উত্তরাপথ
প্রথম জিনিস যা চোখে পড়ে সে হচ্ছে এই যে, এই বিস্তৃত ভূভাগের ভিতর কোনোরূপ পাহাড়পবত নেই, সমস্ত উত্তরাপথ সমতলভূমি। এর ভিতর এক জায়গায় শুধু একটু অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি আছে। পাঞ্জাব ও হিন্দুস্থানের মিলনস্থল হচ্ছে সেই উচ্চভাগ। উত্তরাপথের এই জায়গাটার গড়ন কাছিমের পিঠের মতো। ফলে এ স্থানের পশ্চিমের যত নদী সব পশ্চিমবাহিনী ও পূর্বের যত নদী সব পূর্ববাহিনী।
এই পশ্চিম ভাগের নদী পাঁচটির নাম ঝিলম চেনাব রাবি বিয়াস ও সৎলেজ। এ পাঁচটিরও জন্মভূমি হচ্ছে হিমালয়, আর এ পাঁচটিই পথিমধ্যে এ-ওর সঙ্গে মিলিত হয়ে শেষটা ভারতবর্ষের সবচাইতে পশ্চিমের নদী সিন্ধুনদের সঙ্গে মিশে সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। তোমরা বোধ হয় জান যে, পাহাড় থেকে নদী যে মাটি কেটে নিয়ে আসে, সেই মাটি দিয়েই সমতলভূমি তৈরি হয়। এই পঞ্চনদের কৃপায় পঞ্চনদ-দেশ ওরফে পাঞ্জাব তৈরি হয়েছে। আর এই দেশটাকে ইণ্ডাস ভ্যালি বলা হয়। কারণ সিন্ধুই হচ্ছে এই পঞ্চনদের ভিতর মহানদ।
উত্তরাপথের পূর্ব ভাগের প্রধান নদীগুলির নাম যমুনা গঙ্গা গোমতী গোগরা গণ্ডক ও কুশি। এ-সকল নদীরই উৎপত্তি হিমালয়ে, আর এদের মধ্যে সর্বপ্রধান হচ্ছে গঙ্গা। অপর পাঁচটি একে একে গঙ্গায় মিশে গিয়েছে। সিন্ধুনদের সঙ্গে গঙ্গার একটি বিশেষ প্রভেদ আছে। সিন্ধুনদ তার আগাগোড়া জল হিমালয়ের কাছ থেকে পায়। গঙ্গা কিন্তু কিছু জল বিন্ধ্যপর্বতের কাছ থেকেও পায়। চম্বাল ও শোণ এই দুই নদীরই জন্মভূমি হচ্ছে বিন্ধ্যপর্বত। আর এই দুই নদীই উত্তরবাহিনী হয়ে এসে গঙ্গায় পড়েছে। সংস্কৃত ভাষায় জলের আর-এক নাম জীবন। গঙ্গাই হচ্ছে উত্তরাপথের জীবন। ও দেশের বুকের ভিতর দিয়ে গগা যদি রক্তের মতো বয়ে না যেত, তা হলে উত্তরাপথের প্রাণবিয়োগ হত। এই গাঙ্গেয় দেশই হচ্ছে প্রকৃত হিন্দুস্থান।
আরাবলি পর্বতের পশ্চিমে ও দক্ষিণে হচ্ছে মরভূমি। সিন্ধুনদ দক্ষিণাংশে এই মরভূমির ভিতর দিয়ে বয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। এই সিন্ধুনদীর দু পাশের দেশের নাম সিন্ধুদেশ।
বিন্ধ্যপর্বতের একরকম গা ঘেঁষে পূর্বে অনেক দূর এসে গগা রাজমহলের কাছে পর্বতের বাধা হতে অব্যাহতি লাভ করে দক্ষিণবাহিনী হয়ে সমুদ্রের অভিমুখে যাত্রা করেছেন। তার পর দক্ষিণে অনেক দূর এসে গোয়ালন্দের নিকট ব্ৰহ্মপুত্রের সহিত মিলিত হয়েছেন। এই ব্রহ্মপুত্রেরও জন্মস্থান হিমালয়। ব্রহ্মপুত্র লখনউয়ের উত্তরে হিমালয় থেকে বেরিয়ে পূর্বমুখে বহুদূর পর্যন্ত হিমালয়ের ভিতর দিয়েই প্রবাহিত হয়ে ভুটানের পূর্বে এসে দক্ষিণবাহিনী হয়ে গঙ্গার সঙ্গে মিশে গেছেন। তার পর এই মিলিত গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র আরো দক্ষিণে এসে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে সমুদ্রে এসে পড়লেন। মেঘনার জন্মভূমি হচ্ছে গারো-লসাই পর্বত। এই তিন নদীতে মিলে বাংলাদেশ গড়েছে।
উত্তরাপথের পশ্চিমদেশ সিন্ধুদেশ যেমন শুখনো, তার পূর্বদেশ বাংলা তেমনি ভিজে। সিন্ধুদেশের সক্কর নামক স্থানের মতো গরম জায়গা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই। তার পাশে রোড়ী নামক স্থানে গত বারো বৎসরে মোটে ছ পশলা বৃষ্টি হয়েছে। অপর পক্ষে বাংলার মতো ভিজে দেশও ভারতবর্ষে আর দ্বিতীয় নেই।
দক্ষিণাপথ
এখন দক্ষিণাপথে যাওয়া যাক।
এ ভূভাগ সম্বন্ধে প্রথম বক্তব্য হচ্ছে এই যে, এটি উত্তরাপথ থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন।
অগস্ত্যমুনি বিন্ধ্যপর্বতের মাথা নিচু করে দিয়েছিলেন, কিন্তু সে মাথাকে ভূলণ্ঠিত করতে পারেন নি। ফলে এই দুই ভাগের ভিতর যাতায়াতের সুগম পথ নেই। উত্তরাপথ থেকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে এমন কোনো নদী নেই, সুতরাং এ দুই দেশের ভিতর জলপথ নেই। গঙ্গানদী বিন্ধ্যপর্বতকে প্রদক্ষিণ করে ও সিন্ধুনদ সে পর্বতকে বাঁয়ে ফেলে রেখে তার পর সমুদ্রে এসে পড়েছে।
তার পর এ দুয়ের ভিতর কোনো স্থলপথও নেই। এক রেলের গাড়ি ছাড়া আর কোনোরকম গাড়ি-গোরুর ঘোড়ার কি উটের-বিন্ধ্যপর্বতের এক পাশ থেকে অপর পাশে যেতে পারে না।
মানুষে পায়ে হেঁটে যখন হিমালয় পার হয়ে যায়, তখন বিন্ধ্যপর্বত অবশ্য তার চলাচলের পথ বন্ধ করতে পারে নি। মানুষের অগম্য স্থান ভূ-ভারতে নেই, কিন্তু দুর্গম স্থান আছে। এই বিন্ধ্য অতিক্রম করবার পথ সেকালে অত্যন্ত দুর্গম ছিল। রামচন্দ্র পায়ে হেঁটে বিন্ধ্যপর্বত পার হয়ে দক্ষিণাপথে গিয়েছিলেন, কিন্তু ফিরতি বেলায় তিনি বিমানে চড়ে লঙ্কা থেকে অযোধ্যায় প্রত্যাগমন করাই বেশি আরামজনক অতএব সুযুক্তির কাজ মনে করেছিলেন।
সেকালে বিন্ধ্যপর্বত প্রদক্ষিণ করে আসবারও বিশেষ অসুবিধা ছিল। আরাবলি পর্বতের পশ্চিম দিয়ে আসতে হলে মরুভূমি অতিক্রম করে আসতে হত। অপর পক্ষে রাজমহলের পূর্ব দিয়ে বাংলায় এসে সমুদ্রের ধার দিয়ে মাদ্রাজ পৌঁছতে অনেক দিন নয়, অনেক বছর লাগত। এক, রাজা ও সন্ন্যাসী ছাড়া ওরকম দেশভ্রমণ বোধ হয় সেকালে অপর কেউ করত না। সমগ্র ভারতবর্ষকে এ ভাবে প্রদক্ষিণ করতেন রাজা দিগ্ বিজয়ে বহির্গত হয়ে, আর সন্ন্যাসী তীর্থভ্রমণে।
এই বিন্ধ্যপর্বতের ভিতর একটি ফাঁক আছে–খাণ্ডেয়া নামক স্থানে। এলাহাবাদ থেকে বম্বে যাবার রেলপথ এই খাণ্ডোয়ার ফাঁক দিয়েই যায়। এবং সেকালে এই দুয়োর দিয়েই বোধ হয় উত্তরাপথের লোক দক্ষিণাপথে প্রবেশ করত। ভারতবর্ষের মধ্যে দক্ষিণাপথ হচ্ছে একটি বড়ো কৌটোর মধ্যে আর-একটি ছোটো কৌটো।