সাহারা মরুভূমি আরবদেশের ভিতর দিয়ে এসে প্রথমে পারস্যের দক্ষিণ ভাগকে, তার পর আরো এগিয়ে ভারতবর্ষের সিন্ধুদেশকে আক্রমণ করে। ফলে, আরব থেকে সিন্ধুদেশ পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগকে মরুভূমিতে পরিণত করেছে। এ আক্রমণে বাধা দিয়েছে রাজপুতানা। রাজপুতানার চিরগৌরব এই যে, এই রাজপুতানাই হিন্দুস্থানকে এই ক্রমবর্ধমান আফ্রিকার মরুভূমির কবল থেকে রক্ষা করেছে।
এই আরবদেশ যে ভুলক্রমে এশিয়ার ম্যাপে ঢুকে গেছে, তার কারণ কেবলমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী মানচিত্রকাররা লোহিত-সমুদ্রকে আফ্রিকা ও এশিয়ার মধ্যে পরিখা বলে ধরে নিয়েছিলেন। একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যায়, এ সমুদ্রও আসলে মরুভূমি। এর উপরে যেটুকু জল আছে, তা ভারত-মহাসাগরের দান।
ভারতবর্ষকে যদি এশিয়াখণ্ডের একটি উপমহাদেশ না বলে একটি স্বতন্ত্র মহাদেশ বলা যায়, তা হলেও কথাটা অসংগত হয় না।
ভারতবর্ষ মাপে ১৫,০০,০০০ বর্গমাইল। এক চীন ব্যতীত এত বড়ো দেশ এশিয়ায় আর কোথাও নেই। এশিয়ার রুশিয়া ম্যাপে দেখতে প্রকাণ্ড দেশ; কিন্তু এর দক্ষিণাংশে এত বড়ো বড়ো হ্রদ মরুভূমি তৃণকান্তার ও পর্বত আছে যে, সে অংশটিকে একটি দেশ বলা যায় না। কারণ সে ভূভাগ মানুষের বাসের অযোগ্য। আর এর উত্তরাংশের জমি সমতল হলেও আজও জমাট মাটি হয়ে ওঠে নি। এ দেশে গাছপালা অতি বিরল, যে দুটি-চারটি আছে তারা সব বামন। এরকম দেশ যে কৃষিকার্যের জন্য অনুপযোগী, সে কথা বলাই বাহুল্য। ফলে সাইবিরিয়া একরকম জনশূন্য বললেই হয়।
ভারতবর্ষ যে আকারে বিপুল, শুধু তাই নয়। এ দেশ এশিয়ার অপরাপর দেশ থেকে একরকম সম্পূর্ণ বিভিন্ন বললেও অত্যুক্তি হয় না।
এর উত্তরে হিমালয়ের গগনস্পর্শী প্রাচীর; আর তিন দিকে ভারত-মহাসাগরের অতলস্পর্শী পরিখা। তোমরা ভেব না যে আমি ভুল করছি। আরব-সাগর বঙ্গউপসাগর প্রতি নাম আমিও জানি; কিন্তু ও-সব সাগর-উপসাগর ভারত-মহাসাগরেরই অংশ মাত্র। ভারতবর্ষ তার উত্তরপশ্চিম ও উত্তরপূর্বে কোণে শুধু অপর দেশের সঙ্গে সংলগ্ন। তার উত্তরপশ্চিমে আফগানিস্থান, এবং উত্তরপূর্বে ব্রহ্মদেশ। কিন্তু এ দুই দিকেই আবার অতি দুর্গম পর্বতের ব্যবধান আছে। যে পর্বতশ্রেণী আফগানিস্থান ও বেলুচিস্তানকে হিন্দুখান থেকে পথক করে রেখেছে, সে পর্বতশ্রেণীর অবশ্য দুটি দয়োর আছে—খাইবার পাস ও বোলান পাস-যার ভিতর দিয়ে এ দুই দেশে মানুষে যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু ব্রহ্মদেশে যাবার পথ আজও বঙ্গোপসাগরের জলপথ।
দেখতে পাচ্ছ স্বয়ং প্রকৃতিই ভারতবর্ষকে একটি স্বতন্ত্র মহাদেশ করে গড়েছেন।
এখন দেখা যাক, এই সমগ্র দেশটার আকার কিরকম। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সমগ্র পৃথিবীকে ত্রিকোণ বলতেন। সম্ভবত পৃথিবী বলতে তাঁরা ভারতবর্ষ বুঝতেন। কেননা ভারতবর্ষ সত্যসত্যই ত্রিকোণ।
মানুষে যতক্ষণ জ্যামিতির কোনো মূর্তির সঙ্গে কোনো দেশকে মেলাতে না পারে, ততক্ষণ তার মনস্তুষ্টি হয় না; যদিও জ্যামিতির কোনো আকারের সঙ্গে কোনো দেশই হবহ, মিলে যায় না। পৃথিবীকে আমরা বলি গোলাকার। কথাটা মোটামুটি সত্য। কিন্তু জ্যামিতির বৃত্তের উত্তরদক্ষিণ চাপা নয়। ইউক্লিডের তৃতীয় অধ্যায়ে কমলালেবুর কোনো স্থান নেই। এই কথাটা মনে রাখলে, মহাভারতে ভারতবর্ষকে যে একটি সমভুজ ত্রিকোণ দেশ বলা হয়েছে, সে উক্তিকে গ্রাহ্য করে নিতে আমাদের কোনো আপত্তি হওয়া উচিত নয়।
পৃথিবীতে এমন কোনোই দেশ নেই, যা সম্পূর্ণ একাকার। ভারতবর্ষও একাকার নয়। অর্থাৎ ভারতবর্ষকেও নানা খণ্ডে বিভক্ত করা যায়। এখানে একটি কথা বলে রাখি। রাজ্যের ভাগের সঙ্গে ভৌগোলিক ভাগের বিশেষ কোনো সম্বন্ধ নেই। অর্ধেক পৃথিবী আজ ব্রিটিশরাজের অধীন; কিন্তু তাই বলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্যানেডা অস্ট্রেলিয়া ও ভারতবর্ষকে পাগল ছাড়া আর-কেউ এক দেশ বলবে না। আমি যে ভাগের কথা বলছি, সে ভৌগোলিক ভাগ।
আমাদের শাস্ত্রে ভারতবর্ষকে নানা ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। পুরাণকারদের মতে ভারতবর্ষ নবখণ্ড। বরাহমিহির প্রতি গণিতশাস্ত্রীরা পৌরাণিকদের সঙ্গে একমত, যদিচ এ দুয়ের বর্ণিত নবখণ্ডের মিল নেই। মহাভারতের মতে এ দেশ চার খণ্ডে বিভক্ত। চারিটি equilateral triangleএর সমষ্টি হচ্ছে ভারতবর্ষ নামক বড়ো cquilateral triangle। জ্যামিতির হিসেব থেকে যদিও এ বর্ণনা সত্যের কাছ ঘেঁষে যায়, কিন্তু ভৌগোলিক হিসেব থেকে অনেক দূরে থাকে। সে যাই হোক, সংস্কৃত সাহিত্যে আর-একরকম ভাগের উল্লেখ আছে। ভারতবর্ষ মোটামুটি দু ভাগে বিভক্ত। একটি ভাগের নাম উত্তরাপথ, অপরটির দক্ষিণাপথ। এই লৌকিক ভাগটিই প্রকৃতপক্ষে বৈজ্ঞানিক। উত্তরাপথ ভৌগোলিক হিসেবে দক্ষিণাপথ থেকে বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্ন।
হিমালয় যেমন সমস্ত এশিয়ার মেরুদণ্ড, বিন্ধ্যপর্বত তেমনি ভারতবর্ষের মেরুদণ্ড। এ খলে আমি সাতপরা ও আরাবলি পর্বতকে বিধ্য নামে অভিহিত করছি। উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বতের মধ্যের দেশকে উত্তরাপথ বলা যায়, আর দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত থেকে ভারত-মহাসাগরের মধ্যবর্তী দেশকে দক্ষিণাপথ বলা যায়। কিন্তু তোমরা ম্যাপের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই দেখতে পাবে, আরাবলি পর্বতের পশ্চিমে ও রাজমহলের পূর্বেও অনেকখানি জমি পড়ে রয়েছে। এই পশ্চিম অংশের নাম পাঞ্জাব ও সিন্ধুদেশ, আর পর্ব অংশের নাম বঙ্গদেশ ও আসাম। এ দুটিকেও উত্তরাপথের অন্তর্ভূত করে নিতে হবে।