৪.
ইংরেজ যে সর্বপ্রথমে ভারতবর্ষের মানচিত্র লালবর্ণে চিত্রিত করেছেন, তা নয়। আজ দু হাজার বৎসরেরও পূর্বে আশোকও একবার ঐ মানচিত্র গেরুয়ারঙে রঞ্জিত করেছিলেন। এ কথা শিক্ষিত লোকমাত্রেরই জানা না থাক, শোনা আছে। যা সপরিচিত তার আর নতুন করে আবিষ্কার করা চলে না, সুতরাং রাধাকুমুদবাবু প্রাচীন ভারতের একরাস্ট্রীয়তার মূল বৈদিক সাহিত্যে অনুসন্ধান করেছেন, তাঁর পুস্তিকার মৌলিকতা এইখানেই। সুতরাং তিনি অনুসন্ধানের ফলে যে নূতন সত্য আবিষ্কার করেছেন, তা বিনাপরীক্ষায় গ্রাহ্য করা যায় না।
শাস্ত্রকারেরা বেদকে স্মৃতির মূল বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু বেদ যে শূদ্ররীতি কিংবা বৌদ্ধনীতির মূল, এ কথা তারা কখনো মুখে আনেন নি; বরং বৌদ্ধচার্যেরা যখন বেদের কোনো উৎসন্ন শাখা থেকে বৌদ্ধধর্ম উদ্ভূত হয়েছে এই দাবি করতেন, তখন বৈদিক ব্রাহ্মণেরা কানে হাত দিতেন। অথচ এ কথা অস্বীকার করবার জো নেই যে, ইতিহাস যে প্রাচীন সাম্রাজ্যের পরিচয় দেয় তা বৌদ্ধযুগে ব্রাত্যদেশে শূদ্রভূপতি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মগধের নন্দবংশও শূদ্রবংশ, মৌর্যবংশও শূদ্রবংশ ছিল। এবং অশোক সমগ্র ভারতবর্ষে শুধু রাজচক্র নয় ধর্মচক্রেরও স্থাপনা করে সসাগরা বসুন্ধরার সার্বভৌম চক্রবর্তীর পদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সুতরাং একরাষ্ট্রীয়তার মূল বৈদিক মনে পাওয়া যাবে কি না সে বিষয়ে স্বতই সন্দেহ উপস্থিত হয়।
বৌদ্ধযুগের পূর্বে কোনো একরাটের পরিচয় ইতিহাস দেয় না। কিন্তু ইতিহাসের পশ্চাতে কিংবদন্তি আছে; সেই কিংবদন্তির সাহায্যে, দেশের বিশেষকোনো ঘটনা না হোক, জাতির বিশেষ মনোভাবের পরিচয় আমরা পেতে পারি। রাধাকুমুদবাবু ব্রাহ্মণ এবং শ্রৌত সূত্র প্রভৃতি নানা বৈদিক গ্ৰন্থ থেকে রাজনীতি সম্বন্ধে আর্যজাতির মনোভাব উদ্ধার করবার চেষ্টা করেছেন।
রাধাকুমুদবাবুর দাখিলি বৈদিক দলিলগুলির কোনো তারিখ নেই, সুতরাং তার সবগুলি যে মাগধসাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পূর্বে লিখিত হয়েছিল, তা বলা যায় না। অতএব কোনো বিশেষ ব্রাহ্মণগ্রন্থ বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্ভুত হলেও তার প্রতি বাক্য যে বৈদিক মনোভাবের পরিচয় দেয় এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে না। ওরূপ দলিলের বলে তর্কিত বিষয়ের চুড়ান্ত নিষ্পত্তি করা অসম্ভব, বিশেষত যখন তাঁর সংগৃহীত দলিল তাঁর মতের বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দেয়। রাধাকুমুদবাবুর প্রধান দলিল হচ্ছে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ। ঐ গ্রন্থেই তিনি সাম্রাজ্য শব্দের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, এবং সেই শব্দই হচ্ছে তাঁর মতের মূলভিত্তি। উক্ত ব্রাহ্মণের একখানি বাংলা অনুবাদ আছে; তারই সাহায্যে রাধাকুমুদবাবুর মত যাচাই করে নেওয়া যেতে পারে। সম্রাট কাকে বলে, তার পরিচয় ঐ ব্রাহ্মণে এইরূপ আছে—
পূর্ব দিকে প্রাচ্যগণের যে-সকল রাজা আছেন তাঁহারা দেবগণের ঐ বিধান অনুসারে সাম্রাজ্যের জন্য অভিষিক্ত হন, অভিষেকের পর তাঁহারা সম্রাট নামে অভিহিত হন। (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ৩৮শ অধ্যায়)
রাধাকুমুদবাবু বলেন যে, এ স্থলে মাগধসাম্রাজ্যের উল্লেখ করা হয়েছে। যদি তাঁর উক্ত অনুমান গ্রাহ্য হয় তা হলে প্রাচীন ভারতসাম্রাজ্যের বৈদিক ভিত্তি ঐ এক কথাতেই নষ্ট হয়ে যায়।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে নানারূপ রাজ্যের উল্লেখ আছে, যথা : রাজ্য, সাম্রাজ্য, ভৌজ্য, স্বারাজ্য, বৈরাজ্য, পারমেষ্ঠ্য রাজ্য, মাহারাজ্য ইত্যাদি। রাধাকুমুদবাবু প্রমাণ করতে চান যে, ঐ-সকল নাম উচ্চনীচহিসাবে একরাটের অধীন ভিন্ন ভিন্ন রাজপদ নির্দেশ করে। কিন্তু ঐ ব্রাহ্মণগ্রন্থেই প্রমাণ আছে যে, ঐ-সকল নাম হচ্ছে পৃথক পৃথক দেশের ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের নাম। তার সকল দেশই পঞ্চনদের বহির্ভূত, কোনো কোনো দেশ ভারতবর্ষেরও বহির্ভুত, এবং বিশেষ করে একটি দেশ পৃথিবীর বহিভূত। যথা–
পূর্ব দিকে প্রাচ্যগণের রাজ্য সম্রাট, দক্ষিণ দিকে সত্ত্বৎগণের রাজা ভোজী; পশ্চিম দিকে নীচ্য ও অপাচ্যদিগের রাজা স্বরাট; উত্তর দিকে হিমবানের ওপারে যে উত্তরকুরু ও উত্তরমদ্র জনপদ আছে, তাহারা দেবগণের ঐ বিধানানুসারে বৈরাজ্যের জন্য অভিষিক্ত হয়, অভিষেকের পরে তাহারা বিরাট নামে অভিহিত হয়। মধ্যমদেশে সবশ উশীনরগণের ও কুরপাঞ্চালগণের যে-সকল রাজা আছেন তাঁহারা রাজা নামে অভিহিত হন। এবং ঊর্ধ্বদেশে (অন্তরীক্ষে) ইন্দ্র পরমেষ্ঠ্য লাভ করিয়াছিলেন।
উপরোক্ত উদধৃত বাক্যগলি থেকে দেখা যায় যে, দেশভেদ অনুসারে সে যুগের রাজাদের নামভেদ হয়েছিল, পদমর্যাদা অনুসারে নয়। উক্ত ব্রাহ্মণে একরাট শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সে একরাট, একসঙ্গে স্বরাট্ বিরাট্ সম্রাট, সব রাট্ হতে পারতেন; অর্থাৎ তিনি স্বদেশ বিদেশ এবং আকাশদেশের রাজা হতে পারতেন। বলা বাহুল্য, এরূপ একরাটের নিকট ভারতবর্ষের একরাষ্ট্রীয়তার সন্ধান নিতে যাওয়া বৃথা।
আসল কথা এই যে, রাজনীতি অর্থে আমরা যা বুঝি ও চাণক্য যা বুঝতেন, ব্রাহ্মণগ্রন্থে তার নামগন্ধও নেই। বাজপেয় রাজসূয় অশ্বমেধ পুনরভিষেক ঐন্দ্রমহাভিষেক–এ-সব হচ্ছে যজ্ঞ। এবং এসকল যজ্ঞের উদ্দেশ্য রাজ্যস্থাপনা নয়, পুরোহিতকে ভূরি দান করানো এবং ঐরূপ যজ্ঞ দ্বারা যজমানের অভ্যুদয় সাধিত হতে পারে, তাই প্রমাণ করা। রাধাকুমুদবাবু তাঁর পুস্তিকাতে পুরাকালে যাঁরা একরাট-পদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তাঁদের নামের একটি লম্বা ফর্দ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ হতে তুলেছিলেন। সম্ভবত তিনি উক্ত রাজাগণের সার্বভৌম সাম্রাজ্যলাভ ঐতিহাসিক ঘটনা বলে মনে করেন, কিন্তু আমরা তা পারি নে। কারণ উক্ত ব্রাহ্মণের মতে ঐন্দ্রমহাভিষেকের বলেই প্রাচীন রাজারা ঐ ইন্দ্রবাঞ্ছিত পদ লাভ করেছিলেন। মন্ত্রবলে এবং যজ্ঞফলে তাদৃশ বিশ্বাস না থাকার দরুন আমরা উক্ত রাজযজমানদের ঐরূপ আত্যন্তিক অভ্যুদয় এবং রাজপুরোহিতদের তদনুরূপ দক্ষিণালাভের ইতিহাসে যথেষ্ট আস্থা স্থাপন করতে পারি নে। রাধাকুমুদবাবু নামের ফর্দের পাশাপাশি যদি দানের ফর্দটি তুলে দিতেন, তা হলে পাঠকমাত্রেই ঐতরেয় ব্রাহ্মণের কথা কতদূর প্রামাণিক তা সহজেই বুঝতে পারতেন। ঐন্দ্রমহাভিষেক উপলক্ষে দান করা হত–