৩.
প্রাণের এই স্বাতন্ত্র্য অবশ্য সকলে স্বীকার করেন না। শুধু তাই নয়, ভাইটালিজম, কথাটাও অনেকের কাছে কণশল। এর কারণও স্পষ্ট। ভাইটাল ফোর্স নামক একটি স্বতন্ত্র শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়ার অর্থ প্রাণের উৎপত্তির সধান ত্যাগ করা। এ জগতের সকল পদার্থ সকল ব্যাপারই যখন জড়জগতের কতকগুলি ছোটোবড়ো নিয়মের অধীন, তখন একমাত্র প্রাণই যে স্বাধনি এ কথা বিনা পরীক্ষায় বৈজ্ঞানিকের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। আপাতদৃষ্টিতে যা বিভিন্ন মূলত তা যে অভিন্ন, এই সত্য প্রমাণ করাই বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য। সুতরাং প্রাণ যে জড়শক্তিরই একটি বিশেষ পরিণাম, এটা প্রমাণ না করতে পারলে বিজ্ঞানের অকে একটা মস্ত বড়ো ফাঁক থেকে যায়। গত শতাব্দীতে ইউরোপের বৈজ্ঞানিক সমাজে এই ফাঁক বোজাবার বহু চেষ্টা হয়েছে; কিন্তু সুখের বিষয়ই বলন আর দুঃখের বিষয়ই বলন, সে চেষ্টা অদ্যাবধি সফল হয় নি। প্রাণ জড়জগতে লীন হতে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। পঞ্চভূতে মিলিয়ে যাওয়ার অর্থ যে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হওয়া, এ কথা কে না জানে?
আমার পূর্ববর্তী বা বলেছেন যে, ইউরোপ যা প্রমাণ করতে পারে নি বাংলা তা করেছে; অর্থাৎ তাঁর মতে আচার্য জগদীশচন্দ্র বস, হাতে-কলমে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, জড়ে ও জীবে কোনো প্রভেদ নেই। আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশের সর্বাগ্রগণ্য বিজ্ঞানাচার্য এ কথা কোথায়ও বলেন নি যে, জড়ে ও জীবে কোনো প্রভেদ নেই। আমার ধারণা, তিনি প্রাণের উৎপত্তি নয়, তার অভিব্যক্তি নির্ণয় করতে চেষ্টা করেছেন। কথাটা আর-একটু পরিষ্কার করা যাক। মানুষমাত্রই জানে যে, যেমন মানুষের ও পশুর প্রাণ আছে তেমনি উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। এমন-কি, ছোটো ছেলেরাও জানে যে, গাছপালা জন্মায় ও মরে। সুতরাং মানুষ পশু ও উদ্ভিদ, যে গুণে সমধর্মী সেই গুণের পরিচয় নেবার চেষ্টা বহনকাল থেকে চলে আসছে। ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত হয়েছিল যে, অ্যাসিমিলেশন এবং রিপ্রোডাকশন-এই দুই গুণে তিন শ্রেণীর প্রাণীই সমধর্মী। অর্থাৎ এতদিন আত্মরক্ষা ও বংশরক্ষার প্রবত্তি ও শক্তিই ছিল প্রাণের লীস্ট কমন মালটিপল-একালের কুলের বাংলায় যাকে বলে লসাগু।
আচার্য জগদীশচন্দ্র দেখিয়ে দিয়েছেন যে, এই দুই ছাড়া আরো অনেক বিষয়ে প্রাণীমাত্রেই সমধর্মী। তিনি যে সত্যের আবিষ্কার করেছেন সে হচ্ছে এই যে, প্রাণীমাত্রেই একই ব্যথার ব্যথী। উদ্ভিদের শিরায়-উপশিরায় বিদ্যুৎ সঞ্চার করে দিলে ও-বস্তু আমাদের মতোই সাড়া দেয়, অর্থাৎ তার দেহে স্বেদ কম্প মূর্ছা বেপথু প্রভৃতি সাত্ত্বিক ভাবের লক্ষণ সব ফুটে ওঠে। এক কথায়, আচার্য বসু উদ্ভিদজগতেও হৃদয়ের আবিষ্কার করেছেন, পূর্বাচার্যেরা উদর ও মিথুনত্বের সধান নিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন। বসুমহাশয় প্রাণের লসাগু-তে সন্তুষ্ট না থেকে তার গসাগু, অর্থাৎ গ্রেটেস্ট কমন মেজার -এর আবিষ্কারে ব্রতী হয়েছেন। যখন উদ্ভিদের হৃদয় আবিষ্কৃত হয়েছে তখন সম্ভবত কালে তার মস্তিষ্কও আবিষ্কৃত হবে। কিন্তু তাতে জড় ও জীবের ভেদ নষ্ট হবে না, কেননা জড়পদার্থের যখন উদরই নেই তখন তার অন্তরে হৃদয়-মস্তিকাদি থাকবার কোনোই সম্ভাবনা নেই। যে বস্তুর দেহে অন্নময় কোষ নেই, তার অন্তরে মনোময় কোষের দর্শনলাভ তাঁরাই করতে পারেন যাঁদের চোখে আকাশকুসুম ধরা পড়ে।
৪.
আমি বৈজ্ঞানিকও নই, দার্শনিকও নই; সুতরাং এতক্ষণ যে অনধিকারচর্চা করলাম, তার ভিতর চাই-কি কিছু সার নাও থাকতে পারে। কিন্তু জীবন জিনিসটে দার্শনিক বৈজ্ঞানিকের একচেটে নয়, ও-বস্তু আমাদের দেহেও আছে। সুতরাং প্রাণের সমস্যার মীমাংসা আমাদেরও করতে হবে, আর-কিছুর জন্য না হোক, শুধু প্রাণধারণ করবার জন্য। আমাদের পক্ষে জ্ঞাতব্য বিষয় হচ্ছে প্রাণের মূল্য, সুতরাং আমাদের সমস্যা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক-দার্শনিকের সমস্যার ঠিক বিপরীত। প্রাণীর সঙ্গে প্রাণীর অভেদজ্ঞান নয়, ভেদজ্ঞানের উপরেই আমাদের মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠিত। কেননা, যে গুণে প্রাণীজগতে মানুষ অসামান্য সেই গুণেই সে মানুষ।
উদ্ভিদ ও পশুর সঙ্গে কোন কোন গুণে ও লক্ষণে আমরা সমধর্মী, সে জ্ঞানের সাহায্যে আমরা মানবজীবনের মূল্য নির্ধারণ করতে পারি নে, কোন কোন ধর্মে আমরা ও-দই শ্রেণীর প্রাণী হতে বিভিন্ন, সেই বিশেষ জ্ঞানই আমাদের জীবনযাত্রার প্রধান সহায়; এবং এ জ্ঞান লাভ করবার জন্য আমাদের কোনোরূপ অনুমান-প্রমাণের দরকার নেই, প্রত্যক্ষই যথেষ্ট।
আমরা চোখ মেললেই দেখতে পাই যে, উদ্ভিদ মাটিতে শিকড় গেড়ে বসে আছে, তার চলৎশক্তি নেই। এক কথায় উদ্ভিদের প্রত্যক্ষ ধর্ম হচ্ছে স্থিতি।
তার পর দেখতে পাই, পশরা সর্বত্র বিচরণ করে বেড়াচ্ছে, অর্থাৎ তাদের প্রত্যক্ষ ধর্ম হচ্ছে গতি।
তার পর আসে মানুষ। যেহেতু আমরা পশু সে-কারণ আমাদের গতি তো আছেই, তার উপর আমাদের ভিতর মন নামক একটি পদার্থ আছে, যা পশর নেই। এক কথায় আমাদের প্রত্যক্ষ বিশেষ ধর্ম হচ্ছে মতি।
এ প্রভেদটার অন্তরে রয়েছে প্রাণের মুক্তির ধারাবাহিক ইতিহাস। উদ্ভিদের জীবন সবচাইতে গণ্ডীবদ্ধ, অর্থাৎ উদ্ভিদ, হচ্ছে বন্ধ জীব। পশু মাটির বন্ধন থেকে মুক্ত কিন্তু নৈসর্গিক স্বভাবের বন্ধনে আবদ্ধ, অর্থাৎ পশু বদ্ধমত্ত জীব। আমরা দেহ ও মনে না মাটির না স্বভাবের বন্ধনে আবদ্ধ, অতএব এ পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র মক জীব।