দক্ষিণাপথ উত্তরাপথ থেকে শুধু বিচ্ছিন্ন নয়, বিভিন্ন আকৃতিতেও, প্রকৃতিতেও।
উত্তরাপথকে একটি চতুর্ভুজ হিসেবে ধরা যায়, কিন্তু দক্ষিণাপথ হচ্ছে একটি স্পষ্ট ত্রিভুজ। একটি উলটো পিরামিড, যার base হচ্ছে বিধ্য, আর apex কুমারিকা অন্তরীপ। এর উভয় পাশই পাহাড় দিয়ে বাঁধানো। পশ্চিম দিকের পর্বতের নাম পশ্চিমঘাট, পর্ব দিকের পর্বঘাট। এই দুই পর্বত এসে মিলিত হয়েছে, কুমারিকা অন্তরীপের একটু উত্তরে। এর দক্ষিণে যে জায়গাটুকু আছে, তার পূর্বে আর পাহাড় নেই, কিন্তু পশ্চিমে আছে কারডামম হিলস।
উত্তরাপথ হচ্ছে সমতলভূমি কিন্তু দক্ষিণাপথ মালভূমি। অর্থাৎ ইরান দেশের মতো এ দেশও হচ্ছে পর্বতের উপত্যকা; শুধু ইরানের উপত্যকা হচ্ছে প্রায় তিন হাজার ফুট উঁচু, ও দক্ষিণাপথের হাজার ফিট। সুতরাং এ পিরামিডকে পাথরেগড়া বলা যেতে পারে। এ ভূভাগে সমতলভূমি আছে শুধু পশ্চিমঘাটের পশ্চিমে ও সমুদ্রের উপকূলে, যে দেশকে আমরা মালাবার দেশ বলি; ও পর্বসমুদ্রের উপকূলে, যে দেশকে আমরা করমণ্ডল বলি। দক্ষিণাপথের অন্তরেও কিছু কিছু সমতলভূমি আছে, তার পরিচয় পরে দেব।
এই মালাবার দেশটি অতি সংকীর্ণ, করমণ্ডল অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত। যদি একটি বিমানে চড়ে দূর থেকে দেখা যায় তো দেখা যাবে যে, দক্ষিণাপথের পশ্চিম পাড় বেজায় মাথা উঁচু করে রয়েছে, পশ্চিমঘাট যেন সমুদ্র থেকে ঝাঁপিয়ে উঠেছে আর করমণ্ডল একেবারে সমুদ্রের সঙ্গে বেমালুম মিশে গেছে। এ অংশের তালীবন যেন সমুদ্র থেকেই উদভূত হয়েছে। কালিদাস যে বলেছেন–
দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী তমালতালীবনরাজিনীলা।
আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশেঃ ধারানিবন্ধেব কলঙ্করেখা ৷৷
সে বেলা হচ্ছে করমণ্ডল কোস্ট্।
দক্ষিণাপথের উত্তরে দুটি অপর নদী আছে, নর্মদা ও তাপ্তি। নর্মদা বিন্ধ্যপর্বতের উপত্যকার ভিতর দিয়ে, ও তাপ্তি সাতপরা-পর্বতের দক্ষিণ পাদদেশ ঘেঁষে পশ্চিমবাহিনী হয়ে গালফ অব ক্যাম্বেতে পড়ছে।
এ দুই নদী মানুষের বিশেষ কোনো কাজে লাগে না। এ নদী দুটি মানুষের যাতায়াতের জলপথ নয়। তার পর এদের পলিতে কোনো সমতল দেশ গড়ে ওঠে নি। এরা দুটিতে মিলে সাগরসংগমের মুখে খালি একটুখানি মাটি তৈরি করেছে।
এ দেশের দক্ষিণের নদী-ক’টি সবই পূর্ববাহিনী। প্রথম গোদাবরী, দ্বিতীয় কৃষ্ণা, তৃতীয় কাবেরী। এই তিনটি নদীরই জন্মভূমি হচ্ছে পশ্চিমঘাট, আর এ তিনটিই এসে পড়ছে বঙ্গ-উপসাগরে।
এই তিনটি নদীর উভয় কূলে অল্পস্বল্প সমভূমি আছে, যেখানে ফসল জন্মায়। এই তিনটি নদীর হাতে করমণ্ডল দেশ গড়ে উঠেছে। দক্ষিণাপথের ভিতর থেকে মালাবার ও কোন যাবার কোনো পথ থাকত না, যদি না পশ্চিমঘাটের ভিতর তিনটি ফাঁক থাকত—উত্তরে থালঘাট ও বোরঘাট, দক্ষিণে পালঘাট। এইখানেই কোইম্বাটোর নামক শহর। এই কোইম্বাটোরের দুয়োরই দক্ষিণাপথের অন্তরের সঙ্গে তার পশ্চিম উপকূলের যোগরক্ষা করেছে। দক্ষিণাপথ ও বাংলার ভিতর আর দুটি দেশ আছে—উত্তরে সেন্ট্রাল প্রভিনসেস ও দক্ষিণে উড়িষ্যা।
সেন্ট্রাল প্রভিনসেস পাহাড় ও জঙ্গলে ভরা। উড়িষ্যার অনেকটাই সমভূমি। মহানদী এই সমভূমি গড়েছে। এ দুটি দেশ সম্ভবত কখনোই দক্ষিণাভুক্ত হয় নি বলে একে উত্তরাপথের ভিতর টেনে আনা যায়। আজকাল আমরা যাকে বথে প্রেসিডেন্সি ও ম্যাড্রাস প্রেসিডেন্সি বলি, সে দুই এই দক্ষিণাপথেরই অন্তর্ভূত। শাধ, সিদেশটি ববের গভর্নরের অধীন হলেও দক্ষিণাপথের অন্তর্ভূত নয়।
ভারতবর্ষের উত্তরে হিমালয়ের উপরে চারিটি দেশ আছে, যেগলি ভারতবর্ষের অন্তর্ভূত। পশ্চিমে কাশ্মীর, তার পূর্বে নেপাল, তার পূর্বে সিকিম ও পূর্বপ্রান্তে ভুটান।
কাশ্মীরের লোকের ভাষা সংস্কৃতের অপভ্রংশ, নেপালের গুর্খাদেরও তাই; অপর পক্ষে সিকিম-ভুটানের ভাষা চীনবংশীয়। এই নেপালেই পশ্চিম ও দক্ষিণ থেকে আগত আর্যজাতি এবং পূর্ব ও উত্তর থেকে আগত চীনজাতি মিলেমিশে একজাতি হয়ে গিয়েছে। এ দেশে শুধু দুই জাতির নয়, দুই সভ্যতারও মিলন ঘটেছে। তাই নেপালে বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্ম পাশাপাশি বাস করছে। কাশ্মীরে অবশ্য হিন্দুধর্ম ও মুসলমানধর্ম পাশাপাশি বাস করছে, কিন্তু এই দুই ধর্ম পরস্পরের অশ্য। ফলে উভয় ধর্মই নিজের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। অপর পক্ষে নেপালের বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুধর্মের বিকার অথবা নেপালের হিন্দুধর্মকে বৌদ্ধধর্মের বিকার বললেও অত্যুক্তি হয় না। সিকিম-ভুটানের সংস্রব আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে। শুনতে পাই, বাংলার লোকের দেহে চীনের রক্ত আছে। সেইসঙ্গে বাঙালির মনেও কিঞ্চিৎ চৈনিক ধর্ম আছে কি না বলতে পারি নে।
দেশের পণ্ডিতলোক-সব আজকাল বেদের পুনরুদ্ধারের জন্য ভারতবর্ষের উত্তরপশ্চিম দেশে মহা খোঁড়াখুঁড়ি আরম্ভ করেছেন। বেদ উদ্ধারের পর আমাদের পণ্ডিতরা যদি তন্ত্রের সন্ধানে বেরোন, তা হলে, আমার বিশ্বাস, তাঁদের উত্তরপশ্চিম দেশকে গজভুক্ত কপিখবৎ ত্যাগ করে ভারতবর্ষের উত্তরপূর্বে আসতে হবে। তখন রিসার্চ ওঅক-এর পীঠস্থান হবে প্রথমে ভূটান, পরে সিকিম। তন্ত্রশাস্ত্রের পথি খললেই পাতায় পাতায় মহাচীনের সাক্ষালাভ ঘটে। সে যাই হোক, ভারতবর্ষের পশ্চিমে ইরান ও উত্তরে তুরানের মতো তার পূর্বে মহাচীনকেও পুরাতত্ত্ববিৎ ভাষাতত্ত্ববিং ও নতত্ত্ববিত্রা উপেক্ষা করতে পারেন না। সম্প্রতি অবগত হয়েছি যে, পণ্ডিতরা আজকাল Tarim দেশ নিয়েই উঠে-পড়ে লেগেছেন। Tarim অবশ্য চীন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুত তুর্কস্থানে। সুতরাং আশা করা যায় যে, তাঁরা খোটান থেকে ভুটানে অচিরে নেবে পড়বেন।