৬.
কথাসরিৎসাগরের প্রসাদে পাটলিপুত্রের জন্মকথা আমরা সকলেই জানতুম। এবং আমরা, কাব্যরসের রসিকেরা, সেই জন্মবত্তান্তই সাদরে গ্রাহ্য করে নিয়েছিলুম; কেননা, সেকথায় বস্তুতন্ত্রতা না থাকলেও রস আছে, তাও আবার একটি নয়, তিন-তিনটি–মধুর বীর এবং অদ্ভুত রস। পত্রকর্তৃক পাটলিহরণের বত্তান্ত, কৃষ্ণকর্তৃক রক্মিণীহরণ এবং অর্জনকর্তৃক সুভদ্রাহরণের চাইতেও অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। কৃষ্ণ প্রভৃতি রথে চড়ে স্থূলপথে পলায়ন করেছিলেন, কিন্তু পত্র পাটলিকে ক্রোড়স্থ ক’রে মায়া-পাকায় ভর দিয়ে নভেমার্গে উড্ডীন হয়েছিলেন। কৃষ্ণার্জন স্ব স্ব নগরীতে প্রস্থান করেছিলেন; পত্র কিন্তু তাঁর মায়া-যঠির সাহায্যে যে-পরী আকাশে নির্মাণ করেছিলেন সেই পুরী ভূমিষ্ঠ হয়ে পাটলিপুত্র নাম ধারণ করে। বৈজ্ঞানিকেরা কিন্তু যাদতে বিশ্বাস করেন না। সুতরাং বৈজ্ঞানিক মতে পাটলিপুত্রকে খনন করা অবশ্যকর্তব্য হয়ে পড়েছিল, এবং সে কর্তব্যও সম্প্রতি কার্যে পরিণত করা হয়েছে। খোঁড়া-জিনিসটের ভিতর একটা বিপদ আছে, কেননা, কোনো-কোনো স্থলে কেঁচো খুড়তে সাপ বেরোয়। এক্ষেত্রে হয়েছেও তাই।
ডক্টর স্পূনার নামক জনৈক প্রত্নতত্ত্বের কর্তাব্যক্তি এই ভূমধ্য-রাজধানী খনন করে আবিষ্কার করেছেন যে, এদেশের মাটি খুড়লে দেখা যায় যে তার নীচে ভারতবর্ষ নেই, আছে শুধু পারশ্য। Palimpsest-নামক একপ্রকার প্রাচীন পথি পাওয়া যায়, যার উপরে এক ভাষায় লেখা থাকে আর নীচে আরএক ভাষায়। বলা বাহুল্য, উপরে যা লেখা থাকে তা জাল, আর নীচে যা লেখা থাকে তাই আসল। ডক্টর স্পূনারের দিব্যদৃষ্টিতে এতকাল পরে ধরা পড়েছে যে, আমরা যাকে ভারতবর্ষের ইতিহাস বলি, সে হচ্ছে একটি বিরাট palimpsest; তার উপরে পালি কিংবা সংস্কৃতভাষায় যা লেখা আছে তা জাল, আর তার নীচে যা লেখা আছে তাই আসল। সে লেখা অবশ্য ফারসি; কেননা, আমরা কেউ তা পড়তে পারি নে। ডক্টর স্পূনারের কথা বৈজ্ঞানিকেরা মেনে না নিন, মান্য করতে বাধ্য; কেননা, সেকালের কাব্যের যাদুঘর হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু একালের যাদুঘরের কাব্যকে তা করা চলে না।
ডক্টর স্পূনার তাঁর নব-মত প্রতিষ্ঠা করবার জন্য নানা প্রমাণ, নানা অনুমান, নানা দর্শন, নানা নিদর্শন সংগ্রহ করেছেন। এসকলের মূল্য যে কি, তা নির্ণয় করা আমার সাধ্যের অতীত। এই পর্যন্ত বলতে পারি যে, তিনি এমন-একটি যুক্তি বাদ দিয়েছেন, যার আর কোনো খণ্ডন নেই। স্পূনার সাহেবের মতে যার নাম অসর তারই নাম দানব, এবং যার নাম দানব তারই নাম শক, এবং যার নাম শক তারই নাম পার্শি। একথা যদি সত্য হয়, তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে, এদেশের মাটি খুঁড়লে পাশি-শহর বেরিয়ে পড়তে বাধ্য। দানবপরী যে পাতালে অর্থাৎ মাটির নীচে অবস্থিত, একথা তো হিন্দুর সর্বশাস্ত্রসম্মত।
৭.
অতএব দাঁড়াল এই যে, আমাদের ভবিষ্যৎও নেই অতীতও নেই। এক বাকি থাকল বর্তমান। সুতরাং বঙ্গসাহিত্যকে এখন থেকে এই বর্তমান নিয়েই কারবার করতে হবে। এ অবশ্য মহা মুশকিলের কথা। বই পড়ে বই লেখা এক, আর নিজে বিশ্বসংসার দেখেশুনে লেখা আর। একাজ করতে হলে চোখকান খুলে রাখতে হবে, মনকে খাটাতে হবে; এককথায় সচেতন হতে হবে। তার পর এত কষ্ট স্বীকার করে যে সাহিত্য গড়তে হবে, সে সাহিত্য সকলে সহজে গ্রাহ্য করবেন না। মানুষে বর্তমানকেই সবচাইতে অগ্রাহ্য করে। যাঁদের চোখকান বোজা আর মন পঙ্গু, তাঁরা এই নবসাহিত্যকে নবীন বলে নিন্দা করবেন। তবে এর মধ্যে আরামের কথা এই যে, বর্তমানের কোনো ইতিহাস নেই, সুতরাং এখন হতে বঙ্গসরস্বতীর ঘাড় থেকে ভূত নেমে যাবে।
আষাঢ় ১৩২৩
প্রাণের কথা
প্রাণের কথা
ভবানীপরসাহিত্যসমিতিতেকথিত
এরকম সভার সভাপতির প্রধান কর্তব্য হচ্ছে প্রবন্ধপাঠকের গণগান করা, কিন্তু সে কর্তব্য পালন করা আমার পক্ষে উচিত হবে কি না সে বিষয়ে আমার বিশেষ সন্দেহ ছিল। প্রবন্ধপাঠক শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র ঘটক আমার বন্ধু, এবং সাহিত্যিকবন্ধ। কধর মুখে বন্ধুর প্রশংসা একালে ভদ্রসমাজে অভদ্রভা বলেই গণ্য। ইংরেজিতে যাকে বলে মিউঁচুয়াল অ্যাডমিরেশন, সে ব্যাপারটি আমরা নিতান্ত হাস্যকর মনে করি; অথচ এ কথাও সম্পূর্ণ সত্য যে, গুণানুরাগ উভয়পাক্ষিক না হলে কি প্রণয় কি বন্ধুত্ব কোনোটিই স্থায়ী হয় না। সে যাই হোক, বস্তৃতি সাহিত্যসমাজে যে নিষিদ্ধ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এবং যেহেতু আমি বর্তমান সাহিত্যসমাজের নানারূপ নিয়মভঙ্গের অপরাধে অপরাধী হয়ে আছি, সে কারণ আবার-একটা নূতন অপরাধে অভিযুক্ত হতে অপ্রবত্তি হওয়াটা আমার পক্ষে নিতান্তই স্বাভাবিক।
কিন্তু প্রবন্ধটি শুনে আমি প্রবন্ধলেখকের আর-কিছুর না হোক, সাহসের প্রশংসা না করে থাকতে পারছি নে। প্রবন্ধপাঠক মহাশয় যে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তা যুগপৎ সৎসাহস ও দুঃসাহস। এ পৃথিবীতে মানুষের পক্ষে যা সবচাইতে মূল্যবান অথচ দুর্বোধ্য—অর্থাৎ জীবন-ঘটকমহাশয় তারই উপর হস্তক্ষেপ করেছেন। এ অবশ্য দুঃসাহসের কাজ।
ঘটকমহাশয়ের প্রবন্ধের সার কথা এই যে, উপনিষদের সময় থেকে শুরু করে অদ্যাবধি নানা দেশের নানা দার্শনিক ও নানা বৈজ্ঞানিক জীবনসমস্যার আলোচনা করেছেন, কিন্তু কেউ তার চুড়ান্ত মীমাংসা করতে পারেন নি। আজ পর্যন্ত জীবনের এমন ভাষ্য কেউ করতে পারেন নি যার উপর আর টীকাটিপ্পনী চলে না।