আষাঢ় ১৩২১
ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফি
ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফি
[একটি পারিবারিক সমিতিতে পঠিত]
হে সমিতির কুমার ও কুমারী-গণ, তোমাদের সমিতির কর্ণধার ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির সঙ্গে তোমাদের দু কথায় পরিচয় করিয়ে দেবার ভার আমার উপর ন্যস্ত করেছেন। জিয়োগ্রাফি বিজ্ঞানের অন্তর্ভুত, সাহিত্যের নয়; আর এ কথা সবাই জানে যে, আমি সাহিত্যিক হলেও হতে পারি, কিন্তু বৈজ্ঞানিক নই। তবে যে আমি এ অনুরোধ রক্ষা করবার জন্য উদ্যত হয়েছি, তার কারণ অনধিকারচর্চা করবার কু অভ্যাস ও দুঃসাহস দুই আমার আছে।
কিন্তু প্রথমেই এক মুশকিলে পড়েছি। সকল বিজ্ঞানের মতো জিয়োগ্রাফিরও একটা বিশেষ পরিভাষা আছে। সে পরিভাষা মূলত ইংরেজি। এ বিষয়ে বাংলা ভাষায় যে পরিভাষা আছে, তা হয় সংস্কৃত নয় ইংরেজির অনুবাদ। সে-সব সংস্কৃত কথার অর্থ বুঝতে হলে তাদের আবার মনে মনে ইংরেজি ভাষায় উলটে অনুবাদ করে নিতে হয়। একটি উদাহরণ দিই। অন্তরীপ ও cape, এ দুটি কথাই বাঙালির কাছে সমান অপরিচিত। এ দুয়ের মধ্যে সম্ভবত কেপ শব্দটিই তোমরা স্কুলঘরে বেশি বার শুনেছ, অতএব তোমাদের কাছে বেশি পরিচিত। অপর পক্ষে উত্তমাশা অন্তরীপ বললে আমরা ভাবতে বসে যাই, জিনিসটা কি। আর ততক্ষণ চিন্তার দায় থেকে অব্যাহতি পাই নে, যতক্ষণ না কেউ বলে দেয় যে, ও হচ্ছে কেপ অব গুড হোপ-এর বাংলা নাম। আর শঙ্গ-অন্তরীপ (কেপ হর্ন) শুনলে তো আমরা অগাধ জলে পড়ি। আর সে জলে পড়লে আর উদ্ধার নেই, কারণ সে জল বরফ জল।
আমাদের পরিভাষার দশা যখন এরূপ মারাত্মক, তখন আমি যতদূর সম্ভব পরিভাষা পরিত্যাগ করে আমার কথা ভাষায় বলতে চেষ্টা করব। যেখানে অগত্যা পরিভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য হব, সেখানে ইংরেজি শব্দই ব্যবহার করব। এ প্রস্তাব শুনে আমার হাতে বাংলা ভাষার জাত মারা যাবে ভেবে তোমরা ভীত হোয়ো না। ইংরেজি বিজ্ঞানের পরিভাষাও ইংরেজি নয়, গ্রীক। আর গ্রীক সভ্যতার বয়েস আড়াই হাজার বৎসর। সুতরাং তার পাশে অমাদের ভাষার আভিজাত্য একেবারে নষ্ট হবে না। ভারতবর্ষের সভ্যতার সঙ্গে গ্রীক, সভ্যতার আর-কোনো বিষয়ে মিল থাকুক, বয়েসে মিল আছে।
ভূমণ্ডল
প্রথমেই আমি তোমাদের কাছে পৃথিবী নামক গোলকটির কিঞ্চিৎ পরিচয় দেব। এ গোলকটি ক্ষিতি আর অপ-মাটি আর জল—এই দুই ভূতে গড়া! আর এ গোলকের বহিঃপষ্ঠের চার ভাগের তিন ভাগ হচ্ছে জল, আর এক ভাগ স্থল।
আমরা অবশ্য পৃথিবী বলতে প্রধানত মাটিই বুঝি। তার প্রমাণ আমরা একে ভূমণ্ডল বলি। এর কারণ আমরা ভূচর জীব, অর্থাৎ মাটির উপর বাস করি। জলচর জীবদের যদি শুধু জল-পিপাসা নয়, সেইসঙ্গে জ্ঞান-পিপাসা থাকত ও সেইসঙ্গে তাদের জ্ঞান তরল ভাষায় ব্যক্ত করবার ক্ষমতা থাকত, তা হলে তারা জিয়োগ্রাফি না রচনা করে রচনা করত হাইড্রোগ্রাফি। আর তারা কবিতা লিখত ‘আমার জন্মজলের’ উপর। আর আমরা যাকে বলি মধুর রস, তার নাম তারা দিত লবণ রস। এর থেকেই দেখতে পাচ্ছ যে, আমাদের কল্পনা আশা আকাঙক্ষা কতটা মাটিগত, অর্থাৎ আমরা মনে-প্রাণে কতটা জিয়োগ্রাফির অধীন।
পৃথিবীর ভাগ
এখন শোনো, মাটি কিন্তু একলন্ত ভাবে নেই, খণ্ড খণ্ড ভাবে আছে। প্রাচীন শাস্ত্রকাররা বলেন যে, মেদিনী সপ্তদ্বীপ আকারে ব্যক্ত হয়েছে।
এই দ্বীপ শব্দটার অর্থ তোমরা সবাই জান। যার চারি দিকে জল আর মাঝখানে থল, তাকেই আমরা বলি দ্বীপ। এ হিসাবে আজকের দিনে পৃথিবীতে সাতটি নয়, অসংখ্য দ্বীপ আছে। সমুদ্রের মধ্যে থেকে অসংখ্য ছোটোবড়ো দ্বীপ মাথা তুলে রয়েছে।
সুতরাং এ স্থলে সপ্তদ্বীপ অর্থে সাতটি মহাদ্বীপ বুঝতে হবে। এই মহাদ্বীপকে আমরা একালে মহাদেশ বলি। আজকের দিনে আমরা পৃথিবীকে চারটি মহাদেশে ভাগ করি, যথা : ইউরোপ এশিয়া আফ্রিকা ও আমেরিকা; অস্ট্রেলিয়াকে আমরা আজও মহাদ্বীপ বলেই জানি, মহাদেশ বলে মানি নে।
মহাদেশ বলতে যদি মহাদ্বীপ বোঝায়, তা হলে পৃথিবীতে চারটি নয় তিনটি মাত্র মহাদ্বীপ আছে : প্রথম ইউরেশিয়া, দ্বিতীয় আফ্রিকা, তৃতীয় আমেরিকা। শ্লোবের প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করলেই দেখতে পাবে যে, গোটা ইউরোপ ও গোটা এশিয়ার ভিতর কোথাও জলের ব্যবধান নেই। এ দুই দেশের জমি একলপ্ত। আর এই আদি মহাদেশটি হচ্ছে একটি প্রকাণ্ড দ্বীপ। এর উত্তরে আকীটক সী, দক্ষিণে ইন্ডিয়ান ওশন, পশ্চিমে অ্যাটলান্টিক ও পূর্বে প্যাসিফিক ওশন; আর আফ্রিকার উত্তরে ও পশ্চিমে অ্যাটলান্টিক এবং দক্ষিণে ও পূর্বে ইন্ডিয়ান ওশন। আর আমেরিকার পশ্চিমে প্যাসিফিক, পূর্বে অ্যাটলান্টিক, উত্তরে উত্তর-আর্কটিক ও দক্ষিণে দক্ষিণ-আর্কটিক সাগর। ইউরেশিয়ার সঙ্গে অপর দুটি মহাদেশের গড়নেরও একটা স্পষ্ট প্রভেদ আছে। ইউরেশিয়ার বিস্তার পব হতে পশ্চিমে, অপর দুটির উত্তর হতে দক্ষিণে। অর্থাৎ ইউরেশিয়া লম্বার চাইতে চওড়ায় বেশি। আফ্রিকা ও আমেরিকা চওড়ার চাইতে লম্বায় বেশি। এই আকারভেদ এক দেশের সঙ্গে অপর দেশের অনেক প্রভেদ ঘটিয়েছে।
তোমরা সবাই জান যে ইউরেশিয়া ও আফ্রিকাকে আমরা প্রাচীন পৃথিবী বলি ও আমেরিকাকে নবীন। এর প্রধান কারণ প্রাচীন পৃথিবীর লোক পাঁচশো বৎসর পূর্বে আমেরিকার অস্তিত্বের কথা জানত না। অতএব, এ নাম শুধু লৌকিক, বৈজ্ঞানিক হিসেবে ঠিক নয়। তা ছাড়া, অনেক বিষয়ে এই নতুন পৃথিবী প্রাচীন পৃথিবীর ঠিক উলটো। বিলাতে (গ্রীনউইচ) যখন দিনপর, আমেরিকায় (নিউ অরলিনস) তখন রাতদুপুর। কেন এরকম হয়, সে কথা আর আজ বলব না; কারণ তা বোঝাতে হলে আমাকে মাটি থেকে আকাশে উঠতে হবে। এ ব্যাপারের ব্যাখ্যার ভিতর শুধু পৃথিবী নয়, সচন্দ্রকেও টেনে আনতে হবে। কেননা জিয়োগ্রাফি কতক হিসেবে অ্যাস,ট্রনমির অন্তর্ভূত। আর অ্যাসষ্ট্রনমি তোমরাও জান না, আমিও জানি নে।