২.
এদেশে ঋতুর গমনাগমনটি অলক্ষিত হলেও তার পূর্ণাবতারটি ইতিপূর্বে আমাদের নয়নগোচর হত। কিন্তু আজ যে ফাগুনমাসের পনেরো তারিখ, এ সুখবর পাঁজি না দেখলে জানতে পেতুম না। চোখের সম্মুখে যা দেখছি তা বসন্তের চেহারা নয়, একটা মিশ্রঋতুর শীত ও বর্ষার যুগলমতি। আর এদের পরস্পরের মধ্যে পালায়-পালায় চলছে সন্ধি ও বিগ্রহ। আমাদের এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশেও শীত ও বর্ষার দাম্পত্যবন্ধন এভাবে চিরস্থায়ী হওয়াটা আমার মতে মোটেই ইচ্ছনীয় নয়। কেননা, এহেন অসবর্ণ-বিবাহের ফলে শুধু সংকীর্ণবর্ণ দিবানিশার জন্ম হবে।
এই ব্যাপার দেখে আমার মনে ভয় হয় যে, হয়ত বসন্ত ঋতুর খাতা থেকে নাম কাটিয়ে চিরদিনের মত এদেশ থেকে সরে পড়ল। এ পৃথিবীটি অতিশয় প্রাচীন হয়ে পড়েছে; হয়ত সেই কারণে বসন্ত এটিকে ত্যাগ করে এই বিশ্বের এমন-কোনো নবীন পৃথিবীতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে ফলের গন্ধে পত্রের বর্ণে পাখির গানে বায়ুর স্পর্শে আজও নরনারীর হদয় আনন্দে আকুল হয়ে ওঠে।
আমরা আমাদের জীবনটা এমন দৈনিক করে তুলেছি যে, ঋতুর কথা দরে যাক, মাস-পক্ষের বিভাগটারও আমাদের কাছে কোনো প্রভেদ নেই। আমাদের কাছে শীতের দিনও কাজের দিন, বসন্তের দিনও তাই; এবং অমাবস্যাও ঘমবার রাত, পণিমাও তাই। যে জাত মনের আপিস কামাই করতে জানে না, তার কাছে বসন্তের অস্তিত্বের কোনো অর্থ নেই, কোনো সার্থকতা নেই বরং ও একটা অনর্থেরই মধ্যে; কেননা, ও-ঋতুর ধর্মই হচ্ছে মানুষের মন-ভোলানো, তার কাজ-ভোলানো। আর আমরা সব ভুলতে সব ছাড়তে রাজি আছি, এক কাজ ছাড়া; কেননা, অর্থ যদি কোথায়ও থাকে তো ঐ কাজেই আছে। বসন্তে প্রকৃতিসুন্দরী নেপথ্যবিধান করেন; সে সাজগোজ দেখবার যদি কোনো চোখ থাকে, তাহলে কার জন্যই-বা নবীন পাতার রঙিন শাড়ি পরা, কার জন্যই-বা ফলের অলংকার ধারণ, আর কার জন্যই-বা তরুণ আলোর অরুণ হাসি হাসা? তার চাইতে চোখের জল ফেলা ভালো। অর্থাৎ এ অবস্থায় শীতের পাশে বর্ষাই মানায় ভালো। শুনতে পাই, কোনো ইউরোপীয় দার্শনিক আবিষ্কার করেছেন যে, মানবসভ্যতার তিনটি স্তর আছে। প্রথম আসে শ্রুতির যুগ, তার পর দর্শনের, তার পর বিজ্ঞানের। একথা যদি সত্য হয় তো আমরা, বাঙালিরা, আর-যেখানেই থাকি, মধ্যযুগে নেই; আমাদের বর্তমান-অবস্থা হয় সভ্যতার প্রথম-অবস্থা, নয় শেষ-অবস্থা। আমাদের এ যুগে যে দর্শনের যুগ নয়, তার প্রমাণ— আমরা চোখে কিছুই দেখি নে; কিন্তু হয় সবই জানি, নয় সবই শনি। এ অবস্থায় প্রকৃতি যে আমাদের প্রতি অভিমান করে তাঁর বাসন্তী-মতি লুকিয়ে ফেলবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি।
৩.
আমি এইমাত্র বলেছি যে, এ যুগে আমরা হয় সব জানি, নয় সব শুনি। কিন্তু সত্যকথা এই যে, আমরা একালে যা-কিছু জানি সেসব শুনেই জানি–অর্থাৎ দেখে কিংবা ঠেকে নয়; তার কারণ, আমাদের কোনো কিছু দেখবার আকাঙ্ক্ষা নেই— আর সব-তাতেই ঠেকবার আশঙ্কা আছে।
এই বসন্তের কথাটাও আমাদের শোনা-কথা ও একটা গুজবমাত্র। বসন্তের সাক্ষাৎ আমরা কাব্যের পাকা-খাতার ভিতর পাই, গাছের কচি-পাতার ভিতর নয়। আর বইয়ে যে বসন্তের বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায় তা কস্মিনকালেও এ ভূভারতে ছিল কি না, সেবিষয়ে সন্দেহ করবার বৈধ কারণ আছে।
গীতগোবিন্দে জয়দেব বসন্তের যে রূপবর্ণনা করেছেন, সে রূপ বাংলার কেউ কখনো দেখে নি। প্রথমত, মলয়সমীরণ যদি সোজাপথে সিধে বয়, তাহলে বাংলাদেশের পায়ের নীচে দিয়ে চলে যাবে, তার গায়ে লাগবে না। আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেই নেওয়া যায় যে, সে বাতাস উদভ্রান্ত হয়ে, অর্থাৎ পথ ভুলে, বঙ্গভূমির গায়েই এসে ঢলে পড়ে, তাহলেও লবঙ্গলতাকে তা কখনোই পরিশীলিত করতে পারে না। তার কারণ, লবঙ্গ গাছে ফলে কি লতায় ঝোলে, তা আমাদের কারও জানা নেই। আর হোক-না সে লতা, তার এদেশে দোদুল্যমান হবার কোনোই সম্ভাবনা নেই এবং ছিল না। সংস্কৃত আলংকারিকেরা কাবেরীতীরে কালাগুরতর’র উল্লেখে ঘোরতর আপত্তি করেছেন, কেননা ও বাক্যটি যতই শ্রুতিমধুর হোক না কেন প্রকৃত নয়। কাবেরীতীরে যে কালাগরতর কালেভদ্রেও জন্মাতে পারে না, একথা জোর করে আমরা বলতে পারি নে; অপরপক্ষে, অজয়ের তীরে লবঙ্গলতার আবভ এবং প্রাদুর্ভাব যে একেবারেই অসম্ভব, সেকথা বঙ্গভূমির বীরভূমির সঙ্গে যাঁর চাক্ষুষ পরিচয় আছে তিনিই জানেন। ঐ এক উদাহরণ থেকেই অনুমান, এমনকি প্রমাণ পর্যন্ত, করা যায় যে, জয়দেবের বসন্তবর্ণনা কাল্পনিক অর্থাৎ শাদাভাষায় যাকে বলে অলীক। যার প্রথম কথাই মিথ্যে, তার কোনো কথায় বিশ্বাস করা যায় না; অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, এই কবিবর্ণিত বসত আগাগোড়া মন-গড়া।
জয়দেব যখন নিজের চোখে দেখে বর্ণনা করেন নি, তখন তিনি অবশ্য তাঁর পূর্বেবতী কবিদের বই থেকে বসন্তের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন; এবং কবিপরম্পরায় আমরাও তাই করে আসছি। সুতরাং এ সন্দেহ স্বতঃই মনে উদয় হয় যে, বসন্তঋতু একটা কবিপ্রসিদ্ধিমাত্র; ও বস্তুর বাস্তবিক কোনো অস্তিত্ব নেই। রমণীর পদতাড়নার অপেক্ষা না রেখে অশোক যে ফল ফোটায়, তার গায়ে যে আলতার রং দেখা দেয়, এবং ললনাদের মুখমদ্যসিক্ত না হলেও বকুলফলের মুখে যে মদের গন্ধ পাওয়া যায়–একথা আমরা সকলেই জানি। এ দুটি কবিপ্রসিদ্ধির মূলে আছে মানুষের ঔচিত্য-জ্ঞান। প্রকৃতির যথার্থ কার্যকারণের সন্ধান পেলেই বৈজ্ঞানিক কৃতার্থ হন; কিন্তু কবি কল্পনা করেন তাই, যা হওয়া উচিত ছিল। কবির উক্তি হচ্ছে প্রকৃতির যুক্তির প্রতিবাদ। কবি চান সুন্দর, প্রকৃতি দেন তার বদলে সত্য। একজন ইংরেজ কবি বলেছেন যে, সত্য ও সুন্দর একই বস্তু কিন্তু সে শুধু বৈজ্ঞানিকদের মুখ বন্ধ করবার জন্য। তাঁর মনের কথা এই যে, যা সত্য তা অবশ্য সুন্দর নয়, কিন্তু যা সুন্দর তা অবশ্যই সত্য–অর্থাৎ তার সত্য হওয়া উচিত ছিল। তাই আমার মনে হয় যে, পৃথিবীতে বসন্তঋতু থাকা উচিত— এই ধারণাবশত সেকালের কবিরা কল্পনাবলে উক্ত ঋতুর সৃষ্টি করেছেন। বসন্তের সকল উপাদানই তাঁরা মন-অঙ্কে সংগ্রহ করে প্রকৃতির গায়ে তা বসিয়ে দিয়েছেন।