভ্যতা (synthesis); অর্থাৎ আমাদের সভ্যাসভ্যতাটা হচ্ছে synthetic civilization। অতএব সর্বশ্রেষ্ঠ। বেশি অসভ্য হওয়া যে ভালো নয়, সে তো পুরানো সত্য; আর বেশি সভ্য হওয়াও যে মারাত্মক, এই নতুন সত্য তো ইউরোপে হাতে-হাতে প্রমাণ হয়ে গেল। এক দিকে সভ্যতা আর-এক দিকে অসভ্যতা, এই দুই চাপের ভিতর পড়াটা অবশ্য সুখের অবস্থা নয়; কিন্তু আমাদের বর্তমান অবস্থা যে সুখের অবস্থা, এমন কথা আর যেই বলক, আমরা তো কখনো বলি নে।
আর-এক কথা, কি সভ্যতা কি অসভ্যতা এ দুয়ের কোনোটিরই ভিতর মানুষের শান্তি নেই–না দেহের না মনের। যারা নিজেদের অসভ্য বলে জানে, তারা সভ্য হবার জন্য লালায়িত হয়; আর যারা নিজেদের সভ্য বলে জানে, তারা স্বাভাবিক হবার জন্য লালায়িত হয়। পুরাকালে ভারতবর্ষ যখন অতিসভ্য হল, তখন ভারতবাসী সভ্যতার শিকলি কেটে বনে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল; এবং একই অবস্থায় একই কারণে গ্রীকরা হল ফিলজফর আর রোমানরা খান। তার পর যখন নব রোমক-খস্টান-সভ্যতা পুরোপুরি গড়ে উঠল, তখন রসো সকলকে পরামর্শ দিলেন আবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে— অমনি দেশসদ্ধ লোক মেতে উঠল। অপর পক্ষে যাদের জ্ঞান তারা অসভ্য, তারা যে সভ্য হবার জন্য আঁকুবাঁকু করে তার প্রমাণ কি আর উদাহরণের অপেক্ষা রাখে। অতএব এ কথা নিয়ে বলা যায় যে, শান্তি যদি কোথাও থাকে তো সভ্যতা আর অসভ্যতার মিলনক্ষেত্রে; কেননা ও-ক্ষেত্রে অসভ্যতা সভ্যতার এবং সভ্যতা অসভ্যতার তেজ বিলকু ও বেমালুম মেরে দেয়। সুতরাং একাধারে সভ্য এবং অসভ্য হওয়াটাই বুদ্ধিমান জাতের কাজ; আর আমাদের মাথায় যে মগজ নেই, এমন কথা উইলিয়ম আর্চারও বলেন না।
আমার এ-সব কথা যতই যুক্তিযুক্ত হোক-না কেন, আমার মত কেউ গ্রাহ্য করবেন। কেননা এক দল প্রমাণ করতে যেমন ব্যস্ত যে আমরা অতি-সভ্য, আর-এক দল প্রমাণ করতে তেমনি ব্যস্ত যে আমরা অতি-অসভ্য। সুতরাং এ দুই দলকে কেউ ঠেকাতে পারবে না; তাঁরা তর্ক করবেনই, শুধু উইলিয়ম আচারের সঙ্গে নয়, পরস্পরের সঙ্গেও।
এ উভয়কেই আমি বলি, খিরো ভব। আমরা যে অসভ্য, এ প্রমাণ করবারই বা সার্থকতা কি। আর আমরা যে সভ্য, এ প্রমাণ করবারই বা সার্থকতা কি। কেউ যদি প্রমাণ করে দেয় যে আমরা অসভ্য, তা হলেই কি আমাদের অস্তিত্ব লোপ পাবে, না, আমাদের জীবনের সকল সমস্যা উড়ে যাবে? তা অবশ্য কখনোই হবে না, উপরন্তু আর-একটা সমস্যা বাড়বে, সে হচ্ছে সভ্য হবার মহাসমস্যা।
অপর পক্ষে আমরা যদি প্রমাণ করে দিই যে আমরা সভ্য, তা হলেই কি আমাদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে, না, আমাদের জীবনের সকল সমস্যার চড়ান্ত মীমাংসা হয়ে যাবে? তা অবশ্য কখনোই হবে না। কেননা নিজের সার্টিফিকেট নিজের কোনো কাজে লাগে না, ব্যক্তির পক্ষেও নয় জাতির পক্ষেও নয়। তা ছাড়া নিজের দরখাস্তের বলে, এ ক্ষেত্রে পরের কাছ থেকে ভালো সার্টিফিকেট আমরা কিছুতেই আদায় করতে পারব না। সভ্যতা সম্বন্ধে প্রতি জাত নিজেকে সোহহং মনে করে, কিন্তু অপর কোনো জাতকে তত্ত্বমসি বলতে প্রস্তুত নয়। তবে প্রাচীন সভ্যতার সম্বন্ধে এ কথা অবশ্য খাটে না। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতার সুখ্যাতি যে ইউরোপের মুখে আর ধরে না, এ কথা কে না জানে। তার কারণ এই যে, যে সভ্যতা মরে ভূত হয়ে গেছে, উঁচুগলায় তার গুণগান করবার ভিতর কোনো বিপদ নেই; কেননা কোনো জ্যান্ত সভ্যতার উপর ও-সব মরা সভ্যতার কোনো দাবি নেই। প্রাচীন ও মত সভ্যতা কোনো বতমান সভ্যতার কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারে না, কিন্তু বর্তমান সভ্যতা তার কাছ থেকে ঢের আদায় করে, এবং তার নন খায় বলেই তার গুণে গায়। ভারতবর্ষের সভ্যতা গ্রীস-রোমের সভ্যতার মতো প্রাচীন হলেও প্ৰশস্য নয়; কেননা তা মত নয়, জীবিত। এ সভ্যতার অমার্জনীয় অপরাধ এই যে, তা আজও বেচে আছে, এবং বহুকাল বেচে আছে বলে আরো বহুকাল বেচে থাকতে চায়; তাই তার দাবির আর অন্ত নেই। এ সভ্যতার সপক্ষে ইউরোপের সাটিফিকেট বার করা অসম্ভব। আর যদিই বা করা যায়, তাতেই বা কি লাভ? আমাদের জাতীয় সমস্যার আশ মীমাংসা ততটা নির্ভর করবে না আমাদের প্রাচীন সভ্যতা কিংবা অসভ্যতার উপর যতটা নির্ভর করবে ইউরোপের বর্তমান সভ্যতা কিবা অসভ্যতার উপর।