রামায়ণের যুগে যবদ্বীপ সপ্তরাজ্যে উপশোভিত ছিল; কিন্তু খৃস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে সে দেশে তিনটি মাত্র রাজ্য ছিল। খৃস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে যবদ্বীপের হিন্দুরাজ্যের যখন ধংস হয় ও সে দেশের লোকে মুসলমানধর্ম অবলম্বন করে, তখন এক দল লোক স্বধর্ম রক্ষা করবার জন্য যবদ্বীপ থেকে পালিয়ে বলিদ্বীপে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। এদেরই বংশধরেরা এখন বলির অধিবাসী। আর এই ক্ষুদ্র দ্বীপবাসীরাই আজ পর্যন্ত তাদের স্বধর্ম ও স্বরাজ্য দুই রক্ষা করে আসছে। হিন্দু হলেই পরাধীন হতে হবে, বিধির যে এমন-কোনো নিয়ম নেই, তার তিলমাত্র প্রমাণ ঐ দেশেই আছে। বলিদ্বীপ স্বাধীন, কিন্তু যে হিসাবে জাপান স্বাধীন সে হিসাবে নয়; যে হিসাবে নেপাল স্বাধীন সেই হিসাবে, এবং একই কারণে হিন্দুস্থানের ইতিহাসের ধারা এই যে, সে দেশ প্রথমে মুসলমানের অধীন হয়, ও পরে খৃস্টানের। নেপাল ও বলি আগে মুসলমানের অধীন হয় নি, কাজেই তা আজ খৃস্টানের অধীন হয় নি।
বলিদ্বীপ একরত্তি দেশ হলেও কোনো একটি রাজার রাজ্য নয়, এই একশো মাইল লম্বা ও পঞ্চাশ মাইল চওড়া দেশ অট রাজ্যে উপশোভিত। আর এই আটটি ভাগের আটটি পৃথক রাজা আছে। এর থেকেই বুঝতে পারছ, এ দেশে যা আছে তা পুরোমাত্রায় হিন্দুরাজ্য। ভারতবর্ষও হিন্দুযুগে হাজার পৃথক রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এ দেশে যে দু জন একচ্ছত্র রাজত্ব করে গিয়েছেন, তাঁরা হিন্দু নন। অশোক ছিলেন বৌদ্ধ, আর আকবর মোগল। এক রাজ্যের প্রজা না হলে এক দেশের লোক যে এক নেশন হতে পারে না, এ হচ্ছে ইউরোপের হাল মত। হিন্দুরা প্রাচীন যুগে যদি এক নেশন হয়ে থাকে তো সে এক ধর্মের বন্ধনে। অষ্ট রাজ্যে বিভক্ত হলেও বলির অধিবাসীরা এক নেশন—এক ধর্মাবলম্বী বলে। ইউরোপে একালে নেশন গড়ে রাজায়; আর এ দেশে সেকালে গড়ত দেবতায়। পশ্চিমের সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে রাজনীতি, আর পূর্বের সবচেয়ে বড়ো কথা ছিল ধর্মনীতি।
যেমন রাজ্যের ব্যবস্থায়, তেমনি সমাজেও তারা পুরো হিন্দু। তারা এক জাতি হলেও পাঁচ জাতে বিভক্ত। এ পাঁচ জাত হচ্ছে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র ও চণ্ডাল। এ পাঁচ জাত পরস্পর বিবাহাদি করে না। পূর্বে অসবর্ণ বিবাহের শাস্তি ছিল প্রাণদণ্ড। গীতায় ভয় দেখিয়েছে যে, এ করলে ও হবে, ও হলে তা হবে, আর তা হলেই হবে বর্ণসংকর, তার পরেই প্রলয়। বলির হিন্দুসমাজ বোধ হয় গীতার মতেই চলে। আর প্রাণদণ্ডটাও বোধ হয় দেওয়া হত গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় অনুসারে। যদি কোনো ঘাতক কারো প্রাণ বধ করতে ইতস্তত করত তা হলে তাকে সম্ভবত বলা হত–
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বা উত্তিষ্ঠ পরন্তপঃ।
আমরা সকলেই যখন ব্রহ্ম তখন কে কাকে মারে, আর কেই-বা মরে। কিন্তু এতটা নির্জলা হিঁদুয়ানি এ যুগে চলে না। কারণ এ যুগের লোকের যখন-তখন মরতে ঘোর আপত্তি আছে, কিন্তু যাকে-তাকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই। তাই এখন নিয়ম হয়েছে যে, অসবর্ণ বিবাহ করলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যার বর্ণ নিম্ন, অপর পক্ষও সেই বর্ণভূত হয়ে যাবে। অর্থাৎ জাতিভেদের কাঠামো বজায় থাকবে, কিন্তু লোকের এক বর্ণ ত্যাগ করে আর-এক বর্ণে ভর্তি হবার স্বাধীনতাও থাকবে। স্কুলের ছেলেরা যেমন পড়া মুখস্থ না দিতে পারলে উপরের ক্লাস থেকে নীচের ক্লাসে নেমে যায়, বলির লোকেরাও তেমনি অসবর্ণ বিবাহের ফলে উলটো প্রমোশন পায়।
কিছুদিন পূর্বে বলিদ্বীপে সতীদাহ প্রচলিত ছিল। কিন্তু এখন সে প্রথা উঠে গিয়েছে। এখন সতী যায় শুধু রাজার ঝি-বৌরা। এর কারণ বোধ হয় রাজারা অবলাদের আঁচল না ধরে স্বর্গেও যেতে পারে না। সে যাই হোক, এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বেন্টিক সাহেব এ দেশে না এলেও এতদিনে হিন্দুসমাজে সতীদাহ প্রথা উঠে যেত, ছেরেপ কালের গুণে।
বিবাহের পর আসে অবশ্য আহারের কথা। বলীয়ানরা কি খায় তা জানি নে, কিন্তু তারা গো-মাংস ভক্ষণ করে না, এমন-কি, বলিদ্বীপে গোহত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারা কিন্তু শুয়োর নিত্য খায়, তবে তাতে তাদের হিন্দুত্ব নষ্ট হয় না। সে দেশে সকল বরাহই বন্যবরাহ, কারণ দেশটাই হচ্ছে বুনো দেশ।
তাদের ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় দু কথায় দিই। ভারতবর্ষের সব দেবতা বলিবীপে গিয়ে জুটেছেন। এমন-কি, কার্তিক সমুদ্রলঙ্ঘন করেছেন ময়ুরে চড়ে, আর গণেশ ইঁদুরে চড়ে। ইঁদুর যে পিঁপড়ের মতো চমৎকার সাঁতার কাটতে পারে, তা বোধ হয় তোমরা সবাই জান, কারণ ছেলেরা চিরকালই মেয়েদের কাছে শুনে আসছে যে, পিঁপড়ে খেলে সাঁতার শেখা যায়।
কিন্তু সেখানকার মহাদেব হচ্ছেন কাল, আর মহাদেবী দুর্গা। বলিদ্বীপের দুর্গাপূজা নৈমিত্তিক নয়, নিত্য। বলিদ্বীপের অধিবাসীরা বৌদ্ধও নয়, বৈষ্ণবও নয়। ওসব ধর্ম গ্রহণ করলে তাদের প্রধান ব্যাবসা-অস্ত্রের ব্যাবসা—যে মারা যায়। আর বাকি থাকে শুধু বস্ত্রের ব্যাবসা। একমাত্র বস্ত্রের সাহায্যে স্বরাজ হয়তো লাভ করা যেতে পারে, কিন্তু রক্ষা করা যায় না।
বলিদ্বীপের অধিবাসীদের আচার-ব্যবহার, দেবদেবতার সংক্ষেপে যে পরিচয় দিলাম, তার থেকেই বুঝতে পারছ তারা যে হিন্দু, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। এমন-কি, যে-সব ইউরোপীয়ের সে দেশের সঙ্গে পরিচয় আছে, তাঁরা বলেন যে তাদের যদি কেউ অহিন্দু বলে, তা হলে তারা অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে।