সুতরাং মনুষ্যত্ব রক্ষা করবার অর্থ হচ্ছে আমাদের দেহ ও মনের এই মুক্তভাব রক্ষা। আমাদের সকল চিন্তা সকল সাধনার ঐ একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। যে জীবন যত মক্ত, সে জীবন তত মুল্যবান। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না যে, মানুষের পক্ষে প্রাণীজগতে পশ্চাদপদ হওয়া সহজ। প্রাণের প্রতি মত অবস্থারই এমন-সব বিশেষ সুবিধা ও অসুবিধা আছে যা তার অপর মত অবস্থার নেই। উদ্ভিদ, নিশ্চল, অতএব তা পারিপার্শ্বিক অবস্থার একান্ত অধীন। প্রকৃতি যদি তাকে জল না জোগায় তো সে ঠায় দাঁড়িয়ে নির্জলা একাদশী করে শুকিয়ে মরতে বাধ্য। এই তার অসবিধা। অপর পক্ষে তার সুবিধা এই যে, তাকে আহার সংগ্রহ করবার জন্য কোনোরূপ পরিশ্রম করতে হয় না, সে আলো বাতাস মাটি জল থেকে নিজের আহার অক্লেশে প্রস্তুত করে নিতে পারে। পশুর গতি আছে, অতএব সে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সম্পূর্ণ অধীন নয়, সে এক দেশ ছেড়ে আর-এক দেশে চলে যেতে পারে। এইটকু তার সুবিধা। কিন্তু তার অসুবিধা এই যে, সে নিজগুণে জড়জগৎ থেকে নিজের খাবার তৈরি করে নিতে পারে না, তাকে তৈরি-খাবার অতিকষ্টে সংগ্রহ করে জীবনধারণ করতে হয়। পোষমানা জানোয়ারের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র, সে উদ্ভিদেরই শামিল; কেননা সে শিকড়বদ্ধ না হোক, শিকলবদ্ধ।
মানুষ পারিপার্শ্বিক অবস্থার অধীন হতে বাধ্য নয়; সে স্থানত্যাগ করতেও পারে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার বদল করেও নিতে পারে। একালের ভাষায় যাকে “বেষ্টনী’ বলে মানুষের পক্ষে তা গণ্ডী নয়, মানুষের স্থিতিগতি তার স্বেচ্ছাধীন। এই তার সুবিধা। তার অসুবিধা এই যে, তাকে জীবনধারণ করবার জন্য শরীর ও মন দুই খাটাতে হয়। পশকেও শরীর খাটাতে হয়, মন খাটাতে হয় না; উদ্ভিদকে শরীর মন দুয়ের কোনোটিই খাটাতে হয় না। অর্থাৎ উদ্ভিদের জীবন সবচাইতে আরামের। পশুর শরীরের আরাম না থাক, মনের আরাম আছে। মানুষের শরীর-মন দুয়ের কোনোটিরই আরাম নেই। আমরা যদি মনের আরামের জন্য লালায়িত হই তা হলে আমরা পশুকে আদর্শ করে তুলব; আর যদি দেহমন দয়ের আরামের জন্য লালায়িত হই তা হলে আমরা উদ্ভিদকে আদর্শ করে তুলব, এবং সেই আদর্শ অনুসারে নিজের জীবন গঠন করতে চেষ্টা করব। এ চেষ্টার ফলে আমরা শুধু মনুষ্যত্ব হারিয়ে বসব। ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরোধর্ম ভয়াবহঃ’ এই সনাতন সত্যটি মানুষের সর্বদা স্মরণ রাখা কর্তব্য, নচেৎ মানবজীবন রক্ষ করা অসম্ভব। আর-একটি কথা, মানুষের পক্ষে জীবন রক্ষা করার অর্থ জীবনের উন্নতি করা। মানুষের ভিতরে-বাইরে যে গতিশক্তি আছে, তা মানুষের মতির দ্বারা নিয়মিত ও চালিত। এই মতিগতির শুভপরিণয়ের ফলে যা জন্মলাভ করে তারই নাম উন্নতি। আমাদের মনের অর্থাৎ বুদ্ধি ও হৃদয়ের উৎকর্ষ সাধনেই আমরা মানবজীবনের সার্থকতা লাভ করি। জীবনকে সম্পূর্ণ জাগ্রত করে তোল ছাড়া আয়, বৃদ্ধির অপর কোনো অর্থ নেই।
শ্রাবণ ১৩২৪
ফাল্গুন
ফাল্গুন
আমাদের দেশে কিছুরই হঠাৎ বদল হয় না, ঋতুরও নয়। বর্ষা কেবল কখনো-কখনো বিনা-নোটিশে একেবারে হড়ম করে এসে গ্রীষ্মের রাজ্য জবরদখল করে নেয়। ও ঋতুর চরিত্র কিন্তু আমাদের দেশের ধাতের সঙ্গে মেলে না। প্রাচীন কবিরা বলে গেছেন, বর্ষা আসে দিগ্বিজয়ী যোদ্ধার মত আকাশে জয়ঢাক বাজিয়ে, বিদ্যতের নিশান উড়িয়ে, অজস্র বরণাস্ত্র বর্ষণ করে, এবং দেখতে-না-দেখতে আসমুদ্রহিমালয় সমগ্র দেশটার উপর একছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। এক বর্ষাকে বাদ দিলে, বাকি পাঁচটা ঋতু যে ঠিক কবে আসে আর কবে যায়, তা এক জ্যোতিষী ছাড়া আর-কেউ বলতে পারেন না। আমাদের ছয় রাগের মধ্যে এক মেঘ ছাড়া আর-পাঁচটি যেমন এক সুর থেকে আর-একটিতে বেমালুমভাবে গড়িয়ে যায় আমাদের স্বদেশী পঞ্চঋতুও তেমনি ভূমিষ্ঠ হয় গোপনে, ক্ৰমবিকশিত হয় অলক্ষিতে, ক্রমবিলীন হয় পরঋতুতে।
ইউরোপ কিন্তু ক্রমবিকাশের জগৎ নয়। সেদেশের প্রকৃতি লাফিয়ে চলে, এক ঋতু থেকে আর-এক ঋতুতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বছরে চার বার নবকলেবর ধারণ করে, নবমতিতে দেখা দেয়। তাদের প্রতিটির রূপ যেমন স্বতন্ত্র তেমনি স্পষ্ট। যাঁর চোখ আছে তিনিই দেখতে পান যে, বিলেতের চারটি ঋতু চতুর্বর্ণ। মৃত্যুর পশে বহু যে এক হয়, আর প্রাণের স্পর্শে এক যে বহু হয়, এ সত্য সেদেশে প্রত্যক্ষ করা যায়। সেখানে শীতের রং তুষার-গৌর, সকল বর্ণের সমষ্টি; আর বসন্তের রং ইন্দ্রধনুর, সকল বর্ণের ব্যষ্টি। তার পর নিদাঘের রং ঘন-সবুজ, আর শরতের গাঢ়-বেগনি। বিলেতি ঋতুর চেহারা শুধু; আলাদা নয়, তাদের আসা-যাওয়ার ভগিও বিভিন্ন।
সেদেশে বসন্ত শীতের শব-শীতল কোল থেকে রাতারাতি গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে, মহাদেবের যোগভঙ্গ করবার জন্য মদন-সখা বসন্ত যেভাবে একদিন অকস্মাৎ হিমাচলে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কোনো-এক সুপ্রভাতে ঘুম ভেঙে চোখ মেলে হঠাৎ দেখা যায় যে, রাজ্যির গাছ মাথায় একরাশ ফল প’রে দাঁড়িয়ে হাসছে; অথচ তাদের পরনে একটিও পাতা নেই। সে রাজ্যে বসন্তরাজ তাঁর আগমনবার্তা আকাশের নীল পত্রে সাতরঙা ফলের হরফে এমন স্পষ্ট এমন উজ্জ্বল করে ছাপিয়ে দেন যে, সে বিজ্ঞাপন মানুষের কথা ছেড়ে দিন–পশপেক্ষীরও চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না।
ইউরোপের প্রকৃতির যেমন ক্রমবিকাশ নেই, তেমনি ক্রমবিলয়ও নেই; শরৎও সেদেশে কালক্রমে জরাজীর্ণ হয়ে অলক্ষিতে শিশিরের কোলে দেহত্যাগ করে না। সেদেশে শরৎ তার শেষ-উইল পাণ্ডুলিপিতে নয়— রক্তাক্ষরে লিখে রেখে যায়; কেননা, মৃত্যুর পশে তার পিত্ত নয়–রক্ত প্রকুপিত হয়ে ওঠে। প্রদীপ যেমন নেভবার আগে জলে ওঠে, শরতের তাম্রপত্রও তেমনি ঝরবার আগে অগ্নিবর্ণ হয়ে ওঠে। তখন দেখতে মনে হয়, অস্পৃশ্য শত্রর নির্মম আলিঙ্গন হতে আত্মরক্ষা করবার জন্য প্রকৃতিসন্দরী যেন রাজপুত রমণীর মত স্বহস্তে চিতা রচনা করে সোল্লাসে অগ্নিপ্রবেশ করছেন।