তবে যে লোকে মনে করে যে, আষাঢ়ের দিন গল্পের পক্ষে প্রশস্ত দিন, তার একমাত্র কারণ আষাঢ়ের দিন প্রশস্ত। কোনো বস্তুর পরিমাণ থেকে তার গুণ নির্ণয় করবার প্রবত্তি মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। কারণ, পরিমাণ জিনিসটে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আর গুণ মনোগ্রাহ্য। আর সাধারণত আমাদের পক্ষে মনকে খাটানোর চাইতে ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করা ঢের সহজ। তবে একদল লোক, অর্থাৎ হেগেলের শিষ্যরা, আমার কথা শুনে হাসবেন। তাঁদের গর, বলেছেন যে কোয়ানটিটি বাড়লেই তা কোয়ালিটি হয়ে ওঠে। এই কারণেই সমাজ হচ্ছে গুণনিধি আর ব্যক্তি নির্গুণ; আর সেই জাতিই অতিমানুষের জাত যে জাত অর্ধেক পৃথিবীর মাটির মালিক।
এ দার্শনিক মতের প্রতিবাদ করবার আমার সাহসও নেই ইচ্ছেও নেই। কেননা দেখতে পাই এ দেশেও বেশির ভাগ লোক হেগেল না পড়েও হেগেলের মতাবলম্বী হয়েছেন। ভিড়ে মিশে যাওয়ার নামই যে পরম পরষার্থ, এ জ্ঞান এখন সর্বসাধারণ হয়েছে। গোলে হরিবোল দেওয়াই যে দেশ-উদ্ধারের একমাত্র উপায়, এই হচ্ছে বর্তমান হট্টমত। এ জর্মান-মত সম্বন্ধে যাঁর মনে দ্বিধা আছে তাঁকে আগে একটি মহাসমস্যার মীমাংসা করে পরে মুখ খুলতে হবে। সে সমস্যা এই : কোয়ানটিটি কোয়ালিটির অবনতি, না, কোয়ালিটি কোয়ান, টিটির পরিণতি? এ বিচারের উপযুক্ত সময় হচ্ছে নিদাঘ, বর্ষা নয়। কারণ উক্ত সমস্যার মীমাংসার জন্য তার উপর প্রচণ্ড আলো ফেলতে হবে, যে আলো এই মেঘলা দিনে আকাশেও নেই, মনেও নেই। আজকের দিনে এই গা-ঢাকা আলোর ভিতর বাজে কথা বলাই মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। কালিদাস বলেছেন–
মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহপ্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ
সুতরাং আমার মনও যে অন্যথাবৃত্তি অর্থাৎ অদার্শনিক হয়ে পড়েছে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
৮.
এখন পুরনো কথায় ফিরে যাওয়া যাক। ‘আষাঢ়ে গল্প’ কথাটার সৃষ্টি হল কি সূত্রে তারই এখন অনুসন্ধান করা যাক, কিন্তু সে সূত্ৰ খুঁজতে হলে আমাকে আরএক শাস্ত্রের দ্বারস্থ হতে হবেযে শাস্ত্রের ভিতর প্রবেশ করবার অধিকার আমার নেই, সে শাস্ত্রের নাম শব্দতত্ত্ব। অপর পক্ষে, এই বর্ষার দিনে স্বাধিকারপ্রমত্ত হবার অধিকার সকলেরই আছে, এই বিশ্বাসের বলেই আমি অনধিকারচর্চা করতে ব্ৰতী হচ্ছি।
আমি পূর্বে বলেছি যে, নিরককারদের মতে যে কথার মানে আমরা জানি নে অথচ বলি, সেই কথা থেকেই কিংবদন্তী জন্মলাভ করে। আমার বিশ্বাস ‘আষাঢ়ে গল্প’-রপ কিংবদন্তীর জন্মকথাও তাই।
আমাদের বাঙাল দেশে লোকে ‘আষাঢ়ে গল্প’ বলে না, বলে ‘আজাড়ে গল্প’। এখন এই ‘আজাড়ে’ শব্দটি কি ‘আষাঢ়ে’র অপভ্রংশ? ‘আজাড়’ শব্দের সাক্ষাৎ সংস্কৃতকোষের ভিতর পাওয়া যায় না। এর থেকে অনুমান করছি যে এটি হয় ফারসি নয় আরবি শব্দ। আর ও-কথার মানে আমরা সবাই জানি, অন্য সূত্রে। আমরা যখন বলি মাঠ উজাড় করে দিলে তখন আমরা বুঝি যে উজাড় মানে নির্মূল। কারণ ‘জড়’ মানে যে মূল তা বাংলার চাষীরাও জানে। সুতরাং ‘আজাড়ে গল্পে’র অর্থ যে অমূলক গল্প এরূপ অনুমান করা অসংগত নয়। এই ‘আজাড়’ কথাটার শুদ্ধি করে নিয়ে আমরা তাকে ‘আষাঢ়’ বানিয়েছি। এ কারণ আরব্য-উপন্যাসের সব গল্পই অজাড়ে গল্প, হিন্দু জবানে ‘আষাঢ়ে গল্প’; যদিও আরবদেশে আষাঢ়ও নেই, শ্রাবণও নেই।
সুতরাং এ কিংবদন্তীর অলীকতা ধরতে পারলেই আমরা বুঝতে পারব যে, বৃষ্টির জল পেয়ে গল্প গজায় না, জন্মায় শুধু কবিতা। বর্ষাকাল কবির স্বদেশ, ঔপন্যাসিকের বিদেশ।
৯.
বর্ষা যে গল্পের ঋতু নয় গানের ঋতু-তার প্রমাণ বাংলা সাহিত্যে আষাঢ়ে গল্প নেই, কিন্তু মেঘরাগের অগণ্য গান আছে।
বাংলার আদিকবি জয়দেবের আদিকে কার মনে নেই? সকলেরই মনে আছে এই কারণ যে–
মেঘৈর্মেদরমম্বরং বনভূবশ্যামাস্তমালদ্রুমৈঃ
এ পদ যার একবার কর্ণগোচর হয়েছে তাঁর কানে তা চিরদিন লেগে থাকবার কথা। চিরদিন যে লেগে থাকে তার কারণ A thing of beauty is a joy for ever। এর সৌন্দর্য কোথায়? এ প্রশ্নের কোনো স্পষ্ট জবাব দেবার জো নেই। পোয়েট্রি অথবা বিউটি যে-ভাষায় আমাদের কাছে আত্মপ্রকাশ করে, তা অপর কোনো ভাষায় অনুবাদ করা অসম্ভব। আর আমরা যাকে ভাষা বলি, সে তো হয় কর্মের, নয় জ্ঞানের ভাষা। তবে ঐ ক’টি কথায় জয়দেব আমাদের চোখের সম্মুখে যে-রপ ধরে দিয়েছেন তা একটু নিরীক্ষণ করে দেখা যাক। কবিতা মাত্রেরই ভিতর ছবি থাকে; অতএব দেখা যাক কবি এ ঋলে কি ছবি এঁকেছেন। বর্ষার যে ছবি কালিদাস এঁকেছেন এ সে-ছবি নয়। এর ভিতর বজ্র নেই বিদ্যুৎ নেই বৃষ্টি নেই–অর্থাৎ যে-সব জিনিস মানুষের ইন্দ্রিয়ের উপর হঠাৎ চড়াও হয় এবং মানুষের মনকে চমকিত করে সে-সব জিনিসের বিন্দুবিসর্গও উক্ত পদে নেই। কবি শুধু দুটি কথা বলেছেন, আকাশ মেঘে কোমল ও বনতমালে শ্যাম; তিনি তুলির দুটি টানে একসঙ্গে আকাশের ও পৃথিবীর চেহারা এঁকেছেন। এ চিত্রের ভিতরে কোনো রেখা নেই, আছে শুধু রঙ; আর সে রঙ নানাজাতীয় নয়; একই রঙ-শ্যাম, উপরে একটু ফিকে নীচে একটু গাঢ়। এ বর্ণনা হচ্ছে–চিত্রকররা যাকে বলে—ল্যাণ্ডকেপ পেন্টিং। তুলির দু টানে জয়দেব বর্ষার নির্জনতার, নীরবতার, তার নিবিড় শ্যামশ্রীর কি সমগ্র কি সুন্দর ছবি এঁকেছেন। এ ছবি যার চোখে একবার পড়েছে তার মনে এ ছবির দাগ চিরদিনের মতো থেকে যায়। বাইরে যা ক্ষণিকের, মনে তা চিরস্থায়ী হয়। যা অনিত্য তাকে নিত্য করাই তো কবির ধর্ম।