সোহহং হচ্ছে ইনভিভিডুয়ালিজমের চরম উক্তি। সুতরাং বেদান্তমত আমাদের মনোজগৎকে যে পরিমাণে উদার ও মুক্ত করে দিয়েছে, আমাদের ব্যাবহারিক জীবনকে সেই পরিমাণে বদ্ধ ও সংকীর্ণ করে ফেলেছে। বেদান্তের দর্পণে প্রাচীন যুগের সামাজিক মন প্রতিফলিত হয় নি, প্রতিহত হয়েছে। বেদান্তদর্শন সামাজিক জীবনের প্রকাশ নয়, প্রতিবাদ। অদ্বৈতবাদ হচ্ছে সংকীর্ণ কর্মের বিরুদ্ধে উদার মনের প্রতিবাদ, সীমার বিরুচ্ছে অসীনের প্রতিবাদ, বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে আত্মজ্ঞানের প্রতিবাদ। এক কথায় জড়ের বিরুদ্ধে আমার প্রতিবা। সমাজের দিক থেকে দেখলে জীবের এই ঘরাটন শুধু বিরাট অহংকার মাত্র। সুতরাং যে সূত্রে একালের লোকেরা জাতিকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে চান তা ব্রহ্মসূত্র নয়, কিন্তু তার অপেক্ষা ঢের স্থূল জীবনসূত্র।
কেন যে পুরাকালে অদ্বৈতবাদীরা কৌপীনকমণ্ডল, ধারণ করে বনে যেতেন, তার প্রকৃত মর্ম উপলদ্ধি না করতে পারায় একালের অদ্বৈতবাদীরা চোগাচাপকান পরে আপিসে যান।, উভয়ের ভিতর মিল এইটুকু যে, একজন হচ্ছেন উদাসী আর-একজন শুধু উদাসীন–পরের সম্বন্ধে।
রাধাকুমুদবাবুর প্রবন্ধের প্রধান মর্যাদা এই যে, তিনি ভারতের আত্মজ্ঞানের ভিত্তি অতীতের জীবনক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হয়েছেন। তবে কতদূর কৃতকার্য হয়েছেন সেইটেই বিচার্য। ভবিষ্যতের শুন্যদেশে যা-খুশি-তাই স্থাপনা করবার যে স্বাধীনতা মানুষের আছে, অতীত সম্বন্ধে তা নেই। ভবিষ্যতে সবই সম্ভব হতে পারে, কিন্তু অতীতে যা হয়ে গেছে তার আর একচুলও বদল হতে পারে না। কল্পনার প্রকৃত লীলাভূমি ভূত নয়, ভবিষ্যৎ। আকাশে আশার গোলাপ ফুল অথবা নৈরাশ্যের সরষের ফল দেখবার অধিকার আমাদের সকলেরই আছে; কিন্তু অতীত ফলের নয়, মূলের দেশ। যে মূল আমরা খুঁজে বার করতে চাই তা সেখানে পাই তো ভালোই; না পাই তো, না পাই।
৩.
জীবের অহংজ্ঞান যেমন একটি দেহ আশ্রয় করে থাকে জাতির অহংজ্ঞানও তেমনি একটি দেশ আশ্রয় করে থাকে। মানুষের যেমন দেহাত্মজ্ঞান তার সকল বিশিষ্টতার মূল, জাতির পক্ষেও তেমনি দেশাত্মজ্ঞান তার সকল বিশিষ্টতার মূল। ভারতবাসীর মনে এই দেশাত্মজ্ঞান যে অতি প্রাচীনকালে জন্মলাভ করেছিল, রাধাকুমুদবাবু নানারূপ প্রমাণপ্রয়োগের বলে তাই প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করেছেন।
ভারতবর্ষ মহাদেশ হলেও যে একদেশ এবং ভারতবাসীদের যে সেটি স্বদেশ, এ সত্যটি অন্তত দু হাজার বৎসর পূর্বে আবিষ্কৃত হয়েছিল।
উত্তরে অলঙ্ঘ্য পর্বতের প্রাকার, এবং পশ্চিম দক্ষিণ ও পূর্বে দুর্লঙ্ঘ্য সাগরের পরিখা যে ভারতবর্ষকে অন্যান্য সকল ভূভাগ হতে বিশেষরূপে পৃথক ও স্বতন্ত্র করে রেখেছে, এ হচ্ছে প্রত্যক্ষসত্য। তার পর, এ দেশ অসংখ্যযোজনবিস্তৃত হলেও সমতল; এত সমতল যে, সমগ্র ভারতবর্ষকে একক্ষেত্র বললেও অত্যুক্তি হয় না। বিন্ধ্যাচল সম্ভবত এ মহাদেশকে দুটি চিরবিচ্ছিন্ন খণ্ডদেশে বিভক্ত করতে পারত, যদি অগস্ত্যের আদেশে সে চিরদিনের জন্য নতশির হয়ে থাকতে বাধ্য না হত। রাধাকুমুদবাবু দেখিয়েছেন যে, এই স্বদেশজ্ঞান ভারতবাসীর পক্ষে কেবলমাত্র শুষ্ক জ্ঞান নয়, কিন্তু তাদের আত্যন্তিক প্রীতি ও ভক্তির সঙ্গে জড়িত। ভারতবাসীর পক্ষে ভারতবর্ষ হচ্ছে পূণ্যভূমি। সে দেশের প্রতি ক্ষেত্র ধর্মক্ষেত্র, প্রতি নদী তীর্থ, প্রতি পর্বত দেবতাত্মা। কিন্তু এই ভক্তিভাব আর্য মনোভাব কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বেদ হতে পঞ্চনদের আবাহনস্বরূপ একটিমাত্র শ্লোক উদধৃত করে রাধাকুমুদবাবু প্রমাণ করতে চান যে, ঋষিদের মনে এই একদেশীয়তার ভাব সর্বপ্রথমে উদয় হয়েছিল। কিন্তু সেই বৈদিক মনোভাব যে ক্ৰমে বৃদ্ধি এবং বিস্তার লাভ করে শেষে লৌকিক মনোভাবে পরিণত হয়েছিল, তার কোনো প্রমাণ নেই। আমার বিশ্বাস, বৈদিক ধর্ম নয়, লৌকিক ধর্মই ভারতবর্ষকে পূণ্যভূমি করে তুলেছে। ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীদের ধর্ম হচ্ছে লৌকিক ধর্ম, বিদেশী বিজেতা আর্যদের ধর্ম হচ্ছে বৈদিক ধর্ম। ভারতবর্ষের মাটি ও ভারতবর্ষের জলই হচ্ছে লৌকিক ধর্মের প্রধান উপাদান। সে ধর্ম আকাশ থেকে পড়ে নি, মাটি থেকে উঠেছে। ভারতবর্ষের জনগণ চিরদিন কৃষিজীবী। যে ত্রিকোণ পৃথিবী তাদের চিরদিন অন্নদান করে সেই হচ্ছে অন্নদা এবং যে জল তাদের শস্যক্ষেত্রে রসসঞ্চার করে সেই হচ্ছে প্রাণদা। তাই ভারতবর্ষের অসংখ্য লৌকিক দেবতা সেই অন্নদার বিকাশ। সীতার মতো এ-সকল দেবতা হলমুখে ধরণী হতে উত্থিত হয়েছে। তাই এ দেশের প্রতিমা মাটির দেহ ধারণ করে এবং জলে তার বিসর্জন হয়। ‘তোমারি প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে’ এ কথা মোটেই বৈদিক মনোভাবের পরিচায়ক নয়। কেননা, পঞ্চনদবাসী আর্যেরা মন্দিরও গড়াতেন না, প্রতিমাও পুজা করতেন না। এই দেশভক্তি পৌরাণিক সাহিত্যে অতি পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। তার কারণ, বৈদিক যুগ ও পৌরাণিক যুগের মধ্যে যে বৌদ্ধ যুগ ছিল সেই যুগেই এই দেশজ্ঞান ও স্বদেশপ্রীতি ভারতবর্ষময় ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিল। বৌদ্ধধর্ম অবৈদিক ধর্ম, এবং সার্বজনীন বলে তা সার্বভৌম ধর্ম। অপর পক্ষে বৈদিক ধর্ম আর্যদের গৃহধর্ম, বড়োজোর কুলধর্ম। সমগ্র দেশকে একাত্ম করবার ক্ষমতা সে ধর্মের ছিল না। যেমন অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে সুরেরা এক ঈশানকোণ ব্যতীত আর-সকল দিকেই পরাস্ত হয়েছিলেন, তেমনি সম্ভবত ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণ প্রভৃতি বৈদিক দেবতারা দেশজ দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধে এক গৃহকোণ ব্যতীত আর সর্বত্রই পরাস্ত হয়েছিলেন। অন্তত আকাশের দেবতারা যে মাটির দেবতাদের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার প্রমাণ পৌরাণিক হিন্দুধর্ম। বৈদিক ও লৌকিক মনোভাবের মিশ্রণে এই নবধর্মভাবের জন্ম। আর্যরা যে কস্মিনকালেও সমগ্র ভারতবর্ষকে একদেশ বলে স্বীকার করতে চান নি, তার প্রমাণ স্মৃতিশাস্ত্রে পাওয়া যায়। বৌদ্ধধর্মের অধঃপতন এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরভ্যুদয়ের সময় মনুসংহিতা লিখিত হয়। এই সংহিতাকারের মতে ব্রহ্মাবর্ত-এবং আর্যাবর্ত-বহির্ভূত সমগ্র ভারতবর্ষ হচ্ছে ঘৃণ্য ম্লেচ্ছদেশ। মনুর টীকাকার মেধাতিধি বলেন যে, দেশের ম্লেচ্ছত্বদোষ কিংবা আর্যগুণ নেই। যে দেশে বেদবিহিত ক্রিয়াকর্মনিরত আর্যেরা বাস করেন, সেই হচ্ছে আর্যভূমি, বাদবাকি সব ম্লেচ্ছদেশ। আর্যদের এই স্বজাতিজ্ঞান সমগ্র ভারতবর্ষের স্বদেশজ্ঞানের প্রতিকূল ছিল। পঞ্চনদের পঞ্চনদীর উল্লেখ করে তর্পণের মন্ত্র উচ্চারণপক বৈদিক ঋষিরা যে গণ্ডূষ করতেন, সে কতকটা সেই ভাবে, যে ভাবে একালে বিলাতি আর্যেরা মহোৎসবের ভোজনাতে The Land we live inএর নামোচ্চারণ করে সুরার আচমন করেন। প্রাচীন আর্যজাতির মনে দেশপ্রীতির চাইতে আত্মপ্রীতি ঢের বেশি প্রবল ছিল। দেশের স্বাতন্ত্র রক্ষা নয়, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষাই ছিল তাঁদের স্বধর্ম। রাধাকুমুদবাবু এমন-কোনো বিরুদ্ধপ্রমাণ দেখাতে পারেন নি, যাতে করে আমার এই ধারণা পরিবর্তিত হতে পারে।