- বইয়ের নামঃ ভারতবর্ষ
- লেখকের নামঃ প্রমথ চৌধুরী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অনু-হিন্দুস্থান
অনু-হিন্দুস্থান
[কোনো পারিবারিক সমিতিতে পঠিত]
হে সমিতির কুমারগণ, আমাদের দেশের লোকের বিশ্বাস যে হিন্দুস্থানের বাইরে হিন্দুর আর স্থান নেই। এ বিশ্বাস সর্বসাধারণ। শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেরই ধারণা যে, হিন্দুধর্ম ও হিন্দুজাতি আছে শুধু জিয়োগ্রাফিতে—যাকে বলে ভারতবর্ষ তারই চতুঃসীমার মধ্যে।
আমরা সকলেই দেখতে পাই, ভারতবর্ষের পশ্চিমে রয়েছে মুসলমান, উত্তরেও তাই, পূর্বে বৌদ্ধ, আর দক্ষিণে সমুদ্র। আর সমুদ্রের ওপারে যদি কোনো দেশ থাকে তো সে দেশে হিন্দুজাত কখনো যায় নি; আর যদি কখনো গিয়ে থাকে তো তখনই তাদের হিন্দুত্ব মারা গিয়েছে। কেননা একালে হিন্দুজাতির সমুদ্রযাত্রার অর্থ তার গঙ্গাযাত্রা।
এ ধারণা শিক্ষিতলোকসামান্য হলেও, অশিক্ষিত ধারণা। ইংরেজি শিক্ষার চশমা পরলে আমাদের বর্তমান জাতীয় দৈন্য ও হীনতা সম্বন্ধে আমাদের চোখ যেমন ফোটে, আমাদের জাতীয় পূর্বগৌরব ও ঐশ্বর্য সম্বন্ধে আমরা তেমনি অন্ধ হই। আমাদের নতুন শিক্ষা এসেছে পশ্চিম থেকে। এর ফলে আমরা পূর্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ–পূর্বকাল সম্বন্ধেও, পূর্বদিক সম্বন্ধেও। ভারতবর্ষের পূর্বকালের হিস্টরির সঙ্গে আমাদের যদি কিছুমাত্র পরিচয় থাকত তা হলে আমরা জানতুম যে, ভারতবর্ষের পূর্বের অনেক দেশেও অনেককাল ধরে হিন্দুধর্ম ও হিন্দু,জাতি রাজত্ব করেছে। আজকাল অনেকে যাকে ভারতবর্ষের অতীত বলে চালিয়ে দিতে চান, তা কোনো দেশেরই অতীত নয়, ভারতবর্ষের তো নয়ই। বেশির ভাগ লোকের মতে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ যেমন ইউরোপের বর্তমান, জনকতক লোকের মতে ভারতবর্ষের অতীতও তেমনি ইউরোপের বর্তমান। আমাদের কল্পনার দৌড়ও বিলেত পর্যন্ত।
আমাদের শাস্ত্রকাররা বলেন লোকের নাম থেকে দেশের নাম হয়, দেশের নাম থেকে লোকের নাম হয় না। যথা, আর্যরা বাস করতেন বলেই আধখানা ভারতবর্ষের নাম হয়েছিল আর্যবর্ত; আর আর্যরা যদি অপর কোনো দেশে গিয়ে বাস করেন, তা হলে সে দেশের নামও হবে আর্যাবর্ত। এই হিসেবে ভারতবর্ষ ও চীনের ভিতর যে-সব দেশ আছে, সে-সব ভূভাগকে উপ-হিন্দুস্থান বলা অন্যায় নয়। যাক সেসব পরোনো কথা। তোমরা শুনে আশ্চর্য হবে যে, আজও এশিয়ার এক কোণে এমন একটি দেশ আছে, যেখানকার ষোলো-আনা অধিবাসী আজও হিন্দু। সেই দেশটির সঙ্গে তোমাদের চেনাপরিচয় করিয়ে দিতে চাই। সে পরিচয় করিয়ে দিতে বেশিক্ষণ লাগবে না। মাপে ও ম্যাপে ভারতবর্ষ যেমন বড়ো, সে দেশটি তেমনি ছোটো। ভারতবর্ষের তুলনায় সেটি তালের তুলনায় তিল যদ্রুপ, তদ্রুপ। এমন-কি, মানচিত্রেও সে দেশটি হঠাৎ কারো চোখে পড়ে না; অনেক খুঁজেপেতে সেটিকে বার করতে হয়। সেকালের উপ-হিন্দুস্থানের দক্ষিণে ম্যাপের গায়ে যে কতকগুলো কালির ছিটেফোঁটা দেখা যায়, তারই এক বিন্দু হচ্ছে এই বর্তমান অন-হিন্দুস্থান।
ও দেশের হিস্টরি তোমরা না জান, তার নাম তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ। এর নাম বলিদ্বীপ এবং এটি হচ্ছে যবদ্বীপ থেকে ভাঙা এক টুকরো খণ্ডদ্বীপ। ম্যাপে দেখতে পাওয়া যায় যে, জাভা সমুদ্রের মধ্যে পশ্চিমে মাথা করে পুর্বে পা ছড়িয়ে অনন্তশয্যায় শুয়ে রয়েছে; আর তার পায়ের গোঁড়ায় পুটলি পাকিয়ে জড়োসড়ো হয়ে রয়েছে–বলি। এ দুটি দ্বীপকে যদি খাড়া করে তোলা যায়—অর্থাৎ তাদের মাথা যদি পশ্চিম থেকে উত্তরে ফিরিয়ে দেওয়া যায়, আর পা পর্ব থেকে দক্ষিণে–তা হলে ভারতবর্ষের নীচে লঙ্কা যেমন দেখায়, জাভার নীচে বলিও তেমনি দেখাবে। এ কথাটা এখানে বলে রাখছি এইজন্যে যে, সিংহলের পূর্ব-ইতিহাস যেমন ভারতবর্ষের পূর্ব-ইতিহাসের একটা ছেঁড়াপাতা মাত্র, বলির ইতিহাসও তেমনি জাভার ইতিহাসের একটি ছিন্নপত্র।
জাভা ও বলির মধ্যে যে সমুদ্রের ব্যবধান আছে, সে অতি সামান্য। সে শাখাসমুদ্রটুকু মাইল দেড়েকের বেশি চওড়া নয়, অর্থাৎ চাঁদপুরের নীচে মেঘনার তুল্য। বলিদ্বীপ কতটা লম্বা আর কতটা চওড়া তা শুনলে তোমরা হাসবে। বলি দৈঘ্যে ৯৩ মাইল ও প্রস্থে মোটে ৫০ মাইল; তাও আবার সমস্তটা সমতলভূমি নয়। এই ছোট্ট দেশের মধ্যে বহুসংখ্যক হ্রদ আছে, আর সে-সব হ্রদ এত গভীর যে, তাদের অতলস্পর্শী বললেও অত্যুক্তি হয় না। তার উপর একটি একটানা পর্বতশ্রেণীর দ্বারা দেশটি দু ভাগে বিভক্ত। দেশ ছোটো, কিন্তু তার পর্বত যেমন লম্বা তেমনি উঁচু; অর্থাৎ ও হচ্ছে একরকম বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি। সে পর্বতের উচ্চতা কোথায়ও সাড়ে তিন হাজার ফুটের কম নয়, কোথাও-বা তা দশ হাজার ফট পর্যন্ত মাথা তুলেছে। এ পর্বত বলিদেশকে উত্তরাপথ ও দক্ষিণাপথে ভাগ করেছে–ভারতবর্ষের নকলে।
তোমরা হয়তো মনে ভাববে যে এই দেশেরই ইংরেজি নাম হচ্ছে লিলিপুট, কিন্তু তা নয়। গালিভার লিলিপুট-দেশের লোকের যে বর্ণনা করেছেন, তার সঙ্গে বলির অধিবাসীর চেহারার কোনো মিল নেই। এরা আকারে জাভার লোকের চেয়ে ঢের বেশি দীর্ঘাকৃতি ও বলিষ্ঠ। দেশ ছোটো হলে সেখানকার মানুষ যে বড়ো হয়, তা অন্যত্রও দেখা যায়। ইউরোপের ভিতর ইংলণ্ড সবচেয়ে ছোটো দেশ; কিন্তু এ দেশের মতো বড়োলোক ও-ভূভাগে অন্য কুত্রাপি মেলে না। অপর পক্ষে, অতি ক্ষুদ্র লোকের সাক্ষাৎ শুধু মহাদেশেই মেলে। বামনের জাত শুধু আফ্রিকাতেই আছে। গালিভার বলিদ্বীপে না গেলেও সিন্ধুবাদ যে সে দেশে গিয়েছিলেন তার প্রমাণ, যে বৃদ্ধ ভদ্রলোক তার কাঁধে ভর করেছিলেন, তিনি ছিলেন বলীয়ান।