Site icon BnBoi.Com

বিচিত্র – প্রমথ চৌধুরী

বিচিত্র - প্রমথ চৌধুরী

আমরা ও তোমরা

আমরা ও তোমরা

তোমরা ও আমরা বিভিন্ন। কারণ তোমরা তোমরা, এবং আমরা আমরা। তা যদি না হত, তাহলে ইউরোপ ও এশিয়া এ দুই, দুই হত না–এক হত। আমি ও তুমির প্রভেদ থাকত না। আমরা ও তোমরা উভয়ে মিলে, হয় শুধু আমরা হতুম, নাহয় শুধু তোমরা হতে।

 

২.

আমরা পর্ব, তোমরা পশ্চিম। আমরা আরম্ভ, তোমরা শেষ। আমাদের দেশ মানবসভ্যতার সূতিকাগৃহ, তোমাদের দেশ মানবসভ্যতার শ্মশান। আমরা উষা, তোমরা গোধুলি। আমাদের অন্ধকার হতে উদয়, তোমাদের অন্ধকারের ভিতর বিলয়।

 

৩.

আমাদের রং কালো, তোমাদের রং শাদা। আমাদের বসন শাদা, তোমাদের বসন কালো। তোমরা শ্বেতাঙ্গ ঢেকে রাখো, আমরা কৃষ্ণদেহ খুলে রাখি। আমরা খাই শাদা জল, তোমরা খাও লাল পানি। আমাদের আকাশ আগন, তোমাদের আকাশ ধোঁয়া। নীল তোমাদের স্ত্রীলোকের চোখে, সোনা তোমাদের স্ত্রীলোকের মাথায়; নীল আমাদের শন্যে, সোনা আমাদের মাটির নীচে। তোমাদের ও আমাদের অনেক বর্ণভেদ। ভুলে যেন না যাই যে, তোমাদের দেশ ও আমাদের দেশের মধ্যে কালাপানির ব্যবধান। কালাপানি পার হলে আমাদের জাত যায়, না হলে তোমাদের জাত থাকে না।

 

৪.

তোমরা দৈর্ঘ্য, আমরা প্রস্থ। আমরা নিশ্চল, তোমরা চঞ্চল। আমরা ওজনে ভারি, তোমরা দামে চড়া। অপরকে বশীভূত করবার তোমাদের মতে একমাত্র উপায় গায়ের জোর, আমাদের মতে একমাত্র উপায় মনের নরম ভাব। তোমাদের পুরুষের হাতে ইস্পাত, আমাদের মেয়েদের হাতে লোহা। আমরা বাচাল, তোমরা বধির। আমাদের বুদ্ধি সক্ষম এত সক্ষম যে, আছে কি না বোঝা কঠিন; তোমাদের বুদ্ধি স্থূল–এত স্থূল যে, কতখানি আছে তা বোঝা কঠিন। আমাদের কাছে যা সত্য, তোমাদের কাছে তা কল্পনা; আর তোমাদের কাছে যা সত্য, আমাদের কাছে তা স্বপ্ন।

 

৫.

তোমরা বিদেশে ছটে বেড়াও, আমরা ঘরে শুয়ে থাকি। আমাদের সমাজ স্থাবর, তোমাদের সমাজ জঙ্গম। তোমাদের আদর্শ জানোয়ার, আমাদের আদর্শ উদ্ভিদ। তোমাদের নেশা মদ, আমাদের নেশা আফিং। তোমাদের সুখ ছটফটানিতে, আমাদের সখ ঝিমনিতে। সখ তোমাদের ideal, দুঃখ আমাদের real। তোমরা চাও দুনিয়াকে জয় করবার বল, আমরা চাই দুনিয়াকে ফাঁকি দেবার ছল। তোমাদের লক্ষ্য আরাম, আমাদের লক্ষ্য বিরাম। তোমাদের নীতির শেষ কথা শ্রম, আমাদের আশ্রম।

 

৬.

তোমাদের মেয়ে প্রায়-পুরুষ, আমাদের পুরুষ প্রায়-মেয়ে। বুড়ো হলেও তোমাদের ছেলেমি যায় না, ছেলেবেলাও আমরা বড়োমিতে পরিপূর্ণ। আমরা বিয়ে করি যৌবন না আসতে, তোমরা বিয়ে কর যৌবন গত হলে। তোমরা যখন সবে গৃহপ্রবেশ কর, আমরা তখন বনে যাই।

 

৭.

তোমাদের আগে ভালোবাসা পরে বিবাহ; আমাদের আগে বিবাহ পরে ভালোবাসা। আমাদের বিবাহ ‘হয়’, তোমরা বিবাহ ‘কর’। আমাদের ভাষায় মুখ্য ধাতু ‘ভূ’, তোমাদের ভাষায় ‘কৃ’। তোমাদের রমণীদের রূপের আদর আছে, আমাদের রমণীদের গুণের কদর নেই। তোমাদের স্বামীদের পাণ্ডিত্য চাই অর্থশাস্ত্রে, আমাদের স্বামীদের পাণ্ডিত্য চাই অলংকারশাস্ত্রে।

 

৮.

অর্থাৎ এককথায়, তোমরা যা চাও আমরা তা চাই নে, আমরা যা চাই তোমরা তা চাও না; তোমরা যা পাও আমরা তা পাই নে, আমরা যা পাই তোমরা তা পাও না। আমরা চাই এক, তোমরা চাও অনেক। আমরা একের বদলে পাই শুন্য, তোমরা অনেকের বদলে পাও একের পিঠে অনেক শন্য। তোমাদের দার্শনিক চায় যুক্তি, আমাদের দার্শনিক চায় মুক্তি। তোমরা চাও বাহির, আমরা চাই ভিতর। তোমাদের পুরুষের জীবন বাড়ির বাইরে, আমাদের পুরুষের মরণ বাড়ির ভিতর। আমাদের গান আমাদের বাজনা তোমাদের মতে শুধু বিলাপ, তোমাদের গান তোমাদের বাজনা আমাদের মতে শুধু প্রলাপ। তোমাদের বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য সব জেনে কিছু না জানা, আমাদের জ্ঞানের উদ্দেশ্য কিছু না জেনে সব জানা। তোমাদের পরলোক স্বর্গ, আমাদের ইহলোক নরক। কাজেই পরলোক তোমাদের গম্য, ইহলোক আমাদের ত্যাজ্য। তোমাদের ধর্মমতে আত্মা অনাদি নয় কিন্তু অনন্ত, আমাদের ধর্মমতে আত্মা অনাদি কিন্তু অনন্ত নয়— তার শেষ নির্বাণ। পবেই বলেছি, প্রাচী ও প্রতীচী পথক। আমরাও ভালো, তোমরাও ভালো শুধু তোমাদের ভালো আমাদের মন্দ ও আমাদের ভালো তোমাদের মন্দ। সুতরাং অতীতের আমরা ও বর্তমানের তোমরা, এই দুয়ে মিলে যে ভবিষ্যতের তারা হবে— তাও অসম্ভব।

শ্রাবণ ১৩০৯

প্রত্নতত্ত্বের পারশ্য-উপন্যাস

প্রত্নতত্ত্বের পারশ্য-উপন্যাস

ভারতবর্ষের যে কোনো ভবিষ্যৎ নেই, সেবিষয়ে বিদেশীর দল ও স্বদেশীর দল উভয়েই একমত। আমাদের মধ্যে দুই শ্রেণীর লোক আছেন, যাঁরা ভবিষ্যৎ নিয়ে কারবার করেন : এক, যাঁরা রাজ্যের সংস্কার চান; আর-এক, যাঁরা সমাজের সংস্কার চান। বর্তমানকে ভবিষ্যতে পরিণত করতে হলে তার সংস্কার অর্থাৎ পরিবর্তন করা আবশ্যক। এই নিয়েই তো যত গোল। যা আছে তার বদল করা যে রাজ্যশাসনের পক্ষে ক্ষতিকর, এই হচ্ছে রাজ্যশাসকদের মত; আর যা আছে তার বদল করা যে সমাজশাসনের পক্ষে ক্ষতিকর, এই হচ্ছে সমাজশাসিতদের মত। অতএব দেখা গেল যে, ভারতবর্ষের যে ভবিষ্যৎ নেই এবং থাকা উচিত নয়–এ সত্য ইংরেজি ও সংস্কৃত উভয় শাস্ত্রমতেই প্রতিপন্ন হচ্ছে।

 

২.

ভবিষ্যৎ না থাক, গতকল্য পর্যন্ত ভারতবর্ষের অতীত বলে একটা পদার্থ ছিল; শুধু ছিল বলে ছিল না আমাদের দেহের উপর, আমাদের মনের উপর তা একদম চেপে বসে ছিল। কিন্তু আজ শুনছি, সে অতীত ভারতবর্ষের নয়, অপর দেশের। একথা শুনে আমরা সাহিত্যিকের দল বিশেষ ভীত হয়ে পড়েছি। কেননা, এতদিন আমরা এই অতীতের কালিতে কলম ডুবিয়ে বর্তমান সাহিত্য রচনা করছিলাম। এই অতীত নিয়ে, আমাদের ভিতর যাঁর অন্তরে বীররস আছে তিনি বাহ্বাস্ফোটন করতেন, যাঁর অন্তরে করণরস আছে তিনি ক্রন্দন করতেন, যাঁর অন্তরে হাস্যরস আছে তিনি পরিহাস করতেন, যাঁর অন্তরে শান্তরস আছে তিনি বৈরাগ্য প্রচার করতেন, আর যাঁর অন্তরে বীভৎসরস আছে তিনি কেলেংকারি করতেন। কিন্তু অতঃপর এই যদি প্রমাণ হয়ে যায় যে, ভারতবর্ষের অতীত আমাদের পৈতৃক ধন নয়, কিন্তু তা পরের তাহলে সে ধন নিয়ে সাহিত্যের বাজারে আমাদের আর পোন্দারি করা চলবে না। এককথায়, ইতিহাসের পক্ষে যা পোেষ-মাস, সাহিত্যের পক্ষে তা সর্বনাশ।

 

৩.

আমাদের এতকালের অতীত যে রাতারাতি হস্তান্তরিত হয়ে গেল, সেও আমাদের অতিবুদ্ধির দোষে। এ অতীত যতদিন সাহিত্যের অধিকারে ছিল, ততদিন কেউ তা আমাদের হাত ছাড়িয়ে নিতে পারে নি। কিন্তু সাহিত্যকে উচ্ছেদ করে বিজ্ঞান অতীতকে দখল করতে যাওয়াতেই আমরা ঐ অমূল্য বস্তু হারাতে বসেছি। সকলেই জানেন যে, ভারতবর্ষের অতীত থাকলেও তার ইতিহাস ছিল না। কাজেই এই অতীতের শাদা কাগজের উপর আমরা এতদিন স্বেচ্ছায় এবং স্বচ্ছন্দচিত্তে আমাদের মনোমত ইতিহাস লিখে যাচ্ছিলম। ইতিমধ্যে বাংলায় একদল বৈজ্ঞানিক জন্মগ্রহণ করে সে ইতিহাসকে উপন্যাস বলে হেসে উড়িয়ে দিয়ে এমন ইতিহাস রচনা করতে কৃতসংকল্প হলেন, যার ভিতর রসের লেশমাত্র থাকবে না থাকবে শুধু বহুতলতা। এরা আহেলা বিলেতি শিক্ষার মোহে একথা ভুলে গেলেন যে, অতীতে হিন্দুর প্রতিভা ইতিহাসে নয় পরাণে, বিজ্ঞানে নয় দর্শনে, ফুটে উঠেছিল। অতীতের মর্মগ্রহণ করে তার চর্ম গ্রহণ করতে যাওয়াতেই সে দেশত্যাগী হতে বাধ্য হল। এতে তাঁদের কোনো ক্ষতি নেই, মধ্যে থেকে সাহিত্য শুধু দেউলে হয়ে গেল। বিজ্ঞানের প্রদীপ যে সাহিত্যের লালবাতি— একথা কে না জানে।

 

৪.

আমরা সাহিত্যিকের দল অতীতকে আকাশ হিসেবে দেখতুম, অর্থাৎ আমাদের কাছে ও-বস্তু ছিল একটি অখণ্ড মহাশূন্য। সুতরাং সেই আকাশে আমরা কল্পনার সাহায্যে এমন-সব গিরি-পরী নির্মাণ করে চলেছিলুম, যার ত্রিসীমানার ভিতর বিজ্ঞানের গোলাগুলি পৌঁছয় না। বাংলার নবীন প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এ কার্যটি অকার্য বলেই স্থির হল; কেননা, বৈজ্ঞানিক-মতে ইতিহাস গড়বার জিনিসও নয়, পড়বার জিনিসও নয়— শুধু ঢোঁড়বার জিনিস। সুতরাং ও-জিনিসের অন্বেষণ পায়ের নীচে করতে হবে–মাথার উপরে নয়। যাঁরা আবিষ্কার করতে চান, তাঁদের কর্মক্ষেত্র ভূলোক, দ্যুলোক নয়; কেননা, আকাশদেশ তো স্বতঃআবিষ্কৃত।

এই কারণে, সক্রেটিস যেমন দর্শনকে আকাশ থেকে নামিয়ে মাটির উপরে এনে ফেলেছিলেন, আমাদের বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিকেরাও তেমনি ভারতবর্ষের ইতিহাসকে আকাশ থেকে পেড়ে মাটির নীচে পুতে ফেলেছেন।

 

৫.

এ দলের মতে ভারতবর্ষের অতীত পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হলেও পঞ্চভূতে মিশিয়ে যায় নি; কেননা, কাল অতীতের অগ্নিসৎকার করে না, শুধু তার গোর দেয়। এককথায়, অতীতের আত্মা স্বর্গে গমন করলেও তার দেহ পাতালে প্রবেশ করে। তাই ভারতবর্ষ ইতিহাসের মহাশ্মশান নয়, মহাগোরস্থান। অতএব ভারতবর্ষের কবর খুঁড়ে তার ইতিহাস বার করতে হবে এই জ্ঞান হওয়ামাত্র আমাদের দেশের যত বিদ্বান ও বুদ্ধিমান লোকে কোদাল পাড়তে শর করলেন এই আশায় যে, এদেশের উত্তরে দক্ষিণে পূর্বে পশ্চিমে, যেখানেই কোদাল মারা যাবে সেখানেই, লস্তসভ্যতার গুপ্তধন বেরিয়ে পড়বে। আর সে ধনে আমরা এমনি ধনী হয়ে উঠব যে, মনোজগতে খোরপোশের জন্য আমাদের আর চাষ-আবাদ করতে হবে না।

এই খোঁড়াখুঁড়ির ফলে, সোনা না হোক তামা বেরিয়েছে, হীরে না থাক পাথর বেরিয়েছে। কিন্তু এ যে-সে তামা যে-সে পাথর নয়— সব হরফ-কাটা। এইসব মদ্রাঙ্কিত তাম্রফলকের বিশেষ-কিছু, মূল্য নেই, তা পয়সারই মত শস্তা। একালেও আমরা শিল কুটি, কিন্তু সেই কোটা-শিল পড়া যায় না; কেননা, তার অক্ষর সব রেখাক্ষর। কিন্তু অতীতের এই ক্ষোদিত পাষাণের কথা স্বতন্ত্র। বিদ্যা বলেছিলেন–

‘শিলা জলে ভেসে যায়, বানরে সংগীত গায়,
দেখিলেও না হয় প্রত্যয়’

কিন্তু আজকাল যদি কেউ বলেন যে–

‘কপি জলে ভেসে যায়, পাষাণে সংগীত গায়,
দেখিলেও না হয় প্রত্যয়’

তাহলে তিনি অবিদ্যারই পরিচয় দেবেন। কেননা, আজকাল পাষাণের সংগীতে দেশ মাতিয়ে তুলেছে। অতীত আজ তার পাষাণ-বদনে তারস্বরে আত্মপরিচয় দিচ্ছে। কাগজের কথায় আমরা আর কান দিই নে। রামায়ণমহাভারত এখন উপন্যাস হয়ে পড়েছে, এবং ইতিহাস এখন বন্ধের শরণ গ্রহণ করেছে। তার কারণ, আমরা মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করেছি যে, যাকে আমরা হিসভ্যতা বলি সেটি একটি অর্বাচীন পদার্থ বৌদ্ধসভ্যতার পাকা বনিয়াদের উপরেই তা প্রতিষ্ঠিত। ভারতবর্ষের ইতিহাসের সর্বনিম্নস্তরে যা পাওয়া যায়, সে হচ্ছে বৌদ্ধধর্ম। ফলে, আমরা হিন্দু হলেও বৌদ্ধধর্ম নিয়েই গৌরব করছিলাম। তাই প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, পাটলিপুত্রই হচ্ছে আমাদের ইতিহাসের কেন্দ্রস্থল একাধারে জন্মভূমি এবং পীঠস্থান।

 

৬.

কথাসরিৎসাগরের প্রসাদে পাটলিপুত্রের জন্মকথা আমরা সকলেই জানতুম। এবং আমরা, কাব্যরসের রসিকেরা, সেই জন্মবত্তান্তই সাদরে গ্রাহ্য করে নিয়েছিলুম; কেননা, সেকথায় বস্তুতন্ত্রতা না থাকলেও রস আছে, তাও আবার একটি নয়, তিন-তিনটি–মধুর বীর এবং অদ্ভুত রস। পত্রকর্তৃক পাটলিহরণের বত্তান্ত, কৃষ্ণকর্তৃক রক্মিণীহরণ এবং অর্জনকর্তৃক সুভদ্রাহরণের চাইতেও অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। কৃষ্ণ প্রভৃতি রথে চড়ে স্থূলপথে পলায়ন করেছিলেন, কিন্তু পত্র পাটলিকে ক্রোড়স্থ ক’রে মায়া-পাকায় ভর দিয়ে নভেমার্গে উড্ডীন হয়েছিলেন। কৃষ্ণার্জন স্ব স্ব নগরীতে প্রস্থান করেছিলেন; পত্র কিন্তু তাঁর মায়া-যঠির সাহায্যে যে-পরী আকাশে নির্মাণ করেছিলেন সেই পুরী ভূমিষ্ঠ হয়ে পাটলিপুত্র নাম ধারণ করে। বৈজ্ঞানিকেরা কিন্তু যাদতে বিশ্বাস করেন না। সুতরাং বৈজ্ঞানিক মতে পাটলিপুত্রকে খনন করা অবশ্যকর্তব্য হয়ে পড়েছিল, এবং সে কর্তব্যও সম্প্রতি কার্যে পরিণত করা হয়েছে। খোঁড়া-জিনিসটের ভিতর একটা বিপদ আছে, কেননা, কোনো-কোনো স্থলে কেঁচো খুড়তে সাপ বেরোয়। এক্ষেত্রে হয়েছেও তাই।

ডক্টর স্পূনার নামক জনৈক প্রত্নতত্ত্বের কর্তাব্যক্তি এই ভূমধ্য-রাজধানী খনন করে আবিষ্কার করেছেন যে, এদেশের মাটি খুড়লে দেখা যায় যে তার নীচে ভারতবর্ষ নেই, আছে শুধু পারশ্য। Palimpsest-নামক একপ্রকার প্রাচীন পথি পাওয়া যায়, যার উপরে এক ভাষায় লেখা থাকে আর নীচে আরএক ভাষায়। বলা বাহুল্য, উপরে যা লেখা থাকে তা জাল, আর নীচে যা লেখা থাকে তাই আসল। ডক্টর স্পূনারের দিব্যদৃষ্টিতে এতকাল পরে ধরা পড়েছে যে, আমরা যাকে ভারতবর্ষের ইতিহাস বলি, সে হচ্ছে একটি বিরাট palimpsest; তার উপরে পালি কিংবা সংস্কৃতভাষায় যা লেখা আছে তা জাল, আর তার নীচে যা লেখা আছে তাই আসল। সে লেখা অবশ্য ফারসি; কেননা, আমরা কেউ তা পড়তে পারি নে। ডক্টর স্পূনারের কথা বৈজ্ঞানিকেরা মেনে না নিন, মান্য করতে বাধ্য; কেননা, সেকালের কাব্যের যাদুঘর হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু একালের যাদুঘরের কাব্যকে তা করা চলে না।

ডক্টর স্পূনার তাঁর নব-মত প্রতিষ্ঠা করবার জন্য নানা প্রমাণ, নানা অনুমান, নানা দর্শন, নানা নিদর্শন সংগ্রহ করেছেন। এসকলের মূল্য যে কি, তা নির্ণয় করা আমার সাধ্যের অতীত। এই পর্যন্ত বলতে পারি যে, তিনি এমন-একটি যুক্তি বাদ দিয়েছেন, যার আর কোনো খণ্ডন নেই। স্পূনার সাহেবের মতে যার নাম অসর তারই নাম দানব, এবং যার নাম দানব তারই নাম শক, এবং যার নাম শক তারই নাম পার্শি। একথা যদি সত্য হয়, তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে, এদেশের মাটি খুঁড়লে পাশি-শহর বেরিয়ে পড়তে বাধ্য। দানবপরী যে পাতালে অর্থাৎ মাটির নীচে অবস্থিত, একথা তো হিন্দুর সর্বশাস্ত্রসম্মত।

 

৭.

অতএব দাঁড়াল এই যে, আমাদের ভবিষ্যৎও নেই অতীতও নেই। এক বাকি থাকল বর্তমান। সুতরাং বঙ্গসাহিত্যকে এখন থেকে এই বর্তমান নিয়েই কারবার করতে হবে। এ অবশ্য মহা মুশকিলের কথা। বই পড়ে বই লেখা এক, আর নিজে বিশ্বসংসার দেখেশুনে লেখা আর। একাজ করতে হলে চোখকান খুলে রাখতে হবে, মনকে খাটাতে হবে; এককথায় সচেতন হতে হবে। তার পর এত কষ্ট স্বীকার করে যে সাহিত্য গড়তে হবে, সে সাহিত্য সকলে সহজে গ্রাহ্য করবেন না। মানুষে বর্তমানকেই সবচাইতে অগ্রাহ্য করে। যাঁদের চোখকান বোজা আর মন পঙ্গু, তাঁরা এই নবসাহিত্যকে নবীন বলে নিন্দা করবেন। তবে এর মধ্যে আরামের কথা এই যে, বর্তমানের কোনো ইতিহাস নেই, সুতরাং এখন হতে বঙ্গসরস্বতীর ঘাড় থেকে ভূত নেমে যাবে।

আষাঢ় ১৩২৩

প্রাণের কথা

প্রাণের কথা
ভবানীপরসাহিত্যসমিতিতেকথিত

এরকম সভার সভাপতির প্রধান কর্তব্য হচ্ছে প্রবন্ধপাঠকের গণগান করা, কিন্তু সে কর্তব্য পালন করা আমার পক্ষে উচিত হবে কি না সে বিষয়ে আমার বিশেষ সন্দেহ ছিল। প্রবন্ধপাঠক শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র ঘটক আমার বন্ধু, এবং সাহিত্যিকবন্ধ। কধর মুখে বন্ধুর প্রশংসা একালে ভদ্রসমাজে অভদ্রভা বলেই গণ্য। ইংরেজিতে যাকে বলে মিউঁচুয়াল অ্যাডমিরেশন, সে ব্যাপারটি আমরা নিতান্ত হাস্যকর মনে করি; অথচ এ কথাও সম্পূর্ণ সত্য যে, গুণানুরাগ উভয়পাক্ষিক না হলে কি প্রণয় কি বন্ধুত্ব কোনোটিই স্থায়ী হয় না। সে যাই হোক, বস্তৃতি সাহিত্যসমাজে যে নিষিদ্ধ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এবং যেহেতু আমি বর্তমান সাহিত্যসমাজের নানারূপ নিয়মভঙ্গের অপরাধে অপরাধী হয়ে আছি, সে কারণ আবার-একটা নূতন অপরাধে অভিযুক্ত হতে অপ্রবত্তি হওয়াটা আমার পক্ষে নিতান্তই স্বাভাবিক।

কিন্তু প্রবন্ধটি শুনে আমি প্রবন্ধলেখকের আর-কিছুর না হোক, সাহসের প্রশংসা না করে থাকতে পারছি নে। প্রবন্ধপাঠক মহাশয় যে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তা যুগপৎ সৎসাহস ও দুঃসাহস। এ পৃথিবীতে মানুষের পক্ষে যা সবচাইতে মূল্যবান অথচ দুর্বোধ্য—অর্থাৎ জীবন-ঘটকমহাশয় তারই উপর হস্তক্ষেপ করেছেন। এ অবশ্য দুঃসাহসের কাজ।

ঘটকমহাশয়ের প্রবন্ধের সার কথা এই যে, উপনিষদের সময় থেকে শুরু করে অদ্যাবধি নানা দেশের নানা দার্শনিক ও নানা বৈজ্ঞানিক জীবনসমস্যার আলোচনা করেছেন, কিন্তু কেউ তার চুড়ান্ত মীমাংসা করতে পারেন নি। আজ পর্যন্ত জীবনের এমন ভাষ্য কেউ করতে পারেন নি যার উপর আর টীকাটিপ্পনী চলে না।

আমার মনে হয় দর্শনবিজ্ঞানের এ নিষ্ফলতার কারণও স্পষ্ট। জীবন সম্বন্ধে পূর্ণজ্ঞান লাভ করবার পক্ষে প্রতি লোকের পক্ষে যে বাধা, সমগ্র মানবজাতির পক্ষেও সেই একই বাধা রয়েছে। জীবনসমস্যার চড়ান্ত মীমাংসা করবে মৃত্যু। মৃত্যুর অপর পারে আছে-হয় অনন্ত জীবন নয় অনন্ত মরণ, হয় অমরত্ব নয় নির্বাণ। এর কোনো অবস্থাতেই জীবনের আর কোনোই সমস্যা থাকবে না। যদি আমরা অমরত্ব লাভ করি তা হলে জীবন সম্বন্ধে আমাদের জানবার আর কিছু বাকি থাকবে না; অপর পক্ষে যদি নির্বাণ লাভ করি তো জানবার কেউ থাকবে না। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, সমগ্র মানবজাতি না মরা তর্ক এ সমস্যার শেষ মীমাংসা করতে পারবে না। আর যদি কোনোদিন পারে তা হলে সেই দিনই মানবজাতির মৃত্যু হবে; কেননা তখন আমাদের আর কিছু জানবার কিংবা করবার জিনিস অবশিষ্ট থাকবে না। মানুষের পক্ষে সর্বজ্ঞ হওয়ার অবশ্যম্ভাবী ফল নিষ্ক্রিয় হওয়া, অর্থাৎ মত হওয়া; কেননা প্রাণ বিশেষ্যও নয়, বিশেষণও নয়-ও একটি অসমাপিকা ক্রিয়া মাত্র।

জীবনটা একটা রহস্য বলেই মানুষের বেচে সখ। কিন্তু তাই বলে এ রহস্যের মর্ম উদঘাটন করবার চেষ্টা যে পাগলামি নয় তার প্রমাণ, মানুষ যুগে যুগে এ চেষ্টা করে এসেছে, এবং শতবার বিফল হয়েও অদ্যাবধি সে চেষ্টা থেকে বিরত হয় নি। পৃথিবীর মধ্যে যা সবচেয়ে বড়ো জিনিস তা জানবার ও বোঝবার প্রবৃত্তি মানুষের মন থেকে যে দিন চলে যাবে সে দিন মানুষ আবার পশুত্ব লাভ করবে। জীবনের যা-হয়-একটা অর্থ স্থির করে না নিলে মানুষে জীবনযাপন করতেই পারে না। এবং এ পদার্থের কে কি অর্থ করেন তার উপর তাঁর জীবনের মূল্য নির্ভর করে। এ কথা ব্যক্তির পক্ষেও যেমন সত্য জাতির পক্ষেও তেমনি সত্য। দর্শন-বিজ্ঞান জীবনের ঠিক অর্থ বার করতে পারুক আর না পারুক, এ সম্বন্ধে অনেক ভুল বিশ্বাস নষ্ট করতে পারে। এও বড়ো কম লাভের কথা নয়। সত্য না জানলেও মানুষের তেমন ক্ষতি নেই-মিথ্যাকে সত্য বলে ভুল করাই সকল সর্বনাশের মূল। সুতরাং প্রবন্ধলেখক এ আলোচনার পুনরোপন করে সৎসাহসেরই পরিচয় দিয়েছেন।

২.

সতীশবাবু তাঁর প্রবধে দেখিয়েছেন—এ বিষয়ে যে নানা মুনির নানা মত আছে শুধু তাই নয়, একইরকমের মত নানা যুগে নানা আকারে দেখা দেয়। দর্শনবিজ্ঞানের কাছে জীবনের সমস্যাটা কি, সেইটে বুঝলে সে সমস্যার মীমাংসাটাও যে মোটামুটি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। জীবন

পদার্থটিকে আমরা সকলেই চিনি, কেননা সেটিকে নিয়ে আমাদের নিতা কারবার করতে হয়। কিন্তু তার আদি ও অত আমাদের প্রত্যক্ষ নয়। সহজজ্ঞানের কাছে যা অপ্রত্যক্ষ, অনুমান-প্রমাণের দ্বারা তারই জ্ঞান লাভ করা হচ্ছে দর্শনবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য। জীবনের আদি অন্ত আমরা জানি নে, এই কথাটাকে ঘুরিয়ে দরকম ভাবে বলা যায়। এক, জীবনের আদিতে আছে জন্ম আর অন্তে মৃত্যু; আর-এক, জীবন অনাদি ও অনন্ত। জীবন সম্বন্ধে দার্শনিকতত্ত্ব হয় এর এক পক্ষ নয় আর-এক পক্ষ -ভুক্ত হয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, এ দুয়ের কোনো মীমাংসাতেই আমাদের জ্ঞান কিছুমাত্র এগোয় না; অর্থাৎ এ দুই তত্ত্বের যেটাই গ্রাহ্য কর না, যা আমাদের জানা তা সমান জানাই থেকে যায়, আর যা অজানা তাও সমান অজানা থেকে যায়। সুতরাং এরকম মীমাংসাতে যাঁদের মনস্তুষ্টি হয় না তাঁরা প্রথমে জীবনের উৎপত্তি ও পরে তার পরিণতির সন্ধানে অগ্রসর হন। মোটামুটি ধরতে গেলে এ কথা নিয়ে বলা যায় যে, প্রাণের উৎপত্তির সন্ধান করে বিজ্ঞান, আর পরিণতির সধান করে দর্শন।

এ কথা আমরা সকলেই জানি যে, আমাদের দেহও আছে মনও আছে, আর এ দুয়ের যোগাত্রের নাম প্রাণ। সুতরাং কেউ প্রমাণ করতে চান যে, প্রাণ দেহের বিকার; আর কেউ-বা প্রমাণ করতে চান যে, প্রাণ আত্মার বিকার। অর্থাৎ কারো মতে প্রাণ মূলত আধিভৌতিক, কারো মতে আধ্যাত্মিক। সুতরাং সকল দেশে সকল যুগে জড়বাদ ও আত্মবাদ পাশাপাশি দেখা দেয়—কালের গুণে কখনো এ মত, কখনো ও মত প্রবল হয়ে ওঠে; সে মতের গুণে নয়, যুগের গুণে। আমার বিশ্বাস একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যায় যে, জড়বাদ ও অধ্যাত্মবাদ মূলে একই মত। কেননা উভয় মতেই এমন-একটি নিত্য ও স্থির পদার্থের স্থাপনা করা হয়, যার আসলে কোনো স্থিরতা নেই।

অবশ্য এ দুই ছাড়া একটা তৃতীয় এবং মধ্য পন্থাও আছে, সে হচ্ছে প্রাণের স্বতন্ত্র সত্তা গ্রাহ্য করা। এই মাধ্যমিক মতের নাম ভাইটালিজম, এবং আমি নিজে এই মধ্যমতাবলম্বী। আমার বিশ্বাস, অপ্রাণ হতে প্রাণের উৎপত্তি প্রমাণ করবার সকল চেষ্টা বিফল হয়েছে। এর থেকে এ অনুমান করাও অসংগত হবে না যে, প্রাণ কখনো অপ্রাণে পরিণত হবে না। তার পর জড়, জীবন ও চৈতন্যের অন্তর্ভূত যদি এক-তত্ত্ব বার করতেই হয় তা হলে প্রাণকেই জগতের মূল পদার্থ বলে গ্রাহ্য করে নিয়ে আমরা বলতে পারি-জড় হচ্ছে প্রাণের বিরাম ও চৈতন্য তার পরিণাম। অর্থাৎ জড় প্রাণের সত অবস্থা, আর চৈতন্য তার জাগ্রত অবস্থা। এ পৃথিবীতে জড় জীব ও চৈতন্যের সমন্বয় একমাত্র মানুষেই হয়েছে। আমরা সকলেই জানি আমাদের দেহও আছে, প্রাণও আছে, মনও আছে। প্রাণকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞানের পক্ষে এক লক্ষে দেহ থেকে আত্মায় আরোহণ করা যেমন সম্ভব, দর্শনের পক্ষেও এক লক্ষে আত্মা থেকে দেহে অবরোহণ করাও তেমনি সম্ভব। জমান বৈজ্ঞানিক হেকেল এবং জর্মান দার্শনিক হেগেলের দর্শন আলোচনা করলে দেখা যায় যে, জড়বাদী পরমাণুর অন্তরে গোপনে জ্ঞান অনুপ্রবিষ্ট করে দেন এবং জ্ঞানবাদী জ্ঞানের অন্তরে গোপনে গতি সঞ্চারিত করে দেন। তার পর বাজিকর যেমন খালি মুঠোর ভিতর থেকে টাকা বার করে, এরাও তেমনি জড় থেকে মন এবং মন থেকে জড় বার করেন। এসব দার্শনিক-হাতসাফাইয়ের কাজ। আমাদের চোখে যে এদের বুজরুকি এক নজরে ধরা পড়ে না তার কারণ, সাজানো কথার মশক্তির বলে এরা আমাদের নজরবন্দী করে রেখে দেন। তবে দেহমনের প্রত্যয় যোগস্ত্রটি ছিন্ন করে মানুষে বুদ্ধিসূত্রে যে নূতন যোগ সাধন করে, তা টেকসই হয় না। দর্শনবিজ্ঞানের মনগড়া এই মধ্যপদলোপী সমাস চিরকালই বন্দুসমাসে পরিণত হয়।

৩.

প্রাণের এই স্বাতন্ত্র্য অবশ্য সকলে স্বীকার করেন না। শুধু তাই নয়, ভাইটালিজম, কথাটাও অনেকের কাছে কণশল। এর কারণও স্পষ্ট। ভাইটাল ফোর্স নামক একটি স্বতন্ত্র শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়ার অর্থ প্রাণের উৎপত্তির সধান ত্যাগ করা। এ জগতের সকল পদার্থ সকল ব্যাপারই যখন জড়জগতের কতকগুলি ছোটোবড়ো নিয়মের অধীন, তখন একমাত্র প্রাণই যে স্বাধনি এ কথা বিনা পরীক্ষায় বৈজ্ঞানিকের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। আপাতদৃষ্টিতে যা বিভিন্ন মূলত তা যে অভিন্ন, এই সত্য প্রমাণ করাই বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য। সুতরাং প্রাণ যে জড়শক্তিরই একটি বিশেষ পরিণাম, এটা প্রমাণ না করতে পারলে বিজ্ঞানের অকে একটা মস্ত বড়ো ফাঁক থেকে যায়। গত শতাব্দীতে ইউরোপের বৈজ্ঞানিক সমাজে এই ফাঁক বোজাবার বহু চেষ্টা হয়েছে; কিন্তু সুখের বিষয়ই বলন আর দুঃখের বিষয়ই বলন, সে চেষ্টা অদ্যাবধি সফল হয় নি। প্রাণ জড়জগতে লীন হতে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। পঞ্চভূতে মিলিয়ে যাওয়ার অর্থ যে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হওয়া, এ কথা কে না জানে?

আমার পূর্ববর্তী বা বলেছেন যে, ইউরোপ যা প্রমাণ করতে পারে নি বাংলা তা করেছে; অর্থাৎ তাঁর মতে আচার্য জগদীশচন্দ্র বস, হাতে-কলমে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, জড়ে ও জীবে কোনো প্রভেদ নেই। আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশের সর্বাগ্রগণ্য বিজ্ঞানাচার্য এ কথা কোথায়ও বলেন নি যে, জড়ে ও জীবে কোনো প্রভেদ নেই। আমার ধারণা, তিনি প্রাণের উৎপত্তি নয়, তার অভিব্যক্তি নির্ণয় করতে চেষ্টা করেছেন। কথাটা আর-একটু পরিষ্কার করা যাক। মানুষমাত্রই জানে যে, যেমন মানুষের ও পশুর প্রাণ আছে তেমনি উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। এমন-কি, ছোটো ছেলেরাও জানে যে, গাছপালা জন্মায় ও মরে। সুতরাং মানুষ পশু ও উদ্ভিদ, যে গুণে সমধর্মী সেই গুণের পরিচয় নেবার চেষ্টা বহনকাল থেকে চলে আসছে। ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত হয়েছিল যে, অ্যাসিমিলেশন এবং রিপ্রোডাকশন-এই দুই গুণে তিন শ্রেণীর প্রাণীই সমধর্মী। অর্থাৎ এতদিন আত্মরক্ষা ও বংশরক্ষার প্রবত্তি ও শক্তিই ছিল প্রাণের লীস্ট কমন মালটিপল-একালের কুলের বাংলায় যাকে বলে লসাগু।

আচার্য জগদীশচন্দ্র দেখিয়ে দিয়েছেন যে, এই দুই ছাড়া আরো অনেক বিষয়ে প্রাণীমাত্রেই সমধর্মী। তিনি যে সত্যের আবিষ্কার করেছেন সে হচ্ছে এই যে, প্রাণীমাত্রেই একই ব্যথার ব্যথী। উদ্ভিদের শিরায়-উপশিরায় বিদ্যুৎ সঞ্চার করে দিলে ও-বস্তু আমাদের মতোই সাড়া দেয়, অর্থাৎ তার দেহে স্বেদ কম্প মূর্ছা বেপথু প্রভৃতি সাত্ত্বিক ভাবের লক্ষণ সব ফুটে ওঠে। এক কথায়, আচার্য বসু উদ্ভিদজগতেও হৃদয়ের আবিষ্কার করেছেন, পূর্বাচার্যেরা উদর ও মিথুনত্বের সধান নিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন। বসুমহাশয় প্রাণের লসাগু-তে সন্তুষ্ট না থেকে তার গসাগু, অর্থাৎ গ্রেটেস্ট কমন মেজার -এর আবিষ্কারে ব্রতী হয়েছেন। যখন উদ্ভিদের হৃদয় আবিষ্কৃত হয়েছে তখন সম্ভবত কালে তার মস্তিষ্কও আবিষ্কৃত হবে। কিন্তু তাতে জড় ও জীবের ভেদ নষ্ট হবে না, কেননা জড়পদার্থের যখন উদরই নেই তখন তার অন্তরে হৃদয়-মস্তিকাদি থাকবার কোনোই সম্ভাবনা নেই। যে বস্তুর দেহে অন্নময় কোষ নেই, তার অন্তরে মনোময় কোষের দর্শনলাভ তাঁরাই করতে পারেন যাঁদের চোখে আকাশকুসুম ধরা পড়ে।

৪.

আমি বৈজ্ঞানিকও নই, দার্শনিকও নই; সুতরাং এতক্ষণ যে অনধিকারচর্চা করলাম, তার ভিতর চাই-কি কিছু সার নাও থাকতে পারে। কিন্তু জীবন জিনিসটে দার্শনিক বৈজ্ঞানিকের একচেটে নয়, ও-বস্তু আমাদের দেহেও আছে। সুতরাং প্রাণের সমস্যার মীমাংসা আমাদেরও করতে হবে, আর-কিছুর জন্য না হোক, শুধু প্রাণধারণ করবার জন্য। আমাদের পক্ষে জ্ঞাতব্য বিষয় হচ্ছে প্রাণের মূল্য, সুতরাং আমাদের সমস্যা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক-দার্শনিকের সমস্যার ঠিক বিপরীত। প্রাণীর সঙ্গে প্রাণীর অভেদজ্ঞান নয়, ভেদজ্ঞানের উপরেই আমাদের মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠিত। কেননা, যে গুণে প্রাণীজগতে মানুষ অসামান্য সেই গুণেই সে মানুষ।

উদ্ভিদ ও পশুর সঙ্গে কোন কোন গুণে ও লক্ষণে আমরা সমধর্মী, সে জ্ঞানের সাহায্যে আমরা মানবজীবনের মূল্য নির্ধারণ করতে পারি নে, কোন কোন ধর্মে আমরা ও-দই শ্রেণীর প্রাণী হতে বিভিন্ন, সেই বিশেষ জ্ঞানই আমাদের জীবনযাত্রার প্রধান সহায়; এবং এ জ্ঞান লাভ করবার জন্য আমাদের কোনোরূপ অনুমান-প্রমাণের দরকার নেই, প্রত্যক্ষই যথেষ্ট।

আমরা চোখ মেললেই দেখতে পাই যে, উদ্ভিদ মাটিতে শিকড় গেড়ে বসে আছে, তার চলৎশক্তি নেই। এক কথায় উদ্ভিদের প্রত্যক্ষ ধর্ম হচ্ছে স্থিতি।

তার পর দেখতে পাই, পশরা সর্বত্র বিচরণ করে বেড়াচ্ছে, অর্থাৎ তাদের প্রত্যক্ষ ধর্ম হচ্ছে গতি।

তার পর আসে মানুষ। যেহেতু আমরা পশু সে-কারণ আমাদের গতি তো আছেই, তার উপর আমাদের ভিতর মন নামক একটি পদার্থ আছে, যা পশর নেই। এক কথায় আমাদের প্রত্যক্ষ বিশেষ ধর্ম হচ্ছে মতি।

এ প্রভেদটার অন্তরে রয়েছে প্রাণের মুক্তির ধারাবাহিক ইতিহাস। উদ্ভিদের জীবন সবচাইতে গণ্ডীবদ্ধ, অর্থাৎ উদ্ভিদ, হচ্ছে বন্ধ জীব। পশু মাটির বন্ধন থেকে মুক্ত কিন্তু নৈসর্গিক স্বভাবের বন্ধনে আবদ্ধ, অর্থাৎ পশু বদ্ধমত্ত জীব। আমরা দেহ ও মনে না মাটির না স্বভাবের বন্ধনে আবদ্ধ, অতএব এ পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র মক জীব।

সুতরাং মনুষ্যত্ব রক্ষা করবার অর্থ হচ্ছে আমাদের দেহ ও মনের এই মুক্তভাব রক্ষা। আমাদের সকল চিন্তা সকল সাধনার ঐ একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। যে জীবন যত মক্ত, সে জীবন তত মুল্যবান। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না যে, মানুষের পক্ষে প্রাণীজগতে পশ্চাদপদ হওয়া সহজ। প্রাণের প্রতি মত অবস্থারই এমন-সব বিশেষ সুবিধা ও অসুবিধা আছে যা তার অপর মত অবস্থার নেই। উদ্ভিদ, নিশ্চল, অতএব তা পারিপার্শ্বিক অবস্থার একান্ত অধীন। প্রকৃতি যদি তাকে জল না জোগায় তো সে ঠায় দাঁড়িয়ে নির্জলা একাদশী করে শুকিয়ে মরতে বাধ্য। এই তার অসবিধা। অপর পক্ষে তার সুবিধা এই যে, তাকে আহার সংগ্রহ করবার জন্য কোনোরূপ পরিশ্রম করতে হয় না, সে আলো বাতাস মাটি জল থেকে নিজের আহার অক্লেশে প্রস্তুত করে নিতে পারে। পশুর গতি আছে, অতএব সে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সম্পূর্ণ অধীন নয়, সে এক দেশ ছেড়ে আর-এক দেশে চলে যেতে পারে। এইটকু তার সুবিধা। কিন্তু তার অসুবিধা এই যে, সে নিজগুণে জড়জগৎ থেকে নিজের খাবার তৈরি করে নিতে পারে না, তাকে তৈরি-খাবার অতিকষ্টে সংগ্রহ করে জীবনধারণ করতে হয়। পোষমানা জানোয়ারের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র, সে উদ্ভিদেরই শামিল; কেননা সে শিকড়বদ্ধ না হোক, শিকলবদ্ধ।

মানুষ পারিপার্শ্বিক অবস্থার অধীন হতে বাধ্য নয়; সে স্থানত্যাগ করতেও পারে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার বদল করেও নিতে পারে। একালের ভাষায় যাকে “বেষ্টনী’ বলে মানুষের পক্ষে তা গণ্ডী নয়, মানুষের স্থিতিগতি তার স্বেচ্ছাধীন। এই তার সুবিধা। তার অসুবিধা এই যে, তাকে জীবনধারণ করবার জন্য শরীর ও মন দুই খাটাতে হয়। পশকেও শরীর খাটাতে হয়, মন খাটাতে হয় না; উদ্ভিদকে শরীর মন দুয়ের কোনোটিই খাটাতে হয় না। অর্থাৎ উদ্ভিদের জীবন সবচাইতে আরামের। পশুর শরীরের আরাম না থাক, মনের আরাম আছে। মানুষের শরীর-মন দুয়ের কোনোটিরই আরাম নেই। আমরা যদি মনের আরামের জন্য লালায়িত হই তা হলে আমরা পশুকে আদর্শ করে তুলব; আর যদি দেহমন দয়ের আরামের জন্য লালায়িত হই তা হলে আমরা উদ্ভিদকে আদর্শ করে তুলব, এবং সেই আদর্শ অনুসারে নিজের জীবন গঠন করতে চেষ্টা করব। এ চেষ্টার ফলে আমরা শুধু মনুষ্যত্ব হারিয়ে বসব। ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরোধর্ম ভয়াবহঃ’ এই সনাতন সত্যটি মানুষের সর্বদা স্মরণ রাখা কর্তব্য, নচেৎ মানবজীবন রক্ষ করা অসম্ভব। আর-একটি কথা, মানুষের পক্ষে জীবন রক্ষা করার অর্থ জীবনের উন্নতি করা। মানুষের ভিতরে-বাইরে যে গতিশক্তি আছে, তা মানুষের মতির দ্বারা নিয়মিত ও চালিত। এই মতিগতির শুভপরিণয়ের ফলে যা জন্মলাভ করে তারই নাম উন্নতি। আমাদের মনের অর্থাৎ বুদ্ধি ও হৃদয়ের উৎকর্ষ সাধনেই আমরা মানবজীবনের সার্থকতা লাভ করি। জীবনকে সম্পূর্ণ জাগ্রত করে তোল ছাড়া আয়, বৃদ্ধির অপর কোনো অর্থ নেই।

শ্রাবণ ১৩২৪

ফাল্গুন

ফাল্গুন

আমাদের দেশে কিছুরই হঠাৎ বদল হয় না, ঋতুরও নয়। বর্ষা কেবল কখনো-কখনো বিনা-নোটিশে একেবারে হড়ম করে এসে গ্রীষ্মের রাজ্য জবরদখল করে নেয়। ও ঋতুর চরিত্র কিন্তু আমাদের দেশের ধাতের সঙ্গে মেলে না। প্রাচীন কবিরা বলে গেছেন, বর্ষা আসে দিগ্বিজয়ী যোদ্ধার মত আকাশে জয়ঢাক বাজিয়ে, বিদ্যতের নিশান উড়িয়ে, অজস্র বরণাস্ত্র বর্ষণ করে, এবং দেখতে-না-দেখতে আসমুদ্রহিমালয় সমগ্র দেশটার উপর একছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। এক বর্ষাকে বাদ দিলে, বাকি পাঁচটা ঋতু যে ঠিক কবে আসে আর কবে যায়, তা এক জ্যোতিষী ছাড়া আর-কেউ বলতে পারেন না। আমাদের ছয় রাগের মধ্যে এক মেঘ ছাড়া আর-পাঁচটি যেমন এক সুর থেকে আর-একটিতে বেমালুমভাবে গড়িয়ে যায় আমাদের স্বদেশী পঞ্চঋতুও তেমনি ভূমিষ্ঠ হয় গোপনে, ক্ৰমবিকশিত হয় অলক্ষিতে, ক্রমবিলীন হয় পরঋতুতে।

ইউরোপ কিন্তু ক্রমবিকাশের জগৎ নয়। সেদেশের প্রকৃতি লাফিয়ে চলে, এক ঋতু থেকে আর-এক ঋতুতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বছরে চার বার নবকলেবর ধারণ করে, নবমতিতে দেখা দেয়। তাদের প্রতিটির রূপ যেমন স্বতন্ত্র তেমনি স্পষ্ট। যাঁর চোখ আছে তিনিই দেখতে পান যে, বিলেতের চারটি ঋতু চতুর্বর্ণ। মৃত্যুর পশে বহু যে এক হয়, আর প্রাণের স্পর্শে এক যে বহু হয়, এ সত্য সেদেশে প্রত্যক্ষ করা যায়। সেখানে শীতের রং তুষার-গৌর, সকল বর্ণের সমষ্টি; আর বসন্তের রং ইন্দ্রধনুর, সকল বর্ণের ব্যষ্টি। তার পর নিদাঘের রং ঘন-সবুজ, আর শরতের গাঢ়-বেগনি। বিলেতি ঋতুর চেহারা শুধু; আলাদা নয়, তাদের আসা-যাওয়ার ভগিও বিভিন্ন।

সেদেশে বসন্ত শীতের শব-শীতল কোল থেকে রাতারাতি গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে, মহাদেবের যোগভঙ্গ করবার জন্য মদন-সখা বসন্ত যেভাবে একদিন অকস্মাৎ হিমাচলে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কোনো-এক সুপ্রভাতে ঘুম ভেঙে চোখ মেলে হঠাৎ দেখা যায় যে, রাজ্যির গাছ মাথায় একরাশ ফল প’রে দাঁড়িয়ে হাসছে; অথচ তাদের পরনে একটিও পাতা নেই। সে রাজ্যে বসন্তরাজ তাঁর আগমনবার্তা আকাশের নীল পত্রে সাতরঙা ফলের হরফে এমন স্পষ্ট এমন উজ্জ্বল করে ছাপিয়ে দেন যে, সে বিজ্ঞাপন মানুষের কথা ছেড়ে দিন–পশপেক্ষীরও চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না।

ইউরোপের প্রকৃতির যেমন ক্রমবিকাশ নেই, তেমনি ক্রমবিলয়ও নেই; শরৎও সেদেশে কালক্রমে জরাজীর্ণ হয়ে অলক্ষিতে শিশিরের কোলে দেহত্যাগ করে না। সেদেশে শরৎ তার শেষ-উইল পাণ্ডুলিপিতে নয়— রক্তাক্ষরে লিখে রেখে যায়; কেননা, মৃত্যুর পশে তার পিত্ত নয়–রক্ত প্রকুপিত হয়ে ওঠে। প্রদীপ যেমন নেভবার আগে জলে ওঠে, শরতের তাম্রপত্রও তেমনি ঝরবার আগে অগ্নিবর্ণ হয়ে ওঠে। তখন দেখতে মনে হয়, অস্পৃশ্য শত্রর নির্মম আলিঙ্গন হতে আত্মরক্ষা করবার জন্য প্রকৃতিসন্দরী যেন রাজপুত রমণীর মত স্বহস্তে চিতা রচনা করে সোল্লাসে অগ্নিপ্রবেশ করছেন।

 

২.

এদেশে ঋতুর গমনাগমনটি অলক্ষিত হলেও তার পূর্ণাবতারটি ইতিপূর্বে আমাদের নয়নগোচর হত। কিন্তু আজ যে ফাগুনমাসের পনেরো তারিখ, এ সুখবর পাঁজি না দেখলে জানতে পেতুম না। চোখের সম্মুখে যা দেখছি তা বসন্তের চেহারা নয়, একটা মিশ্রঋতুর শীত ও বর্ষার যুগলমতি। আর এদের পরস্পরের মধ্যে পালায়-পালায় চলছে সন্ধি ও বিগ্রহ। আমাদের এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশেও শীত ও বর্ষার দাম্পত্যবন্ধন এভাবে চিরস্থায়ী হওয়াটা আমার মতে মোটেই ইচ্ছনীয় নয়। কেননা, এহেন অসবর্ণ-বিবাহের ফলে শুধু সংকীর্ণবর্ণ দিবানিশার জন্ম হবে।

এই ব্যাপার দেখে আমার মনে ভয় হয় যে, হয়ত বসন্ত ঋতুর খাতা থেকে নাম কাটিয়ে চিরদিনের মত এদেশ থেকে সরে পড়ল। এ পৃথিবীটি অতিশয় প্রাচীন হয়ে পড়েছে; হয়ত সেই কারণে বসন্ত এটিকে ত্যাগ করে এই বিশ্বের এমন-কোনো নবীন পৃথিবীতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে ফলের গন্ধে পত্রের বর্ণে পাখির গানে বায়ুর স্পর্শে আজও নরনারীর হদয় আনন্দে আকুল হয়ে ওঠে।

আমরা আমাদের জীবনটা এমন দৈনিক করে তুলেছি যে, ঋতুর কথা দরে যাক, মাস-পক্ষের বিভাগটারও আমাদের কাছে কোনো প্রভেদ নেই। আমাদের কাছে শীতের দিনও কাজের দিন, বসন্তের দিনও তাই; এবং অমাবস্যাও ঘমবার রাত, পণিমাও তাই। যে জাত মনের আপিস কামাই করতে জানে না, তার কাছে বসন্তের অস্তিত্বের কোনো অর্থ নেই, কোনো সার্থকতা নেই বরং ও একটা অনর্থেরই মধ্যে; কেননা, ও-ঋতুর ধর্মই হচ্ছে মানুষের মন-ভোলানো, তার কাজ-ভোলানো। আর আমরা সব ভুলতে সব ছাড়তে রাজি আছি, এক কাজ ছাড়া; কেননা, অর্থ যদি কোথায়ও থাকে তো ঐ কাজেই আছে। বসন্তে প্রকৃতিসুন্দরী নেপথ্যবিধান করেন; সে সাজগোজ দেখবার যদি কোনো চোখ থাকে, তাহলে কার জন্যই-বা নবীন পাতার রঙিন শাড়ি পরা, কার জন্যই-বা ফলের অলংকার ধারণ, আর কার জন্যই-বা তরুণ আলোর অরুণ হাসি হাসা? তার চাইতে চোখের জল ফেলা ভালো। অর্থাৎ এ অবস্থায় শীতের পাশে বর্ষাই মানায় ভালো। শুনতে পাই, কোনো ইউরোপীয় দার্শনিক আবিষ্কার করেছেন যে, মানবসভ্যতার তিনটি স্তর আছে। প্রথম আসে শ্রুতির যুগ, তার পর দর্শনের, তার পর বিজ্ঞানের। একথা যদি সত্য হয় তো আমরা, বাঙালিরা, আর-যেখানেই থাকি, মধ্যযুগে নেই; আমাদের বর্তমান-অবস্থা হয় সভ্যতার প্রথম-অবস্থা, নয় শেষ-অবস্থা। আমাদের এ যুগে যে দর্শনের যুগ নয়, তার প্রমাণ— আমরা চোখে কিছুই দেখি নে; কিন্তু হয় সবই জানি, নয় সবই শনি। এ অবস্থায় প্রকৃতি যে আমাদের প্রতি অভিমান করে তাঁর বাসন্তী-মতি লুকিয়ে ফেলবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি।

 

৩.

আমি এইমাত্র বলেছি যে, এ যুগে আমরা হয় সব জানি, নয় সব শুনি। কিন্তু সত্যকথা এই যে, আমরা একালে যা-কিছু জানি সেসব শুনেই জানি–অর্থাৎ দেখে কিংবা ঠেকে নয়; তার কারণ, আমাদের কোনো কিছু দেখবার আকাঙ্ক্ষা নেই— আর সব-তাতেই ঠেকবার আশঙ্কা আছে।

এই বসন্তের কথাটাও আমাদের শোনা-কথা ও একটা গুজবমাত্র। বসন্তের সাক্ষাৎ আমরা কাব্যের পাকা-খাতার ভিতর পাই, গাছের কচি-পাতার ভিতর নয়। আর বইয়ে যে বসন্তের বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায় তা কস্মিনকালেও এ ভূভারতে ছিল কি না, সেবিষয়ে সন্দেহ করবার বৈধ কারণ আছে।

গীতগোবিন্দে জয়দেব বসন্তের যে রূপবর্ণনা করেছেন, সে রূপ বাংলার কেউ কখনো দেখে নি। প্রথমত, মলয়সমীরণ যদি সোজাপথে সিধে বয়, তাহলে বাংলাদেশের পায়ের নীচে দিয়ে চলে যাবে, তার গায়ে লাগবে না। আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেই নেওয়া যায় যে, সে বাতাস উদভ্রান্ত হয়ে, অর্থাৎ পথ ভুলে, বঙ্গভূমির গায়েই এসে ঢলে পড়ে, তাহলেও লবঙ্গলতাকে তা কখনোই পরিশীলিত করতে পারে না। তার কারণ, লবঙ্গ গাছে ফলে কি লতায় ঝোলে, তা আমাদের কারও জানা নেই। আর হোক-না সে লতা, তার এদেশে দোদুল্যমান হবার কোনোই সম্ভাবনা নেই এবং ছিল না। সংস্কৃত আলংকারিকেরা কাবেরীতীরে কালাগুরতর’র উল্লেখে ঘোরতর আপত্তি করেছেন, কেননা ও বাক্যটি যতই শ্রুতিমধুর হোক না কেন প্রকৃত নয়। কাবেরীতীরে যে কালাগরতর কালেভদ্রেও জন্মাতে পারে না, একথা জোর করে আমরা বলতে পারি নে; অপরপক্ষে, অজয়ের তীরে লবঙ্গলতার আবভ এবং প্রাদুর্ভাব যে একেবারেই অসম্ভব, সেকথা বঙ্গভূমির বীরভূমির সঙ্গে যাঁর চাক্ষুষ পরিচয় আছে তিনিই জানেন। ঐ এক উদাহরণ থেকেই অনুমান, এমনকি প্রমাণ পর্যন্ত, করা যায় যে, জয়দেবের বসন্তবর্ণনা কাল্পনিক অর্থাৎ শাদাভাষায় যাকে বলে অলীক। যার প্রথম কথাই মিথ্যে, তার কোনো কথায় বিশ্বাস করা যায় না; অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, এই কবিবর্ণিত বসত আগাগোড়া মন-গড়া।

জয়দেব যখন নিজের চোখে দেখে বর্ণনা করেন নি, তখন তিনি অবশ্য তাঁর পূর্বেবতী কবিদের বই থেকে বসন্তের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন; এবং কবিপরম্পরায় আমরাও তাই করে আসছি। সুতরাং এ সন্দেহ স্বতঃই মনে উদয় হয় যে, বসন্তঋতু একটা কবিপ্রসিদ্ধিমাত্র; ও বস্তুর বাস্তবিক কোনো অস্তিত্ব নেই। রমণীর পদতাড়নার অপেক্ষা না রেখে অশোক যে ফল ফোটায়, তার গায়ে যে আলতার রং দেখা দেয়, এবং ললনাদের মুখমদ্যসিক্ত না হলেও বকুলফলের মুখে যে মদের গন্ধ পাওয়া যায়–একথা আমরা সকলেই জানি। এ দুটি কবিপ্রসিদ্ধির মূলে আছে মানুষের ঔচিত্য-জ্ঞান। প্রকৃতির যথার্থ কার্যকারণের সন্ধান পেলেই বৈজ্ঞানিক কৃতার্থ হন; কিন্তু কবি কল্পনা করেন তাই, যা হওয়া উচিত ছিল। কবির উক্তি হচ্ছে প্রকৃতির যুক্তির প্রতিবাদ। কবি চান সুন্দর, প্রকৃতি দেন তার বদলে সত্য। একজন ইংরেজ কবি বলেছেন যে, সত্য ও সুন্দর একই বস্তু কিন্তু সে শুধু বৈজ্ঞানিকদের মুখ বন্ধ করবার জন্য। তাঁর মনের কথা এই যে, যা সত্য তা অবশ্য সুন্দর নয়, কিন্তু যা সুন্দর তা অবশ্যই সত্য–অর্থাৎ তার সত্য হওয়া উচিত ছিল। তাই আমার মনে হয় যে, পৃথিবীতে বসন্তঋতু থাকা উচিত— এই ধারণাবশত সেকালের কবিরা কল্পনাবলে উক্ত ঋতুর সৃষ্টি করেছেন। বসন্তের সকল উপাদানই তাঁরা মন-অঙ্কে সংগ্রহ করে প্রকৃতির গায়ে তা বসিয়ে দিয়েছেন।

 

৪.

আমার এ অনুমানের স্পষ্ট প্রমাণ সংস্কৃতকাব্যে পাওয়া যায়, কেননা পরাকালে কবিরা সকলেই স্পষ্টবাদী ছিলেন। সেকালে তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে, সকল সত্যই বক্তব্য— সে সত্য মনেরই হোক আর দেহেরই হোক। অবশ্য একালের রচির সঙ্গে সেকালের রুচির কোনো মিল নেই; সেকালে সুরুচির পরিচয় ছিল কথা ভালো করে বলায়, একালে ও-গুণের পরিচয় চুপ করে থাকায়। নীরবতা যে কবির ধর্ম, এ জ্ঞান সেকালে জন্মে নি। সুতরাং দেখা যাক, তাঁদের কাব্য থেকে বসন্তের জন্মকথা উদ্ধার করা যায় কি না।

সংস্কৃত-মতে বসন্ত মদন-সখা। মনসিজের দর্শনলাভের জন্য মানুষকে প্রকৃতির দ্বারস্থ হতে হয় না। কেননা, মন যার জন্মস্থান, তার সাক্ষাৎ মনেই মেলে।

ও-বস্তুর আবির্ভাবের সঙ্গেসঙ্গেই মনের দেশের অপব রুপান্তর ঘটে। তখন সে রাজ্যে ফুল ফোটে, পাখি ডাকে, আকাশ-বাতাস বর্ণে-গন্ধে ভরপুর হয়ে ওঠে। মানুষের স্বভাবই এই যে, সে বাইরের বস্তুকে অন্তরে আর অন্তরের বস্তুকে বাইরে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই ভিতর-বাইরের সমন্বয় করাটাই হচ্ছে আত্মার ধম। সুতরাং মনসিজের প্রভাবে মানুষের মনে যে রূপরাজ্যের সৃষ্টি হয়, তারই প্রতিমূর্তিস্বরূপে বসন্তঋতু কম্পিত হয়েছে; আসলে ও-ঋতুর কোনো অস্তিত্ব নেই। এর একটি অকাট্য প্রমাণ আছে। যে শক্তির বলে মনোরাজ্যের এমন রপান্তর ঘটে, সে হচ্ছে যৌবনের শক্তি। তাই আমরা বসন্তকে প্রকৃতির যৌবনকাল বলি, অথচ একথা আমরা কেউ ভাবি নে যে, জন্মাবামাত্র যৌবন কারও দেহ আশ্রয় করে না; অথচ পয়লা ফান যে বসন্তের জন্মতিথি, একথা আমরা সকলেই জানি। অতএব দাঁড়াল এই যে, বসন্ত প্রকৃতির রাজ্যে একটা আরোপিত ঋতু।

আমার এসব যুক্তি যদিও সুযুক্তি না হয়, তাহলেও আমাদের মেনে নিতে হবে যে বসন্ত মানুষের মনঃকল্পিত; নচেৎ আমাদের স্বীকার করতে হয় যে, বসন্ত ও মনোজ উভয়ে সমধর্মী হলেও উভয়েরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। বলা বাহুল্য, একথা মানার অর্থ সংস্কৃতে যাকে বলে দ্বৈতবাদ এবং ইংরেজিতে প্যারালালিজম–সেই বাতিল দর্শনকে গ্রাহ্য করা। সে তো অসম্ভব। অবশ্য অনেকে বলতে পারেন যে, বসন্তের অস্তিত্বই প্রকৃত এবং তার প্রভাবেই মানুষের মনের যে বিকার উপস্থিত হয়, তারই নাম মনসিজ। এ তো পাকা জড়বাদ, অতএব বিনা বিচারে অগ্রাহ্য।

আমার শেষকথা এই যে, এ পৃথিবীতে বসন্তের যখন কোনোকালে অস্তিত্ব ছিল না, তখন সে অস্তিত্বের কোনোকালে লোপ হতে পারে না। আমরা ও-বস্তু যদি হারাই তবে সে আমাদের অমনোযোগের দরন। যে জিনিস মানুষের মন-গড়া, তা মানুষের মন দিয়েই খাড়া রাখতে হয়। পর্ব-কবিরা কায়মনোবাক্যে যে রুপের-ঋতু গড়ে তুলেছেন, সেটিকে হেলায় হারানো বুদ্ধির কাজ নয়। সুতরাং বৈজ্ঞানিকেরা যখন বস্তুগত্যা প্রকৃতিকে মানুষের দাসী করেছেন, তখন কবিদের কর্তব্য হচ্ছে কল্পনার সাহায্যে তাঁর দেবীত্ব রক্ষা করা। এবং এ উদ্দেশ্য সাধন করতে হলে তাঁর মতির পূজা করতে হবে; কেননা, পুজা না পেলে দেবদেবীরা যে অন্তর্ধান হন, এ সত্য তো ভুবনবিখ্যাত। দেবতা যে মন্ত্ৰাত্মক। আর এ পূজা যে অবশ্যকর্তব্য তার কারণ, বসন্ত যদি অতঃপর আমাদের অন্তরে লাট খেয়ে যায়, তাহলে সরস্বতীর সেবকেরা নিশ্চয়ই স্ফীত হয়ে উঠবে, তাতে করে বঙ্গসাহিত্যের জীবনসংশয় ঘটতে পারে। এস্থলে সাহিত্যসমাজকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, একালে আমরা যাকে সরস্বতী পুজা বলি, আদিতে তা ছিল বসন্তোৎসব।

চৈত্র ১৩২৩

বর্ষা

এমন দিনে কি লিখতে মন যায়?

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি যে, যে দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় সমগ্র আকাশ বর্ষায় ভরে গিয়েছে। মাথার উপর থেকে অবিরাম অবিরল অবিচ্ছিন্ন বৃষ্টির ধারা পড়ছে। সে ধারা এত সক্ষম নয় যে চোখ এড়িয়ে যায়, অথচ এত খুলও নয় যে তা চোখ জুড়ে থাকে। আর কানে আসছে তার একটানা আওয়াজ; সে আওয়াজ কখনো মনে হয় নদীর কুলুনি, কখনো মনে হয় তা পাতার মর্মর। আসলে তা একসঙ্গে ও-ইই; কেননা আজকের দিনে জলের ঘর ও বাতাসের ঘর দুই মিলে-মিশে এক সুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমন দিনে মানুষ যে অন্যমনস্ক হয় তার কারণ তার সকল মন তার চোখ আর কানে এসে ভর করে। আমাদের এই চোখ-পোড়ানো আলোর দেশে বর্ষার আকাশ আমাদের চোখে কি যে অপূর্ব মিথ প্রলেপ মাখিয়ে দেয় তা বাঙালি মাত্রেই জানে। আজকের আকাশ দেখে মনে হয়, ছায়ার রঙের কোনো পাখির পালক দিয়ে বর্ষা তাকে আগাগোড়া মুড়িয়ে দিয়েছে, তাই তার স্পর্শ আমাদের চোখের কাছে এত নরম, এত মোলায়েম।

তার পর চেয়ে দেখি গাছপালা মাঠঘাট সবারই ভিতর যেন একটা নতুন প্রাণের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। সে প্রাণের আনন্দে নারকেল গাছগুলো সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলছে, আর তাদের মাথার ঝাঁকড়া চুল কখনো-বা এলিয়ে পড়ছে, কখনো-বা জড়িয়ে যাচ্ছে। আর পাতার চাপে যে-সব গাছের ডাল দেখা যায় না, সে-সব গাছের পাতার দল এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছে, পরস্পর কোলাকুলি করছে; কখনো-বা বাতাসের স্পর্শে বেঁকে-চুরে এমন আকার ধারণ করছে যে দেখলে মনে হয় বক্ষলতা সব পত্রপুটে ফটিকজল পান করছে। আর এই খামখেয়ালি বাতাস নিজের খুশিমত একবার পাঁচ মিনিটের জন্য লতা-পাতাকে নাচিয়ে দিয়ে বৃষ্টির ধারাকে ছড়িয়ে দিয়ে আবার থেমে যাচ্ছে। তার পর আবার সে ফিরে এসে যা ক্ষণকালের জন্য স্থির ছিল তাকে আবার ছুয়ে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, সে যেন জানে যে তার স্পর্শে যা-কিছু জীবন্ত অথচ শান্ত সে সবই প্রথমে কেপে উঠবে, তার পর ব্যতিব্যস্ত হবে, তার পর মাথা নাড়বে, তার পর হাত-পা ছুড়বে; আর জলের গায়ে ফটবে পলক আর তার মুখে শীৎকার। বৃষ্টির সঙ্গে বক্ষপল্লবের সঙ্গে সমীরণের এই লুকোচুরি খেলা, আমি চোখ ভরে দেখছি আর কান পেতে পেতে শুনেছি। মনের ভিতর আমার এখন আর কোনো ভাবনাচিন্তা নেই, আছে শুধু এমন-একটা অনুভূতি যার কোনো স্পষ্ট রূপ নেই, কোনো নির্দিষ্ট নাম নেই।

মনের এমন বিক্ষিত অবস্থায় কি লেখা যায়? যদি যায় তো সে কবিতা, প্রবন্ধ নয়।

আনন্দে-বিষাদে মেশানো ঐ অনামিক অনুভূতির জমির উপর অনেক ছোটোখাটো ভাব মুহূর্তের জন্য ফুটে উঠছে আবার মহতেই তা মিলিয়ে যাচ্ছে। এই বর্ষার দিনে কত গানের সুর আমার কানের কাছে গনগন করছে, কত কবিতার শ্লোক, কখনো পুরোপুরি কখনো আধখানা হয়ে, আমার মনের ভিতর ঘরে বেড়াচ্ছে। আজকে আমি ইংরেজি ভুলে গিয়েছি। যে-সব কবিতা যে-সব গান আজ আমার মনে পড়ছে সে-সবই হয় সংস্কৃত, নয় বাংলা, নয় হিন্দি।

মেঘৈর্মেদুরম্বরং বনভূবশ্যামাস্তমালদ্রুমৈ

গীতগোবিন্দের এই প্রথম চরণ যে বাঙালি একবার শুনেছে চিরজীবন সে আর তা ভুলতে পারবে না। আকাশে ঘনঘটা হলেই তার কানে ও-চরণ আপনা হতেই বাজতে থাকবে। সেইসঙ্গে মনে পড়ে যাবে মনের কত পুরনো কথা, কত লুকানো ব্যথা। আমি ভাবছি মানুষ ভাষায় তার মনের কথা কত অল্প ব্যক্ত করে, আর কত বেশি অব্যক্ত রয়ে যায়। ভাষায় মনোভাব ব্যক্ত করবার জন্যই যাঁরা এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁরাও, অর্থাৎ কবির দলও, আমার বিশ্বাস, তাঁদের মনকে অর্ধেক প্রকাশ করেছেন, অর্ধেক গোপন রেখেছেন। আজকের দিনে রবীন্দ্র। নাথের একটি পুরনো গানের প্রথম ছত্রটি ঘরে ফিরে ক্রমান্বয়ে আমার কানে আসছে–এমন দিনে তারে বলা যায়। এমন দিনে যা বলা যায় তা হয়তো রবীন্দ্রনাথও আজ পর্যন্ত বলেন নি, শেকসপীয়রও বলেন নি। বলেন যে নি, সে ভালোই করেছেন। কবি যা ব্যক্ত করেন তার ভিতর যদি এই অব্যক্তের ইঙ্গিত না থাকে তা হলে তাঁর কবিতার ভিতর কোনো mystery থাকে না, আর যে কথার ভিতর mystery নেই, তা কবিতা নয়—পদ্য হতে পারে।

সে যাই হোক, আজ আমার কানে শুধু রবীন্দ্রনাথের গানের সুর লেগে নেই, সেইসঙ্গে তিনি বর্ষার যে অসংখ্য ছবি এঁকেছেন সেই-সব চিত্র বায়োস্কোপের ছবির মতো আমার চোখের সমুখ দিয়ে একটির পর আর-একটি চলে যাচ্ছে। ভালো কথা— এটা কখনো ভেবে দেখেছেন যে, বাংলার বর্ষা রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার কবেছেন, ও-ঋতুর রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শে রবীন্দ্রনাথের ভারতী ভরপর, তার ভীমমতি আর তার কান্তমতি’, দুইই তাঁর চোখে ধরা পড়েছে, দুইই তাঁর ভাষায় সমান সাকার হয়ে উঠেছে? নবাবি আমলের বাঙালি কবিরা এ ঋতুকে হয় উপেক্ষা করেছেন, নয় তাকে তেমন আমল দেন নি। চণ্ডীদাসের কবিতায় কি বর্ষার স্থান আছে। আমার তো তা মনে হয় না। হয়তো বীরভূমে সেকালে বৃষ্টি হত না, তাই তিনি ও-ঋতুর বর্ণনা করেন নি। বাকি বৈষ্ণব কবিরাও এ বিষয়ে একরূপ নীরব। অবশ্য ঝড়বৃষ্টি না হলে অভিসার করা চলে না, সুতরাং অভিসারের খাতিরে তাঁদের কাব্যেও মেঘ-বজ্রবিদ্যতের একটু-আধটু চেহারা দেখাতে হয়েছে; অর্থাৎ ও-ক্ষেত্রে বর্ষা এসেছে নিতান্ত আনুষঙ্গিক ভাবে। অবশ্য এ বিষয়ে সেকালের একটা কবিতা আছে যা একাই একশো—

রজনী শাঙন ঘন ঘন দেয়া গরজন
রিমিঝিমি শবদে বরিষে।
পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে বিগলিত চীর অঙ্গে
নিন্দ যাই মনের হরিষে।।

সংগীত হিসেবে এ কবিতা গীতগোবিন্দের তুল্য। আর কাব্য হিসেবে তার অপেক্ষা শতগুণে শ্রেষ্ঠ।

এখন আমার কথা এই যে, আজ আমার মনের ভিতর দিয়ে যে-সব কথা আনাগোনা করছে সে-সব এতই বিচ্ছিন্ন এতই এলোমলো যে, সে-সব যদি ভাষায় ধরে তার পর লেখায় পরে দেওয়া যায় তা হলে আমার প্রবন্ধ এতই বিশৃঙ্খল হবে যে, পাঠক তার মধ্যে ভাবের গোলকধাঁধায় পড়ে যাবেন। বাইরের ল অ্যাণ্ড অর্ডারকে আমরা যতই বিদ্রূপ করি, ভাবের ল অ্যান্ড অর্ডারকে না মান্য করে আমরা সাহিত্য তো মাথায় থাক, সংবাদপত্রও লিখতে পারি নে। আর যদি এমন পাঠকও থাকেন যিনি বাংলাদেশের ছেলেভুলানো ছড়া-পাঁচালির অনরূপ অসম্বদ্ধ গদ্যরচনা মনের সুখে পড়তে পারেন তা হলেও আমি আজ মন খুলে লিখতে প্রস্তুত নই। অনেক কথা যা আজ মনে পড়ছে তার যা-কিছু মূল্য আছে তা আমার কাছেই আছে, অপর কারো কাছে নেই। বহুকাল-মত বহুকাল-বিস্মৃত কোনো শুকনো ফুলের পাপড়ি যদি হঠাৎ আবিষ্কার করা যায় তা হলে যে সেটিকে এককালে সজীব অবস্থায় সাদরে সঞ্চিত করে রেখেছিল, একমাত্র তারই কাছে সে শপপের মূল্য আছে, অপরের কাছে তা বর্ণগহীন আবর্জনা মাত্র। মানুষের স্মৃতির ভিতরও এমন অনেক শুকনো ফল সঞ্চিত থাকে যা অপরের কাছে বার করা যায় না। কিন্তু এমন দিনে তা আবিষ্কার করা যায়।

আবার ঘোর করে এল, বাতি না জালিয়ে লেখা চলে না; আর কালির অপব্যয় করা যত সহজ বাতির অপব্যয় করা তত সহজ নয়। অতএব এইখানেই এ লেখা শেষ করি।

আষাঢ় ১৩২৯

বর্ষার কথা

বর্ষার কথা

আমি যদি কবি হতুম, তাহলে আর যে বিষয়েই হোক, বর্ষার সম্বন্ধে কখনো কবিতা লিখতুম না। কেন? তার কারণগুলি ক্রমান্বয়ে উল্লেখ করছি।

প্রথমত, কবিতা হচ্ছে আট। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতে আট-জিনিসটি দেশকালের বহিভূত। এ মতের সার্থকতা তাঁরা উদাহরণের সাহায্যে প্রমাণ করতে চান। হ্যামলেট, তাঁদের মতে, কালেতে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে না, এবং তার জন্মস্থানেও তাকে আবদ্ধ করে রাখবার জো নেই। কিন্তু সংগীতের উদাহরণ থেকে দেখানো যেতে পারে যে, এদেশে আর্ট কালের সম্পূর্ণ অধীন। প্রতি রাগরাগিণীর ক্ষতির ঋতু মাস দিন ক্ষণ নির্দিষ্ট আছে। যাঁর সুরের দৌড় শুধু ঋষভ পর্যন্ত পৌঁছয়, তিনিও জানেন যে, ভৈরবীর সময় হচ্ছে সকাল আর পুরবীর বিকাল। যেহেতু কবিতা গান থেকেই উৎপন্ন হয়েছে, সে কারণ সাহিত্যে সময়োচিত কবিতা লেখবারও ব্যবস্থা আছে। মাসিকপত্রে পয়লা বৈশাখে নববর্ষের কবিতা, পয়লা আষাঢ়ে বর্ষার, পয়লা আশ্বিনে পূজার, আর পয়লা ফাঙ্গনে প্রেমের কবিতা বেরনো চাইই চাই। এই কারণে আমার পক্ষে বর্ষার কবিতা লেখা অসম্ভব। যে কবিতা আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে প্রকাশিত হবে, তা অন্তত জ্যৈষ্ঠমাসের মাঝামাঝি রচনা করতে হবে। আমার মনের কল্পনার এত বাষ্প নেই যা নিদাঘের মধ্যাহ্নকে মেঘাচ্ছন্ন করে তুলতে পারে। তাছাড়া, যখন বাইরে অহরহ আগন জলছে তখন মনে বিরহের আগুন জালিয়ে রাখতে কালিদাসের যক্ষও সক্ষম হতেন কি না, সেবিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। আর বিরহ বাদ দিয়ে বর্ষার কাব্য লেখাও যা, হ্যামলেটকে বাদ দিয়ে হ্যামলেটনাটক লেখাও তাই।

দ্বিতীয়ত, বর্ষার কবিতা লিখতে আমার ভরসা হয় না এই কারণে যে, এক ভরসা ছাড়া বরষা আর কোনো শব্দের সঙ্গে মেলে না। বাংলা-কবিতায় মিল চাই, এ ধারণা আমার আজও যে আছে, একথা আমি অস্বীকার করতে পারি নে। যখন ভাবের সঙ্গে ভাব না মিললে কবিতা হয় না, তখন কথার সঙ্গে কথা মিললে কেন যে তা কবিতা না হয়ে পদ্য হবে, তা আমি বুঝতে পারি নে। তাছাড়া, বাস্তবজীবনে যখন আমাদের কোনো কথাই মেলে না, তখন অন্তত একটা জায়গা থাকা চাই যেখানে তা মিলবে, এবং সেদেশ হচ্ছে কল্পনার রাজ্য, অর্থাৎ কবিতার জন্মভূমি। আর-এক কথা, অমিত্রাক্ষরের কবিতা যদি শ্রাবণের নদীর মত দল ছাপিয়ে না বয়ে যায়, তাহলে তা নিতান্ত অচল হয়ে পড়ে। মিল অর্থাৎ অন্তঃ-অনুপ্রাস বাদ দিয়ে পদ্যকে হিল্লোলে ও কল্লোলে ভরপুর করে তুলতে হলে মধ্য-অনুপ্রাসের ঘনঘটা আবশ্যক। সে কবিতার সঙ্গে সততসঞ্চরমান নবজলধরপটলের সংযোগ করিয়ে দিতে হয়, এবং তার চলোর্মির গতি যাদঃপতিরোধ ব্যতীত অন্য কোনোরূপ রোধ মানে না। আমার সরস্বতী হচ্ছেন প্রাচীন সরস্বতী, শঙ্কা না হলেও ক্ষীণা; দামোদর নন যে, শব্দের বন্যায় বাংলার সকল ছাঁদবাঁধ ভেঙে বেরিয়ে যাবেন। অতএব মিলের অভাববশতই আমাকে ক্ষান্ত থাকতে হচ্ছে। অবশ্য দরশ পরশ সরস হরষ প্রভৃতি শব্দকে আকার দিয়ে বরষার সঙ্গে মেলানো যায়। কিন্তু সে কাজ রবীন্দ্রনাথ আগেই করে বসে আছেন। আমি যদি ঐসকল শব্দকে সাকার করে ব্যবহার করি, তাহলে আমার চুরিবিদ্যে ঐ আকারেই ধরা পড়ে যাবে।

ঐরূপ শব্দসমূহ আত্মসাৎ করা চৌর্যবৃত্তি কি না, সেবিষয়ে অবশ্য প্রচণ্ড মতভেদ আছে। নব্যকবিদের মতে, মাতৃভাষা যখন কারও পৈতৃকসম্পত্তি নয়, তখন তা নিজের কার্যোপযোগী করে ব্যবহার করবার সকলেরই সমান অধিকার আছে। ঈষৎ বদল-সদল করেছেন বলে রবীন্দ্রনাথ ওসব কথার আরকিছু, পেটেট নেন নি যে, আমরা তা ব্যবহার করলে চোর-দায়ে ধরা পড়ব বিশেষত যখন তাদের কোনো বদলি পাওয়া যায় না। যেকথা একবার ছাপা হয়ে গেছে, তাকে আর চাপা দিয়ে রাখবার জো নেই; সে যার-তার কবিতায় নিজেকে ব্যক্ত করবে। নব্যকবিদের আর-একটি কথা বলবার আছে, যা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। সে হচ্ছে এই যে, রবীন্দ্রনাথ যদি অনেক কথা আগে না ব্যবহার করে ফেলতেন, তাহলে পরবর্তী কবিরা তা ব্যবহার করতেন। পরে জন্মগ্রহণ করার দরুন সে সুযোগ হারিয়েছি বলে আমাদের যে চুপ করে থাকতে হবে, সাহিত্যজগতের এমন-কোনো নিয়ম নেই। এ মত গ্রাহ্য করলেও বর্ষার বিষয়ে কবিতা লেখার আর-একটি বাধা আছে। কলম ধরলেই মনে হয়, মেঘের সম্বন্ধে লিখব আর কি ছাই?

বর্ষার রূপগুণ সম্বন্ধে যা-কিছু, বক্তব্য ছিল, তা কালিদাস সবই বলে গেছেন, বাকি যা ছিল তা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। এবিষয়ে একটি নূতন উপমা কিংবা নূতন অনুপ্রাস খুঁজে পাওয়া ভার। যদি বাদ দিয়ে বর্ষার নগ্নমতির বর্ণনা করতে উদ্যত হই, তাহলেও বড় সুবিধে করতে পারা যায় না। কারণ, বর্ষার রূপ কালো, রস জোলো, গন্ধ পঙ্কজের নয়— পঙ্কের, স্পর্শ ভিজে, এবং শব্দ বেজায়। সুতরাং যে বর্ষা আমাদের ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত, তার যথাযথ বর্ণনাতে বস্তুতন্ত্রতা থাকতে পারে কিন্তু কবিত্ব থাকবে কি না, তা বলা কঠিন।

কবিতার যা দূরকার এবং যা নিয়ে কবিতার কারবার, সেইসব আনুষঙ্গিক উপকরণও এ ঋতুতে বড়-একটা পাওয়া যায় না। এ ঋতু পাখি-ছুট। বর্ষায় কোকিল মৌন, কেননা দর বক্তা; চকোর আকাশদেশত্যাগী, আর চাতক ঢের হয়েছে বলে ফটিকজল শব্দ আর মুখে আনে না। যেসকল চরণ ও চঞ্চসার পাখি, যথা বক হাঁস সারস হাড়গিলে ইত্যাদি, এ ঋতুতে স্বেচ্ছামত জলে-স্থলে ও নভোমণ্ডলে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে, তাদের গঠন এতই অদ্ভুত এবং তাদের প্রকৃতি এতই তামসিক যে, তারা যে বিশ্বামিত্রের সৃষ্টি সেবিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। বস্তুতন্ত্রতার খাতিরে আমরা অনেক দূর অগ্রসর হতে রাজি আছি, কিন্তু বিশ্বামিত্রের জগৎ পর্যন্ত নয়। তারপর কাব্যের উপযোগী ফল ফল লতা পাতা গাছ বর্ষায় এতই দুর্লভ যে, মহাকবি কালিদাসও ব্যাঙের ছাতার বর্ণনা করতে বাধ্য হয়েছেন। সংস্কৃতভাষার ঐশ্বর্যের মধ্যে এ দৈন্য ধরা পড়ে না, তাই কালিদাসের কবিতা বেচে গেছে। বর্ষার দুটি নিজস্ব ফল হচ্ছে কদম আর কেয়া। অপূর্বতায় পল্পজগতে এ দুটির আর তুলনা নেই। অপরাপর সকল ফল অর্ধবিকশিত ও অর্ধনিমীলিত। রূপের যে অধপ্রকাশ ও অর্ধগোপনেই তার মোহিনীশক্তি নিহিত, এ সত্য স্বর্গের অপ্সরারা জানতেন। মনিঋষিদের তপোভঙ্গ করবার জন্য তাঁরা উক্ত উপায়ই অবলম্বন করতেন। কারণ ব্যক্ত-দ্বারা ইন্দ্রিয় এবং অব্যক্ত-দ্বারা কল্পনাকে অভিভূত না করতে পারলে দেহ ও মনের সমষ্টিকে সম্পূর্ণ মোহিত করা যায় না। কদম কিন্তু একেবারেই খোলা, আর কেয়া একেবারেই বোজা। একের ব্যক্ত-রপ নেই, অপরের গল্ড-গন্ধ নেই; অথচ উভয়েই কণ্টকিত। এ ফল দিয়ে কবিতা সাজানো যায় না। এ দুটি ফল বর্ষার ভূষণ নয়, অস্ব; গোলা এবং সঙিনের সঙ্গে এদের সাদশ্য স্পষ্ট।

পূর্বে যা দেখানো গেল, সেসব তো অঙ্গহীনতার পরিচয়। কিন্তু এ ঋতুর প্রধান দোষ হচ্ছে, আর-পাঁচটি ঋতুর সঙ্গে এর কোনো মিল নেই; আর-পাঁচটি ঋতুর সঙ্গে এ ঋতু খাপ খায় না। এ ঋতু বিজাতীয় এবং বিদেশী, অতএব অস্পশ্য। এই প্রক্ষিপ্ত ঋতু আকাশ থেকে পড়ে, দেশের মাটির ভিতর থেকে আবির্ভূত হয় না। বসন্তের নবীনতা সজীবতা ও সরসতার মূল হচ্ছে ধরণী। বসন্তের ঐশ্বর্য হচ্ছে দেশের ফলে, দেশের কিশলয়ে। বসন্তের দক্ষিণপবনের জন্মস্থান যে ভারতবর্ষের মলয়পর্বত, তার পরিচয় তার পশেই পাওয়া যায়; সে পবন আমাদের দেহে চন্দনের প্রলেপ দিয়ে দেয়। বসন্তের আলো, সূর্য ও চন্দ্রের আলো। ও দুটি দেবতা তো সম্পূর্ণ আমাদেরই আত্মীয়; কেননা, আমরা হয় সূর্যবংশীয় নয় চন্দ্রবংশীয় এবং ভবলীলাসংবরণ করে আমরা হয় সযলোকে নয় চন্দ্রলোকে ফিরে যাই। অপরপক্ষে, মেঘ যে কোন দেশ থেকে আসে, তার কোনো ঠিকানা নেই। বর্ষা যে-জল বর্ষণ করে, সে কালাপানির জল। বর্ষার হাওয়া এতই দুরন্ত এতই অশিষ্ট এতই প্রচণ্ড এবং এতই স্বাধীন যে, সে-যে কোনো অসভ্য দেশ থেকে আসে, সেবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তারপর, বর্ষার নিজস্ব আলো হচ্ছে বিদ্যৎ। বিদ্যতের আলো এতই হাস্যোজ্জল এতই চঞ্চল এতই বক্র এবং এতই তীক্ষন যে, এই প্রশান্ত মহাদেশের এই প্রশান্ত মহাকাশে সে কখনোই জন্মলাভ করে নি। আর-এক কথা, বসন্ত হচ্ছে কলকাঠ কোকিলের পঞ্চম সরে মুখরিত। আর বর্ষার নিনাদ? তা শুনে শুধু যে কানে হাত দিতে হয় তা নয়, চোখও বুজতে হয়।

বর্ষার প্রকৃতি যে আমাদের প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত, তার বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় ও-ঋতুর ব্যবহারে। এ-ঋতু শুধু বেখাপা নয়, অতি বেআড়া। বসন্ত যখন আসে, সে এত অলক্ষিতভাবে আসে যে, পঞ্জিকার সাহায্য ব্যতীত কবে মাঘের শেষ হয় আর কবে ফাল্গুনের আরম্ভ হয়, তা কেউ বলতে পারেন না। বসন্ত, বঙ্কিমের রজনীর মত, ধীরে ধীরে অতিধীরে ফলের ডালা হাতে করে, দেশের হদয়-মন্দিরে এসে প্রবেশ করে। তার চরণস্পর্শে ধরণীর মুখে, শব-সাধকের শবের ন্যয়ি, প্রথমে বর্ণ দেখা দেয়, তার পরে ভ, কম্পিত হয়, তার পরে চক্ষু উন্মীলিত হয়, তার পর তার নিশ্বাস পড়ে, তার পর তার সর্বাঙ্গ শিহরিত হয়ে ওঠে। এসকল জীবনের লক্ষণ শুধু পর্যায়ক্রমে নয়, ধীরে ধীরে অতিধীরে প্রকটিত হয়। কিন্তু বর্ষা ভয়ংকর মতি ধারণ ক’রে একেবারে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ে। আকাশে তার চুল ওড়ে, চোখে তার বিদ্যৎ খেলে, মুখে তার প্রচণ্ড হংকার; সে যেন একেবারে প্রমত্ত, উন্মত্ত। ইংরেজেরা বলেন, কে কার সঙ্গ রাখে, তার থেকে তার চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। বসন্তের সখা মদন। আর বর্ষার সখা? পবননন্দন নন, কিন্তু তাঁর বাবা। ইনি একলক্ষ্যে আমাদের অশোকবনে উত্তীর্ণ হয়ে ফল ছে’ড়েন, ডাল ভাঙেন, গাছ ওপড়ান; আমাদের সোনার লঙ্কা একদিনেই লণ্ডভণ্ড করে দেন, এবং যে সৰ্য আমাদের ঘরে বাঁধা রয়েছে তাকে বগলদাবা করেন; আর চন্দ্রের দেহ ভয়ে সংকুচিত হয়ে তার কলঙ্কের ভিতর প্রবিষ্ট হয়ে যায়। এককথায়, বর্ষার ধর্ম হচ্ছে জল-স্থল-আকাশ সব বিপর্যস্ত করে ফেলা। এ-ঋতু কেবল পৃথিবী নয়, দিবারাত্রেরও সাজানো তাস ভেস্তে দেয়। তাছাড়া বর্ষা কখনো হাসেন কখনো কাঁদেন, ইনি ক্ষণে রষ্ট ক্ষণে তুষ্ট। এমন অব্যবস্থিতচিত্ত ঋতুকে ছন্দোবন্ধের ভিতর সুব্যবস্থিত করা আমার সাধ্যাতীত।

এস্থলে এই আপত্তি উঠতে পারে যে, বর্ষার চরিত্র যদি এতই উদ্ভট হয়, তাহলে কালিদাস প্রভৃতি মহাকবিরা কেন ও-ঋতুকে তাঁদের কাব্যে অতখানি স্থান দিয়েছেন। তার উত্তর হচ্ছে যে, সেকালের বর্ষা আর একালের বর্ষা এক জিনিস নয়; নাম ছাড়া এ উভয়ের ভিতর আর-কোনো মিল নেই। মেঘদতের মেঘ শান্ত-দান্ত; সে বন্ধুর কথা শোনে, এবং যে পথে যেতে বলে, সেই পথে যায়। সে যে কতদূর রসজ্ঞ, তা তার উজ্জয়িনী-প্রয়াণ থেকেই জানা যায়। সে রমণীর হদয়জ্ঞ, প্রীজাতির নিকট কোন ক্ষেত্রে হংকার করতে হয় এবং কোন ক্ষেত্রে অল্পভাষে জল্পনা করতে হয়, তা তার বিলক্ষণ জানা আছে। সে করণ, সে কনকনিকষস্নিগ্ধ বিজলির বাতি জেলে সচিভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে অভিসারিকাদের পথ দেখায়, কিন্তু তাদের গায়ে জল বর্ষণ করে না। সে সংগীতজ্ঞ, তার সখা অনিল যখন কীচক-রন্ধে মুখ দিয়ে বংশীবাদন করেন, তখন সে মদঙ্গের সংগত করে। এককথায় ধীরোদাত্ত নায়কের সকল গণই তাতে বর্তমান। সে মেঘ তো মেঘ নয়, পপকরথে আরঢ় স্বয়ং বরুণদেব। সে রথ অলকার প্রাসাদের মত ইন্দ্রচাপে সচিত্র, ললিতবনিতাসনাথ মরজনিতে মুখরিত। সে মেঘ কখনো শিলাবৃষ্টি করে না, মধ্যে মধ্যে পুষ্পবৃষ্টি করে। এহেন মেঘ যদি কবিতার বিষয় না হয়, তাহলে সে বিষয় আর কি হতে পারে?

কিন্তু যেহেতু আমাদের পরিচিত বর্ষা নিতান্ত উদভ্রান্ত উচ্ছখল, সেই কারণেই তার বিষয় কবিত্ব করা সম্ভব হলেও অনুচিত। পৃথিবীতে মানুষের সব কাজের ভিতর একটা উদ্দেশ্য আছে। আমার বিশ্বাস, প্রকৃতির রূপবর্ণনার উদ্দেশ্য হচ্ছে তার সৌন্দর্যের সাহায্যে মানব-মনকে শিক্ষাদান করা। যদি তাই হয়, তাহলে কবিরা কি বর্ষার চরিত্রকে মানুষের মনের কাছে আদর্শস্বরূপ ধরে দিতে চান। আমাদের মত শান্ত সমাহিত সুসভ্য জাতির পক্ষে, বর্ষা নয়, হেমন্ত হচ্ছে আদর্শ ঋতু। এ মত আমার নয়, শাস্ত্রের’; নিম্নে উদ্ধত বাক্যগুলির দ্বারাই তা প্রমাণিত হবে :

‘ঋতুগণের মধ্যে হেমন্তই স্বাহাকার, কেননা হেমন্ত এই প্রজাসমূহকে নিজের বশীভূত করিয়া রাখে, এবং সেইজন্য হেমতে ওষধিসমূহ ম্লান হয়, বনস্পতিসমূহের পত্রনিচয় নিপতিত হয়, পক্ষীসমূহ যেন অধিকতরভাবে স্থির হইয়া থাকে ও অধিকতর নীচে উড়িয়া বেড়ায়, এবং নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের লোমসমূহ যেন (শীতপ্রভাবে) নিপতিত হইয়া যায়, কেননা হেমন্ত এইসমস্ত প্রজাকে নিজের বশীভূত করিয়া থাকে। যে ব্যক্তি ইহা এইরূপ জানেন, তিনি যে (ভূমি) ভাগে থাকেন তাহাকেই শ্রী ও শ্রেষ্ঠ অন্নের জন্য নিজের করিয়া তোলেন।’— শতপথ ব্রাহরণ।

আমরা যে শ্রীভ্রষ্ট এবং শ্রেষ্ঠ-অন্নহীন, তার কারণ আমরা হেমন্তকে এইরূপে জানি নে; এবং জানি নে যে, তার কারণ, কবিরা হেমন্তের স্বরূপের বর্ণনা করেন না, বর্ণনা করেন শুধু বর্ষার; যে বর্ষা ওষধিসমূহকে ম্লান না করে সবুজ করে তোলে।

আষাঢ় ১৩২১

বর্ষার দিন

আজ ঘুম থেকে উঠে চোখ চেয়ে দেখি আকাশে আলো নেই। আকাশের চেহারা দেখে অধস লোক ঠিক বুঝতে পারে না যে, সময়টা সকাল না সধে। এ ভুল হওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক, কারণ সকাল বিকাল দুই কালই হচ্ছে রাত্রি-দিনের সন্ধিস্থল। তার পর যখন দেখা যায় যে, উপর থেকে যা নিঃশব্দে ঝরে পড়েছে তা সর্যের মদ, কিরণ নয় জলের সক্ষম ধারা, তখন জ্ঞান হয় যে এটা দিন বটে, কিন্তু বর্ষার দিন।

এমন দিনে কাব্য-ব্যসনী লোকদের মনে নানারকম পবস্মতি জেগে ওঠে। বর্ষার যে রূপ ও যে গুণের কথা পর্ব-কবিরা আমাদের জাতীয় স্মৃতির ভাণ্ডারে সঞ্চিত করে রেখে গিয়েছেন তা আবার মনশ্চক্ষে আবির্ভূত হয়।

অনেকে বলেন যে, কবির উক্তি আমাদের জ্ঞানের বাধাধরপ। যা চোখে দেখবার জিনিস, শোনা কথা নাকি সে জিনিসের ও চোখের ভিতর একটা পর্দা ফেলে দেয়। এ পৃথিবীতে সব জিনিসকেই নিজের চোখ দিয়ে দেখবার সংকপটা অতি সাধ! কিন্তু স্মৃতি যে প্রত্যক্ষের অন্তরায় এ কথাটা সত্য নয়। আমরা যা-কিছু প্রত্যক্ষ করি তার ভিতর অনেকখানি স্মৃতি আছে, এতখানি যে প্রত্যক্ষ করবার ভিতর চোখই কম ও মনই বেশি। এ কথা যাঁরা মানতে রাজি নন তাঁরা বের্গস’র Matter and Memory নামক গ্রন্থখানি পড়ে দেখলেই ইন্দ্রিয়গোচর বিষয়ের সঙ্গে স্মৃতিগত বিষয়ের অঙ্গাঙ্গিসম্বন্ধটা স্পষ্ট দেখতে পাবেন। সে যাই হোক, কবির হয়ে শুধু এই কথাটা আমি বলতে চাই যে, কবির উক্তি আমাদের অনেকেরই বোজা চোখকে খুলে দেয়, কারো ভোলা চোখকে বুজিয়ে দেয় না। কবিতা পড়তে পড়তে অনেকের অবশ্য চোখ ঢলে আসে, কিন্তু তার কারণ স্বতন্ত্র।

সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে যাঁর কিছুমাত্র পরিচয় আছে তিনিই জানেন যে ও-সাহিত্য বর্ষার কথায় মুখরিত। বর্ষা যে পর্ব-কবিদের এতদর প্রিয় ছিল তার কারণ সেকালেও বর্ষা দেখা দিত গ্রীষ্মের পিঠ পিঠ। ইংরেজ কবিরা যে শতমুখে বসতের গণগান করেন তার কারণ সে দেশে বসন্ত আসে শীতের পিঠ পিঠ। ফলে সে দেশে শীতে মিয়মাণ প্রকৃতি বসতে আবার নবজীবন লাভ করে। বিলেতি শীতের কঠোরতা যিনি রক্তমাংসে অনুভব করেছেন, যেমন আমি করেছি, তিনিই সে দেশে বসন্তঋতু-স্পর্শে প্রকৃতি কি আনন্দে বেঁচে ওঠে তা মর্মে মর্মে অনুভব করেছেন। সে দেশ ও ঋতু প্রকৃতির ফুলসজ্জা।

সংকৃত কবিরা যে দেশের লোক সে দেশে গ্রীষ্ম বিলেতি শীতের চাইতেও ভীষণ ও মারাত্মক। বাণভট্টের শ্রীহর্ষচরিতে গ্রামের একটি লম্বা বর্ণনা আছে। সে বর্ণনা পড়লেও আমাদের গায়ে জ্বর আসে। এ বর্ণনা প্রকৃতির ঘরে আগুন লাগবার বর্ণনা। যে ঋতুতে বাতাস আসে আগুনের হলকার মতো, যে ঋতুতে আলোক অগ্নির রূপ ধারণ করে, যে ঋতুতে পত্র পুষ্প সব জ্বলে পড়ে ছাই হয়ে যায়, আর বৃক্ষলতা সব কঙ্কালসার হয়ে ওঠে, সে ঋতুর অতে বর্ষার আগমন, প্রকৃতির ঘরে নবজীবনের আগমন। কালিদাস একটি লোকে সেকালের কবিদেব মনের আসল কথা বলে দিয়েছে–

বহুগুণরমণীয়ঃ কামিনীচিত্তহারী
তরুরিটপলতানাং বান্ধবো নির্বিকার।
জলদসময় এষ প্রাণিনাং প্রাণভূতো
দিশতু তব হিতানি প্রায়শো বাঞ্ছিতানি।।

পৃথিবীতে যে বস্তুই ‘প্রাণিনাং প্রাণভূতো’ সেই বস্তুই শুধু কামিনী-চিত্তহারী নয় কবি-চিত্তহারীও। আর কালিদাস যে বলেছেন ‘কামিনী-চিত্তহারী’ তার অর্থ–যা সর্বমানবের চিত্তহারী তা স্বীজাতিরও চিত্তহারী হবার কথা, কেননা শ্ৰীলোকও মানুষ। উপরন্তু শ্রীজাতির সঙ্গে প্রকৃতির সম্বন্ধ অতি ঘনিষ্ঠ। এত ঘনিষ্ঠ যে অনেকের ধারণা নারী ও প্রকৃতি একই বস্তু, ও-দুয়ের মধ্যে পুরুষ শুধু প্রক্ষিপ্ত।

৩.

আমাদের দেশে গ্রীষ্মের পরে বর্ষার আবির্ভাব প্রকৃতির একটা অপরূপ এবং অদ্ভুত বদল। গ্রীষ্ম অন্তত এ দেশে ধীরে ধীরে অলক্ষিতে বর্ষায় পরিণত হয় না। এ পরিবর্তন হ্রাসও নয় বৃদ্ধিও নয়, একেবারে বিপর্যয়। বর্ষা গ্রীষ্মের evolution নয়, আমূল revolution। সুতরাং বর্ষার আগমন কানারও চোখে পড়ে, কালারও কানে বাজে। কালিদাস বর্ষাঋতুর বর্ণনা এই বলে আরম্ভ করেছেন

সশীকরাম্ভোধরমত্তকুঞ্জর-
স্তড়িৎপতাকোহশনিশব্দমদলঃ।
সমাগতো রাজবদুদ্ধতদ্যুতি–
ঘর্নাগমঃ কামিজনপ্রিয়ঃ প্রিয়ে।।

বর্ষার এতাদৃশ রূপবর্ণনা ইউরোপীয় সাহিত্যে নেই। কারণ এ ঋতু ও-বেশে সে দেশে প্রবেশ করে না। ইংলন্ডে দেখেছি, সেখানে বৃষ্টি আছে কিন্তু বর্ষা নেই। বিলিতি প্রকৃতি সদাসর্বদা মুখ ভার করে থাকেন এবং যখন তখন কাঁদতে শুরু করেন, আর সে কান্না হচ্ছে নাকে-কান্না, তা দেখে প্রকৃতির উপর মায়া হয় না, রাগ ধরে। সে দেশে বিদ্যুৎ রণপতাকা নয়–পিদিমের সলতে, তার মুখের আলো প্রকৃতির অট্টহাস্য নয়—রোগীর মুখের কষ্টহাসি। আর সে দেশের মেঘের ডাক অশনিশব্দমর্দল নয়, গাব-চটা বাঁয়ার বকচাপা গ্যাঁঙরানি। এক কথায় বিলেতের বর্ষা থিয়েটারের বর্ষা। ও গোলাপপাশের বৃষ্টিতে কারো গা ভেজে না, ও টিনের বজ্ৰধ্বনিতে কারো কান কালা হয় না, ও মেকি বিদ্যতের আলোতে কারো চোখ কানা হয় না। বিলেতের বর্ষার ভিতর চমকও নেই চটকও নেই। ওরকম ধ্যানমঘনে প্যানপেনে জিনিস কবির মনকে স্পর্শ করে না, তাই বিলেতি সাহিত্যে বর্ষার কোনো রূপবর্ণনা নেই। যার রূপ নেই তার রূপবর্ণনা কতকটা যার মাথা নেই তার মাথাব্যথার মতো। শেলির মন অবশ্য পর্বতশঙ্গে মেঘলোকে বিচরণ করত। কিন্তু সে মেঘ হচ্ছে কুয়াশা, তার কোনো পরিচ্ছিন্ন মতি নেই। সুতরাং তাঁর আঁকা প্রকৃতির ছবি কোনো ফ্রেমে আঁটা যায় না, যেমন West Windকে বাঁশির ভিতর পোরা যায় না। ফ্রেম কথাটা শুনে সেই-সব লোক চমকে উঠবেন যাঁরা বলেন যে, অসীমকে নিয়েই কবির কারবার। অবশ্য তাই। জ্ঞানের অসীম সীমার বাইরে, কিন্তু আর্টের অসীম সীমার ভিতর।

৪.

বর্ষা যে রাজার মতো হাতিতে চড়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে নিশান উড়িয়ে ধুমধড়ক্কা ক’রে আসে, এ ঘটনা এ দেশে চিরপুরাতন ও চিরনবীন। সুতরাং যুগ যুগ ধরে কবিরা বর্ষার এই দিগবিজয়ী রাজরপ দেখে এসেছে এবং সে-রপ ভাষায় অকিত করে অপরের চোখের সম্মুখে ধরে দিয়েছে। আমাদের দেশে বর্ষার রূপের মতো আমাদের কাব্যসাহিত্যে তার বর্ণনাও চিরপুরাতন ও চিরনবীন। মানুষের পনেরক্তি প্রকৃতির পুনরুক্তির অনুবাদ মাত্র।

কালিদাসের বহুপরবর্তী কবি বর্ষাঋতুর ঐ রাজরূপ দর্শন করেছেন, সবাই সেই রূপেরই বর্ণনা করেছেন। এমন-কি, হিন্দি কবিরা ও-ছবি তাদের গানে আজও ফুর্তি করে আঁকছে

দবোধন বেশে বাদর আওয়ল

এ পদটি মল্লার রাগের একটি প্রসিদ্ধ পদের প্রথম পদ। ও গান যখন প্রথম শনি তখন আমার চোখের সম্মুখে বিদ্যৎ ঝলকে উঠেছিল, কানের কাছে মর্দগের গুরুগম্ভীর অবিরল পরং বেজে উঠেছিল।

এ গান শুনে যদি কেউ বলেন যে, উক্ত হিন্দি গানের রচয়িতা কালিদাসের কবিতা চুরি করেছেন তা হলে বলতে হয় যে, রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন–

বাদল মেঘে মাদল বাজে

সে কথাও অশনিশব্দমর্দলের বাংলা কথায় অনুবাদ। সাহিত্যে এরূপ চুরিধরা বিদ্যে বাতুলতার না হোক বালিশতার পরিচায়ক। কারণ এ বিদ্যার বলে এও প্রমাণ করা যায় যে, কালিদাস তাঁর পর্ববতী কবিদের বর্ণনা বেমালুম আত্মসাৎ করেছিলেন। মৃচ্ছকটিক-প্রকরণে বিট বসন্তসেনাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন–

পশ্য পশ্য। অয়মপরঃ—
পবনচপলবেগঃ স্থূলধারাশরৌঘঃ।
স্তনিতপটহনাদঃ স্পষ্টবিদ্যুৎপতাকঃ।
হরতি করসমূহং খে শশাঙ্কস্য মেঘো
নৃপ ইব পুরমধ্যে মন্দবীর্যস্য শত্রোঃ।।

উক্ত লোকের ভিতর স্পষ্ট বিদ্যৎপতাকা আছে, পটহনিনাদ আছে, নৃপ আছে। অর্থাৎ কালিদাসের শোকের মালমসলা সবই আছে। আর মৃচ্ছকটিক হচ্ছে দরিদ্র চারুদত্তের রাজসংস্করণ, কারণ তা হচ্ছে রাজা শূদ্রকের সংকরণ। দরিদ্র চারুদত্ত ভাসের লেখা; আর ভাস যে কালিদাসের পূর্ববর্তী কবি তা স্বয়ং কালিদাস নিজমুখেই স্বীকার করেছেন। এর থেকে প্রমাণ হয় শুধু এই মাত্র যে, বর্ষার রূপ এ দেশে সনাতন, তাই তার বর্ণনাও সনাতন। আর শাস্ত্রে বলে, যা সনাতন তাই অপৌরুষেয়।

৫.

স্মৃতি প্রত্যক্ষের পরিপন্থী নয়, কিন্তু শ্রুতি অনেক ক্ষেত্রে দর্শনের প্রতিবন্ধক। অনেকের দেহে কান চোখের প্রতিযোগী। শাস্ত্রের ভাষায় বলতে হলে নাম রূপের প্রতিদ্বন্দী। আমরা যদি কোনো বিষয়ের কথা শুনে নিশ্চিত থাকি তা হলে সে বিষয়ের দিকে চোখ চেয়ে দেখবার আমাদের প্রবত্তি থাকে না। কথা যখন কিংবদন্তী হয়ে ওঠে তখন অনেকের কাছে তা বেদবাক্য হিসেবে গ্রাহ্য হয়। একটা সর্বলোকবিদিত উদাহরণ নেওয়া যাক।

বহুকাল থেকে শুনে এসেছি যে অনেকে বিবাস করেন যে, পয়লা আষাঢ়ে বৃষ্টি নামতে বাধ্য, কেননা কালিদাস বলেছেন, “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে দেশের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

কালিদাস শুধু বড়ো কবি নন, সেইসঙ্গে তিনি যে বড়ো জিয়োগ্রাফার এবং বড়ো অনিথলজিস্ট তা জানি, কিন্তু উপরন্তু তিনি যে একজন অভ্রান্ত মেটিয়রলজিস্ট তা বিশ্বাস করা কঠিন। মেঘদূতকে মেটিয়রলজিকাল অফিসের রিপোর্ট হিসেবে গ্রাহ্য করতে আমি কুণ্ঠিত। কারণ মেঘদূত আর যাই হোক মেঘলোক সঘধে ছেলেভুলানো সংবাদের প্রচারক নয়। মেঘকে দূত করতে হলে তাকে বর্ষাঋতুতেই যাত্রা করাতে হয়। আর কোন পথ দিয়ে উড়ে অলকায় যেতে হবে সে বিষয়েও কালিদাস উক্ত দতকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে উপদেশ দিয়েছেন। কালিদাস খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন যে–

মার্গং তাবচ্ছ্‌ণু কথয়তস্ত্বৎপ্রয়াণানপং
সন্দেশং মে তদন, জলদ শ্রোষ্যসি শ্রোত্রপ্রেয়ম।

অর্থাৎ আগে পথের কথা শোনো, তার পর অলকায় গিয়ে কার কাছে কি বলতে হবে সে কথা পরে শুনো। এ কারণ পূর্বমেঘ আগাগোড়াই পথের কথা।

৬.

এ পথ ভারতবর্ষের উত্তরাপথ। বাংলা থেকে অন্তত দেড় হাজার মাইল দূরে। সুতরাং সে দেশে কখন বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়, তার থেকে বাংলায় কোন দিন বৃষ্টি নামবে তা বলা যায় না, অন্তত ন্যায়শারে এমন কোনো নিয়ম নেই যার বলে রামগিরি থেকে এক লক্ষে কলকাতায় অবতীর্ণ হওয়া যায়।

কিন্তু আসল কথা এই যে, কালিদাস এমন কথা বলেন নি যে পয়লা আষাঢ়ে বৃষ্টি নামে। তাঁর কথা এই যে–

তস্মিন্নদ্রৌ কতিচিদবলাবিপ্রযুক্তঃ স কামী
নীত্বা মাসান্‌ কনকবলয়ভ্রংশরিক্তপ্রকোষ্ঠঃ।
আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ৷৷

সমস্ত শ্লোকটা উদ্‌ধৃত করে দিলাম এইজন্যে যে সকলেই দেখতে পাবেন যে, এর ভিতর বৃষ্টির নামগন্ধও নেই। যক্ষ যা দেখেছিলেন তা হচ্ছে ‘মেঘমাশ্লিষ্টসানুং’ অর্থাৎ পাহাড়ের গায়ে নেপটে-লাগা মেঘ। এরকম মেঘ বাংলাদেশে কখনো চোখে পড়ে না, দেখা যায় শুধু পাহাড়ে পর্বতে। যক্ষ যে তা দেখেছিলেন তাও অবিশ্বাস করবার কোনো কারণ নেই, কেননা তিনি বাস করতেন তস্মিন্নদ্রৌ–সেই পাহাড়ে। সুতরাং বাংলাদেশে যাঁরা পয়লা আষাঢ়ে সেইরকম উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, যথা—

চাতকিনী কুতুকিনী ঘনদরশনে

তাঁরা সেই শ্রেণীর লোক যাঁরা কথার মোহে ইন্দ্রিয়ের মাথা খেয়ে বসে আছেন। শুনতে পাই বৈজ্ঞানিকরা আবিষ্কার করেছেন যে, কথার অর্থ ভুল বোঝা থেকেই mythএর জন্ম হয়। বৈজ্ঞানিকদের এ মতের সত্যতার প্রমাণ .তো হাতে-হাতেই পাওয়া গেল।

৭.

আষাঢ় সম্বন্ধে বাংলাদেশে আর-একটি কিংবদন্তী আছে, যা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে এবং চিরকাল লেগেছে। কথায় বলে ‘আষাঢ়ে গল্প’, কিন্তু গল্পের সঙ্গে আষাঢ়ের কি নৈসর্গিক যোগাযোগ আছে তা আমি ভেবে পাই নে।

আমার বিশ্বাস, গপের অনকল ঋতু হচ্ছে শীত, বর্ষা নয়। কেননা গল্প লোকে রাত্তিরেই বলে। তাই পৃথিবীর অফুরন্ত গল্পরাশি একাধিক সহস্র রজনীতেই বলা হয়েছিল। শীতকাল যে গল্প বলার ও গল্প শোনার উপযুক্ত সময় তার কারণ শীতকালে রাত বড়ো দিন ছোটো। অপর পক্ষে আষাঢ়ের দিনরাতের হিসেব শীতের ঠিক উলটো; একালের দিন বড়ো, রাত ছোটো। দিনের আলোতে গল্পের আলাদিনের প্রদীপ জ্বালানো যায় না।

তবে যে লোকে মনে করে যে, আষাঢ়ের দিন গল্পের পক্ষে প্রশস্ত দিন, তার একমাত্র কারণ আষাঢ়ের দিন প্রশস্ত। কোনো বস্তুর পরিমাণ থেকে তার গুণ নির্ণয় করবার প্রবত্তি মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। কারণ, পরিমাণ জিনিসটে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আর গুণ মনোগ্রাহ্য। আর সাধারণত আমাদের পক্ষে মনকে খাটানোর চাইতে ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করা ঢের সহজ। তবে একদল লোক, অর্থাৎ হেগেলের শিষ্যরা, আমার কথা শুনে হাসবেন। তাঁদের গর, বলেছেন যে কোয়ানটিটি বাড়লেই তা কোয়ালিটি হয়ে ওঠে। এই কারণেই সমাজ হচ্ছে গুণনিধি আর ব্যক্তি নির্গুণ; আর সেই জাতিই অতিমানুষের জাত যে জাত অর্ধেক পৃথিবীর মাটির মালিক।

এ দার্শনিক মতের প্রতিবাদ করবার আমার সাহসও নেই ইচ্ছেও নেই। কেননা দেখতে পাই এ দেশেও বেশির ভাগ লোক হেগেল না পড়েও হেগেলের মতাবলম্বী হয়েছেন। ভিড়ে মিশে যাওয়ার নামই যে পরম পরষার্থ, এ জ্ঞান এখন সর্বসাধারণ হয়েছে। গোলে হরিবোল দেওয়াই যে দেশ-উদ্ধারের একমাত্র উপায়, এই হচ্ছে বর্তমান হট্টমত। এ জর্মান-মত সম্বন্ধে যাঁর মনে দ্বিধা আছে তাঁকে আগে একটি মহাসমস্যার মীমাংসা করে পরে মুখ খুলতে হবে। সে সমস্যা এই : কোয়ানটিটি কোয়ালিটির অবনতি, না, কোয়ালিটি কোয়ান, টিটির পরিণতি? এ বিচারের উপযুক্ত সময় হচ্ছে নিদাঘ, বর্ষা নয়। কারণ উক্ত সমস্যার মীমাংসার জন্য তার উপর প্রচণ্ড আলো ফেলতে হবে, যে আলো এই মেঘলা দিনে আকাশেও নেই, মনেও নেই। আজকের দিনে এই গা-ঢাকা আলোর ভিতর বাজে কথা বলাই মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। কালিদাস বলেছেন–

মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহপ্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ

সুতরাং আমার মনও যে অন্যথাবৃত্তি অর্থাৎ অদার্শনিক হয়ে পড়েছে, সে কথা বলাই বাহুল্য।

৮.

এখন পুরনো কথায় ফিরে যাওয়া যাক। ‘আষাঢ়ে গল্প’ কথাটার সৃষ্টি হল কি সূত্রে তারই এখন অনুসন্ধান করা যাক, কিন্তু সে সূত্ৰ খুঁজতে হলে আমাকে আরএক শাস্ত্রের দ্বারস্থ হতে হবেযে শাস্ত্রের ভিতর প্রবেশ করবার অধিকার আমার নেই, সে শাস্ত্রের নাম শব্দতত্ত্ব। অপর পক্ষে, এই বর্ষার দিনে স্বাধিকারপ্রমত্ত হবার অধিকার সকলেরই আছে, এই বিশ্বাসের বলেই আমি অনধিকারচর্চা করতে ব্ৰতী হচ্ছি।

আমি পূর্বে বলেছি যে, নিরককারদের মতে যে কথার মানে আমরা জানি নে অথচ বলি, সেই কথা থেকেই কিংবদন্তী জন্মলাভ করে। আমার বিশ্বাস ‘আষাঢ়ে গল্প’-রপ কিংবদন্তীর জন্মকথাও তাই।

আমাদের বাঙাল দেশে লোকে ‘আষাঢ়ে গল্প’ বলে না, বলে ‘আজাড়ে গল্প’। এখন এই ‘আজাড়ে’ শব্দটি কি ‘আষাঢ়ে’র অপভ্রংশ? ‘আজাড়’ শব্দের সাক্ষাৎ সংস্কৃতকোষের ভিতর পাওয়া যায় না। এর থেকে অনুমান করছি যে এটি হয় ফারসি নয় আরবি শব্দ। আর ও-কথার মানে আমরা সবাই জানি, অন্য সূত্রে। আমরা যখন বলি মাঠ উজাড় করে দিলে তখন আমরা বুঝি যে উজাড় মানে নির্মূল। কারণ ‘জড়’ মানে যে মূল তা বাংলার চাষীরাও জানে। সুতরাং ‘আজাড়ে গল্পে’র অর্থ যে অমূলক গল্প এরূপ অনুমান করা অসংগত নয়। এই ‘আজাড়’ কথাটার শুদ্ধি করে নিয়ে আমরা তাকে ‘আষাঢ়’ বানিয়েছি। এ কারণ আরব্য-উপন্যাসের সব গল্পই অজাড়ে গল্প, হিন্দু জবানে ‘আষাঢ়ে গল্প’; যদিও আরবদেশে আষাঢ়ও নেই, শ্রাবণও নেই।

সুতরাং এ কিংবদন্তীর অলীকতা ধরতে পারলেই আমরা বুঝতে পারব যে, বৃষ্টির জল পেয়ে গল্প গজায় না, জন্মায় শুধু কবিতা। বর্ষাকাল কবির স্বদেশ, ঔপন্যাসিকের বিদেশ।

৯.

বর্ষা যে গল্পের ঋতু নয় গানের ঋতু-তার প্রমাণ বাংলা সাহিত্যে আষাঢ়ে গল্প নেই, কিন্তু মেঘরাগের অগণ্য গান আছে।

বাংলার আদিকবি জয়দেবের আদিকে কার মনে নেই? সকলেরই মনে আছে এই কারণ যে–

মেঘৈর্মেদরমম্বরং বনভূবশ্যামাস্তমালদ্রুমৈঃ

এ পদ যার একবার কর্ণগোচর হয়েছে তাঁর কানে তা চিরদিন লেগে থাকবার কথা। চিরদিন যে লেগে থাকে তার কারণ A thing of beauty is a joy for ever। এর সৌন্দর্য কোথায়? এ প্রশ্নের কোনো স্পষ্ট জবাব দেবার জো নেই। পোয়েট্রি অথবা বিউটি যে-ভাষায় আমাদের কাছে আত্মপ্রকাশ করে, তা অপর কোনো ভাষায় অনুবাদ করা অসম্ভব। আর আমরা যাকে ভাষা বলি, সে তো হয় কর্মের, নয় জ্ঞানের ভাষা। তবে ঐ ক’টি কথায় জয়দেব আমাদের চোখের সম্মুখে যে-রপ ধরে দিয়েছেন তা একটু নিরীক্ষণ করে দেখা যাক। কবিতা মাত্রেরই ভিতর ছবি থাকে; অতএব দেখা যাক কবি এ ঋলে কি ছবি এঁকেছেন। বর্ষার যে ছবি কালিদাস এঁকেছেন এ সে-ছবি নয়। এর ভিতর বজ্র নেই বিদ্যুৎ নেই বৃষ্টি নেই–অর্থাৎ যে-সব জিনিস মানুষের ইন্দ্রিয়ের উপর হঠাৎ চড়াও হয় এবং মানুষের মনকে চমকিত করে সে-সব জিনিসের বিন্দুবিসর্গও উক্ত পদে নেই। কবি শুধু দুটি কথা বলেছেন, আকাশ মেঘে কোমল ও বনতমালে শ্যাম; তিনি তুলির দুটি টানে একসঙ্গে আকাশের ও পৃথিবীর চেহারা এঁকেছেন। এ চিত্রের ভিতরে কোনো রেখা নেই, আছে শুধু রঙ; আর সে রঙ নানাজাতীয় নয়; একই রঙ-শ্যাম, উপরে একটু ফিকে নীচে একটু গাঢ়। এ বর্ণনা হচ্ছে–চিত্রকররা যাকে বলে—ল্যাণ্ডকেপ পেন্টিং। তুলির দু টানে জয়দেব বর্ষার নির্জনতার, নীরবতার, তার নিবিড় শ্যামশ্রীর কি সমগ্র কি সুন্দর ছবি এঁকেছেন। এ ছবি যার চোখে একবার পড়েছে তার মনে এ ছবির দাগ চিরদিনের মতো থেকে যায়। বাইরে যা ক্ষণিকের, মনে তা চিরস্থায়ী হয়। যা অনিত্য তাকে নিত্য করাই তো কবির ধর্ম।

১০.

এর থেকে মনে পড়ে গেল যে, কবিতা বস্তু কি? এ প্রশ্ন মানুষে আবহমানকাল জিজ্ঞাসা ক’রে এসেছে, আর যথাশক্তি তার উত্তর দিতে চেষ্টা করেছে। এ সমস্যার মীমাংসায় ইউরোপীয় সাহিত্য ভরপুর। আরিস্টটলের যুগ থেকে এ আলোচনা পরে হয়েছে আর আজও থামে নি, বরং সটান চলছে। এর চুড়ান্ত মীমাংসা যে আজ পর্যন্ত হয় নি তার কারণ, যুগে যুগে মানুষের মন বদলায় এবং তার ফলে পুরনো মীমাংসা সব নতুন সমস্যা হয়ে ওঠে। যখন মানুষের মনে কোনো সমস্যা থাকবে না তখনই তার চুড়ান্ত মীমাংসা হবে। যাক বিদেশের কথা। কাব্যজিজ্ঞাসা যে এ দেশের লোকের মনেও উদয় হয়েছিল তার পরিচয় যিনি পেতে চান, তিনি ‘কাব্যজিজ্ঞাসা’ সম্বন্ধে আমার বন্ধু, শ্ৰীঅতুলচন্দ্র গুপ্তের বিস্তৃত আলোচনা পড়ে দেখুন। আমাদের দেশের দার্শনিকরা ব্রহ্মজিজ্ঞাসা’র যে উত্তর দিয়েছেন ‘কাব্যজিজ্ঞাসা’রও সেই একই উত্তর দিয়েছেন। সে উত্তর হচ্ছে নেতি নেতি, অর্থাৎ কাব্যের প্রাণ রীতিও নয়, নীতিও নয়, ভাষাও নয় ভাবও নয়। এক কথায় কাব্যের প্রাণ হচ্ছে একটি mystery। প্রাণ জিনিসটা mystery, এ সত্য জেনেও মানুষে দেহের ভিতর প্রাণের সধান করেছে, আর তা কতকটা পেয়েছে। সুতরাং কবিতার দেহতত্ত্বের আলোচনা করলে আমরা তার প্রাণের সন্ধান পেতে পারি। দার্শনিকের সঙ্গে কবির প্রভেদই এই যে, দার্শনিকের কাছে দেহ ও মন, ভাষা আর ভাব দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বস্তু; কিন্তু কবির কাছে ও-দই এক। তাঁর কাছে ভাষাই ভাব, আর ভাবই ভাষা। কাব্যবস্তু যে ভাষার অতিরিক্ত তার কারণ ভাষার প্রতি পরমাণুর ভিতর ভাব আছে, এবং তা যে ভাবের অতিরিক্ত, তার কারণ প্রতি ভাবকণার ভিতর ভাষা আছে। এই কারণে বলতে সাহসী হচ্ছি যে, জয়দেবের উত্ত পদ যে আমাদের মুগ্ধ করে তার একটি কারণ তার music, আর এ musicএর মূলে আছে অনুপ্রাস। অনুপ্রাস জিনিসটে কতদূর বিরক্তিকর হতে পারে তার পরিচয় বাংলার অনেক যাত্রাওয়ালা ও কবিওয়ালার গানে পাওয়া যায়। কিন্তু কবির হাতে পড়লে অনুপ্রাস যে কবিতাতে প্রাণসঞ্চার করে তার পরিচয় অপর ভাষার অপর কবিদের মুখেও পাওয়া যায়। শেকসপীয়রের full fathom five thy father lies, এবং কোলরিজের five miles meandering with a mazy motion-এ দুটি পদ যে মনের দুয়ারে ঘা দেয় এ কথা কোন সহৃদয় লোক অস্বীকার করবে? এ দুটি লাইনের সৌন্দর্য যে অনুপ্রাস-নিরপেক্ষ নয় সে তো প্রত্যক্ষ সত্য। জয়দেবের বর্ষার রূপবর্ণনা অনুপ্রাসের গুণে ভাবঘন হয়ে উঠেছে, আর এই একই কবির বসন্তবর্ণনা অনুপ্রাসের দোষে নিরর্থক হয়েছে–

ললিতলবঙ্গলতা পরিশীলনকোমলমলয়সমীরে

শুধু শব্দঘটা মাত্র, ছবিও নয়, গানও নয়। ও-পদের ভিতর সে ধ্বনিও নেই, সে আলোকও নেই, যা আমাদের ভিতরের বাইরের রূপলোককে আলোকিত ও প্রতি ধ্বনিত করে।

১১.

কাব্যবস্তুর স্বরূপ বর্ণনা করতে হলে যে নেতি নেতি বলতে হয়—এ কথা আমিও জানি, আমিও মানি। কিন্তু এ নেতি নেতির অর্থ এই যে, রচনার যে গুণকে অথবা রূপকে আমরা কাব্য বলি তা শব্দালংকার অর্থালংকার প্রভৃতি সবরকম অলংকারের অতিরিক্ত। তবে কাব্য অলংকার-অতিরিক্ত বলে অলংকার-রিক্ত নয়। কাব্যের সর্বপ্রকার অলংকারের মধ্যে যে অলংকার সবচেয়ে সস্তা সেই অলংকার অর্থাং অনুপ্রাসও যে আমাদের মনে কাব্যের সুর সঞ্চার করতে পারে, এ কথা মেনে নিলে বহু কবিতার রস উপভোগ করা আমাদের পক্ষে সহজ হয়ে আসে, কারণ এ বিষয়ে আমাদের মন অনেক ভুল আইডিয়ার বাধামুক্ত হয়। ভালোকথা, ভাবেরও কি অনুপ্রাস নেই? সেই অনুপ্রাসই কানের ভিতর দিয়ে মর্মে প্রবেশ করে না, যে অনুপ্রাসের ভিতর অনুভাষ নেই; যেমন সে সংগীত মানুষের মনের দুয়োর খুলতে পারে না, যে সংগীতের অন্তরে অনুরণন নেই।

অনুপ্রাস সম্বন্ধে এত কথা বলোম এইজন্য যে, আজকের দিনে যে-সব বাংলা গান মনের ভিতর গুনগুন করছে তারা সবই অনুপ্রাসে প্রাণবন্ত। বাংলার পুরনো কবিদের দুটি পুরনো গান রবীন্দ্রনাথ আমাদের নতুন করে শুনিয়েছেন। বিদ্যাপতি কোম্‌ অতীত বর্ষার দিনে গেয়ে উঠেছিলেন–

এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।

কিন্তু তার পরেই তিনি যা বলেছেন তার ভিতর কাব্যরস এক ফোঁটাও নেই–

কুলিশ শত শত পাত মোদিত
ময়ূর নাচত মাতিয়া

এ হচ্ছে সংস্কৃত কবিদের বাঁধিগৎ। তাই ও কবিতা থেকে ঐ প্রথম দুটি পদ বাদ দিলে বিদ্যাপতির বাদবাকি কথা কাব্য হত না। বরং সত্য কথা বলতে গেলে ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর’ এই কথা-ক’টিই সমগ্র কবিতাটিকে রূপ দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। ভরা বাদর মাহ ভাদরের সর যার কানে বেজেছে, সেই মুহূর্তে সে অনুভব করেছে যে ‘শূন্য মন্দির মোর’। যে মুহূর্তে আমরা শুন্যতার রূপ প্রত্যক্ষ করি, সে মুহূর্তে যে ভাব আমাদের মনকে পেয়ে বসে তার নাম মুক্তির আনন্দ। কাব্যজ আনন্দকেও আলংকারিকরা মুক্তির আনন্দ বলেছেন। আলংকারিকদের এ কথা মিছে নয়।

১২

অপর কবিতাটি এই–

রজনী শাঙন ঘন ঘন দেয়া-গরজন
রিমিঝিমি শবদে বরিষে।
পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে বিগলিত চীর অঙ্গে
নিন্দ যাই মনের হরিষে॥

এ কবিতা যাঁর কানে ও প্রাণে একসঙ্গে না বাজে তাঁর কাছে কবিতা সম্বন্ধে বো করে কোনো ফল নেই। আলংকারিকরা বলেন—

তয়া কবিতয়া কিংবা তয়া বনিতয়া চ কিম্‌।
পদবিন্যাস মাত্রেন বয়া নাপহৃতং মনঃ।।

উক্ত কবিতা পদবিন্যাস মাত্র যাঁর মন হরণ করে, তিনিই যথার্থ কাব্যরসিক। আর যাঁদের করে না, ভগবান তাদের মঙ্গল করুন।

উপরে যে দু-চারিটি নমুনা দিলম তার থেকেই দেখা যায় যে, বাঙালি কবির বর্ষবর্ণনা ছবিপ্রধান নয়, গানপ্রধান। বাঙালি কবিরা বর্ষার বাহ্যরূপের তেমন খুঁটিয়ে বর্ণনা করেন না যেমন প্রকাশ করেন বর্ষাগমে নিজেদের মনের রপান্তরের। শব্দ দিয়ে ছবি আঁকার চাইতে শব্দ দিয়ে সংগীত রচনা করবার দিকেই বাঙালি কবির ঝোঁক বেশি। তাই তাঁদের কবিতায় উপমার চাইতে অনুপ্রাস প্রবল।

সংস্কৃত কবির চোখ আর বাঙালি কবির কান এ দুইই তাদের পণ অভিব্যক্তি লাভ করেছে রবীন্দ্রনাথের কাব্যে। সকলেই জানেন যে, রবীন্দ্রনাথ বর্ষার বিষয়ে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। ফলে ও-ঋতুর বিচিত্র রূপের প্রতি রূপের চিত্র তাঁর কাব্যে ছন্দোবধে আবদ্ধ হয়েছে। এ ঋতু সম্বন্ধে তাঁর কবিতাবলীকে একটি বিচিত্র পিকচার গ্যালারি বললে অসংগত কথা বলা হয় না। অপর পক্ষে বর্ষার সরে মনের ভিতর যে সুর বেজে ওঠে সেই অপার্থিব সুরের দিব্যরূপ পর্ণেমাত্রায় পরিস্ফুট হয়েছে রবীন্দ্রনাথের একটি বর্ষার কবিতায়, সে কবিতার প্রথম পদ হচ্ছে–

এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।

যে কবিতার ভাষা ও ভাব মিলে এক হয়ে যায় সেই কবিতাই যদি perfect কবিতা হয় তা হলে আমি জোর করে বলতে পারি এর তুল্য perfect কবিতা বাংলাতেও নেই, সংস্কৃতেও নেই। ও-কবিতা শুনে–

সমাজসংসার মিছে সব
মিছে এ জীবনের কলরব

এ কথা যিনি ক্ষণিকের জন্যও হৃদয়ঙ্গম না করেন তাঁর এই বর্ষার দেশে জন্মগ্রহণ করাটা কর্মভোগ মাত্র।

ভাদ্র ১৩৩৪

মলাট-সমালোচনা

মলাট-সমালোচনা

‘সাহিত্য’সম্পাদকমহাশয় সমীপেষু

‘বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীচি’ -জিনিসটা এদেশে একটা মস্ত ঠাট্টার সামগ্রী। কিন্তু বারো পাতা বইয়ের তেরো পাতা সমালোচনা দেখে কারোই হাসি পায় না। অথচ বীজ পরিমাণে এক হাত কমই হোক আর এক হাত বেশিই হোক, তার থেকে নতুন ফল জন্মায়; কিন্তু ঐরূপ সমালোচনায় সাহিত্যের কিংবা সমাজের কি ফললাভ হয়, বলা কঠিন। সেকালে যখন সত্রআকারে মূল গ্রন্থ রচনা করবার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, তখন ভাষ্যে-টীকায়কারিকায় তার বিস্তৃত ব্যাখ্যার আবশ্যকতা ছিল। কিন্তু একালে যখন, যেকথা দু কথায় বলা যায় তাই দ শ কথায় লেখা হয়, তখন সমালোচকদের ভাষ্যকার না হয়ে সত্ৰকার হওয়াই সংগত। তাঁরা যদি কোনো নব্যগ্রন্থের খেই ধরিয়ে দেন, তাহলেই আমরা পাঠকবর্গ যথেষ্ট মনে করি। কিন্তু ঐরূপ করতে গেলে তাঁদের ব্যাবসা মারা যায়। সুতরাং তাঁরা যে সমালোচনার রীতিপরিবর্তন করবেন, এরূপ আশা করা নিষ্ফল।

শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যুক্তির প্রতিবাদ করে একটি প্রবন্ধ লেখেন। আমার ঠিক মনে নেই যে, তিনি সাহিত্যেও অত্যুক্তি যে নিন্দনীয়, একথাটা বলেছেন কি না। সে যাই হোক, রবীন্দ্রবাবুর সেই তীব্র প্রতিবাদে বিশেষ কোনো সুফল হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং দেখতে পাই যে, অত্যুক্তির মাত্রা ক্রমে সপ্তমে চড়ে গেছে। সমালোচকদের অত্যুক্তিটা প্রায় প্রশংসা করবার সময়েই দেখা যায়। বোধ হয় তাঁদের বিশ্বাস যে, নিন্দা-জিনিসটা সোজা কথাতেই করা চলে কিন্তু প্রশংসাকে ডালপালা দিয়ে পত্রে-পুষ্পে সাজিয়ে বার করা উচিত। কেননা, নিন্দুকের চাইতে সমাজে চাটকারের মর্যাদা অনেক বেশি। কিন্তু আসলে অতিনিন্দা এবং অতিপ্রশংসা উভয়ই সমান জঘন্য। কারণ, অত্যুক্তির ‘অতি’ শুধু সুরুচি এবং ভদ্রতা নয়, সত্যেরও সীমা অতিক্রম করে যায়। এককথায়, অত্যুক্তি মিথ্যোক্তি। মিছাকথা মানযে বিনা কারণে বলে না। হয় ভয়ে নাহয় কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্যই লোকে সত্যের অপলাপ করে। সম্ভবত অভ্যাসবশত মিথ্যাকে সত্যের অপেক্ষা অধিকমাত্রায় কেউ-কেউ চর্চা করে। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে মিথ্যাকথা বলা চর্চা করলে ক্রমে তা উদ্দেশ্যবিহীন অভ্যাসে পরিণত হয়। বাংলাসাহিত্যে আজকাল যেরূপ নির্লজ্জ অতিপ্রশংসার বাড়াবাড়ি দেখতে পাওয়া যায়, তাতে মনে হয় যে, তার মূলে উদ্দেশ্য এবং অভ্যাস দুই জিনিসই আছে। এক-একটি ক্ষুদ্র লেখকের ক্ষুদ্র পস্তকের যেসকল বিশেষণে স্তুতিবাদ করা হয়ে থাকে, সেগুলি বোধ হয় শেক্সপীয়র কিংবা কালিদাসের সম্বন্ধে প্রয়োগ করলেও একটু বেশি হয়ে পড়ে। সমালোচনা এখন বিজ্ঞাপনের মতি ধারণ করেছে। তার থেকে বোঝা যায় যে, যাতে বাজারে বইয়ের ভালোরকম কাটতি হয়, সেই উদ্দেশ্যে আজকাল সমালোচনা লেখা হয়ে থাকে। যে উপায়ে পেটেন্ট ঔষধ বিক্রি করা হয়, সেই উপায়েই সাহিত্যও বাজারে বিক্রি করা হয়। লেখক সমালোচক হয় একই ব্যক্তি, নয় পরপরে একই কারবারের অংশীদার। আমার মাল তুমি যাচাই করে পয়লা নম্বরের বলে দাও, তোমার মাল আমি যাচাই করে পয়লা নম্বরের বলে দেব, এইরকম একটা বন্দোবস্ত পেশাদার লেখকদের মধ্যে যে আছে, একথা সহজেই মনে উদয় হয়। এই কারণেই, পেটেন্ট ঔষধের মতই একালের ছোটগল্প কিংবা ছোটকবিতার বই মেধা হ্রী ধী শ্রী প্রভৃতির বর্ধক এবং নৈতিক-বলকারক বলে উল্লিখিত হয়ে থাকে। কিন্তু এরূপ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে পাঠক নিত্যই প্রতারিত এবং প্রবঞ্চিত হয়। যা চ্যবনপ্রাশ বলে কিনে আনা হয় তা দেখা যায় প্রায়ই অকালকুষ্মাণ্ডখণ্ডমাত্র।

অতি-বিজ্ঞাপিত জিনিসের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অতি ম। কারণ, মানবহাদয়ের স্বাভাবিক দুর্বলতার উপর বিজ্ঞাপনের হল, এবং মানবমনের সরল বিশ্বাসের উপর বিজ্ঞাপনের ছল প্রতিষ্ঠিত। যখন আমাদের একমাথা চুল থাকে, তখন আমরা কেশবধক তৈলের বড়-একটা সন্ধান রাখি নে। কিন্তু মাথায় যখন টাক চকচক করে ওঠে, তখনই আমরা কুতলবষ্যের শরণ গ্রহণ করে নিজেদের অবিমৃষ্যকারিতার পরিচয় পাই এবং দিই। কারণ, তাতে টাকের প্রসার ক্রমশই বৃদ্ধি পায়, এবং সেইসঙ্গে টাকাও নষ্ট হয়। বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য আমাদের মন ও নয়ন আকর্ষণ করা। বিজ্ঞাপন প্রতি ছত্রের শেষে প্রশ্ন করে— মনোযোগ করছেন তো?’ আমাদের চিত্ত আকর্ষণ করতে না পারলেও, বিজ্ঞাপন চব্বিশঘণ্টা আমাদের নয়ন আকর্ষণ করে থাকে। ও জিনিস চোখ এড়িয়ে যাবার জো নেই। কারণ, এ যুগে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রবন্ধের গা ঘেঁষে থাকে, মাসিকপত্রিকার শিরোভূষণ হয়ে দেখা দেয়; এককথায় সাহিত্যজগতে যেখানেই একটু ফাঁক দেখে, সেইখানেই এসে জুড়ে বসে। ইংরেজিভাষায় একটি প্রবচন আছে যে, প্রাচীরের কান আছে। এদেশে সে বধির কি না জানি নে, কিন্তু বিজ্ঞাপনের দৌলতে মক নয়। রাজপথের উভয় পার্শ্বের প্রাচীর মিথ্যাকথা তারস্বরে চীৎকার করে বলে। তাই আজকাল পৃথিবীতে চোখকান না বুজে চললে বিজ্ঞাপন কারও ইন্দ্রিয়ের অগোচর থাকে না। যদি চোখকান বুজে চল, তাহলেও বিজ্ঞাপনের হাত থেকে নিস্তার নেই। কারণ, পদব্রজেই চল, আর গাড়িতেই যাও, রাস্তার লোকে তোমাকে বিজ্ঞাপন ছড়ে মারে। এতে আশ্চর্য হবার কোনো কথা নেই; ছুড়ে মারাই বিজ্ঞাপনের ধর্ম। তার রং ছড়ে মারে, তার ভাষা ছড়ে মারে, তার ভাব ছুড়ে মারে। সুতরাং বিজ্ঞাপিত জিনিসের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা না থাকলেও তার মোড়কের সঙ্গে এবং মলাটের সঙ্গে আমার চাক্ষুষ পরিচয় আছে। আমি বহু ঔষধের এবং বহু গ্রন্থের কেবলমাত্র মুখ চিনি ও নাম জানি। যা জানি, তারই সমালোচনা করা সম্ভব। সুতরাং আমি মলাটের সমালোচনা করতে উদ্যত হয়েছি। অন্তত মুখপাতটকু দোরস্ত করে দিতে পারলে আপাতত বঙ্গসাহিত্যের মুখরক্ষা হয়।

আমি পূর্বেই বলেছি যে, নব্য বঙ্গসাহিত্যের কেবলমাত্র নাম-রূপের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। প্রধানত সেই নাম-জিনিসটার সমালোচনা করাই আমার উদ্দেশ্য। কিন্তু রূপ-জিনিসটে একেবারে ছেটে দেওয়া চলে না বলে সেসম্বন্ধে দুই-একটা কথা বলতে চাই। ডাক্তারখানার আলো যেমন লাল নীল সবুজ বেগনে প্রভৃতি নানারূপ কাঁচের আবরণের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়, তেমনি পুস্তকের দোকানে একালের পুস্তক-পুস্তিকাগুলি নানারূপ বর্ণচ্ছটায় নিজেদের প্রকাশ করে। সুতরাং নব্যসাহিত্যের বর্ণপরিচয় যে আমার হয় নি, একথা বলতে পারি নে। কবিতা আজকাল গোধুলিতে গা-ঢাকা দিয়ে ‘লজ্জান নববধ সম’ আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হয় না; কিন্তু গালে আলতা মেখে রাজপথের সম্মুখে বাতায়নে এসে দেখা দেয়। বর্ণেরও একটা আভিজাত্য আছে। তার সসংযত ভাবের উপরেই তার গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য নির্ভর করে। বাড়াবাড়ি-জিনিসটা সব ক্ষেত্রেই ইতরতার পরিচায়ক। আমার মতে পুজার বাজারের নানারূপ রংচঙে পোশাক পরে প্রাপ্তবয়স্ক সাহিত্যের সমাজে বার হওয়া উচিত নয়। তবে পুজার উপহারস্বরূপে যদি তার চলন হয়, তাহলে অবশ্য কিছু বলা চলে না। সাহিত্য যখন কুন্তলীন তাম্বুলীন এবং তরলআলতার সঙ্গে একশ্রেণীভুক্ত হয়, তখন পুরুষের পক্ষে পুরুষ বাক্য ছাড়া তার সম্বন্ধে অন্যকোনো ভাষা ব্যবহার করা চলে না। তবে এইকথা জিজ্ঞাসা করি যে, এতে যে আত্মমর্যাদার লাঘব হয়, এ সহজ কথাটা কি গ্রন্থকারেরা বুঝতে পারেন না; কবি কি চান যে, তাঁর হদয়রক্ত তরল-আল তার শামিল হয়; চিন্তাশীল লেখক কি এইকথা মনে করে সুখী হন যে, তাঁর মস্তিষ্ক লোকে সুবাসিত নারিকেলতৈল হিসাবে দেখবে; এবং বাণী কি রসনানিঃসত পানের পিকের সঙ্গে জড়িত হতে লজ্জা বোধ করেন না? আশা করি যে, বইয়ের মলাটের এই অতিরঞ্জিত রূপ শীঘ্রই সকলের পক্ষেই অরুচিকর হয়ে উঠবে। অ্যান্টিক কাগজে ছাপানো এবং চকচকে ঝকঝকে তর্কতকে করে বাঁধানো পুস্তকে আমার কোনো আপত্তি নেই। দপ্তরিকে আসল গ্রন্থকার বলে ভুল না করলেই খুশি হই। আমরা যেন ভুলে না যাই যে, লেখকের কৃতিত্ব মলাটে শুধু ঢাকা পড়ে। জীর্ণ কাগজে, শীর্ণ অক্ষরে, ক্ষীণ কালিতে ছাপানো একখানি পদকপতর, যে শত শত তর্কতকে ঝকঝকে চকচকে গ্রন্থের চাইতে শতগুণ আদরের সামগ্রী।

এখন সমালোচনা শুরু করে দেবার পূর্বেই কথাটার একটু আলোচনা করা দরকার। কারণ, ঐ শব্দটি আমরা ঠিক অর্থে ব্যবহার করি কি না, সেবিষয়ে আমার একটু সন্দেহ আছে। প্রথমেই, ‘সম’-উপসর্গটির যে বিশেষ কোনো সার্থকতা আছে, এরূপ আমার বিশ্বাস নয়। শব্দ অতিকায় হলে যে তার গৌরব-বৃদ্ধি হয়, একথা আমি মানি; কিন্তু, দেহভারের সঙ্গেসঙ্গে যে বাক্যের অর্থ ভার বেড়ে যায়, তার কোনো বিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায় না। এ যুগের লেখকেরা মাতৃভাষায় লিখেই সন্তুষ্ট থাকেন না, কিন্তু সেইসঙ্গে মায়ের দেহপষ্টি করাও তাঁদের কর্তব্য বলে মনে করেন। কিন্তু সে পটিসাধনের জন্য বহুসংখ্যক অর্থপর্ণে ছোট-ছোট কথা চাই, যা সহজেই বঙ্গভাষার অঙ্গীভূত হতে পারে। স্বল্পসংখ্যক এবং কতকাংশে নিরর্থক বড়-বড় কথার সাহায্যে সে উদ্দেশ্যসিদ্ধি হবে না। সংস্কৃতভাষার সঙ্গে আমার পরিচয় অতি সামান্য; কিন্তু সেই স্বল্প পরিচয়েই আমার এইটকু জ্ঞান জন্মেছে যে, সে ভাষার বাক্যাবলী আয়ত্ত করা নিতান্ত কঠিন। সংস্কৃতের উপর হস্তক্ষেপ করবামাত্রই তা আমাদের হস্তগত হয় না। বরং আমাদের অশিক্ষিত হাতে পড়ে প্রায়ই তার অর্থ বিকৃতি ঘটে। সংস্কৃতসাহিত্যে গোঁজামিলন-দেওয়া-জিনিসটা একেবারেই প্রচলিত ছিল না। কবি হোন, দার্শনিক হোন, আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রত্যেক কথাটি ওজন করে ব্যবহার করতেন। শব্দের কোনোরূপ অসংগত প্রয়োগ সেকালে অমার্জনীয় দোষ বলে গণ্য হত। কিন্তু একালে আমরা কথার সংখ্যা নিয়েই ব্যস্ত, তার ওজনের ধার বড়-একটা ধারি নে। নিজের ভাষাই যখন আমরা সক্ষম অর্থ বিচার করে ব্যবহার করি নে, তখন স্বল্পপরিচিত এবং অনায়ত্ত সংস্কৃত শব্দের অর্থ বিচার করে ব্যবহার করতে গেলে সে ব্যবহার যে বন্ধ হবার উপক্রম হয়, তা আমি জানি। তবুও একেবারে বেপরোয়াভাবে সংস্কৃত শব্দের অতিরিক্ত-ব্যবহারের আমি পক্ষপাতী নই। তাতে মনোভাবও স্পষ্ট করে ব্যক্ত করা যায় না, এবং ভাষাও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপে দেখানো যেতে পারে, এই সমালোচনা’-কথাটা আমরা যে অর্থে ব্যবহার করি, তার আসল অর্থ ঠিক তা নয়। আমরা কথায় বলি লেখাপড়া শিখি; কিন্তু আসলে আমরা অধিকাংশ শিক্ষিত লোক শুধু পড়তেই শিখি লিখতে শিখি নে। পাঠকমাত্রেরই পাঠ্য কিংবা অপাঠ্য পুস্তক সম্বন্ধে মতামত গড়ে তোলবার ক্ষমতা থাক আর না থাক, মতামত ব্যক্ত করবার অধিকার আছে; বিশেষত সে কার্যের উদ্দেশ্য যখন আর-পাঁচজনকে বই পড়ানো, লেখানো নয়। সতরাং সমালোচিতব্য বিষয়ের বাংলাসাহিত্যে অভাব থাকলেও সমালোচনার কোনো অভাব নেই। এই সমালোচনা-বন্যার ভিতর থেকে একখানিমাত্র বই উপরে ভেসে উঠেছে। সে হচ্ছে শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আলোচনা। তিনি যদি উক্ত নামের পরিবর্তে তার সমালোচনা নাম দিতেন, তাহলে, আমার বিশ্বাস, বৃথা বাগাড়ম্বরে ‘আলোচনা’র ক্ষদ্র দেহ আয়তনে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে এত গরভার হয়ে উঠত যে, উক্ত শ্রেণীর আর-পাঁচখানা বইয়ের মত এখানিও বিস্মৃতির অতল জলে ডুবে যেত। এই দুটি শব্দের মধ্যে যদি একটি রাখতেই হয়, তাহলে ‘সম বাদ দিয়ে আলোচনা’ রক্ষা করাই শ্রেয়। যদিচ ওকথাটিকে আমি ইংরেজি criticism শব্দের ঠিক প্রতিবাক্য বলে মনে করি নে। আলোচনা মানে ‘আ’ অর্থাৎ বিশেষরূপে ‘লোচন’ অর্থাৎ ঈক্ষণ। যেবিষয়ে সন্দেহ হয়, তার সন্দেহভঞ্জন করবার জন্য বিশেষরূপে সেটিকে লক্ষ্য করে দেখবার নামই আলোচনা। তর্কবিতক বাগবিতণ্ডা আন্দোলন-আলোড়ন প্রভৃতি অর্থেও ঐ কথাটি আজকালকার বাংলাভাষায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু ওকথায় তার কোনো অর্থই বোঝায় না। আলোচনা’ ইংরেজি scrutinize শব্দের যথার্থ প্রতিবাক্য।Criticismশব্দের ঠিক প্রতিবাক্য বাংলা কিংবা সংস্কৃত ভাষায় না থাকলেও, ‘বিচার’ শব্দটি অনেকপরিমাণে সেই অর্থ প্রকাশ করে। কিন্তু ‘সমালোচনার পরিবতে ‘বিচার’ যে বাঙালি সমালোচকদের কাছে গ্রাহ্য হবে, এ আশা আমি রাখি নে। কারণ, এদের উদ্দেশ্য বিচার করা নয়, প্রচার করা। তাছাড়া যেকথাটা একবার সাহিত্যে চলে গেছে, তাকে অচল করবার প্রস্তাব অনেকে হয়ত দুঃসাহসিকতার পরিচয় বলে মনে করবেন। তার উত্তরে আমার বক্তব্য এই যে, পূর্বে যখন আমরা নির্বিচারে বহুসংখ্যক সংস্কৃত শব্দকে বঙ্গসাহিত্যের কারাগারে প্রবেশ করিয়েছি, এখন আবার সুবিচার করে তার গুটিকতককে মুক্তি দেওয়াটা বোধ হয় অন্যায় কার্য হবে না। আর-এক কথা। যদি criticism অর্থেই আমরা আলোচনা শব্দ ব্যবহার করি, তাহলে scrutinize অর্থে আমরা কি শব্দ ব্যবহার করব? সুতরাং, যে উপায়ে আমরা মাতৃভাষার দেহপটি করতে চাই, তাতে ফলে শুধু তার অঙ্গহানি হয়। শব্দ সম্বন্ধে যদি আমরা একটু শুচিবাতিকগ্রস্ত হতে পারি, তাহলে, আমার বিশ্বাস, বঙ্গভাষার নির্মলতা অনেকপরিমাণে রক্ষিত হতে পারে। অনাবশ্যকে যদি আমরা সংস্কৃতভাষার উপর হস্তক্ষেপ করতে সংকুচিত হই, তাতে সংস্কৃতভাষার উপর অবজ্ঞা দেখানো হবে না, বরং তার প্রতি যথার্থ ভক্তিই দেখানো হবে। শব্দগৌরবে সংস্কৃতভাষা অতুলনীয়। কিন্তু তাই বলে তার ধনিতে মধ হয়ে আমরা যে শুধু তার সাহায্যে বাংলাসাহিত্যে ফাঁকা আওয়াজ করব, তাও ঠিক নয়। বাণী কেবলমাত্র ধ্বনি নয়। আমি বহুদিন থেকে এই মত প্রচার করে আসছি, কিন্তু আমার কথায় কেউ কর্ণপাত করেন না। সাহিত্যজগতে একশ্রেণীর জীব বিচরণ করে, যাদের প্রাণের চাইতে কান বড়। সংগীতচর্চার লোভ তারা কিছুতেই সংবরণ করতে পারে না, এবং সে ব্যাপার থেকে তাদের নিরস্ত করবার ক্ষমতাও কারও নেই। প্রতিবাদ করায় বিশেষ-কোনো ফল নেই জেনেও আমি প্রতিবাদ করি; কারণ, আজকালকার মতে, আপত্তি নিশ্চিত অগ্রাহ্য হবে জেনেও আপত্তি করে আপত্তিকর জিনিসটে সম্পূর্ণ গ্রাহ্য করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কার্য বলে বিবেচিত হয়।

এখানে বলে রাখা আবশ্যক যে, কোনো বিশেষ লেখকের বা লেখার প্রতি কটাক্ষ করে আমি এসব কথা বলছি নে। বাংলাসাহিত্যের একটা প্রচলিত ধরন ফ্যাশান এবং ঢঙের সম্বন্ধেই আমার আপত্তি, এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই আমার উদ্দেশ্য। সমাজের কোনো চলতি স্রোতে গা ঢেলে দিয়ে যে আমরা কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থানে পৌঁছতে পারি, এমন অন্যায় ভরসা আমি রাখি নে। সকল উন্নতির মূলে থামা-জিনিসটে বিদ্যমান। এ পৃথিবীতে এমনকোনো সিড়ি নেই, যার ধাপে ধাপে পা ফেলে আমরা অবলীলাক্রমে স্বর্গে গিয়ে উপস্থিত হতে পারি। মনোজগতে প্রচলিত পথ ক্রমে সংকীর্ণ হতে সংকীর্ণতর হয়ে শেষে চোরাগলিতে পরিণত হয়, এবং মানুষের গতি আটকে দেয়। বিজ্ঞানে যাকে ইভলিউশন বলে, এককথায় তার পদ্ধতি এই যে, জীব একটা প্রচলিত পথে চলতে চলতে হঠাৎ এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে ডাইনে কি বাঁয়ে একটা নতুন পথ আবিষ্কার করে এবং সাহস করে সেই পথে চলতে আরম্ভ করে। এই নতুন পথ বার করা, এবং সেই পথ ধরে চলার উপরেই জীবের জীবন এবং মানুষের মনুষ্যত্ব নির্ভর করে। মুক্তির জন্যে, হয় দক্ষিণ নয় বাম মাগ যে অবলম্বন করতেই হবে, একথা এদেশে ঋষিমুনিরা বহুকাল পূর্বে বলে গেছেন; অতএব একেলে বিজ্ঞান এবং সেকেলে দর্শন উভয়ই এই শিক্ষা দেয় যে, সিধে পথটাই মৃত্যুর পথ। সুতরাং বাংলা লেখার প্রচলিত পথটা ছাড়তে পরামর্শ দিয়ে আমি কাউকে বিপথে নিয়ে যাবার চেষ্টা করি নে। আমার বিশ্বাস যে, সংস্কৃত ছেড়ে যদি আমরা দেশী পথে চলতে শিখি, তাতে বাংলাসাহিত্যের লাভ বই লোকসান নেই। ঐ পথটাই তো স্বাধীনতার পথ, এবং সেই কারণেই উন্নতির পথ— এই ধারণাটি মনে এসে যাওয়াতেও আমাদের অনেক উপকার আছে। আমি জানি যে, সাহিত্যে কিংবা ধর্মে একটা নতুন পথ আবিষ্কার করবার ক্ষমতা কেবলমাত্র দু-চারজন মহাজনেরই থাকে, বাদবাকি আমরা পাঁচজনে সেই মহাজন-প্রদর্শিত পন্থা অনুসরণ করে চলতে পারলেই আমাদের জীবন সার্থক হয়। গড্ডলিকাপ্রবাহ ন্যায়ের অবলম্বন করা জনসাধারণের পক্ষে স্বাভাবিকও বটে, কর্তব্যও বটে; কেননা, পৃথিবীর সকল ভেড়াই যদি মেড়া হয়ে ওঠে তো ঢুঁ-মারামারি করেই মেষ-বংশ নির্বংশ হবে। উক্ত কারণেই আমি লেখবার একটা প্রচলিত ধরনের বিরোধী হলেও প্রচলিত ভাষা ব্যবহারের বিরোধী নই। আমরা কেউ ভাষা-জিনিসটে তৈরি করি নে, সকলেই তৈরি ভাষা ব্যবহার করি। ভাষা-জিনিসটে কোনো-একটি বিশেষ ব্যক্তির মনগড়া নয়, যুগযুগান্তর ধরে একটি জাতির হাতে-গড়া। কেবলমাত্র মনোমত কথা বেছে নেবার, এবং ব্যাকরণের নিয়মরক্ষা করে সেই বাছাই কথাগলিকে নিজের পছন্দমত পাশাপাশি সাজিয়ে রাখবার স্বাধীনতাই আমাদের আছে। আমাদের মধ্যে যাঁরা জহরি, তাঁরা এই চলতি কথার মধ্যেই রত্ন আবিষ্কার করেন, এবং শিল্পগুণে গ্রথিত করে দিব্য হার রচনা করেন। নিজের রচনাশক্তির দারিদ্র্যের চেহারাই আমরা মাতৃভাষার মুখে দেখতে পাই, এবং রাগ করে সেই আয়নাখানিকে নষ্ট করতে উদ্যত হই ও পূর্বপুরুষদের সংস্কৃত পণের সাহায্যে মুখরক্ষা করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠি। একরকম কাঁচ আছে, যাতে মুখ মস্ত দেখায়, কিন্তু সেইসঙ্গে চেহারা অপরিচিত বিকটাকার ধারণ করে। আমাদের নিজেকে বড় দেখাতে গিয়ে যে আমরা কিম্ভূতকিমাকার রূপ ধারণ করি, তাতে আমাদের কোনো লজ্জাবোধ হয় না। এখানে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, প্রচলিত ভাষা কাকে বলে। তার উত্তরে আমি বলি, যে ভাষা আমাদের সুপরিচিত, সম্পূর্ণ আয়ত্ত, এবং যা আমরা নিত্য ব্যবহার করে থাকি। তা খাঁটি বাংলাও নয়, খাঁটি সংস্কৃতও নয়, কিংবা উভয়ে মিলিত কোনোরূপ খিচুড়িও নয়। যে সংস্কৃত শব্দ প্রকৃত কিংবা বিকৃত রূপে বাংলা কথার সঙ্গে মিলেমিশে রয়েছে, সে শব্দকে আমি বাংলা বলেই জানি এবং মানি। কিন্তু কেবলমাত্র নতুনত্বের লোভে নতুন করে যেসকল সংস্কৃত শব্দকে কোনো লেখক জোর করে বাংলাভাষার ভিতর প্রবেশ করিয়েছেন, অথচ খাপ খাওয়াতে পারেন নি, সেইসকল শব্দকে ছতে আমি ভয় পাই। এবং যেসকল সংস্কৃত শব্দ স্পষ্টত ভুল অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেইসকল শব্দ যাতে ঠিক অর্থে ব্যবহত হয়, সেবিষয়ে আমি লেখকদের সতর্ক হতে বলি। নইলে বঙ্গভাষার বনলতা যে সংস্কৃতভাষার উদ্যানলতাকে তিরস্কৃত করবে, এমন দুরাশা আমার মনে স্থান পায় না। শব্দকল্পদ্রুম থেকে আপনা হতে খসে যা আমাদের কোলে এসে পড়েছে, তা মুখে তুলে নেবার পক্ষে আমার কোনো আপত্তি নেই। তলার কুড়োও, কিন্তু সেইসঙ্গে গাছেরও পেড়ো না। তাতে যে পরিমাণ পরিশ্রম হবে, তার অনুরূপ ফললাভ হবে না।

শুধু গাছ থেকে পাড়া নয়, একেবারে তার আগডাল থেকে পাড়া গুটিকতক শব্দের পরিচয় আমি সম্প্রতি বইয়ের মলাটে পেয়েছি। এবং সে সম্বন্ধে আমার দু-একটি কথা বক্তব্য আছে। যাঁরা ‘শব্দাধিক্যাৎ অর্থাধিক্যং’ মীমাংসার এই নিয়ম মানেন না, বরং তার পরিবর্তে সংস্কৃত শব্দ সম্বন্ধে ‘অধিকন্তু ন দোষায়’— এই উদ্ভট বচন অনুসারে কার্যানুবর্তী হয়ে থাকেন, তাঁরাও একটা গণ্ডির ভিতর থেকে বেরিয়ে যেতে সাহসী হন না। এমন সাহিত্য-বীর বোধ হয় বাংলাদেশে খুব কম আছে, যারা বঙ্গরমণীর মাথায় ধম্মিল্ল চাপিয়ে দিতে সংকুচিত না হয়, যদি সে বেচারারা নীরবে পুরুষের সব অত্যাচারই সহ্য করে থাকে। বঙ্কিমী যুগে সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার কিছু, কম ছিল না। অথচ স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রও ‘প্রাড়বিবাক’ বাক্যটি ‘মলিম্লুচে’র ন্যায় কটু ভাষার হিসাবে গণ্য করে চোর এবং বিচারপতিকে একই আসনে বসিয়ে দিয়েছিলেন। ‘প্রাড়বিবাক’ বেচারা বাঙালিজাতির নিকট এতই অপবিচিত ছিল যে, বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে তার ঐরূপ লাঞ্ছনাতেও কেউ আপত্তি করে নি। কিন্তু আজকাল ওর চাইতেও অপরিচিত শব্দও নতুন গ্রন্থের বক্ষে কৌস্তুভমণির মত বিরাজ করতে দেখা যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমি দু-একটির উল্লেখ করব।

শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার বড়াল জাতকবি। তাঁর ভালো-মন্দ-মাঝারি সকল কবিতাতেই তাঁর কবির জাতির পরিচয় পাওয়া যায়। বোধ হয় তাঁর রচিত এমন-একটি কবিতাও নেই, যার অন্তত একটি চরণেও ধ্বজবজ্রাঙ্কুশের চিহ্ন না লক্ষিত নয়। সত্যের অনুরোধে একথা আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে, তাঁর নতুন পুস্তকের নামটিতে আমার একটু খটকা লেগেছিল। ‘এষা’ শব্দের সঙ্গে আমার ইতিপূর্বে কখনো দেখা-সাক্ষাৎ হয় নি, এবং তার নামও আমি পূর্বে কখনো শুনি নি। কাজেই আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল যে, হয়ত ‘আয়েষা’ নয়ত ‘এশিয়া’ কোনোরূপ ছাপার ভুলে ‘এষা’-রপ ধারণ করেছে। আমার এরূপ সন্দেহ হবার কারণও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। বঙ্কিমচন্দ্র যখন আয়েষাকে নিয়ে নভেল লিখেছেন, তখন তাকে নিয়ে অক্ষয়কুমার যে কবিতা রচনা করবেন, এতে আর আশ্চর্য হবার কারণ কি থাকতে পারে। আবার বলি ওসমান! এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর।’— এই পদটির উপর রমণীহদয়ের সপ্তকাণ্ড-রামায়ণ খাড়া করা কিছু কঠিন নয়। তারপর ‘এশিয়া’, প্রাচীর এই নবজাগরণের দিনে তার প্রাচীন নিদ্রাভঙ্গ করবার জন্য যে কবি উৎসুক হয়ে উঠবেন, এও তো স্বাভাবিক। যার ঘুম সহজে ভাঙে না, তার ঘুম ভাঙাবার দুটিমাত্র উপায় আছে–হয় টেনে-হিঁচড়ে, নয় ডেকে। এশিয়ার ভাগ্যে টানাহেঁচড়ানো-ব্যাপারটা তো পুরোদমে চলছে, কিন্তু তাতেও যখন তার চৈতন্য হল না, তখন ডাকা ছাড়া আর কি উপায় আছে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এশিয়াকে কাব্যে দর্শনে নানারূপ ঘুমপাড়ানি-মাসিপিসির গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে গেছেন। এখন আবার জাগাতে হলে এ যুগের কবিরা ‘জাগর’-গান গেয়েই তাকে জাগাতে পারবেন। সে গান অনেক কবি সুরে-বেসুরে গাইতেও শুরু করে দিয়েছেন। সুতরাং আমার সহজেই মনে হয়েছিল যে, অক্ষয়কুমার বড়ালও সেই কার্যে ব্রতী হয়েছেন। কিন্তু এখন শুনছি যে, ও ছাপার ভুল নয়, আমারই ভুল। প্রাচীন গাঁথার ভাষায় নাকি ‘এষা’র অর্থ অন্বেষণ। একালের লেখকেরা যদি শব্দের অন্বেষণে সংস্কৃতযুগ ডিঙিয়ে একেবারে প্রাচীন গাঁথা-যুগে গিয়ে উপস্থিত হন, তাহলে একেলে বঙ্গ-পাঠকদের উপর একটু অত্যাচার করা হয়; কারণ, সেই শব্দের অর্থ-অন্বেষণে পাঠক যে কোন দিকে যাবে, তা স্থির করতে পারে না। আজকালকার বাংলা বুঝতে অমরের সাহায্য আবশ্যক, তারপর যদি আবার যাস্ক চর্চা করতে হয়, তাহলে বাংলাসাহিত্য পড়বার অবসর আমরা কখন পাব? যাস্কের সাহায্যেও যদি তার অর্থবোধ না হয়, তাহলে বাংলাসাহিত্যের চর্চা যে আমরা ত্যাগ করব, তাতে আর সন্দেহ কি। অর্থবোধ হয় না বলে যখন আমরা আমাদের পরকালের সম্পতির একমাত্র সহায় যে সন্ধ্যা, তারই পাঠ বন্ধ করেছি, তখন ইহকালের ক্ষণিক সুখের লোভে যে আমরা গাঁথার শব্দে রচিত বাংলাসাহিত্য পড়ব, এ আশা করা যেতে পারে না। তাছাড়া বৈদিক এবং অতিবৈদিক ভাষা থেকে যদি আমরা বাক্যসংগ্রহ করতে আরম্ভ করি, তাহলে তান্ত্রিক ভাষাকেই বা ছাড়ব কেন। আমার লিখিত নতুন বইখানির নাম যদি আমি ‘ফেৎকারিণী’ ‘ডামর’ কিংবা ‘উড্ডীশ’ দিই, তাহলে কি পাঠকসম্প্রদায় খুব খুশি হবেন?

শ্রীযুক্ত সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পুস্তিকাগুলির নামকরণবিষয়ে যে অপূর্বতা দেখিয়ে থাকেন, তা আমাকে ভীত না করুক, বিস্মিত করে। আমি সাহিত্যের বাজারে মাল যাচাই করবার জন্য কষ্টিপাথর হাতে নিয়ে ব্যাবসা খুলে বসি নি। সুতরাং সুধীন্দ্রবাবুর রচনার দোষগুণ দেখানো আমার কর্তব্যের মধ্যে নয়। একমাত্র মলাটে তাঁর লেখা যেটকু আত্মপরিচয় দেয়, সেইটকু আমার বিচারাধীন। ‘মঞ্জষা করঙ্ক’ প্রভৃতি শব্দের সঙ্গে যে আমাদের একেবারে মুখ দেখাদেখি নেই, একথা বলতে পারি নে। তাহলেও স্বীকার করতে হবে যে, অন্তত পাঠিকাদের নিকট ও পদার্থগলি যত সুপরিচিত, ও নামগুলি তাদশ নয়। তাছাড়া ঐরূপ নামের যে বিশেষ কোনো সার্থকতা আছে, তাও আমার মনে হয় না। আমাদের কল্পনাজাত বস্তু আমরা প্যাটরায় পরে সাধারণের কাছে দিই নে, বরং সত্যকথা বলতে গেলে মনের প্যাটরা থেকে সেগুলি বার করে জনসাধারণের চোখের সম্মুখে সাজিয়ে রাখি। করল্কের কথা শুনলেই তালের কথা মনে হয়। পানের খিলির সঙ্গে সুধীন্দ্রবাবুর ছোটগল্পগুলির কি সাদশ্য আছে, জানি নে। করণ রস এবং পানের রস এক জিনিস নয়। আর-একটি কথা। তাম্বুলের সঙ্গেসঙ্গে চর্বিতচর্বণের ভাবটা মানুষের মনে সহজেই আসে। সে যাই হোক, আমি লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করছি যে, সুধীন্দ্রবাবুর আবিষ্কৃত ‘বৈতানিক’ শব্দ আমি বৈতালিক শব্দের ছাপান্তর মনে করেছিলাম। হাজারে ন-শ-নিরানব্বই জন বাঙালি পাঠক যে ও শব্দের অর্থ জানেন না, একথা বোধ হয় সুধীন্দ্রবাবু অস্বীকার করবেন না। আমার যতদূর মনে পড়ে তাতে কেবলমাত্র ভৃগুপোক্ত মানব-ধর্মশাস্ত্রে এক স্থলে ঐ শব্দটির ব্যবহার দেখেছি। কিন্তু তার অর্থ জানা আবশ্যক মনে করি নি। এইরূপ নামে বইয়ের পরিচয় দেওয়া হয় না, বরং তার পরিচয় গোপন করাই হয়। বাংলা-সরস্বতীকে ছদ্মবেশ না পরালে যে তাঁকে সমাজে বার করা চলে না, একথা আমি মানি নে।

এই নামের উদাহরণক’টি টেনে আনবার উদ্দেশ্য, আমার সেই প্রথম কথার প্রমাণ দেওয়া। সেকথা এই যে, বঙ্গসাহিত্যের ভিতর সমালোচনার মত নামকরণেও বিজ্ঞাপনের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। বিজ্ঞাপনের আরপাঁচটা দোষের ভিতর একটা হচ্ছে তার ন্যাকামি। ন্যাকামির উদ্দেশ্য হচ্ছে সহজে লোকপ্রিয় হওয়া, এবং তার লক্ষণ হচ্ছে ভাবে এবং ভাষায় মাধুর্যের ভান এবং ভঙ্গি। বঙ্গসাহিত্যে ক্ৰমে যে তাই প্রশ্রয় পাচ্ছে, সেইটে দেখিয়ে দেবার জন্যে আমার এত কথা বলা। আমরা এতটাই কোমলের ভক্ত হয়ে পড়েছি যে, শুদ্ধ স্বরকেও কোমল করতে গিয়ে বিকৃত করতে আমরা তিলমাত্র দ্বিধা করি নে। কথায় বলে, ‘যত চিনি দেবে ততই মিষ্টি হবে’। কিন্তু শর্করার ভাগ অতিরিক্ত হলে মিষ্টান্নও যখন অখাদ্য হয়ে ওঠে, তাতে আর সন্দেহ কি। লেখকেরা যদি ভাষাকে সুকুমার করবার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে তাকে সুস্থ এবং সবল করবার চেষ্টা করেন, তাহলে বঙ্গসাহিত্যে আবার প্রাণ দেখা দেবে। ভাষা যদি প্রসন্ন হয়, তাহলে তার কর্কশতাও সহ্য হয়। এ এতই সোজা কথা যে, এও যে আবার লোককে বোঝাতে হয়, এই মহা আপসোসের বিষয়। যখন বঙ্গসাহিত্যে অন্ধকার আর ‘বিরাজ’ করবে না, তখন এবিষয়ে আর কারও ‘মনোযোগ আকর্ষণ’ করবার দরকারও হবে না।

অগ্রহায়ণ ১৩১৯

যৌবনে দাও রাজটিকা

‘যৌবনে দাও রাজটিকা’

গতমাসের সবুজপত্রে শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যৌবনকে রাজটিকা দেবার প্রস্তাব করেছেন। আমার কোনো টীকাকার বন্ধ এই প্রস্তাবের বক্ষ্যমাণরূপ ব্যাখ্যা করেছেন–

যৌবনকে টিকা দেওয়া অবশ্যকর্তব্য, তাহাকে বসন্তের হস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য। এস্থলে রাজটিকা অর্থ রাজা অর্থাৎ যৌবনের শাসনকর্তাকর্তৃক তাহার উপকারার্থে দত্ত যে টিকা, সেই টিকা। উক্তপদ তৃতীয়াতৎপুরুষ সমাসে সিদ্ধ হইয়াছে।

উল্লিখিত ভাষ্য আমি রহস্য বলে মনে করতুম, যদি-না আমার জানা থাকত যে, এদেশে জ্ঞানীব্যক্তিদিগের মতে মনের বসন্তঋতু ও প্রকৃতির যৌবনকাল –দুই অশায়েস্তা, অতএব শাসনযোগ্য। এ উভয়কে জড়িতে জতলে আর বাগ মানানো যায় না; অতএব এদের প্রথমে পথক করে পরে পরাজিত করতে হয়।

বসন্তের স্পর্শে ধরণীর সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠে; অবশ্য তাই বলে পৃথিবী তার আলিঙ্গন হতে মুক্তিলাভ করবার চেষ্টা করে না, এবং পোষমাসকেও বারোমাস পষে রাখে না। শীতকে অতিক্রম করে বসন্তের কাছে আত্মসমর্পণ করায় প্রকৃতি যে অর্বাচীনতার পরিচয় দেয় না, তার পরিচয় ফলে।

প্রকৃতির যৌবন শাসনযোগ্য হলেও তাকে শাসন করবার ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই; কেননা, প্রকৃতির ধর্ম মানবধর্মশাস্ত্রবহির্ভূত। সেই কারণে জ্ঞানীব্যক্তিরা আমাদের প্রকৃতির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে বারণ করেন, এবং নিত্যই আমাদের প্রকৃতির উলটো টান টানতে পরামর্শ দেন; এই কারণেই মানুষের যৌবনকে বসন্তের প্রভাব হতে দরে রাখা আবশ্যক। অন্যথা, যৌবন ও বসন্ত এ দুয়ের আবির্ভাব যে একই দৈবীশক্তির লীলা–এইরূপ একটি বিশ্বাস আমাদের মনে স্থানলাভ করতে পারে।

এদেশে লোকে যে যৌবনের কপালে রাজটিকার পরিবর্তে তার পঠে রাজদণ্ড প্রয়োগ করতে সদাই প্রস্তুত, সেবিষয়ে আর-কোনো সন্দেহ নেই। এর কারণ হচ্ছে যে, আমাদের বিশ্বাস মানবজীবনে যৌবন একটা মস্ত ফাঁড়া কোনোরকমে সেটি কাটিয়ে উঠতে পারলেই বাঁচা যায়। এ অবস্থায় কি জ্ঞানী, কি অজ্ঞানী সকলেই চান যে, একলম্ফে বাল্য হতে বার্ধক্যে উত্তীর্ণ হন। যৌবনের নামে আমরা ভয় পাই, কেননা তার অন্তরে শক্তি আছে। অপরপক্ষে বালকের মনে শক্তি নেই, বালকের জ্ঞান নেই, বন্ধের প্রাণ নেই। তাই আমাদের নিয়ত চেষ্টা হচ্ছে, দেহের জড়তার সঙ্গে মনের জড়তার মিলন করা, অজ্ঞতার সঙ্গে বিজ্ঞতার সন্ধিস্থাপন করা। তাই আমাদের শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে ইচড়ে পাকানো, আর আমাদের সমাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে জাগ দিয়ে পাকানো।

আমাদের উপরোক্ত চেষ্টা যে ব্যর্থ হয় নি, তার প্রমাণ আমাদের সামাজিক জীবন। আজকের দিনে এদেশে রাজনীতির ক্ষেত্রে একদিকে বালক, অপরদিকে বদ্ধ; সাহিত্যক্ষেত্রে একদিকে স্কুলবয়, অপর দিকে স্কুলমাস্টার; সমাজে একদিকে বাল্যবিবাহ, অপরদিকে অকালমৃত্যু; ধর্মক্ষেত্রে একদিকে শুধু ইতি ইতি’, অপরদিকে শুধু নেতি নেতি’; অর্থাৎ একদিকে লোষ্ট্রকাঠও দেবতা, অপরদিকে ঈশ্বরও ব্রহ্ম নন। অর্থাৎ আমাদের জীবনগ্রন্থে প্রথমে ভূমিকা আছে, শেষে উপসংহার আছে; ভিতরে কিছু নেই। এ বিশ্বের জীবনের আদি নেই, অন্ত নেই, শুধু মধ্য আছে; কিন্তু তারই অংশীভূত আমাদের জীবনের আদি আছে, অন্ত আছে; শুধু মধ্য নেই।

বার্ধক্যকে বাল্যের পাশে এনে ফেললেও আমরা তার মিলন সাধন করতে পারি নি; কারণ ক্রিয়া বাদ দিয়ে দুটি পদকে জুড়ে এক করা যায় না। তাছাড়া যা আছে, তা নেই বললেও তার অস্তিত্ব লোপ হয়ে যায় না। এ বিশ্বকে মায়া বললেও তা অস্পৃশ্য হয়ে যায় না, এবং আত্মাকে ছায়া বললেও তা অদশ্য হয়ে যায় না। বরং কোনো-কোনো সত্যের দিকে পিঠ ফেরালে তা অনেক সময়ে আমাদের ঘাড়ে চড়ে বসে। যে যৌবনকে আমরা সমাজে স্থান দিই নি, তা এখন নানা বিকৃতরূপে নানা ব্যক্তির দেহ অবলম্বন করে রয়েছে। যাঁরা সমাজের সম্মুখে জীবনের শুধু নান্দী ও ভরতবচন পাঠ করেন, তাঁদের জীবনের অভিনয়টা যবনিকার অন্তরালেই হয়ে থাকে। রদ্ধ ও বন্ধ করে রাখলে পদার্থ মাত্রই আলোর ও বায়ুর সম্পর্ক হারায়, এবং সেইজন্য তার গায়ে কলঙ্ক ধরাও অনিবার্য। গুপ্ত জিনিসের পক্ষে দুষ্ট হওয়া স্বাভাবিক।

আমরা যে যৌবনকে গোপন করে রাখতে চাই, তার জন্য আমাদের প্রাচীন সাহিত্য অনেক পরিমাণে দায়ী। কোনো বিখ্যাত ইংরেজ লেখক বলেন যে, literature হচ্ছে criticism of life; ইংরেজিসাহিত্য জীবনের সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু সংস্কৃতসাহিত্য হচ্ছে যৌবনের আলোচনা।

সংস্কৃতসাহিত্যে যুবকযুবতী ব্যতীত আর কারও স্থান নেই। আমাদের কাব্যরাজ্য হচ্ছে সূর্যবংশের শেষ নপতি অগ্নিবর্ণের রাজ্য, এবং সেদেশ হচ্ছে অষ্টাদশবর্ষদেশীয়াদের স্বদেশ। যৌবনের যে ছবি সংস্কৃত দশ্যেকাব্যে ফটে উঠেছে, সে হচ্ছে ভাৈগবিলাসের চিত্র। সংস্কৃতকাব্যজগৎ মাল্যচন্দনবনিতা দিয়ে গঠিত এবং সে জগতের বনিতাই হচ্ছে স্বর্গ, ও মাল্যচন্দন তার উপসর্গ।

এ কাব্যজগতের স্রষ্টা কিংবা দ্রষ্টা কবিদের মতে প্রকৃতির কাজ হচ্ছে শুধু রমণীদেহের উপমা যোগানো, এবং পুরুষের কাজ শুধু রমণীর মন যোগানো। হিন্দুযুগের শেষকবি জয়দেব নিজের কাব্যসম্বন্ধে স্পষ্টাক্ষরে যেকথা বলেছেন, তাঁর পববতী কবিরাও ইঙ্গিতে সেই একই কথা বলেছেন। সেকথা এই যে, যদি বিলাস-কলায় কুতুহলী হও তো আমার কোমলকান্ত পদাবলী শ্রবণ করো’। এককথায় যে-যৌবন য্যাতি নিজের পুত্রদের কাছে ভিক্ষা করেছিলেন, সংস্কৃতকবিরা সেই যৌবনেরই রূপগুণ বর্ণনা করেছেন।

একথা যে কত সত্য, তা একটি উদাহরণের সাহায্যে প্রমাণ করা যেতে পারে। কৌশাবির যুবরাজ উদয়ন এবং কপিলবার যুবরাজ সিদ্ধার্থ উভয়ে সমসাময়িক ছিলেন। উভয়েই পরম রূপবান এবং দিব্য শক্তিশালী যুবাপুরুষ; কিন্তু উভয়ের মধ্যে প্রভেদ এইটুকু যে, একজন হচ্ছেন ভোগের আর একজন হচ্ছেন ত্যাগের পর্ণ অবতার। ভগবান গৌতমবুদ্ধের জীবনের ব্রত ছিল মানবের মোহনাশ করে তাকে সংসারের সকল শখল হতে মুক্ত করা; আর বৎসরাজ উদয়নের জীবনের ব্রত ছিল ঘোষবতী বীণার সাহায্যে অরণ্যের গজকামিনী এবং অন্তঃপুরের গজগামিনীদের প্রথমে মদ্ধে ক’রে পরে নিজের ভোগের জন্য তাদের অবরুদ্ধ করা। অথচ সংস্কৃতকাব্যে বন্ধচরিতের স্থান নেই, কিন্তু উদয়নকথায় তা পরিপূর্ণ।

সংস্কৃতভাষায় যে বুদ্ধের জীবনচরিত লেখা হয় নি, তা নয়; তবে ললিতবিস্তরকে আর-কেউ কাব্য বলে স্বীকার করবেন না, এবং অশ্বঘোষের নাম পর্যন্তও লুপ্ত হয়ে গেছে। অপরদিকে উদয়ন-বাসবদত্তার কথা অবলম্বন করে যাঁরা কাব্যরচনা করেছেন, যথা ভাস গুণাঢ্য সবন্ধ, ও শ্রীহর্ষ ইত্যাদি, তাঁদের বাদ দিলে সংস্কৃতসাহিত্যের অর্ধেক বাদ পড়ে যায়। কালিদাস বলেছেন যে, কৌশারি গ্রামবন্ধেরা উদয়নকথা শুনতে ও বলতে ভালোবাসতেন; কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কেবল কৌশারি গ্রামবদ্ধ কেন, সমগ্র ভারতবর্ষের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই ঐ কথা-রসের রসিক। সংস্কৃতসাহিত্য এ সত্যের পরিচয় দেয় না যে, বন্ধের উপদেশের বলে জাতীয় জীবনে যৌবন এনে দিয়েছিল, এবং উদয়নের দ্রষ্টান্তের ফলে অনেকের যৌবনে অকালবার্ধক্য এনে দিয়েছিল। বৌদ্ধধর্মের অনুশীলনের ফলে রাজা অশোক লাভ করেছিলেন সাম্রাজ্য; আর উদয়নধর্মের অনুশীলন করে রাজা অগ্নিবর্ণ লাভ করেছিলেন রাজক্ষমা। সংস্কৃতকবিরা এ সত্যটি উপেক্ষা করেছিলেন যে, ভোগের ন্যায় ত্যাগও যৌবনেরই ধর্ম। বার্ধক্য কিছু অর্জন করতে পারে না বলে কিছু বর্জনও করতে পারে না। বার্ধক্য কিছু কাড়তে পারে না বলে কিছু ছাড়তেও পারে না— দুটি কালো চোখের জন্যও নয়, বিশকোটি কালো লোকের জন্যও নয়।

পাছে লোকে ভুল বোঝেন বলে এখানে আমি একটি কথা বলে রাখতে চাই। কেউ মনে করবেন না যে, আমি কাউকে সংস্কৃতকাব্য বয়কট করতে বলছি কিংবা নীতি এবং রচির দোহাই দিয়ে সে কাব্যের সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশ করবার পরামর্শ দিচ্ছি। আমার মতে যা সত্য তা গোপন করা সুনীতি নয় এবং তা প্রকাশ করাও দুর্নীতি নয়। সংস্কৃতকাব্যে যে যৌবনধর্মের বর্ণনা আছে তা যে সামান্য মানবধর্ম— এ হচ্ছে অতি স্পষ্ট সত্য; এবং মানবজীবনের উপর তার প্রভাব যে অতি প্রবল— তাও অস্বীকার করবার জো নেই।

তবে এই একদেশদর্শিতা ও অত্যুক্তি— ভাষায় যাকে বলে একরোখামি ও বাড়াবাড়ি তাই হচ্ছে সংস্কৃতকাব্যের প্রধান দোষ। যৌবনের স্থূল-শরীরকে অত আশকারা দিলে তা উত্তরোত্তর স্থূল হতে স্থূলতর হয়ে ওঠে, এবং সেইসঙ্গে তার সক্ষ-শরীরটি সক্ষম হতে এত সক্ষম হয়ে উঠে যে, তা খুঁজে পাওয়াই ভার হয়। সংস্কৃতসাহিত্যের অবনতির সময়, কাব্যে রক্তমাংসের পরিমাণ এত বেড়ে গিয়েছিল যে, তার ভিতর আত্মার পরিচয় দিতে হলে সেই রক্তমাংসের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করা ছাড়া আর আমাদের উপায় নেই। দেহকে অতটা প্রাধান্য দিলে মন-পদার্থটি বিগড়ে যায়; তার ফলে দেহ ও মন পথক হয়ে যায় এবং উভয়ের মধ্যে আত্মীয়তার পরিবর্তে জ্ঞাতিশত্রতা জন্মায়। সম্ভবত বৌদ্ধধর্মের নিরামিষের প্রতিবাদস্বরূপ হিন্দু, কবিরা তাঁদের কাব্যে এতটা আমিষের আমদানি করেছিলেন। কিন্তু যে কারণেই হোক প্রাচীন ভারতবর্ষের চিন্তার রাজ্যে দেহমনের পরস্পরের যে বিচ্ছেদ ঘটেছিল, তার প্রমাণ প্রাচীন সমাজের একদিকে বিলাসী অপরদিকে সন্ন্যাসী, একদিকে পত্তন অপরদিকে বন, একদিকে রঙ্গালয় অপরদিকে হিমালয়; এককথায় একদিকে কামশাস্ত্র অপরদিকে মোক্ষশাস্ত্র। মাঝামাঝি আর-কিছু, জীবনে থাকতে পারত কিন্তু সাহিত্যে নেই। এবং এ দুই বিরুদ্ধ-মনোভাবের পরস্পরমিলনের যে কোনো পন্থা ছিল না, সেকথা ভর্তৃহরি স্পষ্টাক্ষরে বলেছেন–

‘একা ভার্যা সুন্দরী বা দরী বা’

এই হচ্ছে প্রাচীনযুগের শেষকথা। যাঁরা দরী-প্রাণ তাঁদের পক্ষে যৌবনের নিন্দা করা যেমন স্বাভাবিক, যাঁরা সন্দরী-প্রাণ তাঁদের পক্ষেও তেমনি স্বাভাবিক। যতির মুখের যৌবন-নিন্দা অপেক্ষা কবির মুখের যৌবননিন্দার, আমার বিশ্বাস, অধিক ঝাঁঝ আছে। তার কারণ, ত্যাগীর অপেক্ষা ভোগীরা অভ্যাসবশত কথায় ও কাজে বেশি অসংযত।

যাঁরা স্ত্রীজাতিকে কেবলমাত্র ভোগের সামগ্রী মনে করেন, তাঁরাই যে শ্ৰী-নিন্দার ওস্তাদ— এর প্রমাণ জীবনে ও সাহিত্যে নিত্য পাওয়া যায়।

স্ত্রী-নিন্দুকের রাজা হচ্ছেন রাজকবি ভর্তৃহরি ও রাজকবি সোলোমন। চরম ভোগবিলাসে পরম চরিতার্থতা লাভ করতে না পেরে এরা শেষবয়সে স্ত্রীজাতির উপর গায়ের ঝাল ঝেড়েছেন। যাঁরা বনিতাকে মাল্যচন্দনহিসাবে ব্যবহার করেন, তাঁরা শুকিয়ে গেলে সেই বনিতাকে মাল্যচন্দনের মতই ভূতলে নিক্ষেপ করেন, এবং তাকে পদদলিত করতেও সংকুচিত হন না। প্রথমবয়সে মধুর রস অতিমাত্রায় চর্চা করলে শেষবয়সে জীবন তিতো হয়ে ওঠে। এ শ্রেণীর লোকের হাতে শগার-শতকের পরেই বৈরাগ্য-শতক রচিত হয়।

একই কারণে, যাঁরা যৌবনকে কেবলমাত্র ভোগের উপকরণ মনে করেন, তাঁদের মুখে যৌবন-নিন্দা লেগে থাকবারই কথা। যাঁরা যৌবন-জোয়ারে গা-ভাসিয়ে দেন, তাঁরা ভাটার সময় পাঁকে পড়ে গত জোয়ারের প্রতি কটুকাটব্য প্রয়োগ করেন। যৌবনের উপর তাঁদের রাগ এই যে, তা পালিয়ে যায় এবং একবার চলে গেলে আর ফেরে না। যযাতি যদি পরের কাছে ভিক্ষা করে যৌবন ফিরে না পেতেন, তাহলে তিনি যে কাব্য কিংবা ধর্মশাস্ত্র রচনা করতেন, তাতে যে কি সুতীব্র যৌবননিন্দা থাকত— তা আমরা কল্পনাও করতে পারি নে। পর, যে পিতৃভক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন, তার ভিতর পিতার প্রতি কতটা ভক্তি ছিল এবং তাতে পিতারই যে উপকার করা হয়েছিল, তা বলতে পারি নে, কিন্তু তাতে দেশের মহা অপকার হয়েছে; কারণ নীতির একখানা বড় গ্রন্থ মারা গেছে।

যযাতি-কাঙ্ক্ষিত যৌবনের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ এই যে, তা অনিত্য। এবিষয়ে ব্রাহণ ও শ্রমণ, নগ্নক্ষপণক ও নাগরিক, সকলেই একমত।

যৌবন ক্ষণস্থায়ী— এই আক্ষেপে এদেশের কাব্য ও সংগীত পরিপূর্ণ–

‘ফাগুন গয়ী হয়, বহরা ফিরি আয়ী হয়
গয়ে রে যোবন, ফিরি আওত নাহি’

এই গান আজও হিন্দুস্থানের পথে-ঘাটে অতি করুণ সুরে গাওয়া হয়ে থাকে। যৌবন যে চিরদিন থাকে না, এ আপসোস রাখবার স্থান ভারতবর্যে নেই।

যা অতি প্রিয় এবং অতি ক্ষণস্থায়ী, তার স্থায়িত্ব বাড়াবার চেষ্টা মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। সম্ভবত নিজের অধিকার বিস্তার করবার উদ্দেশ্যেই এদেশে যৌবন শৈশবের উপর আক্রমণ করেছিল। বাল্যবিবাহের মূলে হয়ত এই যৌবনের মেয়াদ বাড়াবার ইচ্ছাটাই বর্তমান। জীবনের গতিটি উলটো দিকে ফেরাবার ভিতরও একটা মহা আর্ট আছে। পৃথিবীর অপরসব দেশে লোকে গাছকে কি করে বড় করতে হয় তারই সন্ধান জানে, কিন্তু গাছকে কি করে ছোট করতে হয় সে কৌশল শুধু জাপানিরাই জানে। একটি বটগাছকে তারা চিরজীবন একটি টবের ভিতর পরে রেখে দিতে পারে। শুনতে পাই, এইসব বামন-বট হচ্ছে অক্ষয়বট’। জাপানিদের বিশ্বাস যে, গাছকে হ্রস্ব করলে তা আর বন্ধ হয় না। সম্ভবত আমাদেরও মনুষ্যত্বের চর্চা সম্বন্ধে এই জাপানি আট জানা আছে, এবং বাল্যবিবাহ হচ্ছে সেই আর্টের একটি প্রধান অঙ্গ। এবং উক্ত কারণেই, অপরসকল প্রাচীন সমাজ উৎসন্নে গেলেও আমাদের সমাজ আজও টিকে আছে। মনুষ্যত্ব খর্ব করে মানবসমাজটাকে টবে জিইয়ে রাখায় যে বিশেষ-কিছু অহংকার করবার আছে, তা আমার মনে হয় না। সে যাই হোক, এ যুগে যখন কেউ যৌবনকে রাজটিকা দেবার প্রস্তাব করেন, তখন তিনি সমাজের কথা ভাবেন, ব্যক্তিবিশেষের কথা নয়।

ব্যক্তিগত হিসেবে জীবন ও যৌবন অনিত্য হলেও মানবসমাজের হিসেবে ও দুই পদার্থ নিত্য বললেও অত্যুক্তি হয় না। সুতরাং সামাজিক জীবনে যৌবনের প্রতিষ্ঠা করা মানুষের ক্ষমতার বহির্ভূত না হলেও না হতে পারে।

কি উপায়ে যৌবনকে সমাজের যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করা যেতে পারে, তাই হচ্ছে বিবেচ্য ও বিচার্য।

এ বিচার করবার সময় এ কথাটি মনে রাখা আবশ্যক যে, মানবজীবনের পর্ণ অভিব্যক্তি–যৌবন।

যৌবনে মানুষের বাহ্যেন্দ্রিয় কর্মেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয় সব সজাগ ও সবল হয়ে ওঠে, এবং সৃষ্টির মূলে যে প্রেরণা আছে, মানুষে সেই প্রেরণা তার সকল অগে, সকল মনে অনুভব করে।

দেহ ও মনের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধের উপর মানবজীবন প্রতিষ্ঠিত হলেও হেমনের পার্থক্যের উপরেই আমাদের চিন্তারাজ্য প্রতিষ্ঠিত। দেহের যৌবনের সঙ্গে মনের যৌবনের একটা যোগাযোগ থাকলেও দৈহিক যৌবন ও মানসিক যৌবন স্বতন্ত্র। এই মানসিক যৌবন লাভ করতে পারলেই আমরা তা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারব। দেহ সংকীর্ণ ও পরিচ্ছিন্ন; মন উদার ও ব্যাপক। একের দেহের যৌবন অপরের দেহে প্রবেশ করিয়ে দেবার জো নেই; কিন্তু একের মনের যৌবন লক্ষ লোকের মনে সংক্রমণ করে দেওয়া যেতে পারে।

পূর্বে বলেছি যে, দেহ ও মনের সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য। একমাত্র প্রাণশক্তিই জড় ও চৈতন্যের যোগ সাধন করে। যেখানে প্রাণ নেই, সেখানে জড়ে ও চৈতন্যে মিলনও দেখা যায় না। প্রাণই আমাদের দেহ ও মনের মধ্যে মধ্যস্থতা করছে। প্রাণের পায়ের নীচে হচ্ছে জড়জগৎ, আর তার মাথার উপরে মনোজগৎ। প্রাণের ধর্ম যে, জীবনপ্রবাহ রক্ষা করা, নবনব সৃষ্টির দ্বারা সৃষ্টি রক্ষা করা— এটি সর্বলোকবিদিত। কিন্তু প্রাণের আর-একটি বিশেষ ধর্ম আছে, যা সকলের কাছে সমান প্রত্যক্ষ নয়। সেটি হচ্ছে এই যে, প্রাণ প্রতিমুহূর্তে রুপান্তরিত হয়। হিন্দুদর্শনের মতে, জীবের প্রাণময় কোষ, অন্নময় কোষ ও মনোময় কোষের মধ্যে অবস্থিত। প্রাণের গতি উভয়মুখী। প্রাণের পক্ষে মনোময় কোষে ওঠা এবং অন্নময় কোষে নামা দুই সম্ভব। প্রাণ অধোগতি প্রাপ্ত হয়ে জড়জগতের অন্তর্ভূত হয়ে যায়; আর উন্নত হয়ে মনোজগতের অন্তভূত হয়। মনকে প্রাণের পরিণতি এবং জড়কে প্রাণের বিকৃতি বললেও অত্যুক্তি হয় না। প্রাণের স্বাভাবিক গতি হচ্ছে মনোজগতের দিকে; প্রাণের স্বাধীন ক্ষতিতে বাধা দিলেই তা জড়তাপ্রাপ্ত হয়। প্রাণ নিজের অভিব্যক্তির নিয়ম নিজে গড়ে নেয়; বাইরের নিয়মে তাকে বন্ধ করাতেই সে জড়জগতের অধীন হয়ে পড়ে। যেমন প্রাণীজগতের রক্ষার জন্য নিত্য নূতন প্রাণের সৃষ্টি আবশ্যক, এবং সে সৃষ্টির জন্য দেহের যৌবন চাই; তেমনি মনোজগতের এবং তদধীন কর্মজগতের রক্ষার জন্য সেখানেও নিত্য নব সৃষ্টির আবশ্যক, এবং সে সৃষ্টির জন্য মনের যৌবন চাই। পুরাতনকে আঁকড়ে থাকাই বার্ধক্য অর্থাৎ জড়তা। মানসিক যৌবন লাভের জন্য প্রথম আবশ্যক, প্রাণশক্তি যে দৈবী শক্তি— এই বিশ্বাস।

এই মানসিক যৌবনই সমাজে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে আমাদের উদ্দেশ্য। এবং কি উপায়ে তা সাধিত হতে পারে, তাই হচ্ছে আলোচ্য।

আমরা সমগ্র সমাজকে একটি ব্যক্তিহিসেবে দেখলেও আসলে মানবসমাজ হচ্ছে বহব্যক্তির সমষ্টি। যে সমাজে বহু ব্যক্তির মানসিক যৌবন আছে, সেই সমাজেরই যৌবন আছে। দেহের যৌবনের সঙ্গেসঙ্গেই মনের যৌবনের আবির্ভাব হয়। সেই মানসিক যৌবনকে, স্থায়ী করতে হলে শৈশব নয়, বাধক্যের দেশ আক্রমণ এবং অধিকার করতে হয়। দেহের যৌবনের অন্তে বার্ধক্যের রাজ্যে যৌবনের অধিকার বিস্তার করবার শক্তি আমরা সমাজ হতেই সংগ্রহ করতে পারি। ব্যক্তিগত জীবনে ফাগন একবার চলে গেলে আবার ফিরে আসে না; কিন্তু সমগ্র সমাজে ফাগুনে চিরদিন বিরাজ করছে। সমাজে নূতন প্রাণ, নূতন মন, নিত্য জন্মলাভ করছে। অর্থাৎ নূতন সুখদুঃখ, নূতন আশা, নূতন ভালোবাসা, নূতন কর্তব্য ও নূতন চিন্তা নিত্য উদয় হচ্ছে। সমগ্র সমাজের এই জীবনপ্রবাহ যিনি নিজের অন্তরে টেনে নিতে পারবেন, তাঁর মনের যৌবনের আর ক্ষয়ের আশঙ্কা নেই। এবং তিনিই আবার কথায়। ও কাজে সেই যৌবন সমাজকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন।

এ যৌবনের কপালে রাজটিকা দিতে আপত্তি করবেন, এক জড়বাদী আর এক মায়াবাদী; কারণ এরা উভয়েই একমন। এরা উভয়েই বিশ্ব হতে অস্থির প্রাণটুকু বার করে দিয়ে যে এক স্থিরতত্ত্ব লাভ করেন, তাকে জড়ই বল আর চৈতন্যই বল, সে বস্তু হচ্ছে এক, প্রভেদ যা তা নামে।

জ্যৈষ্ঠ ১৩২১

রূপের কথা

 

রূপের কথা

এদেশে সচরাচর লোকে যা লেখে ও ছাপায় তাই যদি তাদের মনের কথা হয়, তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে, আমরা মানবসভ্যতার চরম পদ লাভ করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এই প্রকাণ্ড সত্যটা বিদেশীরা মোটেই দেখতে পায় না। এটা সত্যিই দুঃখের বিষয়। কেননা, সভ্যতারও একটা চেহারা আছে; এবং যে সমাজের সচেহারা নেই, তাকে সুসভ্য বলে মানা কঠিন। বিদেশী বলতে দু শ্রেণীর লোক বোঝায়— এক পরদেশী, আর-এক বিলেতি। আমরা যে বড়-একটা কারও চোখে পড়ি নে, সেবিষয়ে এই দুই দলের বিদেশীই একমত।

যাঁরা কালাপানি পার হয়ে আসেন, তাঁরা বলেন যে, আমাদের দেশ দেখে তাঁদের চোখ জড়োয়, কিন্তু আমাদের বেশ দেখে সে চোখ ক্ষম হয়। এর কারণ, আমাদের দেশের মোড়কে রং আছে, আমাদের দেহের মোড়কে নেই। প্রকৃতি বাংলাদেশকে যে কাপড় পরিয়েছেন, তার রং সবুজ; আর বাঙালি নিজে যে কাপড় পরেছে, তার রং, আর যেখানেই পাওয়া যাক, ইন্দ্রধনুর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা আপাদমস্তক রং-ছট বলেই অপর কারও নয়নাভিরাম নই। সুতরাং যারা আমাদের দেশ দেখতে আসে, তারা আমাদের দেখে খুশি হয় না। যাঁর বোম্বাই-শহরের সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় আছে, তিনিই জানেন কলকাতার সঙ্গে সে শহরের প্রভেদটা কোথায় এবং কত জাজল্যমান। সেদেশে জনসাধারণ পথেঘাটে সকালসন্ধ্যে রঙের ঢেউ খেলিয়ে যায় এবং সে রঙের বৈচিত্র্যের ও সৌন্দর্যের আর অন্ত নেই। কিন্তু আমাদের গায়ে জড়িয়ে আছে চির-গোধুলি; তাই শুধু বিলেতি নয়, পরদেশী ভারতবাসীর চোখেও আমরা এতটা দৃষ্টিকট। বাকি ভারতবর্ষ সাজসজ্জায় স্বদেশী, আমরা আধ-স্বদেশী হাফ-বিলেতি। আর বিলেতি মতে, হয় কালো নয় শাদা–নইলে সভ্যতার লজ্জা নিবারণ হয় না। রং চাই শুধু সং সাজবার জন্যে। আমাদের নবসভ্যতাও কার্যত এই মতে সায় দিয়েছে।

 

২.

আপনারা বলতে পারেন যে, একথা যদি সত্যও হয়, তাতে আমাদের কি যায়-আসে। বিদেশীর মনোরঞ্জন করবার জন্য আমরা তো আর জাতকে-জাত আমাদের পরন-পরিচ্ছদ আমাদের হাল-চাল সব বদলে ফেলতে পারি নে? জীবনযাত্রা ব্যাপারটা তো আর অভিনয় নয় যে, দর্শকের মুখ চেয়ে সে-জীবন গড়তে হবে এবং তার উপর আবার রং ফলাতে হবে। একথা খুব ঠিক। জীবন আমরা কিসের জন্য ধারণ করি তা না জানলেও, এটা জানি যে, পরের জন্য আমরা তা ধারণ করি নে–অপর দেশের অপর লোকের জন্য তো নয়ই। তবে বিদেশীর কথা উত্থাপন করবার সার্থকতা এই যে, জাতীয়জীবনের একটি বিদেশীর চোখে যেমন একনজরে ধরা পড়ে, স্বদেশীর চোখে তা পড়ে না। কেননা, আজন্ম দেখে দেখে লোকের চোখে যা সয়ে গেছে, যারা প্রথম দেখে তাদের চোখে তা সয় না।

এই বিদেশীরাই আমাদের সজ্ঞান করে দিয়েছে যে, রূপ সম্বন্ধে আমরা চোখ থাকতেও কানা। আমাদের রূপজ্ঞান যে নেই, কিংবা যদি থাকে তো অতি কম, সেবিষয়ে বোধ হয় কোনো মতভেদ নেই। কেননা, এ জ্ঞানের অভাবটা আমরা জাতীয় মনের দৈন্য বলে মনে করি নে। বরং সত্যকথা বলতে গেলে, আমাদের বিশ্বাস যে, এই রূপান্ধতাটাই আমাদের জাতীয় চরিত্রের মহত্ত্বের পরিচয় দেয়। রূপ তো একটা বাইরের জিনিস; শুধু তাই নয়, বাহ্যবস্তুরও বাইরের জিনিস; ও জিনিসকে যারা উপেক্ষা, এমনকি অবজ্ঞা, করতে না শিখেছে তারা আধ্যাত্মিকতার সন্ধান জানে না। আর আমরা আরকিছু হই আর না-হই, বালবৃদ্ধবনিতা সকলেই যে আধ্যাত্মিক। সেকথা যে অস্বীকার করবে, সে নিশ্চয়ই স্বদেশ এবং স্বজাতিদ্রোহী।

 

৩.

রপ-জিনিসটাকে যাঁরা একটা পাপ মনে করেন, তাঁদের মতে অবশ্য রুপের প্রশ্রয় দেওয়ার অর্থ পাপের প্রশ্রয় দেওয়া। কিন্তু দলে পাতলা হলেও পৃথিবীতে এমনসব লোক আছে, যারা রূপকে মান্য করে শ্রদ্ধা করে, এমনকি পুজো করতেও প্রস্তুত; অথচ নিজেদের মহাপাপী মনে করে না। এই রূপেভক্তের দল অবশ্য স্বদেশীর কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য, অর্থাৎ প্রমাণপ্রয়োগ-সহকারে রুপের স্বত্বসাব্যস্ত করতে বাধ্য। আপসোসের কথা এই যে, যে সত্য সকলের প্রত্যক্ষ হওয়া উচিত, সেই সত্য এদেশে প্রমাণ করতে হয়— অর্থাৎ একটা সহজ কথা বলতে গেলে, আমাদের ন্যায়-অন্যায়ের স্রোতের উজান ঠেলে যেতে হয়।

যা সকলে জানে–আছে, তা নেই বলাতে অতিবন্ধির পরিচয় দেওয়া হতে পারে, কিন্তু বুদ্ধির পরিচয় দেওয়া হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা এই ‘অতি’র অতিভক্ত হওয়াতে আমাদের ইতির জ্ঞান নষ্ট হয়েছে।

বস্তুর রূপে বলে যে একটি ধর্ম আছে, এ হচ্ছে শোনা-কথা নয়। দেখাজিনিস। যাঁর চোখ-নামক ইন্দ্রিয় আছে, তিনিই কখনো-না-কখনো তার সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। এবং আমাদের সকলেরই চোখ আছে; সম্ভবত শুধু তাঁদের ছাড়া, যাঁরা সৌন্দর্যের নাম করলেই অতীন্দ্রিয়তার ব্যাখ্যান অর্থাৎ উপাখ্যান শর, করেন। কিন্তু আমি এই রূপ-জিনিসটিকে অতিবজিত ইন্দ্রিয়ের কোঠাতেই টিকিয়ে রাখতে চাই; কেননা, অতীন্দ্রিয়-জগতে রূপ নিশ্চয়ই অরূপ হয়ে যায়।

 

৪.

রূপের বিষয় দার্শনিকেরা কি বলেন আর না-বলেন, তাতে কিছু যায়আসে না; কেননা, যা দৃষ্টির অগোচর, তাই দর্শনের বিষয়। অতএব একথা নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, বস্তুর রূপ বলে যে একটি গুণ আছে, তা মানুষমাত্রেই জানে এবং মানে। তবে সেই গুণের পক্ষপাতী হওয়াটা গুণের কি দোষের— এই নিয়েই যা মতভেদ।

রূপকে আমরা ভক্তি করি নে, সম্ভবত ভালোবাসি নে। আপনারা সকলেই জানেন যে, হালে একটা মতের বহুলপ্রচার হয়েছে, যার ভিতরকার কথা এই যে, জাতীয় আত্মমর্যাদা হচ্ছে পরশ্রীকাতরতারই সদর পিঠ। সম্ভবত একথা সত্য, কিন্তু তাই বলে শ্রীকাতরতাও যে ঐ জাতীয় আত্মমর্যাদার লক্ষণ একথা স্বীকার করা যায় না; কেননা, বিশ্বমানবের সভ্যতার ইতিহাস এর বিরদ্ধে চিরদিন সাক্ষি দিয়ে আসছে।

স্বদেশের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেলেই অপর সভ্যজাতির কাছে রূপের মর্যাদা যে কত বেশি, তার প্রমাণ হাতে-হাতে পাওয়া যাবে। বর্তমান ইউরোপ সুন্দরকে সত্যের চাইতে নীচে আসন দেয় না, সেদেশে জ্ঞানীর চাইতে আর্টিস্টের মান্য কম নয়। তারা সভ্যসমাজের দেহটাকে অর্থাৎ দেশের রাস্তাঘাট বাড়িঘরদোর মন্দিরপ্রাসাদ, মানুষের আসনবসন সাজসরঞ্জাম ইত্যাদি নিত্য নূতন করে সুন্দর করে গড়ে তোলবার চেষ্টা করছে। সে চেষ্টার ফল স, কি কু হচ্ছে, সে স্বতন্ত্র কথা। ইউরোপীয় সভ্যতার ভিতর অবশ্য একটা কুৎসিত দিক আছে, যার নাম কমার্শিয়ালিজম; কিন্তু এই দিকটে কদর্য বলেই তার সর্বনাশের দিক। কমার্শিয়ালিজম,এর মূলে আছে লোভ। আর লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। আপনারা সকলেই জানেন যে, রূপের সঙ্গে মোহের সম্পর্ক থাকতে পারে, কিন্তু লোভের নেই।

ইউরোপ ছেড়ে এশিয়াতে এলে দেখতে পাই যে, চীন ও জাপান রূপের এতই ভক্ত যে, রুপের আরাধনাই সেদেশের প্রকৃত ধর্ম বললেও অত্যুক্তি হয় না। রূপের প্রতি এই পরাপ্ৰীতিবশত চীনজাপানের লোকের হাতে-গড়া এমন জিনিস নেই যার রূপ নেই–তা সে ঘটিই হোক আর বাটিই হোক। যাঁরা তাদের হাতের কাজ দেখেছেন, তাঁরাই তাদের রূপ-সৃষ্টির কৌশল দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছেন। মোঙ্গলজাতিকে ভগবান রূপ দেন নি, সম্ভবত সেই কারণে সন্দরকে তাদের নিজের হাতে গড়ে নিতে হয়েছে। এই তো গেল বিদেশের কথা।

 

৫.

আবার শুধু স্বদেশের নয়, সকালের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেলে আমরা ঐ একই সত্যের পরিচয় পাই। প্রাচীন গ্রীকো-ইতালীয় সভ্যতার ঐকান্তিক রূপচর্চার ইতিহাস তো জগৎবিখ্যাত। প্রাচীন ভারতবর্ষও রূপ সম্বন্ধে অন্ধ ছিল না; কেননা, আমরা যাই বলি নে কেন, সে সভ্যতাও মানবসভ্যতা–একটা সৃষ্টিছাড়া পদার্থ নয়। সে সভ্যতারও শুধু আত্মা নয়, দেহ ছিল; এবং সে দেহকে আমাদের পপুরুষেরা সুঠাম ও সুন্দর করেই গড়তে চেষ্টা করেছিলেন। সে দেহ আমাদের চোখের সম্মুখে নেই বলেই আমরা মনে করি যে, সেকালে যা ছিল তা হচ্ছে শুধু অশরীরী আত্মা। কিন্তু সংস্কৃতসাহিত্য থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তাঁদের কতটা সৌন্দর্য জ্ঞান ছিল। আমরা যাকে সংস্কৃতকাব্য বলি, তাতে রূপবর্ণনা ছাড়া আর বড়-কিছু নেই; আর সে রূপবর্ণনাও আসলে দেহের, বিশেষত রমণী-দেহের, বর্ণনা; কেননা, সে কাব্যসাহিত্যে যে প্রকৃতিবর্ণনা আছে তাও বস্তুত রমণীর রূপবর্ণনা। প্রকৃতিকে তাঁরা সুন্দরী রমণী হিসেবেই দেখেছিলেন। তার যে অংশ নারীঅঙ্গের উপমেয় কি উপমান নয়, তার স্বরূপ হয় তাঁদের চোখে পড়ে নি, নয় তা তাঁরা রূপ বলে গ্রাহ্য করেন নি। সংস্কৃতসাহিত্যে হরেকরকমের ছবি আছে, কিন্তু ল্যাণ্ডসকেপ নেই বললেই হয়; অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে নিঃসম্পর্ক প্রকৃতির অস্তিত্বের বিষয় তাঁরা সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। ল্যাণ্ডসকেপ প্রাচীন গ্রীস কিংবা রোমের হাত থেকেও বেরয় নি। তার কারণ, সেকালে মানুষে মানুষে বাদ দিয়ে বিশ্বসংসার দেখতে শেখে নি। এর প্রমাণ শুধু আটে নয়, দর্শনে-বিজ্ঞানেও পাওয়া যায়। আমরা আমাদের নববিজ্ঞানের প্রসাদে মানুষকে এ বিশ্বের পরমাণুতে পরিণত করেছি, সম্ভবত সেই কারণে আমরা মানবদেহের সৌন্দর্য অবজ্ঞা করতে শিখেছি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা কিন্তু সে সৌন্দর্যকে একটি অমূল্য বস্তু বলে মনে করতেন; শুধু স্ত্রীলোকের নয়, পুরুষের রূপের উপরও তাঁদের ভক্তি ছিল। যাঁর অলোকমান্য রূপ নেই, তাঁকে এদেশে পুরাকালে মহাপুরুষ বলে কেউ মেনে নেয় নি। শ্রীরামচন্দ্র বুদ্ধদেব শ্রীকৃষ্ণ প্রভৃতি অবতারেরা সকলেই সৌন্দর্যের অবতার ছিলেন। রূপগণের সন্ধিবিচ্ছেদ করা সেকালের শিক্ষার একটা প্রধান অঙ্গ ছিল না। শুধু তাই নয়, আমাদের পূর্বপুরুষদের কদাকারের উপর এতটাই ঘণা ছিল যে, পরাকালের শদ্রেরা যে দাসত্ব হতে মুক্তি পায় নি, তার একটি প্রধান কারণ তারা ছিল কৃষ্ণবর্ণ এবং কুৎসিত অন্তত আর্যদের চোখে। সেকালের দর্শনের ভিতর অরূপের জ্ঞানের কথা থাকলেও সেকালের ধর্ম রূপজ্ঞানের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। পরব্রহ নিরাকার হলেও ভগবান, মন্দিরে মন্দিরে মতিমান। প্রাচীন মতে নির্গুণ-ব্রহ্ম অরূপ এবং সগুণ-ব্রহ্ম স্বরূপ।

 

৬.

সভ্যতার সঙ্গে সৌন্দর্যের এই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকবার কারণ, সভ্যসমাজ বলতে বোঝায় গঠিত-সমাজ। যে সমাজের গড়ন নেই, তাকে আমরা সভ্যসমাজ বলি নে। একালের ভাষায় বলতে হলে সমাজ হচ্ছে একটি অর্গানিজম; আর আপনারা সকলেই জানেন যে সকল অর্গানিজম, একজাতীয় নয়, ও-বস্তুর ভিতর উচুনিচুর প্রভেদ বিস্তর। অর্গানিক-জগতে প্রোটোপ্ল্যাজম হচ্ছে সবচাইতে নীচে এবং মানুষ সবচাইতে উপরে। এবং মানুষের সঙ্গে প্রোটোপ্ল্যাজম এর প্রত্যক্ষ পার্থক্য হচ্ছে রূপে; অপর-কোনো প্রভেদ আছে কি না, সে হচ্ছে তর্কের বিষয়। মানুষে যে প্রোটোপ্ল্যাজম,এর চাইতে রূপবান, এবিষয়ে, আশা করি, কোনো মতভেদ নেই। এই থেকে প্রমাণ হয় যে, যে সমাজের চেহারা যত সুন্দর, সে সমাজ তত সভ্য। এরূপ হবার একটি স্পষ্ট কারণও আছে। এ জগতে রূপ হচ্ছে শক্তির চরম বিকাশ; সমাজ গড়বার জন্য মানুষের শক্তি চাই এবং সুন্দর করে গড়বার জন্য তার চাইতেও বেশি শক্তি চাই। সুতরাং মানুষ যেমন বাড়বার মুখে ক্ৰমে অধিক সশ্রী হয়ে ওঠে এবং মরবার মুখে ক্রমে অধিক কুশ্রী হয় জাতের পক্ষেও সেই একই নিয়ম খাটে। কদর্যতা দুর্বলতার বাহ্য লক্ষণ, সৌন্দর্য শক্তির। এই ভারতবর্ষের অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই দেখা যায় যে, যখনই দেশে নবশক্তির আবির্ভাব হয়েছে তখনই মঠে-মন্দিরে-বেশে-ভূষায় মানুষের আশায়-ভাষায় নবসৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। ভারতবর্ষের আর্টের বৌদ্ধযুগ ও বৈষ্ণবযুগ এই সত্যেরই জাজল্যমান প্রমাণ।

আমাদের এই কোণঠাসা দেশে যেদিন চৈতন্যদেবের আবির্ভাব হয়, সেইদিনই বাঙালি সৌন্দর্যের আবিষ্কার করে। এর পরিচয় বৈষ্ণবসাহিত্যে পাওয়া যায়। কিন্তু সে সৌন্দর্যবৃদ্ধি যে টিকল না, বাংলার ঘরেবাইরে যে তা নানারূপে নানা আকারে ফটল না তার কারণ চৈতন্যদেব যা দান করতে এসেছিলেন তা ষোলোআনা গ্রহণ করবার শক্তি আমাদের ছিল না। যে কারণে বাংলার বৈষ্ণবধর্ম বাঙালিসমাজকে একাকার করবার চেষ্টায় বিফল হয়েছে, হয়ত সেই একই কারণে তা বাঙালিসভ্যতাকে সাকার করে তুলতে পারে নি। ভক্তির রস আমাদের বুকে ও মুখে গড়িয়েছে, আমাদের মনে ও হাতে তা জমে নি। ফলে, এক গান ছাড়া আর-কিছুকেই আমরা নবরপ দিতে পারি নি।

 

৭.

এসব কথা যদি সত্য হয়, তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের রূপজ্ঞানের অভাবটা আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেয় না। কিন্তু একথা মুখ ফটে বললেই আমাদের দেশের অন্ধের দল লগড় ধারণ করবেন। এর কারণ কি, তা বলছি।

সত্য ও সৌন্দর্য, এ দুটি জিনিসকে কেউ উপেক্ষা করতে পারেন না। হয় এদের ভক্তি করতে হবে, নয় অভক্তি করতে হবে। অর্থাৎ সত্যকে উপেক্ষা করলে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে; আর সুন্দরকে অবজ্ঞা করলে কুৎসিতের প্রশ্রয় দিতেই হবে। এ পৃথিবীতে যা-কিছু আছে, তা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত এক স, আর-এক কু। সু-কে অর্জন না করলে কু-কে বর্জন করা কঠিন। আমাদের দশাও হয়েছে তাই। আমাদের সুন্দরের প্রতি যে অনুরাগ নেই, শুধু তাই নয়, ঘোরতর বিরাগ আছে।

আমরা দিনে-দুপুরে চীৎকার করে বলি যে, সাহিত্যে যে ফলের কথা জ্যোৎস্নার কথা লেখে সে লেখক নিতান্তই অপদার্থ।

এঁদের কথা শুনলে মনে হয় যে, সব ফলই যদি ডুমুর হয়ে ওঠে আর অমাবস্যা যদি বারোমেসে হয়, তাহলেই এ পৃথিবী ভূস্বর্গ হয়ে উঠবে; এবং সে স্বর্গে অবশ্য কোনো কবির স্থান হবে না। চন্দ্র যে সৌরমণ্ডলের মধ্যে একটি প্রক্ষিপ্ত গোলক, সেবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ও রিফ্লেক্টর ভগবান আকাশে ঝুলিয়ে দিয়েছেন; সুতরাং জ্যোৎস্না যে আছে, তার জন্য কবি দায়ী নন, দায়ী স্বয়ং ভগবান। কিন্তু এই জ্যোৎস্নাবিদ্বেষ থেকেই এদের প্রকৃত মনোভাব বোঝা যায়। এ রাগটা আসলে আলোর উপর রাগ। জ্ঞানের আলোক যখন আমাদের চোখে পরোপরি সয় না, তখন রূপের আলোক যে মোটেই সইবে না— তাতে আর বিচিত্র কি। জ্ঞানের আলো বস্তুজগৎকে প্রকাশ করে, সুতরাং এমন অনেক বস্তু প্রকাশ করে, যা আমাদের পেটের ও প্রাণের খোরাক যোগাতে পারে; কিন্তু রুপের আলো শুধু নিজেকেই প্রকাশ করে, সুতরাং তা হচ্ছে শুধু আমাদের চোখের ও মনের খোরাক। বলা বাহুল্য, উদর ও প্রাণ প্রোটোল্যাজম এরও আছে, কিন্তু চোখ ও মন শুধু মানুষেরই আছে। সুতরাং যাঁরা জীবনের অর্থ বোঝেন একমাত্র বেচে থাকা এবং তজ্জন্য উদরপতি করা, তাঁদের কাছে জ্ঞানের আলো গ্রাহ্য হলেও রূপের আলো অবজ্ঞাত। এ দুয়ের ভিতর প্রভেদও বিস্তর। জ্ঞানের আলো শাদা ও একঘেয়ে, অর্থাৎ ও হচ্ছে আলোর মূল; অপরপক্ষে, রূপের আলো রঙিন ও বিচিত্র, অর্থাৎ আলোর ফল। আদিম মানবের কাছে ফলের কোনো আদর নেই, কেননা ও-বস্তু আমাদের কোনো আদিম ক্ষুধার নিবৃত্তি করে না; ফলে আর-যাই হোক, চর্ব্য-চোষ্য কিংবা লেহ্য-পেয় নয়।

 

৮.

এসব কথা শুনে আমার বৈজ্ঞানিক বন্ধুরা নিশ্চয়ই বলবেন যে, আমি যা বলছি সেসব জ্ঞানবিজ্ঞানের কথা নয়, সেরেফ কবিত্ব। বিজ্ঞানের কথা এই যে, যে আলোকে আমি শাদা বলছি, সেই হচ্ছে এ বিশ্বের একমাত্র অখণ্ড আলো; সেই সমস্ত আলো রিফ্র্যাকটেড অর্থাৎ ব্যস্ত হয়েই আমাদের চোখে বহুরুপী হয়ে দাঁড়ায়। তথাস্তু। এই রিফ্র্যাকশনএর একাধারে নিমিত্ত এবং উপাদান কারণ হচ্ছে–পঞ্চভূতের বহির্ভূত ইথার-নামক রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শশব্দের অতিরিক্ত একটি পদার্থ। এবং এই হিল্লোলিত পদার্থের ধর্ম হচ্ছে এই জড়জগৎটাকে উৎফুল্ল করা, রুপান্বিত করা। রূপ যে আমাদের খুল-শরীরের কাজে লাগে না, তার কারণ বিশ্বের স্থূল-শরীর থেকে তার উৎপত্তি হয় নি। আমাদের ভিতর যে সক্ষম-শরীর অর্থাৎ ইথার আছে, বাইরের রূপের স্পর্শে সেই সুক্ষ-শরীর স্পন্দিত হয়, আনন্দিত হয়, পুলকিত হয়, প্রস্ফুটিত হয়। রূপজ্ঞানেই মানুষের জীবন্মক্তি, অর্থাৎ স্থূল-শরীরের বন্ধন হতে মুক্তি। রূপজ্ঞান হারালে মানুষ আজীবন পঞ্চভূতেরই দাসত্ব করবে। রূপবিদ্বেষটা হচ্ছে আত্মার প্রতি দেহের বিদ্বেষ, আলোর বিরুদ্ধে অন্ধকারের বিদ্রোহ। রূপের গুণে অবিশ্বাস করাটা নাস্তিকতার প্রথম সত্র।

 

৯.

ইন্দ্ৰিয়জ বলে বাইরের রূপের দিকে পিঠ ফেরালে ভিতরের রূপের সাক্ষাৎ পাওয়া কঠিন; কেননা, ইন্দ্রিয়ই হচ্ছে জড় ও চৈতন্যের একমাত্র বন্ধনসত্র। এবং ঐ সত্রেই রূপের জন্ম। অন্তরের রূপও যে আমাদের সকলের মনশ্চক্ষে ধরা পড়ে না, তার প্রমাণস্বরূপ একটা চলতি উদাহরণ নেওয়া যাক।

রবীন্দ্রনাথের লেখার প্রতি অনেকের বিরক্তির কারণ এই যে, সে লেখার রূপ আছে। রবীন্দ্রনাথের অন্তরে ইথার আছে, তাই সে মনের ভিতর দিয়ে যে ভাবের আলো রিফ্র্যাকটেড হয়ে আসে, তা ইন্দ্রধনুর বর্ণে রঞ্জিত ও ছন্দে মত হয়ে আসতে বাধ্য। স্থূলদর্শীর স্থূলষ্টিতে তা হয় অসত্য নয় অশিব বলে ঠেকা কিছু আশ্চর্য নয়।

মানুষে তিনটি কথাকে বড় বলে স্বীকার করে, তার অর্থ তারা বুঝুক আর না- বুঝুক। সে তিনটি হচ্ছে : সত্য শিব আর সুন্দর। যার রুপের প্রতি বিদ্বেষ আছে, সে সন্দরকে তাড়না করতে হলে হয় সত্যের নয় শিবের দোহাই দেয়; যদিচ সম্ভবত সে ব্যক্তি সত্য কিংবা শিবের কখনো একমনে সেবা করে নি। যদি কেউ বলেন যে, সুন্দরের সাধনা কর— অমনি দশজনে বলে ওঠেন, কি দ-নীতির কথা। বিষয়বধির মতে সৌন্দর্যপ্রিয়তা বিলাসিতা এবং রূপের চচা চরিত্রহীনতার পরিচয় দেয়। সন্দরের উপর এদেশে সত্যের অত্যাচার কম, কেননা এদেশে সত্যের আরাধনা করবার লোকও কম। শিবই হচ্ছে এখন আমাদের একমাত্র, কেননা অমনি-পাওয়া, ধন। এ তিনটির প্রতিটি যে প্রতিঅপরটির শত্র, তার কোনো প্রমাণ নেই। সুতরাং এদের একের প্রতি অভক্তি অপরের প্রতি ভক্তির পরিচায়ক নয়। সে যাই হোক, শিবের দোহাই দিয়ে কেউ কখনো সত্যকে চেপে রাখতে পারে নি; আমার বিশ্বাস, সুন্দরকেও পারবে না। যে জানে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, সে সে-সত্য স্বীকার করতে বাধ্য, এবং সামাজিক জীবনের উপর তার কি ফলাফল হবে সেকথা উপেক্ষা করে সে-সত্য প্রচার করতেও বাধ্য। কেননা, সত্যসেবকদের একটা বিশ্বাস আছে যে, সত্যজ্ঞানের শেষফল ভালো বই মন্দ নয়। তেমনি যার রূপজ্ঞান আছে, সে সৌন্দর্যের চর্চা এবং সুন্দর বস্তুর সৃষ্টি করতে বাধ্য তার আশু সামাজিক ফলাফল উপেক্ষা করে, কেননা রুপের পূজারীদেরও বিশ্বাস যে, রূপজ্ঞানের শেষফল ভালো বই মন্দ নয়। তবে মানুষের এ জ্ঞানলাভ করতে দেরি লাগে।

শিবজ্ঞান আসে সবচাইতে আগে। কেননা, মোটামুটি ও-জ্ঞান না থাকলে সমাজের সৃষ্টিই হয় না, রক্ষা হওয়া তো দুরের কথা। ও জ্ঞান বিষয়বৃদ্ধির উত্তমাঙ্গ হলেও একটা অঙ্গমাত্র।

তার পর আসে সত্যের জ্ঞান। এ জ্ঞান শিবজ্ঞানের চাইতে ঢের সক্ষমজ্ঞান এবং এ জ্ঞান আংশিকভাবে বৈষয়িক, অতএব জীবনের সহায়; এবং আংশিকভাবে তার বহির্ভূত, অতএব মনের সম্পদ।

সবশেষে আসে রূপজ্ঞান। কেননা, এ জ্ঞান অতিসক্ষম এবং সাংসারিক হিসেবে অকেজো। রূপজ্ঞানের প্রসাদে মানুষের মনের পরমায়ু বেড়ে যায়, দেহের নয়। সুনীতি সভ্যসমাজের গোড়ার কথা হলেও সুরুচি তার শেষকথা। শিব সমাজের ভিত্তি, আর সুন্দর তার অভ্রভেদী চড়া।

অবশ্য হার্বার্ট স্পেনসার বলেছেন যে, মানুষের রূপজ্ঞান আসে আগে এবং সত্যজ্ঞান তার পরে। তার কারণ, যে জ্ঞান তাঁর জন্মায় নি, তিনি মনে করতেন সে জ্ঞান বাতিল হয়ে গিয়েছে। সত্যকথা এই যে, মানবসমাজের পক্ষে রূপজ্ঞান লাভ করাই সাধনাসাপেক্ষ খোয়ানো সহজ। আমাদের পর্বপুরুষদের সাধনার সেই বঞ্চিত ধন আমরা অবহেলাক্রমে হারিয়ে বসেছি। বিলেতি সভ্যতার কেজো অংশের সংস্পর্শে আমাদের মনের ভিত টলকে আর না-টলুক, তার চড়া ভেঙে পড়েছে।

এবিষয়ে বৌদ্ধদর্শনের মত প্রণিধানযোগ্য। বৌদ্ধদার্শনিকেরা কল্পনা করেন যে, এ জগতে নানা লোক আছে। সবনীচে কামলোক, তার উপরে রূপলোক, তার উপরে ধ্যানলোক ইত্যাদি।

আমার ধারণা, আমরা-সব জন্মত কামলোকের অধিবাসী; সুতরাং রূপলোকে যাওয়ার অর্থ আত্মার পক্ষে ওঠা, নামা নয়।

আর-এক কথা, রূপের চর্চার বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তি এই যে, আমরা দরিদ্র জাতি–অতএব ও আমাদের সাধনার ধন নয়। এ ধারণার কারণ, ইউরোপের কমার্শিয়ালিজম, আমাদের মনের উপর এ যুগে রাজার মত প্রভুত্ব করছে। সত্যকথা এই যে, জাতীয়-শ্রীহীনতার কারণ অর্থের অভাব নয়, মনের দারিদ্র। তার প্রমাণ, আমাদের হালফ্যাশানের বেশভূষা সাজসজ্জা আচারঅনুষ্ঠানের শ্রীহীনতা সোনার-জলে ছাপানো বিয়ের কবিতার মত আমাদের ধনীসমাজেই বিশেষ করে ফুটে উঠেছে। আসল কথা, আমাদের নবশিক্ষার বৈজ্ঞানিক আলোক আমাদের জ্ঞাননেত্র উন্মীলিত করুক আর নাই করুক, আমাদের রূপেকানা করেছে। গুণ হয়ে দোষ হল বিদ্যার বিদ্যায়’–ভারতচন্দ্রের একথা সুন্দরের দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে, আমাদের সকলের পক্ষেই সমান খাটে। আর যদি এইকথাই সত্য হয় যে, আমরা সুন্দরভাবে বাঁচতে পারি নে— তাহলে আমাদের সুন্দরভাবে মরাই শ্রেয়। তাতে পৃথিবীর কারও কোনো ক্ষতি হবে না, এমনকি আমাদেরও নয়।

ফাল্গুন ১৩২৩

সুরের কথা

 

সুরের কথা

আপনারা দেশী বিলেতি সংগীত নিয়ে যে বাদানুবাদের সৃষ্টি করেছেন, সে গোলযোগে আমি গলাযযাগ করতে চাই।

এবিষয়ে বক্তৃতা করতে পারেন এক তিনি, যিনি সংগীতবিদ্যার পারদশী; আর-এক তিনি, যিনি সংগীতশাস্ত্রের সারদর্শী অর্থাৎ যিনি সংগীত সম্বন্ধে হয় সর্বজ্ঞ, নয় সর্বজ্ঞ। আমি শেষোক্ত শ্রেণীর লোক, অতএব এবিষয়ে আমার কথা বলবার অধিকার আছে।

আপনাদের সুরের আলোচনা থেকে আমি যা সার সংগ্রহ করেছি সংক্ষেপে তাই বিবত করতে চাই। বলা বাহুল্য, সংগীতের সুর ও সার পরস্পর পরস্পরের বিরোধী। এর প্রথমটি হচ্ছে কানের বিষয়, আর দ্বিতীয়টি জ্ঞানের। আমরা কথায় বলি সরসার, কিন্তু সে দ্বন্দ্বসমাস হিসেবে।

সব বিষয়েরই শেষকথা তার প্রথমকথার উপরেই নির্ভর করে; যে বস্তুর আমরা আদি জানি নে, তার অন্ত পাওয়া ভার। অতএব কোনো সমস্যার চড়ান্ত মীমাংসা করতে হলে তার আলোচনা ক-খ থেকে শুরু করাই সনাতন পদ্ধতি; এবং এক্ষেত্রে আমি সেই সনাতন পদ্ধতিই অনুসরণ করব।

অবশ্য একথা অস্বীকার করা যায় না যে, এমন লোক ঢের আছে যারা দিব্যি বাংলা বলতে পারে অথচ ক-খ জানে না; আমাদের দেশের বেশির ভাগ স্ত্রী-পুরুষই তো ঐ দলের। অপরপক্ষে, এমন প্রাণীরও অভাব নেই, যারা ক-খ জানে অথচ বাংলা ভালো বলতে পারে না— যথা আমাদের ভদ্রশিশুর দল। অতএব এরূপ হওয়াও আশ্চর্য নয় যে— এমন গুণী ঢের আছে, যারা দিব্যি গাইতে-বাজাতে পারে অথচ সংগীতশাস্ত্রের ক-খ জানে না; অপরপক্ষে এমন জ্ঞানীও ঢের থাকতে পারে, যারা সংগীতের শুধু ক-খ নয় অনুঘরবিসর্গ পর্যন্ত জানে, কিন্তু গানবাজনা জানে না।

তবে যারা গানবাজনা জানে, তারা গায় ও বাজায়; যারা জানে না, তারা ও-বস্তু নিয়ে তর্ক করে। কলধনি না করতে পারি, কলরব করবার অধিকার আমাদের সকলেরই আছে। সুতরাং এই তকে যোগ দেওয়াটা আমার পক্ষে অনধিকারচর্চা হবে না। অতএব আমাকে ক-খ থেকেই শুরু করতে হবে, অ-আ থেকে নয়। কেননা, আমি যা লিখতে বসেছি, সে হচ্ছে সংগীতের ব্যঞ্জনলিপি, স্বরলিপি নয়। আমার উদ্দেশ্য সংগীতের তত্ত্ব ব্যক্ত করা, তার স্বত্ব সাব্যস্ত করা নয়। আমি সংগীতের সারদর্শী, সুরস্পর্শী নই।

 

২.

হিন্দুসংগীতের ক-খ-জিনিসটে কি?–বলছি।

আমাদের সকল শাস্ত্রের মুল যা, আমাদের সংগীতেরও মূল তাই–অর্থাৎ শ্রুতি।

শুনতে পাই, এই শ্রুতি নিয়ে সংগীতাচার্যের দল বহুকাল ধরে বহু বিচার করে আসছেন, কিন্তু আজ-তক, এমন-কোনো মীমাংসা করতে পারেন নি, যাকে ‘উত্তর’ বলা যেতে পারে অর্থাৎ যার আর উত্তর নেই।

কিন্তু যেহেতু আমি পণ্ডিত নই, সে কারণ আমি ওবিষয়ের একটি সহজ মীমাংসা করেছি, যা সহজ মানুষের কাছে সহজে গ্রাহ্য হতে পারে।

আমার মতে শ্রুতির অর্থ হচ্ছে সেই ঘর, যা কানে শোনা যায় না; যেমন দর্শনের অর্থ হচ্ছে সেই সত্য, যা চোখে দেখা যায় না। যেমন দর্শন দেখবার জন্য দিব্যচক্ষু, চাই, তেমনি শ্ৰতি শোনবার জন্য দিব্যকণ চাই। বলা বাহুল্য, তোমার-আমার মত সহজ মানুষদের দিব্যচক্ষুও নেই, দিব্যকণও নেই; তবে আমাদের মধ্যে কারও কারও দিব্যি চোখও আছে, দিব্যি কানও আছে। ওতেই তো হয়েছে মুশকিল। চোখ ও কান সম্বন্ধে দিব্য এবং দিব্যি— এ দুটি বিশেষণ, কানে অনেকটা এক শোনালেও মানেতে ঠিক উলটো।

সংগীতে যে সাতটি শাদা আর পাঁচটি কালো সুর আছে, এ সত্য পিয়ানো কিংবা হারমোনিয়ামের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সকলেই দেখতে পাবেন। এই পাঁচটি কালো সুরের মধ্যে যে, চারটি কোমল আর একটি তীব্র তা আমরা সকলেই জানি এবং কেউ-কেউ তাদের চিনিও। কিন্তু চেনাশনোজিনিসে পণ্ডিতের মনস্তুষ্টি হয় না। তাঁরা বলেন যে, এদেশে ঐ পাঁচটি ছাড়া আরও কালো এবং এমন কালো সুর আছে, যেমন কালো বিলেতে নেই। শাস্ত্রমতে সেসব হচ্ছে অতিকোমল ও অতিতীব্র। ঐ নামই প্রমাণ যে, সেসব অতীন্দ্রিয় সুর এবং তা শোনবার জন্যে দিব্যকর্ণ চাই–যা তোমার-আমার তো নেই, শাস্ত্রীমহাশয়দেরও আছে কি না সন্দেহ। আমার বিশ্বাস, তাঁদেরও নেই। শ্ৰতি সেকালে থাকলেও একালে তা স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। স্মৃতিই যে শ্ৰতিধরদের একমাত্র শক্তি, এ সত্য তো জগদ্বিখ্যাত। সুতরাং একথা নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, সংগীত সম্বন্ধে পরের মুখে ঝাল খাওয়া, অর্থাৎ পরের কানে মিষ্টি শোনা, যাঁদের অভ্যাস শুধু তাঁদের কাছেই শ্রুতি এতিমধুর। আমি স্থির করেছি যে, আমাদের পক্ষে ঐ বারোই ভালো; অবশ্য সাতপাঁচ ভেবেচিন্তে। ও দ্বাদশকে ছাড়াতে গেলে, অর্থাৎ ছাড়লে, আমাদের কানকে একাদশী করতে হবে।

আর ধরুন, যদি ঐ দ্বাদশ সরের ফাঁকে ফাঁকে সত্যসত্যই শ্ৰতি থাকে, তাহলে সেসব স্বর হচ্ছে অনুঘর। সা- এবং নি-র অন্তর্ভূত দশটি সুরের গায়ে যদি কোনো অসাধারণ পণ্ডিত দশটি অনুঘর জুড়ে দিতে পারেন, তাহলে সংগীত এমনি সংস্কৃত হয়ে উঠবে যে, আমাদের মত প্রাকৃতজনেরা তার এক বর্ণও বুঝতে পারবে না।

 

৩.

এসব তো গেল সংগীতের বর্ণপরিচয়ের কথা, শব্দবিজ্ঞানের নয়। শব্দেরও যে একটা বিজ্ঞান আছে, এ জ্ঞান সকলের নেই। সুতরাং সরের। সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব গ্রাহ্য না হলেও আলোচ্য।

শব্দজ্ঞানের মতে শ্রুতি অপৌরুষেয়; অর্থাৎ স্বরগ্রাম কোনো পুরুষ কতৃক রচিত হয় নি, প্রকৃতির বক্ষ থেকে উত্থিত হয়েছে। একটি একটানা তারের গায়ে ঘা মারলে প্রকৃতি অমনি সাত-সরে কেঁদে ওঠেন। এর থেকে বৈজ্ঞানিকেরা ধরে নিয়েছেন যে, প্রকৃতি তাঁর একতারায় যে সকাতর সাগম আলাপ করেন, মানুষে শুধু তার নকল করে। কিন্তু সে নকলও মাছিমারা হয় না। মানুষের গলগ্রহ কিংবা যন্ত্রস্থ হয়ে প্রকৃতিদত্ত স্বরগ্রামের কোনো সুর একটু চড়ে, কোনো সুর একটু ঝুলে যায়। তা তো হবারই কথা।  প্রকৃতির হদয়তলী থেকে এক ঘায়ে যা বেরয়, তা যে একঘেয়ে হবে–এ তো স্বতঃসিদ্ধ। সুতরাং মানুষে এইসব প্রাকৃত সরকে সংস্কৃত করে নিতে বাধ্য।

এ মত লোকে সহজে গ্রাহ্য করে; কেননা, প্রকৃতি যে একজন মহা ওস্তাদ— এ সত্য লৌকিক ন্যায়েও সিদ্ধ হয়। প্রকৃতি অন্ধ, এবং অন্ধের সংগীতে বৎপত্তি যে সহজ, এ সত্য তো লোকবিশ্রত।

প্রকৃতির ভিতর যে শব্দ আছে শুধু শব্দ নয়, গোলযোগ আছেএকথা সকলেই জানেন; কিন্তু তাঁর গলায় যে সুর আছে, একথা সকলে মানেন না। এই নিয়েই তো আট ও বিজ্ঞানে বিরোধ।

আর্টিস্টরা বলেন, প্রকৃতি শুধু অন্ধ নন, উপরন্তু বধির। যাঁর কান নেই, তাঁর কাছে গানও নেই। সাংখ্যদর্শনের মতে পুরুষ দ্রষ্টা এবং প্রকৃতি নর্তকী; কিন্তু প্রকৃতি যে গায়িকা এবং পুরুষ শ্রোতা–একথা কোনো দর্শনেই বলে না। আর্টিস্টদের মতে তৌত্রিকের একটিমাত্র অঙ্গ-নৃত্যই প্রকৃতির অধিকারভুক্ত, অপর দুটি— গীত বাদ্য— তা নয়।

এর উত্তরে বিজ্ঞান বলেন, এ বিশ্বের সকল রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দের উপাদান এবং নিমিত্তকারণ হচ্ছে ঐ প্রকৃতির নত্য। কথাটা উড়িয়ে দেওয়া চলে না, অতএব পুড়িয়ে দেখা যাক ওর ভিতর কতটুকু খাঁটি মাল আছে।

শাস্ত্রে বলে, শব্দ আকাশের ধর্ম; বিজ্ঞান বলে, শব্দ আকাশের নয় বাতাসের ধর্ম। আকাশের নত্য অর্থাৎ সর্বাগের স্বচ্ছন্দ কম্পন থেকে যে আলোকের, এবং বাতাসের উত্তরপ কম্পন থেকে যে ধনির উৎপত্তি হয়েছেতা বৈজ্ঞানিকেরা হাতে-কলমে প্রমাণ করে দিতে পারেন। কিন্তু আর্ট বলে, আত্মার কম্পন থেকে সরের উৎপত্তি, সতরাং জড়প্রকৃতির গভে তা জন্মলাভ করে নি। আত্মা কাঁপে আনন্দে, সৃষ্টির চরম আনন্দে; আর আকাশ-বাতাস কাঁপে বেদনায়, সৃষ্টির প্রসববেদনায়। সুতরাং আর্টিস্টদের মতে সুর শব্দের অনুবাদ নয়, প্রতিবাদ।

যেখানে আটে ও বিজ্ঞানে মতভেদ হয়, সেখানে আপোস-মীমাংসার জন্য দর্শনকে সালিশ মানা ছাড়া আর উপায় নেই। দার্শনিকেরা বলেন, শব্দ হতে সুরের কিংবা সুর হতে শব্দের উৎপত্তি— সে বিচার করা সময়ের অপব্যয় করা। এস্থলে আসল জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, রাগ ভেঙে সুরের, না সুর জুড়ে রাগের সৃষ্টি হয়েছে এককথায়, সর আগে না রাগ আগে। অবশ্য রাগের বাইরে সাগমের কোনো অস্তিত্ব নেই, এবং সাগমের বাইরে রাগের কোনো অস্তিত্ব নেই। সুতরাং সর পর্বরাগী কি অনুরাগী, এই হচ্ছে আসল সমস্যা। দার্শনিকেরা বলেন যে, এ প্রশ্নের উত্তর তাঁরাই দিতে পারেন যাঁরা বলতে পারেন বীজ আগে কি বক্ষ আগে; অর্থাৎ কেউ পারেন না।

আমার নিজের বিশ্বাস এই যে, উক্ত দার্শনিক সিদ্ধান্তের আর-কোনো খণ্ডন নেই। তবে বক্ষায়ুর্বেদীরা নিশ্চয়ই বলবেন যে, বক্ষ আগে কি বীজ আগে, সে রহস্যের ভেদ তাঁরা বালাতে পারেন। কিন্তু তাতে কিছু আসেযায় না। কেননা, ওকথা শোনবামাত্র আর-এক দলের বৈজ্ঞানিক, অর্থাৎ পরমাণবাদীরা, জবাবু দেবেন যে সংগীত আয়ুর্বেদের নয় বায়ুর্বেদের অন্তর্ভূত; অর্থাৎ বিজ্ঞানের বিষে বিষক্ষয় হয়ে যাবে।

আসল কথা এই যে, আমি কর্তা তুমি ভোত্তা এ জ্ঞান যার নেই, তিনি আর্টিস্ট নন। সুতরাং সংগীত সম্বন্ধে প্রকৃতিকে সম্বােধন করে— তুমি কর্তা আমি ভোক্তা–একথা কোনো আর্টিস্ট কখনো বলতে পারবেন না, এবং ওকথা মুখে আনবার কোনো দরকারও নেই। প্রকৃতির হাতে-গড়া এই বিশ্বসংসার যে আগাগোড়া বেসুরো, তার অকাট্য প্রমাণ আমরা পৃথিবীসদ্ধ লোক পৃথিবী ছেড়ে সরলোকে যাবার জন্য লালায়িত।

অতএব দাঁড়াল এই যে, সংগীতের উৎপত্তির আলোচনায় তার লয়ের সম্ভাবনাই বেড়ে যায়। তাই সহজ মানুষে চায় তার স্থিতি, ভিত্তি নয়।

 

৪.

অতঃপর দেশী বিলেতি সংগীতের ভেদাভেদ নির্ণয় করবার চেষ্টা করা যাক।

।এ দুয়ের মধ্যে আর যা প্রভেদই থাক, তা অবশ্য ক-খ-গত নয়। যে বারো সরে এদেশের সংগীতের মূলধন, সেই বারো সুরই যে সেদেশের সংগীতের মূলধন–একথা সর্ববাদিসম্মত। তবে আমরা বলি যে, সে মূলধন আমাদের হাতে সদে বেড়ে গিয়েছে। আমাদের হাতে কোনো ধন যে সুদে বাড়ে, তার বড়-একটা প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাছাড়া আমি পূর্বে দেখিয়েছি যে, সরের এই অতিসদের লোভে আমরা সংগীতের মূলধন হারাতে বসেছি। সুতরাং এবিষয়ে আর বেশিকিছু বলা নিষ্প্রয়োজন।

দেশীর সঙ্গে বিলেতি সংগীতের আসল প্রভেদটা ক-খ নিয়ে নয়, করখল নিয়ে। BLA=ব্লে –CLA=ক্লের সঙ্গে কর-খলের, কানের দিক থেকেই হোক আর মানের দিক থেকেই হোক, একটা-যে প্রকাণ্ড প্রভেদ আছে— এ হচ্ছে একটি প্রকাণ্ড সত্য। এ প্রভেদ উপাদানের নয়, গড়নের। অতএব রাগ ও মেলডির ভিতর পার্থক্য হচ্ছে ব্যাকরণের, এবং একমাত্র ব্যাকরণেরই।

সুতরাং আমরা যদি বিলেতি ব্যাকরণ অনুসারে সুর সংযোগ করি তাহলে তা রাগ না হয়ে মেলডি হবে, এবং তাতে অবশ্য রাগের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। আমরা ইংরেজি ব্যাকরণ অনুসারে ইংরেজিভাষা লিখলে সে লেখা ইংরেজিই হয়, এবং তাতে বাংলাসাহিত্যের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না, যদিচ এক্ষেত্রে শুধু ব্যাকরণ নয় শব্দও বিদেশী। কিন্তু যেমন কতকটা ইংরেজি এবং কতকটা বাংলা ব্যাকরণ মিলিয়ে, এবং সেইসঙ্গে বাংলা শব্দের অনুবাদের গোঁজামিলন দিলে, তা বাবু ইংলিশ হয়, এবং উক্ত পদ্ধতি অনুসারে বাংলা লিখলে তা সাধুভাষা হয় তেমনি ঐ দুই ব্যাকরণ মেলাতে বসলে সংগীতেও আমরা রাগ-মেলডির একটি খিচুড়ি পাকাব। সাহিত্যের খিচুড়িভোগে যখন আমার রুচি নেই, তখন সংগীতের ও-ভোগ যে আমি ভোগ করতে চাই নে, সেকথা বলাই বাহুল্য।

 

৫.

দেশী বিলেতি সংগীতের মধ্যে আর-একটা স্পষ্ট প্রভেদ আছে। বিলেতি সংগীতে হারমনি আছে, আমাদের নেই।

এই হারমনি-জিনিসটে ঘরের যুক্তাক্ষর বই আর-কিছুই নয়, অর্থাৎ ও-বস্তু হচ্ছে সংগীতের বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয়ভাগের অধিকারে। আমাদের সংগীত এখনও প্রথমভাগের দখলেই আছে। আমাদের পক্ষে সংগীতের দ্বিতীয়ভাগের চর্চা করা উচিত কি না, সেবিষয়ে কেউ মনস্থির করতে পারেন নি। অনেকে ভয় পান যে, দ্বিতীয়ভাগ ধরলে তাঁরা প্রথমভাগ ভুলে যাবেন। তা ভুলন আর না-ভুলন, তাঁরা যে প্রথমভাগকে আর আমল দেবেন না, সেবিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের সাহিত্য থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, একবার যুক্তাক্ষর শিখলে আমরা অযুক্তাক্ষরের ব্যবহার যুক্তিযুক্ত মনে করি নে এবং অপর-কেউ করতে গেলে অমনি বলে উঠি, সাহিত্যের সর্বনাশ হল, ভাষাটা একদম অসাধ এবং অশদ্ধ হয়ে গেল। তবে সংগীতে এ বিপদ ঘটবার বিশেষ সম্ভাবনা নেই। সেদিন একজন ইংরেজ বলছিলেন যে, যে সংগীতে ছয়টি রাগ এবং প্রতি রাগের ছয়টি করে স্ত্রী আছে, সেখানে হারমনি কি করে থাকতে পারে। আমি বলি, ও তো ঠিকই কথা, বিশেষত স্বামী যখন মতিমান রাগ আর স্ত্রীরা প্রত্যেকেই এক-একটি মতিমতী রাগিণী। অবশ্য এরূপ হবার কারণ আমাদের সংগীতের কৌলিন্য। আমাদের রাগসকল যদি কুলীন না হত, তাহলেও আমরা হারমনির চর্চা করতে পারতুম না; কেননা, ও-বস্তু আমাদের ধাতে নেই। আমাদের সমাজের মত আমাদের সংগীতেও জাতিভেদ আছে, আর তার কেউ আরকারও সঙ্গে মিশ্রিত হতে পারে না। মিশ্রিত হওয়া দূরে থাক, আমরা পরস্পর পরস্পরকে স্পর্শ করতে ভয় পাই; কেননা, জাতির ধর্মই হচ্ছে জাত বাঁচিয়ে মরা। আর মিলে-মিশে এক হয়ে যাবার নামই হচ্ছে হারমনি।

পৌষ ১৩২৩

Exit mobile version