রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, ইউরোপীয় সভ্যতা জন্মলাভ করেছে শহরে ও সেইখানেই লালিত-পালিত হয়েছে; অপর পক্ষে ভারতবর্ষের সভ্যতা জন্মগ্রহণ করেছে বনে, অর্থাৎ ঋষির আশ্রমে, ও সেইখানেই লালিত-পালিত হয়েছে।
এ দেশ যদি ঋষিক্ষেত্র হয়, তার কারণ এ দেশ মূলে কৃষিক্ষেত্র। বন গ্রামেরই অপর পৃষ্ঠা। আশ্রম মাটির নয়, মনেরই কৃষিক্ষেত্র।
আজকাল অনেক ইংরেজশিক্ষিত সদাশয় লোক ভিলেজ অরগ্যানিজেশন করবার জন্য অতিশয় ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু মানুষ কৃষিকর্মের জন্য যুগ যুগ ধরে যে অরগ্যানিজেশন করেছে, তারই নাম কি ভিলেজ নয়? ভিলেজ জিনিসটে শুধু অরগ্যানাইজড নয়, কালবশে প্রতি গ্রাম এক-একটি অরগ্যানিজম হয়ে উঠেছে। অরগ্যানিজমকে অরগ্যানাইজ করবার প্রবৃত্তিটি যেমন উচ্চ, তেমনি নিরর্থক। অরগ্যানিজমও ব্যাধিগ্রস্ত হয়; যদি আমাদের দেশের গ্রামসমূহ তাই হয়ে থাকে, তা হলে তাদের ব্যাধিমুক্ত করবার জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্তু চিকিৎসার নাম অরগ্যানিজেশন নয়; অরগ্যানাইজ্ মানুষে করে শুধু কলকারখানা। যে ভূভাগকে ভগবান চাষের দেশ করে গড়েছেন, তাকে আমরা পাঁচজনে কলকারখানার দেশ তৈরি করতে পারব না, তা চাষার মুখের গ্রাস কেড়ে টাটা কোম্পানির লোহার কলের পেট যতই ভরাই নে কেন। ভারতবর্ষ কখনো বিলেত হবে না। মনে ভেবো না যে আমি ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে শুরু করেছি। পুরাণকাররা বলেছেন যে, ভারতবর্ষ হচ্ছে আসলে কর্মভূমি, আর এ দেশ সেই কর্মের ভূমি যে কর্ম দেবদানবরা করতে পারেন না। এ কর্ম হচ্ছে কৃষিকর্ম। আর এইটিই হচ্ছে, ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির গোঁড়ার কথা আর অন্তরের কথা। আর এই ভিত্তির উপরেই ভারতবাসীর মনপ্রাণ গড়ে উঠেছে। এ সত্য উপেক্ষা করলে সেকালের ধর্মশাস্ত্রেও অধিকার জন্মাবে না, একালের অর্থশাস্ত্রেও অধিকার জন্মাবে না। আর তখন তোমরা ধর্ম বলতে বুঝবে অর্থ, আর অর্থ বলতে বুঝবে ধর্ম; যেমন আজকালকার পলিটিশিয়ানরা বোঝেন।
উদ্ভিদ
মানুষের জীবন উদ্ভিদের জীবনের অধীন। উদ্ভিদের কাছ থেকে যে আমরা শুধু অন্ন পাই তাই নয়, বস্ত্রও পাই। ভারতবর্ষের বক্ষলতা তৃণশস্য আমাদের এই দুই জিনিসই জোগায়। উত্তরাপথ প্রধানত আমাদের দেয় অন্ন, আর দক্ষিণাপথ বস্ত্র।
উত্তরাপথের পশ্চিমাংশ রুটির দেশ, পূর্বাংশ ভাতের দেশ। প্রথমত ধান জন্মায় অতিবৃষ্টির দেশে, ও গম জন্মায় অল্পবৃষ্টি এমন-কি, অনাবৃষ্টির দেশে। তার পর ধানের জন্য চাই নরম মাটি, ও গমের জন্য শক্ত মাটি। বাংলার মাটিও নরম আর এখানে বৃষ্টিও হয় বেশি, তাই বাংলা হচ্ছে আসলে ধানের দেশ। পাঞ্জাবে বৃষ্টি কম ও মাটি শক্ত, তাই পাঞ্জাবের প্রধান ফসল হচ্ছে গম। সিন্ধুদেশেও আজকাল দেদার গম জন্মাচ্ছে। অনেক উদ্ভিদের মাথায়ও জল ঢালতে হয়, গোঁড়ায়ও জল দিতে হয়। বৃষ্টির জলে স্নান না করতে পেলে ধান বাঁচে না। কিন্তু খেজুর গাছের মাথায় এক ফোঁটাও জল দিতে হয় না। গোঁড়ায় রস পেলে ও গাছ তেড়ে বেড়ে ওঠে। এ কারণ সাহারা মরুভূমি ও আরবদেশই আসলে খেজুরের দেশ। ও দুই মরভূমির ভিতর যেখানে একটু জল আছে, সেইখানেই চমৎকার খেজুর জন্মায়। জানোয়ারের ভিতর যেমন উট, গাছের ভিতর তেমনি খেজুর-মরুভূমিরই জীব। গমের মাথায়ও বারিবর্ষণ করবার দরকার নেই। মরুভূমির ভিতর নালা কেটে যদি জল নিয়ে যাওয়া যায়, তা হলেই সেখানে গম জন্মায় ও প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। শস্যের যে শুধু পিপাসা আছে তাই নয়, খিদেও আছে। মাটির ভিতর যে রাসায়নিক পদার্থ ওরফে সার থাকে, তাই হচ্ছে শস্যের প্রধান খাদ্য। যে দেশে বেশি বৃষ্টি হয়, সে দেশের মাটি থেকে অনেক সময়ে এই সার ধুয়ে যায়। মরভূমির অন্তরে কিন্তু এ সার সঞ্চিত থাকে। সেখানে অভাব শুধু জলের। তাই মরভূমির অন্তরে জল ঢোকাতে পারলেই যে-সব শস্যের শুধু গোঁড়ায় জল চাই সে-সব শস্য প্রভূত পরিমাণে জন্মায়। সিন্ধুনদ থেকে খাল কেটে জল নিয়ে গিয়ে সিন্ধুদেশকে এখন শস্যশ্যামলা করে তোলা হয়েছে।
দক্ষিণাপথের ভিতরকার মাটি আগ্নেয়গিরি থেকে উদগত পাথর-ভাঙা মাটি। এ মাটিতে খাবার জিনিস তেমন জন্মায় না। আর দক্ষিণাপথের অপর মাটিও অতি নিরেস মাটি, তাতে ধান জন্মায় না, গমও জন্মায় না; জন্মায় শুধু বাজরি আর জোয়ারি, আর তারই রুটি খেয়েই এ দেশের লোক জীবনধারণ করে। এ দু ভাগের দুটি অংশ কিন্তু খুব উর্বর, পশ্চিমে মালাবার ও পূর্বে করমণ্ডল উপকূল। মালাবার নারিকেল গাছের দেশ, আর করমণ্ডল তাল গাছের। তা ছাড়া এই দেশে শস্যও প্রচুর জন্মায়। তবুও দক্ষিণাপথ নিজের দেশেরই খোরাক জুগিয়ে উঠতে পারে না; দেশে-বিদেশে অন্ন বিতরণ করা তো তার পক্ষে অসম্ভব।
কিন্তু এই দক্ষিণাপথের আর-একটি সম্পদ আছে। আগ্নেয়গিরির পাথর-ভাঙা মাটিকে ব্ল্যাক কটন সয়েল বলা হয়, কারণ ও-মাটির রঙ কালো ও তাতে কার্পাস জন্মায়। এ দেশে এত কার্পাস জন্মায় যে দক্ষিণাপথ শুধু সমগ্র ভারতবর্ষকে নয়, দেশ-বিদেশকে তুলো জোগায়। বাংলা যেমন ধানের দেশ, পাঞ্জাব যেমন গমের দেশ, দক্ষিণাপথ তেমনি মুখ্যত তুলোর দেশ। এ দেশ শুধু কাপাসের দেশ নয়, শিমুলেরও দেশ। অতি গোদাবরীতীরে বিশাল শাল্মলীতর-এ কথাটা শুধু গল্পের কথা নয়। দক্ষিণাপথের তুল্য বিশাল শাল্মলীতর, পৃথিবীর অন্য দেশে বিরল।