বলির লোক শুধু বলিষ্ঠ নয়, অত্যন্ত কমিষ্ঠ। চাষবাসে তারা অতিশয় দক্ষ। তারা হাল-চালনা ছাড়া হাতের আরো অনেক কাজ করে। তারা চমৎকার কাপড় বোনে ও চমৎকার অস্ত্র বানায়। তাদের তুল্য তাঁতি ও কামার জাভায় পাওয়া যায় না। অন্ন বস্ত্র ও অস্ত্রের সংস্থান যে দেশে আছে, সে দেশে একালের আদর্শ সভ্যতার কোন উপকরণ নেই? আর শৌখিন অশনসনের ব্যবস্থাতেও বলি বঞ্চিত নয়। সে দেশে কফি জন্মায় আর তামাক জন্মায়। আর এ দুই তারা পান করে; একটা তাতিয়ে জল করে, আর-একটা পুড়িয়ে ধোঁয়া করে—যেমন আমরা করি। বলির লোক রেশমের কাপড়ও বোনে আর তা রঙাবার জন্য নীলের চাষও করে। সোনা দিয়ে তারা গহনা গড়ায় ও জরি বানায়। গহনা গড়তে ও জরির কাজ করতে তারা অদ্বিতীয় ওস্তাদ।
বলির ভাষা জাভার ভাষারই অনুরূপ। তবে ইতালির ভাষার সঙ্গে ফরাসি ভাষার যে প্রভেদ, যবীয় ভাষার সঙ্গে বলীয় ভাষার সেই প্রভেদ। এ দেশের সাহিত্যের ভাষার নাম ‘কবি’, ‘সাধু’ নয়। পাঁচশো বৎসর পূর্বে জাভার সাহিত্য কবি-ভাষাতেই লেখা হত। এ ভাষার অনেক শব্দ সংস্কৃত। এ যুগে জাভার লোক তাদের সাহিত্যের ভাষা বড়ো-একটা বুঝতে পারে না—কিন্তু বলির লোকের কাছে কবি মৃত নয়। চারশো বৎসর আগে জাভার লোক সব মুসলমান হয়ে যায়। সম্ভবত সেইজন্য তারা তাদের পূর্ব কবি-ভাষা ভুলে গিয়েছে; আর বলির লোক আজও হিন্দু, রয়েছে বলে কবির পঠনপাঠন সে দেশে আজও চলছে।
জাভার যথার্থ নাম যে যবদ্বীপ, তা তোমরা সবাই জান। সংস্কৃত যব শব্দের অন্তস্থ য আরবদেশের মুসলমানদের মুখে বর্গীয় জ-এ ও ব ভ-এ পরিণত হয়ে তদুপরি অকার আকার হয়ে জাভা রূপ ধারণ করেছে।
এই সংস্কৃত নাম থেকেই আন্দাজ করা যায় যে, পুরাকালে ও-দ্বীপের নামকরণ করেছিল হিন্দুরা। এখন তোমরা জিজ্ঞাসা করতে পার, কবে হিন্দুরা এ দ্বীপ আবিষ্কার করে। এর উত্তর দেওয়া অসম্ভব। তবে যেকালে এ দেশে রামায়ণ লেখা হয়, সেকালে যবদ্বীপ যে হিন্দুদের কাছে উক্ত নামেই পরিচিত ছিল তার প্রমাণ রামায়ণেই আছে। আর সে বড়ো কম দিনের কথা নয়। তোমরা সবাই জান যে, রামায়ণ রাম জন্মাবার ষাট হাজার বৎসর আগে লেখা হয়েছিল; আর রাম জন্মেছিলেন ত্রেতা যুগে।
শ্রীমৎ হনুমানকে যখন দেশদেশান্তরে সীতাকে অন্বেষণ করতে আদেশ দেওয়া হয়, তখন তাকে বলা হয়—
গিরিভির্যে চ গম্যন্তে প্লবনেন প্লবেন চ।
রত্নবন্তং যবদ্বীপং সপ্তরাজ্যোপশোভিতম।।
সুবৰ্ণরূপ্যকং চৈব সুবর্ণাকরমণ্ডিতম।
যবদ্বীপমতিক্রম্য শিশিরো নাম পর্বতঃ।
দিবং স্পৃশতি শৃঙ্গেন দেবদানবসেবিতঃ।
এ যবদ্বীপ যে বর্তমান জাভা, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা সেখানে যেতে হত প্লবনেন প্লবেন চ-অর্থাৎ হয় লাফিয়ে, নয় সাঁতরে, নয় ভেলায় চড়ে। কিষ্কিন্ধ্যা থেকে লঙ্কায় এক লম্ফে যাওয়া সোজা, কারণ এক লম্ফে তা যাওয়া যায়। কিন্তু মাদ্রাজ থেকে বলি যেতে হলে অসম্ভব হাই জাম্প ও লং জাম্প একসঙ্গে দুই চাই। আর বঙ্গ-উপসাগর তো ইংলিশ চ্যানেল নয় যে, সাঁতরে পার হওয়া যায়। সুতরাং ও দেশে ভেলায় চড়েই যেতে হত। যবদ্বীপ রত্নবন্ত ও সোনারূপোর দেশ আর সোনার খনিতে মণ্ডিত। কোনো কোনো ইউরোপীয় পণ্ডিত বলেন, এ দেশ জাভা নয়, সুমাত্রা। কেননা সোনার খনি জাভায় নেই ও কোনো কালে ছিল না–ছিল ও আছে শুধু সুমাত্রায়। অপর আর-এক দল বলেন যে, যবদ্বীপ জাভাই, সুমাত্রা নয়। কিন্তু আসল কথা এই যে, সেকালে হিন্দুদের কাছে জাভা ও সুমাত্রা উভয় দ্বীপই যবদ্বীপ বলে পরিচিত ছিল। সুমাত্রা পরে স্বর্ণদ্বীপ সুবর্ণদ্বীপ প্রভৃতি নাম ধারণ করে। সুমাত্রা নাম পুরোনো নয়। স্বর্ণদ্বীপে সমুদ্র বলে একটি নগর ছিল। সেই সমুদ্রই আরবি জবানে রুপান্তরিত হয়ে সুমাত্রা হয়েছে, এবং এই নতুন নামেই ও-দ্বীপ ইউরোপীয়দের কাছে পরিচিত, আর একালের জিয়োগ্রাফিতে প্রসিদ্ধ।
ইউরোপীয় পণ্ডিতরা বলেন যে, প্রাচীন হিন্দুদের ভূগোলের জ্ঞানের দৌড় ঐ যবদ্বীপ পর্যন্ত ছিল। তার পূর্বে যে আর-কোনো দেশ আছে, তা তাঁরা জানতেন না। তাই তাঁরা যবদ্বীপ অতিক্রম করে যে শিশির-পর্বতের উল্লেখ করেছেন, সে পর্বত তাঁদের ষোলো-আনা মনগড়া। আমি প্রথমত ইউরোপীয় নই, দ্বিতীয়ত পণ্ডিত নই; সুতরাং তাঁদের কথা আমি নতমস্তকে মেনে নিতে বাধ্য নই।
যবদ্বীপ অতিক্রম করে যে দ্বীপটি পাওয়া যায়, তার নাম বলিদ্বীপ; এবং তার অন্তরে যে পর্বত আছে, সে পর্বতকে শিশির বলা ছেরেফ কবিকল্পনা নয়। কেননা যার এক-একটি শৃঙ্গ দশ হাজার ফটের চেয়েও উঁচু, সে পর্বতকে কিছুতেই গ্রীষ্মপর্বত বলা যায় না, যদি কিছু বলতে হয় তো শিশির বলাই সংগত। শুনতে পাই উক্ত দ্বীপপুঞ্জ চিরবসন্তের দেশ। সুতরাং সে দেশের পাহাড়ে শীত হবারই কথা। আর সে পর্বত দেবদানব-সেবিত বলবার অর্থ সেখানে মানুষের বসতি নেই। হনুমানকে সীতার খোঁজে আরো অনেক স্থানে যেতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সে-সব দেশ যে রূপকথার দেশ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যে দেশে মানুষের কান হাতির কানের মতো বড়ো, ও যে দেশে মানুষের কান উটের কানের মতো ছোটো, আর যে দেশে মানুষের পা দুটো নয়, একটা মাত্র, অথচ সেই এক পায়ে তারা খুব ফুর্তি করে চলে, সে-সব দেশেও হনুমানকে ভ্রাম্যমাণ হবার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ-সব দেশের কোনো নাম বলা হয় নি। এর থেকেই স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, যে-সব দেশের নাম হিন্দুরা জানত না, সেই-সব দেশ সম্বন্ধে তাদের কল্পনা খেলত। যে দেশের নাম তারা জানত, সে দেশের রূপও তারা চিনত।