ভারতবর্ষের প্রকৃতি
এতক্ষণে তোমরা ভারতবর্ষ নামক মহাদেশ, আর তার অন্তর্ভুত খণ্ড দেশগুলির আকৃতির মোটামুটি পরিচয় পেলে। এখন, তার প্রকৃতির পরিচয় সংক্ষেপে দেওয়া যাক।
প্রথমত ভারতবর্ষ হচ্ছে গ্রীষ্মপ্রধান দেশ। তবে উত্তরাপথের সঙ্গে দক্ষিণপথের এ বিষয়েও একটু প্রভেদ আছে। তোমরা বোধ হয় লোবে লক্ষ্য করেছ যে পিপের গায়ে লোহার পঞ্জার বাঁধনের মতো কতকগুলি কালো কালো রেখা এই গোলকটির দেহ বেষ্টন করে আছে। এই রেখাগুলির ভিতর দুটি রেখায় একটু বিশেষত্ব আছে। সে দুটি একটানা নয়, কাটা কাটা। এ উভয়ের মধ্যে ইকোয়েটরর উত্তরে যে রেখাঁটি আছে, সেটির নাম ট্রীপক অব ক্যানসার; আর ইকোয়েটরএর দক্ষিণে যেটি আছে, তার নাম ট্রপিক অব ক্যাপ্রিকর্ন।
সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর কি যোগাযোগ আছে, তাই দেখাবার জন্য এ দুটি রেখা আঁকা হয়েছে। এই রেখাঙ্কিত জায়গাতেই সূর্যের কিরণ পৃথিবীর উপর ঠিক খাড়া হয়ে পড়ে, অপর সব স্থানে তেরচা ভাবে। এই ট্রপিক অব ক্যানসারের উত্তরদেশ শীতের দেশ, আর ট্রপিক অব ক্যাপ্রিকর্নের দক্ষিণদেশও শীতের দেশ।
আর এই রেখাদ্বয়ের মধ্যের দেশ সব দারুণ গরম দেশ। ভারতবর্ষের উত্তরাপথ, প্রায় সমস্তটাই ট্রপিক অব ক্যানসারের উত্তরে, ও দক্ষিণাপথ আগাগোড়া তার দক্ষিণে। ফলে দক্ষিণাপথে শীতঋতু বলে কোনো ঋতু নেই। জনৈক ইংরেজ বলেছেন যে, দক্ষিণাপথ হচ্ছে Nine months hot and three months hotter। কথাটা কিপলিঙের মুখ থেকে বেরোলেও মিথ্যে নয়। উত্তরাপথে কিন্তু শীতগ্রীষ্ম দুই বেশি। দক্ষিণাপথে গ্রীষ্মকালে গরম যে উত্তরাপথের মতো অসহ্য হয় না, তার কারণ দক্ষিণাপথ উত্তরাপথের চাইতে প্রথমত উঁচু, দ্বিতীয়ত তার তিন দিক সমুদ্রে ঘেরা।
মাটি
তার পর ভারতবর্ষের এ দুই ভূভাগের মাটিও এক জাতের নয়, এবং তাদের গণাগণও পথক। মানুষের পৃথিবীর সঙ্গে কারবার প্রধানত মাটি নিয়ে। গাছপালা তৃণ শস্য সব মাটিতেই জন্মায়। এবং অনেক পণ্ডিতের মতে সব জীবজন্তুর ন্যায় মানুষের আদিমাতা হচ্ছে ভূমি। এ মতে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা কোন জমিতে কে জন্মেছে তার থেকেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও নিকৃষ্টত্ব নির্ণয় করেন।
এ সত্ত্বেও আমাদের জানা উচিত যে, মাটি হচ্ছে পৃথিবীর চামড়া মাত্র। ও চামড়ার নীচে পাথর আছে, যে পাথর থেকে কিছুই জন্মায় না।–জীবজন্তুও নয়, গাছপালাও নয়। মা-বসুন্ধরা আসলে পাষাণী।
এই মাটিও পাথরের বিকার মাত্র। অর্থাৎ পাথরকে ভেঙে মাটি তৈরি করতে হয়। পাথরকে চূর্ণ করা হচ্ছে জল আর বাতাসের কাজ।
নদনদী পাহাড় থেকে বেরোয়, পাহাড় ভেঙে। আর তারা যে চূর্ণপাষাণ বয়ে নিয়ে আসে, তাই দিয়ে যে মাটি গড়ে, সেই মাটিকে আমরা পলিমাটি বলি। সেই মাটিই প্রধানত গাছপালার জন্মভূমি। আর সমগ্র উত্তরাপথ প্রায় এই মাটিতেই তৈরি।
আমরা ভারতবর্ষকে উপদ্বীপ, পেনিনসুলা বলি; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষের ত্রিকোণ দক্ষিণাংশই একটি উপদ্বীপ। এ অংশ অতি পুরাকালে একটি দ্বীপ মাত্র ছিল। হিমালয় ও বিন্ধ্যপর্বতের মধ্যের দেশ তখন জলমগ্ন ছিল। তার পর সেই জলমগ্ন দেশ যখন হিমালয়ের নদনদীর কৃপায় উত্তরাপথ হয়ে উঠল, তখন তার দক্ষিণ দ্বীপ উত্তরাপথের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতবর্ষ নামক মহাদেশ সৃষ্টি করল। দক্ষিণাপথ উত্তরাপথের চাইতে ঢের প্রাচীন দেশ। তোমরা যখন জিয়োলজি পড়বে, তখন এ দেশের বয়সের গাছপাথরের অথবা গাছপাথরের বয়সের হিসেব পাবে।
দক্ষিণাপথের বেশির ভাগ মাটি নদনদীর দান নয়। আগ্নেয়গিরি হতে যে গলা পাথরের (লাভা) উদগম হয়েছে, তাই চুর্ণ হয়ে হয়েছে দক্ষিণাপথের মাটি। উত্তরাপথ বরুণদেবতার সৃষ্টি, দক্ষিণাপথ অগ্নিদেবতার। এ দুই মাটি এক জাতেরও নয়, এ দুয়ের ধর্মও এক নয়।
এ দুই দেশের জলবায়ুও বিভিন্ন। মেঘ আসে সমুদ্র থেকে, আর পবনদেবই মেঘকে উড়িয়ে নিয়ে আসেন। সুতরাং কোন দেশে কত বৃষ্টি হয় তা নির্ভর করে কোন দেশে কোন দিক থেকে কি বাতাস বয়, তার উপর। তোমাদের পূর্বে বলেছি যে, সিন্ধুদেশ হচ্ছে অনাবৃষ্টির ও আসাম অতিবৃষ্টির দেশ। এর মধ্যবর্তী দেশ অল্পবন্টির দেশ। অপর পক্ষে দক্ষিণাপথের পশ্চিম উপকূল অতিবৃষ্টির দেশ, ও তার পূর্বে অংশই অনাবৃষ্টির দেশ।
যে বায়ুকে আমরা মনসুন নামে আখ্যাত করি, তার চলবার পথ হচ্ছে ভারতবর্ষের দক্ষিণপশ্চিম কোণ থেকে উত্তরপূর্বে কোণে। এ বাতাস মালাবার দেশকে জলে ভাসিয়ে দেয়। আবার বাংলায় ঢোকার পর এর গতি হয় দক্ষিণপূর্ব থেকে উত্তরপশ্চিমে। এই বাতাস বাংলা ও আসামের গায়ে প্রচুর জল ঢেলে দিয়ে তার পর উত্তরাপথের অন্তরে গিয়ে প্রবেশ করে। গ্রীষ্মঋতুর অবসানেই এ দেশে বর্ষাঋতু দেখা দেয়। মনসুন কিন্তু পঞ্চনদ পর্যন্ত ঠেলে উঠতে পারে না। এজন্য বাংলায় যখন বৃষ্টি হয়, পাঞ্জাব তখন শুখনো। পাঞ্জাবে শীতকালই বর্ষাকাল।
ভারতবর্ষের লোক শতকরা নব্বই জন হচ্ছে কৃষিজীবী। এই কারণে ভারতবর্ষ নাগরিক দেশ নয়, গ্রাম্য দেশ। এ দেশে সাত লক্ষ পঞ্চাশ হাজার গ্রাম আছে, আর পঁচাত্তরটি নগর নেই। নগরেও একরকম সভ্যতার সৃষ্টি হয়, যেমন হয়েছিল পুরাকালে গ্রীসের আথেন্স ও ইতালির রোম নগরীতে। আর সেই সভ্যতাই কতক অংশে বর্তমান ইউরোপের মনের উপর প্রভুত্ব করছে। এই শহরে মনোভাব থেকে নিষ্কৃতি না পেলে মানুষের মন ভারতবর্ষ ও চীনদেশের সভ্যতার প্রতি অনুকূল হয় না। এই কারণেই ইউরোপের সাধারণ লোক ও বর্তমান ভারতবর্ষের অসাধারণ লোকে–অর্থাৎ যারা শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাবে বিলেতের সাধারণ লোকের শামিল হয়ে গিয়েছে, তারা ভারতবর্ষের সভ্যতাকে অসভ্যতা মনে করে।