সে যাই হোক, বলিদ্বীপের নাম যখন সংস্কৃত, তখন সে নামকরণ যে হিন্দুরাই করেছিলেন, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। আর খৃস্টজন্মের পূর্বেও যে হিন্দুরা বলিদ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন, তারও কিছু কিঞ্চিৎ প্রমাণ আছে।
এই দ্বীপপুঞ্জে উপনিবেশ-স্থাপন হিন্দুজাতির ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। সে ইতিহাস আমি আজ তোমাদের শোনাব না; কারণ সে মস্ত লম্বা ইতিহাস। হিন্দু জাতির মহা গৌরবের কথা এই যে, হিন্দুরা এই দ্বীপবাসী অসভ্য জাতদের সভ্য করে তুলেছিলেন। এ দেশের লোক পূর্বে যে কিরকম যোর অসভ্য ও ভীষণপ্রকৃতির লোক ছিল, তা রামায়ণে দ্বীপবাসীদের বর্ণনা থেকেই অনুমান করা যায়। তারা ছিল ‘আমমীনাশনাঃ’ অর্থাৎ তারা কাঁচা মাছ খেত। তাতে কিছু যায় আসে না; কেননা সুসভ্য জাপানিরা আজও তাই খায়। বাল্মীকি শুনেছিলেন যে, তারা ‘অন্তর্জলচরা ঘোরা নরব্যাঘ্রাঃ’। নরশার্দূল অবশ্য আমরা বীরপুরুষদেরই বলি, কিন্তু নরব্যাঘ্র বলতে বীরপুরুষ বোঝায় না, বোঝায় সেই জাতীয় পুরুষদের, যারা ‘অক্ষয়া বলবন্ত পুরুষা পুরুষাদকা’–ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যানিবলস। এই হেমাঙ্গ কিরাতের দল ছিল সব ক্যালিবনের দাদা ক্যানিবল।
শ্রীবিজয়রাজ্যের অর্থাৎ সুমাত্রার ইতিহাস-লেখক জনৈক ফরাসি পণ্ডিত বলেছেন যে আমরা পুরোনো দলিলপত্র থেকে প্রমাণ পেয়েছি যে, ভারত-মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ পুরাকালে এক নব সভ্যতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। যেমন কম্বোজের (ক্যাম্বোডিয়া) ও চম্পার (আনাম-কোচিনচায়না) তেমনি এ দেশেরও Alma Mater ভারতবর্ষ বহুকাল পূর্বে তার দেবতা, তার শিল্পকলা, তার ভাষা, তার সাহিত্য, সংক্ষেপে তার সভ্যতার সকল মহামূল্য উপকরণ এই দ্বীপবাসীদের সানন্দে দান করেছিল, এবং সহস্র বৎসরের অধিককাল ধরে এই দ্বীপবাসীরা সমগ্র হিন্দু-সভ্যতা ভক্তিভরে শিক্ষা ও আয়ত্ত করে তাদের হিন্দুগুরুদের গৌরবান্বিত করেছিল।
একটি সভ্য জাতি একটি অসভ্য জাতিকে নিজের ধর্ম আর্ট ও সাহিত্যের চেয়ে বড়ো আর কোন মহামুল্য বস্তু দান করতে পারে!
প্রসিদ্ধ চীন-পরিব্রাজক ই-চিং খৃস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ভারতবর্ষ থেকে স্বদেশে ফেরবার পথে সুমাত্রার অন্তর্গত শ্রীবিজয়রাজ্যে কিছুকাল বাস করেন। তিনি তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখে গিয়েছেন যে—
শ্রীবিজয়ের বৌদ্ধ-পণ্ডিতরা ভারতবর্ষের মধ্যদেশের পণ্ডিতদের মত সমগ্ৰ সংস্কৃত শাস্ত্র চর্চা করেন, ও তাঁদের ক্রিয়াকলাপ আচার-বিচার মধ্যদেশের ক্রিয়াকলাপ আচার-বিচারের সম্পূর্ণ অনুরূপ। সুতরাং ভবিষ্যতে চীন-পরিব্রাজকরা যেন প্রথমে শ্রীবিজয়ে এসে সংস্কৃত শিক্ষা করেন পরে ভারতবর্ষে যান।
আমরা যেমন আগে গোলদিঘির পণ্ডিতদের কাছে ইংরেজি শিক্ষা করে পরে বিলেত যাই।
ই-চিংয়ের পরামর্শ অনুসারে তাঁর পরবর্তী বহু চীনদেশীয় পরিব্রাজক সংস্কৃত সাহিত্য শিক্ষা করবার জন্য যবদ্বীপ ও শ্রীবিজয়ে গিয়েছিলেন। এখানে একটি কথা বলে রাখি। যবদ্বীপে প্রথমত হিন্দুধর্ম প্রচলিত ছিল, পরে সে দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়। কিন্তু যবদ্বীপে এ দুই ধর্ম পৃথক ছিল না, দুয়ে মিলে একই ধর্ম হয়। বুদ্ধ সে দেশে শিববুদ্ধ নামেই পরিচিত। এ দেশে বুদ্ধদেব বিষ্ণর অবতার হিসেবেই গণ্য; কিন্তু সে দেশে শিবে ও বুদ্ধে সমান হয়ে গিয়েছিল। সেকালে হিন্দুরা যে অপর দেশের লোককে সভ্য করেছিল, এ কথা বিশ্বাস করা দূরে থাক, এ যুগের আমরা তা কল্পনাও করতে পারি নে; কারণ এখন অপর দেশের লোক আমাদের সভ্য করছে, আর তাদের সভ্যতা আমরা সকল তনু মন ধন দিয়ে মুখস্থ করতে এতই ব্যস্ত যে, ভারতবর্ষ যে এককালে সভ্য ছিল সে কথা আমাদের মনে স্থান পায় না, পায় শুধু মুখে।
সুতরাং ভারতবর্ষের কোন প্রদেশের লোক যবদ্বীপে গিয়ে বসতি করে, এ প্রশ্ন তোমাদের মনে উদয় হওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে প্রমাণের চেয়ে অনুমানের উপর বেশি নির্ভর করতে হয়; অর্থাৎ অন্ধকারে ঢিল মারতে হয়। ঐতিহাসিকরা সে ঢিল দেদার মেরেছেন, কিন্তু তার একটাও যে ঠিক লোকের গায়ে গিয়ে পড়েছে, এমন কথা জোর করে বলা যায় না।
তবে এটুকু ভরসা করে বলা যায় যে, তারা আর যে জাতই হোক, মাদ্রাজি নয়। যে উত্তরাপথের লোক দক্ষিণাপথকে সভ্য করেছে, খুব সম্ভবত তারাই ঐ দ্বীপবাসীদেরও সভ্য করেছে। যবদ্বীপে যে মহাভারতের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তা উত্তরাপথে যে মহাভারত প্রচলিত ছিল, তারই অনুবাদ।
কোথায় ভারতবর্ষের উত্তরাপথ আর কোথায় মহাসাগর, সুতরাং তাঁরা কোন বন্দর থেকে মহাসমুদ্রে অবতরণ করলেন? খুব সম্ভবত তাঁরা মসলিপত্তনে গিয়ে জাহাজে চড়েছিলেন। আর গুজরাটের Broach নগর থেকে মসলিপত্তন পর্যন্ত যে একটি স্থলপথ ছিল, তারও প্রমাণ আছে। সুতরাং এরূপ অনুমান করা অসংগত নয় যে, আর্যাবর্তের আর্যরাই এই সভ্যতা-প্রচারকার্যে ব্রতী হয়েছিলেন। মন, বলেছেন যে, আর্যদের আচারই একমাত্র সাধু আচার, অতএব তা ‘শিক্ষেরন, পৃথিব্যাং সর্বমানবাঃ’। এ কথার ভিতর মস্ত একটা গর্ব আছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আছে উদারতা আর মহত্ত্ব। দক্ষিণাপথের তামিলরাও সুমাত্রা জয় করতে গিয়েছিল, কিন্তু সে বহুকাল পরে—খৃস্টীয় দশম ও একাদশ শতাব্দীতে। তাদের উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল শ্রীবিজয়রাজ্য বিজয় করে তাকে শ্রীভ্রষ্ট করা। বলিদ্বীপের কথা বলতে গিয়ে যবদ্বীপের বিষয় দু কথা বলোম এইজন্য যে, সেকালের যবদ্বীপের হিন্দুধর্ম একালে বলিদ্বীপে মজুত রয়েছে।