বদ্ধ শতকোটি গাভীর মধ্যে প্রতিদিন মাধ্যন্দিন সবনে দুই দুই সহস্র। আটাশি হাজার পুষ্ঠবাহনযোগ্য শ্বেত অশ্ব। এদেশ ওদেশ হইতে আনীত নিষ্ককণ্ঠী আঢ্য দুহিতার মধ্যে দশ সহস্র।
এরূপ দানের দাতা দুর্লভ হলেও গ্রহীতা আরো বেশি দুর্লভ। এত গোরু, এত ঘোড়া এত বনিতা রাখি কোথায় আর খাওয়াই কি, এ প্রশ্ন বোধ হয় দরিদ্র ব্রাহ্মণের মনে উদিত হত। ব্রাহ্মণগ্রন্থ এই সত্যেরই পরিচয় দেয় যে, সে যুগে এমন বহু ক্ষত্রিয় ছিলেন যাঁদের নিজেদের কোষবৃদ্ধি এবং অধিকারবৃদ্ধির প্রতি লোভ ছিল, এবং তাঁরা ব্রাহ্মণদের তন্তরমন্তরজাদুতে বিশ্বাস করতেন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে যে সাম্রাজ্যের উল্লেখ আছে তা বিয়ের বাহুবল বুদ্ধিবল ও চরিত্রবল দ্বারা নয়, ব্রাহ্মণের মন্ত্রবলের দ্বারা লাভ করবার বস্তু। কারণ শত্রুনাশের জন্য তাঁদের যুদ্ধ করা আবশ্যক হত না, ব্ৰহ্ম-পরিমর-কর্ম প্রভৃতি অভিচারের দ্বারাই সে কামনা সিদ্ধ হত। এই অতীত সাহিত্যের ভিত্তির উপর যদি ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ ঐক্যের প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তা হলে আমাদের মনোজগতের গন্ধর্বপুরী চিরকাল আকাশেই ঝলবে।
আমরা ইউরোপীয় সভ্যতার নূতন মদ নিত্যই সংস্কৃত সাহিত্যের পুরোনো বোতলে ঢালছি। আমরা স্পেন্সরের বিলেতি মদ শংকরের বোতলে ঢালি Comte কঁতের ফরাসি মদ মনুর বোতলে ঢালি, এবং তাই যুগসঞ্চিত সোমরস বলে পান করে তৃপ্তিও লাভ করি মোহও প্রাপ্ত হই। কিন্তু এই ঢালাঢলি এবং ঢলাঢলিরও একটা সীমা আছে। বিস্মার্কের জর্মান মদ ব্রাহ্মণের যজ্ঞের চমসে ঢালতে গেলে আমরা সে সীমা পেরিয়ে যাই। ও-হাতায় এ-জিনিস কিছুতেই ধরবে না। ইংরেজি শিক্ষার প্রসাদে আমরা ব্রাহ্মণসাহিত্যের আধিদৈবিক ব্যাপার -সকলের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার চেষ্টা করতে পারি, এবং চাই কি তাতে কৃতকার্যও হতে পারি; কিন্তু শুধু ইংরেজি শিক্ষা নয় তদুপরি ইংরেজি ভাষার সাহায্যেও তার ‘আধিরাষ্ট্রিক’ ব্যাখ্যা করতে পারি নে।
৫.
এতদিন প্রাচীন ভারতের নাম উল্লেখ করবামাত্রই বর্ণাশ্রমধর্ম, ধ্যান-ধারণা নিদিধ্যাসন–এই-সকল কথাই আমাদের স্মরণপথে উদিত হত, এবং বঙ্গ সাহিত্যে তারই গুণকীর্তন করে আমরা যশ ও খ্যাতি লাভ করতুম। ইমপরিয়লিজম নামক আহেলবিলাতি পদার্থ পুরাকালে এদেশে ছিল, এরূপ কথা পূর্বে কেউ বললে তার উপর আমরা খড়্গহস্ত হয়ে উঠতুম, কেননা ওরূপ কথা আমাদের দেশভক্তিতে আঘাত করত। বৈরাগ্যের দেশ ঐহিক ঐশ্বর্যের স্পর্শে কলুষিত হয়ে ওঠে। কিন্তু আজ যে নবদেশভক্তি ঐ ইমপীরিয়লিজমের উপর এত ঝুকেছে, তার একমাত্র কারণ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের আবিষ্কার। উক্ত গ্রন্থ থেকেই আমরা এই জ্ঞান লাভ করেছি যে, ইউরোপীয় রাজনীতির যা শেষ কথা ভারতবর্ষের রাজনীতির তাই প্রথম কথা। এই সত্যের সাক্ষাৎকার লাভ করে আমাদের চোখ এতই ঝলসে গেছে যে, আমরা সকল তন্ত্রে সকল মাত্রে ঐ সাম্রাজ্যেরই প্রতিরূপ দেখছি। এরূপ হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু আমাদের চোখ যখন আবার প্রকৃতিস্থ হবে তখন আমরা এই প্রাচীন ইমপীরিয়লিজমকেও খুঁটিয়ে দেখতে পারব এবং কৌটিল্যকেও জেরা করতে শিখব। ইতিমধ্যে এই কথাটি আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, চন্দ্রগুপ্ত রাজনীতির ক্ষেত্রে যে মহাভারত রচনা করেছিলেন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র শুধু তারই ভাষ্য। যে মনোভাবের উপর সে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে মনোভাব বৈদিক নয়, সম্ভব আর্যও নয়। মন, প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করে দেখলে দেখতে পাওয়া যায় যে, উক্ত অর্থশাস্ত্রকারের মানসিক প্রকৃতি এবং ধর্মশাস্ত্রকারদের প্রকৃতি এক নয়। সে পার্থক্য যে কোথায় ও কতখানি তা আমি একটিমাত্র উদাহরণের সাহায্যে দেখিয়ে দেব।
সংস্কৃত ভাষায় ধর্ম শব্দের অর্থ law, এবং শাস্ত্রকারদের মতে ল-এর মূল হচ্ছে বেদ স্মৃতি সদাচার ও আত্মতুষ্টি। রাজশাসন অর্থাৎ লেজিসলেশন যে ধর্মের মূল হতে পারে, এ কথা ধর্মশাস্ত্রে স্বীকৃত হয় নি। রাজা ধর্মের রক্ষক, স্রষ্টা নন। অপর পক্ষে কৌটিল্যের মতে রাজশাসন সকল ধর্মের উপরে। এ কথা বৈদিক ব্রাহ্মণ কখনোই মেনে নেন নি, কেননা তাঁদের মতে ধর্মের মূল হচ্ছে বেদ; অতএব ধর্ম অপৌরুষেয়। তার পরে আসে স্মৃতি, অর্থাৎ আর্যঋষিদের স্মৃতি; তার পর সদাচার, অর্থাৎ আর্যদের কুলাচার; তার পর আত্মতুষ্টি, অর্থাৎ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের আত্মতুষ্টি। এক কথায় ধর্মশাস্ত্রের মতে ‘পারম্পর্ষক্রমাগত’ আর্য-আচারই একমাত্র এবং সমগ্র ল। যাঁরা এরূপ মনোভাব পোষণ করতেন, তাঁরা চন্দ্রগুপ্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং চাণক্য কর্তৃক ব্যাখ্যাত রাজনীতি কখনোই স্বচ্ছন্দমনে গ্রাহ্য করতেন না। সম্ভবত এই কারণেই চাণক্য নিজে ব্রাহ্মণ হলেও সংস্কৃত সাহিত্যে হিংসা প্রতিহিংসা ক্রোধ দ্বেষ ক্রূরতা ও কুটিলতার অবতার-স্বরূপ বর্ণিত হয়েছেন, এবং একই কারণে ব্রাহ্মণসমাজে তাঁর অনাদৃত গ্রন্থ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বৌদ্ধধর্ম এবং সেইসঙ্গে মৌর্য সাম্রাজ্যের অধঃপতনের সকল কারণ আমরা অবগত নই। যখন সে ইতিহাস আবিষ্কৃত হবে, তখন সম্ভবত আমরা দেখতে পাব যে, এ ধংসব্যাপারে বৈদিক ব্রাহ্মণের যথেষ্ট হাত ছিল।
এ কথা বোধ হয় নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, ভারতবাসী আর্যদের কৃতিত্ব সাম্রাজ্যগঠনে নয়, সমাজগঠনে; এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় শিল্পে-বাণিজ্যে নয়, চিন্তার রাজ্যে। শাস্ত্রের ভাষায় বলতে হলে ‘পৃথিবীর সর্বমানব’কে আর্য-আচার শিক্ষা দেওয়া এবং সেই আচারের সাহায্যে সমগ্র ভারতবাসীকে একসমাজভুক্ত করাই ছিল তাঁদের জীবনের ব্রত। তার ফলে, হিন্দুসমাজের যা-কিছু গঠন আছে তা আর্যদের গুণে, এবং যা-কিছু জড়তা আছে তাও তাঁদের দোষে। এই বিরাট সমাজের ভিতর নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও প্রভুত্ব রক্ষা করবার জন্য তাঁরা যে দুর্গ গঠন করেছিলেন, তাই আজ আমাদের কারাগার হয়েছে। দর্শনে বিজ্ঞানে কাব্যে অলংকারে অভিধানে ব্যাকরণে তাঁদের অপূর্ব কীর্তি, যে ভাষার তুলনা জগতে নেই সেই সংস্কৃত ভাষায়, অক্ষয় হয়ে রয়েছে। এ দেশের প্রাচীন আর্যেরা যে সাম্রাজ্যের চাইতে সমাজকে, এবং সমাজের চাইতেও মানুষের আত্মাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন, তার জন্য সমাজের লজ্জিত হবার কোনো কারণ নেই; কারণ বর্তমানে ইউরোপের মনেও এ ধারণা হয়েছে যে, political problemsএর অপেক্ষা social problemsএর মূল্য কিছু কম নয়। এবং শাসনযন্ত্রের চাইতে মানুষের মুল্য ঢের বেশি।