তয়া কবিতয়া কিংবা তয়া বনিতয়া চ কিম্।
পদবিন্যাস মাত্রেন বয়া নাপহৃতং মনঃ।।
উক্ত কবিতা পদবিন্যাস মাত্র যাঁর মন হরণ করে, তিনিই যথার্থ কাব্যরসিক। আর যাঁদের করে না, ভগবান তাদের মঙ্গল করুন।
উপরে যে দু-চারিটি নমুনা দিলম তার থেকেই দেখা যায় যে, বাঙালি কবির বর্ষবর্ণনা ছবিপ্রধান নয়, গানপ্রধান। বাঙালি কবিরা বর্ষার বাহ্যরূপের তেমন খুঁটিয়ে বর্ণনা করেন না যেমন প্রকাশ করেন বর্ষাগমে নিজেদের মনের রপান্তরের। শব্দ দিয়ে ছবি আঁকার চাইতে শব্দ দিয়ে সংগীত রচনা করবার দিকেই বাঙালি কবির ঝোঁক বেশি। তাই তাঁদের কবিতায় উপমার চাইতে অনুপ্রাস প্রবল।
সংস্কৃত কবির চোখ আর বাঙালি কবির কান এ দুইই তাদের পণ অভিব্যক্তি লাভ করেছে রবীন্দ্রনাথের কাব্যে। সকলেই জানেন যে, রবীন্দ্রনাথ বর্ষার বিষয়ে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। ফলে ও-ঋতুর বিচিত্র রূপের প্রতি রূপের চিত্র তাঁর কাব্যে ছন্দোবধে আবদ্ধ হয়েছে। এ ঋতু সম্বন্ধে তাঁর কবিতাবলীকে একটি বিচিত্র পিকচার গ্যালারি বললে অসংগত কথা বলা হয় না। অপর পক্ষে বর্ষার সরে মনের ভিতর যে সুর বেজে ওঠে সেই অপার্থিব সুরের দিব্যরূপ পর্ণেমাত্রায় পরিস্ফুট হয়েছে রবীন্দ্রনাথের একটি বর্ষার কবিতায়, সে কবিতার প্রথম পদ হচ্ছে–
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
যে কবিতার ভাষা ও ভাব মিলে এক হয়ে যায় সেই কবিতাই যদি perfect কবিতা হয় তা হলে আমি জোর করে বলতে পারি এর তুল্য perfect কবিতা বাংলাতেও নেই, সংস্কৃতেও নেই। ও-কবিতা শুনে–
সমাজসংসার মিছে সব
মিছে এ জীবনের কলরব
এ কথা যিনি ক্ষণিকের জন্যও হৃদয়ঙ্গম না করেন তাঁর এই বর্ষার দেশে জন্মগ্রহণ করাটা কর্মভোগ মাত্র।
ভাদ্র ১৩৩৪
মলাট-সমালোচনা
মলাট-সমালোচনা
‘সাহিত্য’সম্পাদকমহাশয় সমীপেষু
‘বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীচি’ -জিনিসটা এদেশে একটা মস্ত ঠাট্টার সামগ্রী। কিন্তু বারো পাতা বইয়ের তেরো পাতা সমালোচনা দেখে কারোই হাসি পায় না। অথচ বীজ পরিমাণে এক হাত কমই হোক আর এক হাত বেশিই হোক, তার থেকে নতুন ফল জন্মায়; কিন্তু ঐরূপ সমালোচনায় সাহিত্যের কিংবা সমাজের কি ফললাভ হয়, বলা কঠিন। সেকালে যখন সত্রআকারে মূল গ্রন্থ রচনা করবার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, তখন ভাষ্যে-টীকায়কারিকায় তার বিস্তৃত ব্যাখ্যার আবশ্যকতা ছিল। কিন্তু একালে যখন, যেকথা দু কথায় বলা যায় তাই দ শ কথায় লেখা হয়, তখন সমালোচকদের ভাষ্যকার না হয়ে সত্ৰকার হওয়াই সংগত। তাঁরা যদি কোনো নব্যগ্রন্থের খেই ধরিয়ে দেন, তাহলেই আমরা পাঠকবর্গ যথেষ্ট মনে করি। কিন্তু ঐরূপ করতে গেলে তাঁদের ব্যাবসা মারা যায়। সুতরাং তাঁরা যে সমালোচনার রীতিপরিবর্তন করবেন, এরূপ আশা করা নিষ্ফল।
শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যুক্তির প্রতিবাদ করে একটি প্রবন্ধ লেখেন। আমার ঠিক মনে নেই যে, তিনি সাহিত্যেও অত্যুক্তি যে নিন্দনীয়, একথাটা বলেছেন কি না। সে যাই হোক, রবীন্দ্রবাবুর সেই তীব্র প্রতিবাদে বিশেষ কোনো সুফল হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং দেখতে পাই যে, অত্যুক্তির মাত্রা ক্রমে সপ্তমে চড়ে গেছে। সমালোচকদের অত্যুক্তিটা প্রায় প্রশংসা করবার সময়েই দেখা যায়। বোধ হয় তাঁদের বিশ্বাস যে, নিন্দা-জিনিসটা সোজা কথাতেই করা চলে কিন্তু প্রশংসাকে ডালপালা দিয়ে পত্রে-পুষ্পে সাজিয়ে বার করা উচিত। কেননা, নিন্দুকের চাইতে সমাজে চাটকারের মর্যাদা অনেক বেশি। কিন্তু আসলে অতিনিন্দা এবং অতিপ্রশংসা উভয়ই সমান জঘন্য। কারণ, অত্যুক্তির ‘অতি’ শুধু সুরুচি এবং ভদ্রতা নয়, সত্যেরও সীমা অতিক্রম করে যায়। এককথায়, অত্যুক্তি মিথ্যোক্তি। মিছাকথা মানযে বিনা কারণে বলে না। হয় ভয়ে নাহয় কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্যই লোকে সত্যের অপলাপ করে। সম্ভবত অভ্যাসবশত মিথ্যাকে সত্যের অপেক্ষা অধিকমাত্রায় কেউ-কেউ চর্চা করে। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে মিথ্যাকথা বলা চর্চা করলে ক্রমে তা উদ্দেশ্যবিহীন অভ্যাসে পরিণত হয়। বাংলাসাহিত্যে আজকাল যেরূপ নির্লজ্জ অতিপ্রশংসার বাড়াবাড়ি দেখতে পাওয়া যায়, তাতে মনে হয় যে, তার মূলে উদ্দেশ্য এবং অভ্যাস দুই জিনিসই আছে। এক-একটি ক্ষুদ্র লেখকের ক্ষুদ্র পস্তকের যেসকল বিশেষণে স্তুতিবাদ করা হয়ে থাকে, সেগুলি বোধ হয় শেক্সপীয়র কিংবা কালিদাসের সম্বন্ধে প্রয়োগ করলেও একটু বেশি হয়ে পড়ে। সমালোচনা এখন বিজ্ঞাপনের মতি ধারণ করেছে। তার থেকে বোঝা যায় যে, যাতে বাজারে বইয়ের ভালোরকম কাটতি হয়, সেই উদ্দেশ্যে আজকাল সমালোচনা লেখা হয়ে থাকে। যে উপায়ে পেটেন্ট ঔষধ বিক্রি করা হয়, সেই উপায়েই সাহিত্যও বাজারে বিক্রি করা হয়। লেখক সমালোচক হয় একই ব্যক্তি, নয় পরপরে একই কারবারের অংশীদার। আমার মাল তুমি যাচাই করে পয়লা নম্বরের বলে দাও, তোমার মাল আমি যাচাই করে পয়লা নম্বরের বলে দেব, এইরকম একটা বন্দোবস্ত পেশাদার লেখকদের মধ্যে যে আছে, একথা সহজেই মনে উদয় হয়। এই কারণেই, পেটেন্ট ঔষধের মতই একালের ছোটগল্প কিংবা ছোটকবিতার বই মেধা হ্রী ধী শ্রী প্রভৃতির বর্ধক এবং নৈতিক-বলকারক বলে উল্লিখিত হয়ে থাকে। কিন্তু এরূপ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে পাঠক নিত্যই প্রতারিত এবং প্রবঞ্চিত হয়। যা চ্যবনপ্রাশ বলে কিনে আনা হয় তা দেখা যায় প্রায়ই অকালকুষ্মাণ্ডখণ্ডমাত্র।