এই থেকে দেখতে পাচ্ছ যে ভারতবর্ষ, কি অন্ন কি বস্তু, কিছুরই জন্য অপর কোনো দেশের মুখাপেক্ষী নয়। আজকাল কেউ কেউ বাংলাদেশে কাপাসের চাষ করতে চান। এ চেষ্টা দক্ষিণাপথে ধানের চাষ চালাবার অনুরূপ। এ ইচ্ছা অবশ্য অতি সদিচ্ছা, কিন্তু এ ইচ্ছা জিয়োগ্রাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সমগ্র ভারতবর্ষকে ঢেলে সাজাবার মহৎ বাধা হচ্ছে ভারতবর্ষের প্রকৃতি।
ভারতবর্ষের ঐক্য
ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির পরিচয় দিতে হলে বোধ হয় এক বৎসর কাল লাগে। আমি আমার বরাদ্দ এক ঘণ্টার ভিতর সে দেশের আকৃতি ও প্রকৃতির মোটামুটি পরিচয় দিতে চেষ্টা করেছি। তাতে তোমাদের তরুণ জ্ঞানপিপাসা কতদূর মিটেছে বলতে পারি নে। যদি না মিটে থাকে তো আমার বক্তব্য এই যে— যত্নে কৃতে যদি ন সিধ্যতি কোহত্র দোষঃ।
এখন এই কথাটি তোমাদের বলতে চাই যে, এই সমগ্র দেশটি একদেশ। পৃথিবীতে আর যে-সব দেশ একদেশ বলে গণ্য, সে-সব ছোটো ছোটো দেশ। এক মহাচীন ব্যতীত অপর কোথাও এত বড়ো দেশ একদেশ বলে গণ্য হয় নি।
প্রথমত, এদেশের চতুঃসীমা এ দেশকে যেমন পরিচ্ছিন্ন করেছে, অন্য কোনো দেশকে তেমন করে নি। চীনদেশে এর তুল্য স্বাভাবিক সীমানা নেই, তাই চীনেরা তাদের দেশ প্রাচীর দিয়ে ঘিরতে চেষ্টা করেছিল, পাশাপাশি অন্যান্য দেশ থেকে স্বদেশকে পৃথক করবার জন্য। এ চেষ্টা অবশ্য ব্যর্থ হয়েছে।
হিমালয়ই হচ্ছে ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির সবচেয়ে বড়ো জিনিস। পৃথিবীর আর-কোনো দেশের অত বড়ো প্রাচীর নেই। তার পর ঐ হিমালয়ই সত্যসত্য ভারতবর্ষের ভাগ্যবিধাতা ও জলবায়ুর নিয়ন্তা। হিমালয়ের জলই হচ্ছে উত্তরাপথের প্রাণ। আর হিমালয়ই সমগ্র ভারতবর্ষের বায়ুর চলাচল নিয়ন্ত্রিত করে। এর ফলে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ এমন উর্বর, এমন মানুষের বাসোপযোগী দেশ হয়েছে। তার পর ভারতবর্ষের অন্তরে কোনো সমদ্র কিংবা হ্রদ নেই, আর তার মধ্যস্থ একমাত্র পর্বতশ্রেণী বিন্ধ্যশ্রেণী এত উচ্চ নয় যে, ভারতবর্ষের উত্তর-দক্ষিণকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারে। তার পর এই একদেশ এত বৈচিত্র্যপূর্ণ যে, এক হিসেবে একে পৃথিবীর সংক্ষিপ্তসার বলা যেতে পারে।
ভারতবর্য মহাদেশটি অতি সুরক্ষিত দেশ। প্রকৃতি নিজ হাতেই এ দুর্গের পর্বতের প্রাকার ও সাগরের পরিখা গড়ে দিয়েছেন। তবে এ দেশ এশিয়ার অপরাপর দেশ হতে বিচ্ছিন্ন হলেও তাদের সঙ্গে একেবারে যোগাযোগশন্য নয়। পূর্বেই বলেছি যে, উত্তরাপথের পশ্চিমে দুটি প্রবেশদ্বার আছে—উত্তরে খাইবার পাস ও দক্ষিণে বোলান পাস। অতীতে এই দুই রন্ধ্র দিয়ে ইরানি তুরানি শক হূন যবন বাহ্লিক মোগল পাঠান প্রভৃতি জাতিরা এ দেশে প্রবেশ করেছে, কিন্তু সহজে নয়। খাইবার পাস দিয়ে ঢুকলে পাঞ্জাবের পঞ্চনদ পার হয়ে এসে গঙ্গাযমুনার দেশে পৌঁছতে হত, আর বোলান পাস দিয়ে এলে বিদেশীদের বুকে মরুভূমি ঠেকত।
ভারতবর্ষের অন্তরে প্রবেশ করবার আসল দ্বার হচ্ছে দিল্লি নামক শহর। কারণ সেখানে মরভূমি ও আরাবলি পর্বত শেষ হয়ে শস্যশ্যামল সমভূমি আরম্ভ হয়েছে। সেই মিলনস্থানেই মোগল-পাঠানরা দিল্লি নগর প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর্যদের ইন্দ্রপ্রস্থ নগরও এইখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর, দিল্লির উপকণ্ঠেই ভারতবর্ষের সর্ব প্রধান রণক্ষেত্র। কুরুক্ষেত্র থানেশ্বর পাণিপথ এ-সবই প্রায় এক জায়গায়। পুরাকালে দিল্লির গেট না ভেঙে কোনো বিদেশী জাতি ভারতবর্ষের ভিতর প্রবেশ করতে পারে নি। ফলে যে-সকল জাত ও-দ্বার খুলতে পারে নি তারা হয় দেশে ফিরে গিয়েছে, নয় সিন্ধু ও পঞ্চনদ-দেশ অধিকার করে বসেছে।
ভারতবর্ষের সমুদ্রকূলেও দু-চারটি ছাড়া আর প্রবেশদ্বার ছিল না, আর সে-কটি বন্দর দক্ষিণাপথের পশ্চিম উপকূলে; উত্তরে ভৃগুকচ্ছ ও সুরপারগ এবং দক্ষিণে কালিকট ও কোচিন।
এই-ক’টি দ্বার দিয়েই ইউরোপীয় জাতিরা জাহাজে করে সমুদ্র পার হয়ে এ দেশে প্রবেশ করেছে। পোর্তুগিজ ওলন্দাজ ইংরেজ ও ফরাসিরা এই পথ দিয়েই ভারতবর্ষে ঢুকেছে। ভারতবর্ষে প্রবেশ করবার স্থলপথ এখন বন্ধ। খাইবার পাস এবং বোলান পাস এই দুই দুয়োরই এখন দুর্গ দিয়ে সুরক্ষিত; কিন্তু জলপথ এখন পশ্চিম দক্ষিণ ও পূর্ব তিন দিকে খোলা। এখন ভারতবর্ষের সঙ্গে এশিয়ার যোগ ছিন্ন হয়েছে, তার পরিবর্তে নূতন যোগ স্থাপিত হয়েছে ইউরোপের সঙ্গে; সে যোগ অবশ্য দৈহিক নয়, মানসিক।
এই এক ঘণ্টা ধরে তোমাদের কাছে ভারতবর্ষের যে মোটামুটি বর্ণনা করলাম, সে বর্ণনার ভিতর থেকে তার একটা অঙ্গ বাদ পড়ে গেল। দেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। সুতরাং ভারতবাসীদের কথা বাদ দিয়ে ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির বর্ণনা পূর্ণাঙ্গ হয় না। তবে-যে ভারতবর্ষের নানা দেশের নানা জাতীয় লোকের রূপগণের পরিচয় দিতে চেষ্টামাত্র করি নি, তার কারণ সে পরিচয় দেওয়া আমার পক্ষে অসাধ্য। অ্যানথ্রপলজি নামক বিজ্ঞান আমি জানি নে, আর সে বিজ্ঞানেরও এ বিষয়ে বিশেষ কোনো জ্ঞান নেই। অ্যানথ্রপলজি এ বিষয়ে সত্য খুঁজছে, কিন্তু আজও তার সাক্ষাৎ পায় নি। আজ এক অ্যানথ্রপলজিস্ট যা বলেন, কাল অপর অ্যানথ্রপলজিস্ট তার খণ্ডন করেন। সুতরাং ও-শাস্ত্রের মনগড়া কথা সব তোমাদের নিয়ে কোনো লাভ নেই; বরং সে-সব কথা শোনায় তোমাদের ক্ষতি আছে। বিজ্ঞানের নাম শুনলেই আমরা অজ্ঞান হই। অর্থাৎ ঐ নামে যে-সব কথা চলে, সে-সব কথাকে এ যুগে বেদবাক্য বলে মেনে নিই। আমাদের মতো বয়স্ক লোক দেরই যখন মনের চরিত্র এহেন, তখন তোমাদের পক্ষে এ-সব অনিশ্চিত বিজ্ঞানের সুনিশ্চিত কথা শোনায় ভয়ের কারণ আছে। তোমাদের মন স্বভাবতই বিশ্বাসপ্রবণ। বিজ্ঞানের কথা ছেড়ে দাও, খবরের কাগজের কথাতেও তোমরা বিশ্বাস কর। বুজরুক শব্দটার মানে শুনতে পাই জ্ঞানী। বুজরুক নামক জ্ঞান নিয়েই কাগজওয়ালাদের কারবার। আর নিত্য দেখতে পাই যে, সেই বুজরুকি কথা তোমাদের নরম মনে এমনই বসে যায় যে, সে কালির ছাপ অনেকের মনে চিরজীবন থেকে যায়। সুতরাং ভারতবর্ষের নৃতত্ত্ব অথবা জাতিতত্ত্ব নিয়ে তোমাদের সব মনকে ব্যস্ত করবার কোনো প্রয়োজন নেই।