আমার মনে হয় দর্শনবিজ্ঞানের এ নিষ্ফলতার কারণও স্পষ্ট। জীবন সম্বন্ধে পূর্ণজ্ঞান লাভ করবার পক্ষে প্রতি লোকের পক্ষে যে বাধা, সমগ্র মানবজাতির পক্ষেও সেই একই বাধা রয়েছে। জীবনসমস্যার চড়ান্ত মীমাংসা করবে মৃত্যু। মৃত্যুর অপর পারে আছে-হয় অনন্ত জীবন নয় অনন্ত মরণ, হয় অমরত্ব নয় নির্বাণ। এর কোনো অবস্থাতেই জীবনের আর কোনোই সমস্যা থাকবে না। যদি আমরা অমরত্ব লাভ করি তা হলে জীবন সম্বন্ধে আমাদের জানবার আর কিছু বাকি থাকবে না; অপর পক্ষে যদি নির্বাণ লাভ করি তো জানবার কেউ থাকবে না। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, সমগ্র মানবজাতি না মরা তর্ক এ সমস্যার শেষ মীমাংসা করতে পারবে না। আর যদি কোনোদিন পারে তা হলে সেই দিনই মানবজাতির মৃত্যু হবে; কেননা তখন আমাদের আর কিছু জানবার কিংবা করবার জিনিস অবশিষ্ট থাকবে না। মানুষের পক্ষে সর্বজ্ঞ হওয়ার অবশ্যম্ভাবী ফল নিষ্ক্রিয় হওয়া, অর্থাৎ মত হওয়া; কেননা প্রাণ বিশেষ্যও নয়, বিশেষণও নয়-ও একটি অসমাপিকা ক্রিয়া মাত্র।
জীবনটা একটা রহস্য বলেই মানুষের বেচে সখ। কিন্তু তাই বলে এ রহস্যের মর্ম উদঘাটন করবার চেষ্টা যে পাগলামি নয় তার প্রমাণ, মানুষ যুগে যুগে এ চেষ্টা করে এসেছে, এবং শতবার বিফল হয়েও অদ্যাবধি সে চেষ্টা থেকে বিরত হয় নি। পৃথিবীর মধ্যে যা সবচেয়ে বড়ো জিনিস তা জানবার ও বোঝবার প্রবৃত্তি মানুষের মন থেকে যে দিন চলে যাবে সে দিন মানুষ আবার পশুত্ব লাভ করবে। জীবনের যা-হয়-একটা অর্থ স্থির করে না নিলে মানুষে জীবনযাপন করতেই পারে না। এবং এ পদার্থের কে কি অর্থ করেন তার উপর তাঁর জীবনের মূল্য নির্ভর করে। এ কথা ব্যক্তির পক্ষেও যেমন সত্য জাতির পক্ষেও তেমনি সত্য। দর্শন-বিজ্ঞান জীবনের ঠিক অর্থ বার করতে পারুক আর না পারুক, এ সম্বন্ধে অনেক ভুল বিশ্বাস নষ্ট করতে পারে। এও বড়ো কম লাভের কথা নয়। সত্য না জানলেও মানুষের তেমন ক্ষতি নেই-মিথ্যাকে সত্য বলে ভুল করাই সকল সর্বনাশের মূল। সুতরাং প্রবন্ধলেখক এ আলোচনার পুনরোপন করে সৎসাহসেরই পরিচয় দিয়েছেন।
২.
সতীশবাবু তাঁর প্রবধে দেখিয়েছেন—এ বিষয়ে যে নানা মুনির নানা মত আছে শুধু তাই নয়, একইরকমের মত নানা যুগে নানা আকারে দেখা দেয়। দর্শনবিজ্ঞানের কাছে জীবনের সমস্যাটা কি, সেইটে বুঝলে সে সমস্যার মীমাংসাটাও যে মোটামুটি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। জীবন
পদার্থটিকে আমরা সকলেই চিনি, কেননা সেটিকে নিয়ে আমাদের নিতা কারবার করতে হয়। কিন্তু তার আদি ও অত আমাদের প্রত্যক্ষ নয়। সহজজ্ঞানের কাছে যা অপ্রত্যক্ষ, অনুমান-প্রমাণের দ্বারা তারই জ্ঞান লাভ করা হচ্ছে দর্শনবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য। জীবনের আদি অন্ত আমরা জানি নে, এই কথাটাকে ঘুরিয়ে দরকম ভাবে বলা যায়। এক, জীবনের আদিতে আছে জন্ম আর অন্তে মৃত্যু; আর-এক, জীবন অনাদি ও অনন্ত। জীবন সম্বন্ধে দার্শনিকতত্ত্ব হয় এর এক পক্ষ নয় আর-এক পক্ষ -ভুক্ত হয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, এ দুয়ের কোনো মীমাংসাতেই আমাদের জ্ঞান কিছুমাত্র এগোয় না; অর্থাৎ এ দুই তত্ত্বের যেটাই গ্রাহ্য কর না, যা আমাদের জানা তা সমান জানাই থেকে যায়, আর যা অজানা তাও সমান অজানা থেকে যায়। সুতরাং এরকম মীমাংসাতে যাঁদের মনস্তুষ্টি হয় না তাঁরা প্রথমে জীবনের উৎপত্তি ও পরে তার পরিণতির সন্ধানে অগ্রসর হন। মোটামুটি ধরতে গেলে এ কথা নিয়ে বলা যায় যে, প্রাণের উৎপত্তির সন্ধান করে বিজ্ঞান, আর পরিণতির সধান করে দর্শন।
এ কথা আমরা সকলেই জানি যে, আমাদের দেহও আছে মনও আছে, আর এ দুয়ের যোগাত্রের নাম প্রাণ। সুতরাং কেউ প্রমাণ করতে চান যে, প্রাণ দেহের বিকার; আর কেউ-বা প্রমাণ করতে চান যে, প্রাণ আত্মার বিকার। অর্থাৎ কারো মতে প্রাণ মূলত আধিভৌতিক, কারো মতে আধ্যাত্মিক। সুতরাং সকল দেশে সকল যুগে জড়বাদ ও আত্মবাদ পাশাপাশি দেখা দেয়—কালের গুণে কখনো এ মত, কখনো ও মত প্রবল হয়ে ওঠে; সে মতের গুণে নয়, যুগের গুণে। আমার বিশ্বাস একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যায় যে, জড়বাদ ও অধ্যাত্মবাদ মূলে একই মত। কেননা উভয় মতেই এমন-একটি নিত্য ও স্থির পদার্থের স্থাপনা করা হয়, যার আসলে কোনো স্থিরতা নেই।
অবশ্য এ দুই ছাড়া একটা তৃতীয় এবং মধ্য পন্থাও আছে, সে হচ্ছে প্রাণের স্বতন্ত্র সত্তা গ্রাহ্য করা। এই মাধ্যমিক মতের নাম ভাইটালিজম, এবং আমি নিজে এই মধ্যমতাবলম্বী। আমার বিশ্বাস, অপ্রাণ হতে প্রাণের উৎপত্তি প্রমাণ করবার সকল চেষ্টা বিফল হয়েছে। এর থেকে এ অনুমান করাও অসংগত হবে না যে, প্রাণ কখনো অপ্রাণে পরিণত হবে না। তার পর জড়, জীবন ও চৈতন্যের অন্তর্ভূত যদি এক-তত্ত্ব বার করতেই হয় তা হলে প্রাণকেই জগতের মূল পদার্থ বলে গ্রাহ্য করে নিয়ে আমরা বলতে পারি-জড় হচ্ছে প্রাণের বিরাম ও চৈতন্য তার পরিণাম। অর্থাৎ জড় প্রাণের সত অবস্থা, আর চৈতন্য তার জাগ্রত অবস্থা। এ পৃথিবীতে জড় জীব ও চৈতন্যের সমন্বয় একমাত্র মানুষেই হয়েছে। আমরা সকলেই জানি আমাদের দেহও আছে, প্রাণও আছে, মনও আছে। প্রাণকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞানের পক্ষে এক লক্ষে দেহ থেকে আত্মায় আরোহণ করা যেমন সম্ভব, দর্শনের পক্ষেও এক লক্ষে আত্মা থেকে দেহে অবরোহণ করাও তেমনি সম্ভব। জমান বৈজ্ঞানিক হেকেল এবং জর্মান দার্শনিক হেগেলের দর্শন আলোচনা করলে দেখা যায় যে, জড়বাদী পরমাণুর অন্তরে গোপনে জ্ঞান অনুপ্রবিষ্ট করে দেন এবং জ্ঞানবাদী জ্ঞানের অন্তরে গোপনে গতি সঞ্চারিত করে দেন। তার পর বাজিকর যেমন খালি মুঠোর ভিতর থেকে টাকা বার করে, এরাও তেমনি জড় থেকে মন এবং মন থেকে জড় বার করেন। এসব দার্শনিক-হাতসাফাইয়ের কাজ। আমাদের চোখে যে এদের বুজরুকি এক নজরে ধরা পড়ে না তার কারণ, সাজানো কথার মশক্তির বলে এরা আমাদের নজরবন্দী করে রেখে দেন। তবে দেহমনের প্রত্যয় যোগস্ত্রটি ছিন্ন করে মানুষে বুদ্ধিসূত্রে যে নূতন যোগ সাধন করে, তা টেকসই হয় না। দর্শনবিজ্ঞানের মনগড়া এই মধ্যপদলোপী সমাস চিরকালই বন্দুসমাসে পরিণত হয়।