আমার মতে শ্রুতির অর্থ হচ্ছে সেই ঘর, যা কানে শোনা যায় না; যেমন দর্শনের অর্থ হচ্ছে সেই সত্য, যা চোখে দেখা যায় না। যেমন দর্শন দেখবার জন্য দিব্যচক্ষু, চাই, তেমনি শ্ৰতি শোনবার জন্য দিব্যকণ চাই। বলা বাহুল্য, তোমার-আমার মত সহজ মানুষদের দিব্যচক্ষুও নেই, দিব্যকণও নেই; তবে আমাদের মধ্যে কারও কারও দিব্যি চোখও আছে, দিব্যি কানও আছে। ওতেই তো হয়েছে মুশকিল। চোখ ও কান সম্বন্ধে দিব্য এবং দিব্যি— এ দুটি বিশেষণ, কানে অনেকটা এক শোনালেও মানেতে ঠিক উলটো।
সংগীতে যে সাতটি শাদা আর পাঁচটি কালো সুর আছে, এ সত্য পিয়ানো কিংবা হারমোনিয়ামের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সকলেই দেখতে পাবেন। এই পাঁচটি কালো সুরের মধ্যে যে, চারটি কোমল আর একটি তীব্র তা আমরা সকলেই জানি এবং কেউ-কেউ তাদের চিনিও। কিন্তু চেনাশনোজিনিসে পণ্ডিতের মনস্তুষ্টি হয় না। তাঁরা বলেন যে, এদেশে ঐ পাঁচটি ছাড়া আরও কালো এবং এমন কালো সুর আছে, যেমন কালো বিলেতে নেই। শাস্ত্রমতে সেসব হচ্ছে অতিকোমল ও অতিতীব্র। ঐ নামই প্রমাণ যে, সেসব অতীন্দ্রিয় সুর এবং তা শোনবার জন্যে দিব্যকর্ণ চাই–যা তোমার-আমার তো নেই, শাস্ত্রীমহাশয়দেরও আছে কি না সন্দেহ। আমার বিশ্বাস, তাঁদেরও নেই। শ্ৰতি সেকালে থাকলেও একালে তা স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। স্মৃতিই যে শ্ৰতিধরদের একমাত্র শক্তি, এ সত্য তো জগদ্বিখ্যাত। সুতরাং একথা নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, সংগীত সম্বন্ধে পরের মুখে ঝাল খাওয়া, অর্থাৎ পরের কানে মিষ্টি শোনা, যাঁদের অভ্যাস শুধু তাঁদের কাছেই শ্রুতি এতিমধুর। আমি স্থির করেছি যে, আমাদের পক্ষে ঐ বারোই ভালো; অবশ্য সাতপাঁচ ভেবেচিন্তে। ও দ্বাদশকে ছাড়াতে গেলে, অর্থাৎ ছাড়লে, আমাদের কানকে একাদশী করতে হবে।
আর ধরুন, যদি ঐ দ্বাদশ সরের ফাঁকে ফাঁকে সত্যসত্যই শ্ৰতি থাকে, তাহলে সেসব স্বর হচ্ছে অনুঘর। সা- এবং নি-র অন্তর্ভূত দশটি সুরের গায়ে যদি কোনো অসাধারণ পণ্ডিত দশটি অনুঘর জুড়ে দিতে পারেন, তাহলে সংগীত এমনি সংস্কৃত হয়ে উঠবে যে, আমাদের মত প্রাকৃতজনেরা তার এক বর্ণও বুঝতে পারবে না।
৩.
এসব তো গেল সংগীতের বর্ণপরিচয়ের কথা, শব্দবিজ্ঞানের নয়। শব্দেরও যে একটা বিজ্ঞান আছে, এ জ্ঞান সকলের নেই। সুতরাং সরের। সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব গ্রাহ্য না হলেও আলোচ্য।
শব্দজ্ঞানের মতে শ্রুতি অপৌরুষেয়; অর্থাৎ স্বরগ্রাম কোনো পুরুষ কতৃক রচিত হয় নি, প্রকৃতির বক্ষ থেকে উত্থিত হয়েছে। একটি একটানা তারের গায়ে ঘা মারলে প্রকৃতি অমনি সাত-সরে কেঁদে ওঠেন। এর থেকে বৈজ্ঞানিকেরা ধরে নিয়েছেন যে, প্রকৃতি তাঁর একতারায় যে সকাতর সাগম আলাপ করেন, মানুষে শুধু তার নকল করে। কিন্তু সে নকলও মাছিমারা হয় না। মানুষের গলগ্রহ কিংবা যন্ত্রস্থ হয়ে প্রকৃতিদত্ত স্বরগ্রামের কোনো সুর একটু চড়ে, কোনো সুর একটু ঝুলে যায়। তা তো হবারই কথা। প্রকৃতির হদয়তলী থেকে এক ঘায়ে যা বেরয়, তা যে একঘেয়ে হবে–এ তো স্বতঃসিদ্ধ। সুতরাং মানুষে এইসব প্রাকৃত সরকে সংস্কৃত করে নিতে বাধ্য।
এ মত লোকে সহজে গ্রাহ্য করে; কেননা, প্রকৃতি যে একজন মহা ওস্তাদ— এ সত্য লৌকিক ন্যায়েও সিদ্ধ হয়। প্রকৃতি অন্ধ, এবং অন্ধের সংগীতে বৎপত্তি যে সহজ, এ সত্য তো লোকবিশ্রত।
প্রকৃতির ভিতর যে শব্দ আছে শুধু শব্দ নয়, গোলযোগ আছেএকথা সকলেই জানেন; কিন্তু তাঁর গলায় যে সুর আছে, একথা সকলে মানেন না। এই নিয়েই তো আট ও বিজ্ঞানে বিরোধ।
আর্টিস্টরা বলেন, প্রকৃতি শুধু অন্ধ নন, উপরন্তু বধির। যাঁর কান নেই, তাঁর কাছে গানও নেই। সাংখ্যদর্শনের মতে পুরুষ দ্রষ্টা এবং প্রকৃতি নর্তকী; কিন্তু প্রকৃতি যে গায়িকা এবং পুরুষ শ্রোতা–একথা কোনো দর্শনেই বলে না। আর্টিস্টদের মতে তৌত্রিকের একটিমাত্র অঙ্গ-নৃত্যই প্রকৃতির অধিকারভুক্ত, অপর দুটি— গীত বাদ্য— তা নয়।
এর উত্তরে বিজ্ঞান বলেন, এ বিশ্বের সকল রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দের উপাদান এবং নিমিত্তকারণ হচ্ছে ঐ প্রকৃতির নত্য। কথাটা উড়িয়ে দেওয়া চলে না, অতএব পুড়িয়ে দেখা যাক ওর ভিতর কতটুকু খাঁটি মাল আছে।
শাস্ত্রে বলে, শব্দ আকাশের ধর্ম; বিজ্ঞান বলে, শব্দ আকাশের নয় বাতাসের ধর্ম। আকাশের নত্য অর্থাৎ সর্বাগের স্বচ্ছন্দ কম্পন থেকে যে আলোকের, এবং বাতাসের উত্তরপ কম্পন থেকে যে ধনির উৎপত্তি হয়েছেতা বৈজ্ঞানিকেরা হাতে-কলমে প্রমাণ করে দিতে পারেন। কিন্তু আর্ট বলে, আত্মার কম্পন থেকে সরের উৎপত্তি, সতরাং জড়প্রকৃতির গভে তা জন্মলাভ করে নি। আত্মা কাঁপে আনন্দে, সৃষ্টির চরম আনন্দে; আর আকাশ-বাতাস কাঁপে বেদনায়, সৃষ্টির প্রসববেদনায়। সুতরাং আর্টিস্টদের মতে সুর শব্দের অনুবাদ নয়, প্রতিবাদ।
যেখানে আটে ও বিজ্ঞানে মতভেদ হয়, সেখানে আপোস-মীমাংসার জন্য দর্শনকে সালিশ মানা ছাড়া আর উপায় নেই। দার্শনিকেরা বলেন, শব্দ হতে সুরের কিংবা সুর হতে শব্দের উৎপত্তি— সে বিচার করা সময়ের অপব্যয় করা। এস্থলে আসল জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, রাগ ভেঙে সুরের, না সুর জুড়ে রাগের সৃষ্টি হয়েছে এককথায়, সর আগে না রাগ আগে। অবশ্য রাগের বাইরে সাগমের কোনো অস্তিত্ব নেই, এবং সাগমের বাইরে রাগের কোনো অস্তিত্ব নেই। সুতরাং সর পর্বরাগী কি অনুরাগী, এই হচ্ছে আসল সমস্যা। দার্শনিকেরা বলেন যে, এ প্রশ্নের উত্তর তাঁরাই দিতে পারেন যাঁরা বলতে পারেন বীজ আগে কি বক্ষ আগে; অর্থাৎ কেউ পারেন না।