ভৌগোলিক হিসেবে এশিয়া চারটি উপমহাদেশে (সাব-কন্টিনেন্ট) বিভক্ত। কি হিসেবে এশিয়াকে চার ভাগে বিভক্ত করা হয়, তা এখন শোনো।
মনুভাষ্যকার মেধাতিথি বলেছেন যে–
জগৎ সরিৎ সমুদ্ৰা শৈলাদ্যাত্মকম্
অর্থাৎ এ জগৎ নদী সমুদ্র ও পাহাড় দিয়ে গড়া। জগৎ সম্বন্ধে এ কথাটা যে কতদূর সত্য, তা বলতে পারি নে—তবে একেবারে যে বাজে নয়, তার প্রমাণ চন্দ্র উপগ্রহে পাহাড় আছে, মার্স গ্রহে নদী আছে এবং সম্ভবত অপর কোনো গ্রহে সমুদ্রও থাকতে পারে। সে যাই হোক, পৃথিবী সম্বন্ধে মেধাতিথির উক্তি যে সম্প সত্য সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আর, এই তিন বস্তুই পৃথিবীকে নানাদেশে বিভক্ত করে রেখেছে।
সমুদ্রের ব্যবধানেই যে মহাদেশ হয়, তার কারণ সমুদ্র আগে ছিল অলঘ্য আর এখন হয়েছে দুর্লঙ্ঘ্য। শৈলমালা সমুদ্রের চাইতে কিছু, কম অঘ্য বা দল নয়। সুতরাং পর্বতের ব্যবধানও এক ভূভাগকে অপর ভূভাগ থেকে পৃথক করে রাখে।
কালিদাস বলেছেন যে–
অস্ত্যুত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা হিমালয়ো নাম নগাধিরাজঃ।
পূর্বাপরৌ তোয়নিধী বগাহ্য স্থিতঃ পৃথিব্যা ইব মানদণ্ড।
ভারতবর্ষের উত্তরে স্থিত যে পর্বতশ্রেণীর স্বদেশী অংশকে আমরা হিমালয় বলি, তা অবশ্য এশিয়ার পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রে অবগাহন করছে না। কিন্তু হিমালয় বলতে আমরা যদি সেই শৈলমালা বুঝি, যে পর্বতশ্রেণী সমগ্র এশিয়ার মেরুদণ্ড, আর যাকে এ যুগের ভৌগোলিকরা সেন্ট্রাল মাউনটেনস আখ্যা দিয়েছেনহলে আমরা কালিদাসের উক্তি সত্য বলে স্বীকার করতে বাধ্য। এ নগাধিরাজ সত্য সত্যই এশিয়ার পূর্ব ও পশ্চিম তোয়নিধিতে অবগাহন করে অবস্থিতি কমছে। পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর ও পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত এ পর্বতশ্রেণী বিস্তৃত। আর পৃথিবী বলতে যদি আমরা শুধু প্রাচীন পৃথিবী বুঝি, তা হলে তো কালিদাসের উক্তি অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়। কারণ এশিয়ার এই সেন্ট্রাল মাউন, টেনস হচ্ছে প্রাচীন পৃথিবীর মিড-ওঅলড মাউনটেনএরই অংশ। তার পর এ সমগ্র পর্বতশ্রেণীকে হিমালয় বলা যেতে পারে; কেননা এ পর্বতের অধিকাংশই চিরহিমের আলয়।
এই হিমালয়, ভাষান্তরে সেন্ট্রাল মাউনটেনসএর মতো বিরাট প্রাচীর পৃথিবীর আর কোনো মহাদেশকে দু ভাগে বিভক্ত করে নি। এ প্রাচীরের উত্তরদেশকে এশিয়ার উত্তরাপথ এবং দক্ষিণদেশকে দক্ষিণাপথ বলা যেতে পারে। এই প্রাচীর যে কত উঁচু তা তো তোমরা সবাই জান। এই ভারতবর্ষের উত্তরেই এর পাঁচটি শৃঙ্গ আছে, যার প্রতিটির উচ্চতা হচ্ছে পঁচিশ হাজার ফুটের চাইতেও বেশি। কাশ্মীরে নাংঘা পর্বত উঁচুতে ২৬,৬২১ ফুট, তিব্বতে নন্দাদেবী ২৫,৬৪৫, নেপালে ধবলগিরি ২৬,৭৯৯ ফুট, এভারেস্ট ২৯,০০২, কিনচিনজঙ্গা ২৮,১৪৬। এখন এ পর্বত প্রস্থে কত বড়ো তা শোনো।–
ভারতবর্ষের পশ্চিমে যে দেশ আছে, সে দেশকে আমরা ইরান বলি; আর উত্তরপশ্চিমে যে দেশ আছে, তাকে তুরান বলি। ইরান ও তুরানে এই পর্বত কোথাও চারশো মাইল, কোথাও আটশো মাইল চওড়া। এ মহাপর্বতের অনেক শাখাপ্রশাখা আছে। তাদের মিলনভূমি হচ্ছে পামির অধিত্যকা। এ অধিত্যকাও প্রায় চৌদ্দ হাজার ফুট উঁচু। এই পামিরের উত্তরে এ পর্বতের প্রস্থ হচ্ছে বারোশশা মাইল, এবং এর সঙ্গে এ পর্বতের নিদাংশ অর্থাৎ উপত্যকাগুলি যদি যোগ দেওয়া যায়, তা হলে এ ব্যবধানের প্রস্থ হয় দু হাজার মাইল—অর্থাৎ হিমালয় হতে কন্যাকুমারিকা যতদূর ততদূর। এর থেকে দেখতে পাচ্ছ যে, এশিয়ার উত্তরাপথ ও দক্ষিণাপথকে এক দেশ বলা কতদূর সংগত।।
এই কারণে এশিয়ার উত্তরাখণ্ডকে একটি উপমহাদেশ বলা হয় আর তার দক্ষিণাপথের পশ্চিম ভাগকে দ্বিতীয়, পূর্ব ভাগকে তৃতীয়, তার মধ্য ভাগকে চতুর্থ উপমহাদেশ বলা যায়।
এই মধ্যদেশই ভারতবর্ষ। ভূমধ্য পর্বত থেকে এই চারটি উপমহাদেশ ঢাল হয়ে সমুদ্রের দিকে নেমে এসেছে। ফলে উত্তর ভাগের সকল নদী উত্তরবাহিনী, ও তারা সব গিয়ে পড়ে আর্কটিক সমুদ্রে; পশ্চিম ভাগের জল গড়িয়ে পড়ে ভূমধ্যসাগরে, পর্ব ভাগের জল প্রশান্ত-মহাসাগরে ও মধ্যদেশের জল ভারত-মহাসাগরে। মধ্য এশিয়া পর্বতময়। আর এ পর্বত অর্ধেক এশিয়া জুড়ে বসে আছে। আর তার চার পাশের চার ভাগের প্রকৃতি ও চরিত্র সম্পূর্ণ বিভিন্ন। উত্তরদেশ অর্থাৎ সাইবিরিয়া সমতল ভূমি কিন্তু জলবায়ুর গুণে মানুষের বাসের পক্ষে অনুকল নয়। পশ্চিম একে পাহাড়ে, উপরন্তু নির্জলা দেশ। সে দেশের জমিতে ফসল একরকম হয় না বললেই চলে। ইরান-তুরানের অধিকাংশ লোক গৃহস্থ নয়, তারা অন্নের সন্ধানে তাঁবু ঘাড়ে করে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। বাকি দুটি ভূভাগ, ভারতবর্ষ ও চীনদেশ, মানুষের বাসের পক্ষে সম্পূর্ণ উপযোগী। এ দুটি দেশ মুখ্যত সমতল ভূমি, আর সে ভূমি কর্ষণ করে অন্নবস্ত্র দুই লাভ করা যায়; অতএব এ দুই দেশের লোকই গহস্থ হয়েছে। আর শাস্ত্রে বলে, মানুষের সকল আশ্রম গার্হস্থ্যআশ্রমেরই বিকল্প মাত্র।
এশিয়াকে ত্যাগ করবার পূর্বে সে মহাদেশ সম্বন্ধে আর-একটি কথা বলছি, যা শুনে তোমরা একটু চমকে যাবে। এ মহাদেশের ম্যাপে একটি দেশ ভুলক্রমে ঢুকে পড়েছে, যেটি ভৌগোলিক হিসেবে এশিয়ার নয়, আফ্রিকার অঙ্গ। সে দেশের নাম আরবদেশ। এই আরবদেশ প্রকৃতপক্ষে আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিরই একটি অংশ। তোমরা বোধ হয় জান যে, মরুভূমির একটি ধর্ম হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশকে আক্রমণ করা। হাওয়ায় তার তপ্ত বালি উড়ে এসে পার্শ্ববর্তী দেশকে চাপা দেয়। তার স্পর্শে গাছপালা-তৃণপুষ্প সবই মারা যায়। মরুভূমির শুধু বালুকা নয়, তার বায়ুও সমান মারাত্মক। যে দেশের উপর দিয়ে সে বাতাস বয়ে যায়, সে দেশের রস-কষ একেবারে শুকিয়ে যায়। সাহারার এই নিজস্ব বাতাসের নাম ট্রেড উইন্ড্স। এবার গ্লোবের দিকে তাকিয়ে দেখলেই দেখতে পাবে যে, এই ট্রেড উইন্ড্স চলার পথটি হচ্ছে আগাগোড়া পোড়ামাটি।