কালিদাসের বহুপরবর্তী কবি বর্ষাঋতুর ঐ রাজরূপ দর্শন করেছেন, সবাই সেই রূপেরই বর্ণনা করেছেন। এমন-কি, হিন্দি কবিরা ও-ছবি তাদের গানে আজও ফুর্তি করে আঁকছে
দবোধন বেশে বাদর আওয়ল
এ পদটি মল্লার রাগের একটি প্রসিদ্ধ পদের প্রথম পদ। ও গান যখন প্রথম শনি তখন আমার চোখের সম্মুখে বিদ্যৎ ঝলকে উঠেছিল, কানের কাছে মর্দগের গুরুগম্ভীর অবিরল পরং বেজে উঠেছিল।
এ গান শুনে যদি কেউ বলেন যে, উক্ত হিন্দি গানের রচয়িতা কালিদাসের কবিতা চুরি করেছেন তা হলে বলতে হয় যে, রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন–
বাদল মেঘে মাদল বাজে
সে কথাও অশনিশব্দমর্দলের বাংলা কথায় অনুবাদ। সাহিত্যে এরূপ চুরিধরা বিদ্যে বাতুলতার না হোক বালিশতার পরিচায়ক। কারণ এ বিদ্যার বলে এও প্রমাণ করা যায় যে, কালিদাস তাঁর পর্ববতী কবিদের বর্ণনা বেমালুম আত্মসাৎ করেছিলেন। মৃচ্ছকটিক-প্রকরণে বিট বসন্তসেনাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন–
পশ্য পশ্য। অয়মপরঃ—
পবনচপলবেগঃ স্থূলধারাশরৌঘঃ।
স্তনিতপটহনাদঃ স্পষ্টবিদ্যুৎপতাকঃ।
হরতি করসমূহং খে শশাঙ্কস্য মেঘো
নৃপ ইব পুরমধ্যে মন্দবীর্যস্য শত্রোঃ।।
উক্ত লোকের ভিতর স্পষ্ট বিদ্যৎপতাকা আছে, পটহনিনাদ আছে, নৃপ আছে। অর্থাৎ কালিদাসের শোকের মালমসলা সবই আছে। আর মৃচ্ছকটিক হচ্ছে দরিদ্র চারুদত্তের রাজসংস্করণ, কারণ তা হচ্ছে রাজা শূদ্রকের সংকরণ। দরিদ্র চারুদত্ত ভাসের লেখা; আর ভাস যে কালিদাসের পূর্ববর্তী কবি তা স্বয়ং কালিদাস নিজমুখেই স্বীকার করেছেন। এর থেকে প্রমাণ হয় শুধু এই মাত্র যে, বর্ষার রূপ এ দেশে সনাতন, তাই তার বর্ণনাও সনাতন। আর শাস্ত্রে বলে, যা সনাতন তাই অপৌরুষেয়।
৫.
স্মৃতি প্রত্যক্ষের পরিপন্থী নয়, কিন্তু শ্রুতি অনেক ক্ষেত্রে দর্শনের প্রতিবন্ধক। অনেকের দেহে কান চোখের প্রতিযোগী। শাস্ত্রের ভাষায় বলতে হলে নাম রূপের প্রতিদ্বন্দী। আমরা যদি কোনো বিষয়ের কথা শুনে নিশ্চিত থাকি তা হলে সে বিষয়ের দিকে চোখ চেয়ে দেখবার আমাদের প্রবত্তি থাকে না। কথা যখন কিংবদন্তী হয়ে ওঠে তখন অনেকের কাছে তা বেদবাক্য হিসেবে গ্রাহ্য হয়। একটা সর্বলোকবিদিত উদাহরণ নেওয়া যাক।
বহুকাল থেকে শুনে এসেছি যে অনেকে বিবাস করেন যে, পয়লা আষাঢ়ে বৃষ্টি নামতে বাধ্য, কেননা কালিদাস বলেছেন, “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে দেশের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
কালিদাস শুধু বড়ো কবি নন, সেইসঙ্গে তিনি যে বড়ো জিয়োগ্রাফার এবং বড়ো অনিথলজিস্ট তা জানি, কিন্তু উপরন্তু তিনি যে একজন অভ্রান্ত মেটিয়রলজিস্ট তা বিশ্বাস করা কঠিন। মেঘদূতকে মেটিয়রলজিকাল অফিসের রিপোর্ট হিসেবে গ্রাহ্য করতে আমি কুণ্ঠিত। কারণ মেঘদূত আর যাই হোক মেঘলোক সঘধে ছেলেভুলানো সংবাদের প্রচারক নয়। মেঘকে দূত করতে হলে তাকে বর্ষাঋতুতেই যাত্রা করাতে হয়। আর কোন পথ দিয়ে উড়ে অলকায় যেতে হবে সে বিষয়েও কালিদাস উক্ত দতকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে উপদেশ দিয়েছেন। কালিদাস খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন যে–
মার্গং তাবচ্ছ্ণু কথয়তস্ত্বৎপ্রয়াণানপং
সন্দেশং মে তদন, জলদ শ্রোষ্যসি শ্রোত্রপ্রেয়ম।
অর্থাৎ আগে পথের কথা শোনো, তার পর অলকায় গিয়ে কার কাছে কি বলতে হবে সে কথা পরে শুনো। এ কারণ পূর্বমেঘ আগাগোড়াই পথের কথা।
৬.
এ পথ ভারতবর্ষের উত্তরাপথ। বাংলা থেকে অন্তত দেড় হাজার মাইল দূরে। সুতরাং সে দেশে কখন বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়, তার থেকে বাংলায় কোন দিন বৃষ্টি নামবে তা বলা যায় না, অন্তত ন্যায়শারে এমন কোনো নিয়ম নেই যার বলে রামগিরি থেকে এক লক্ষে কলকাতায় অবতীর্ণ হওয়া যায়।
কিন্তু আসল কথা এই যে, কালিদাস এমন কথা বলেন নি যে পয়লা আষাঢ়ে বৃষ্টি নামে। তাঁর কথা এই যে–
তস্মিন্নদ্রৌ কতিচিদবলাবিপ্রযুক্তঃ স কামী
নীত্বা মাসান্ কনকবলয়ভ্রংশরিক্তপ্রকোষ্ঠঃ।
আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ৷৷
সমস্ত শ্লোকটা উদ্ধৃত করে দিলাম এইজন্যে যে সকলেই দেখতে পাবেন যে, এর ভিতর বৃষ্টির নামগন্ধও নেই। যক্ষ যা দেখেছিলেন তা হচ্ছে ‘মেঘমাশ্লিষ্টসানুং’ অর্থাৎ পাহাড়ের গায়ে নেপটে-লাগা মেঘ। এরকম মেঘ বাংলাদেশে কখনো চোখে পড়ে না, দেখা যায় শুধু পাহাড়ে পর্বতে। যক্ষ যে তা দেখেছিলেন তাও অবিশ্বাস করবার কোনো কারণ নেই, কেননা তিনি বাস করতেন তস্মিন্নদ্রৌ–সেই পাহাড়ে। সুতরাং বাংলাদেশে যাঁরা পয়লা আষাঢ়ে সেইরকম উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, যথা—
চাতকিনী কুতুকিনী ঘনদরশনে
তাঁরা সেই শ্রেণীর লোক যাঁরা কথার মোহে ইন্দ্রিয়ের মাথা খেয়ে বসে আছেন। শুনতে পাই বৈজ্ঞানিকরা আবিষ্কার করেছেন যে, কথার অর্থ ভুল বোঝা থেকেই mythএর জন্ম হয়। বৈজ্ঞানিকদের এ মতের সত্যতার প্রমাণ .তো হাতে-হাতেই পাওয়া গেল।
৭.
আষাঢ় সম্বন্ধে বাংলাদেশে আর-একটি কিংবদন্তী আছে, যা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে এবং চিরকাল লেগেছে। কথায় বলে ‘আষাঢ়ে গল্প’, কিন্তু গল্পের সঙ্গে আষাঢ়ের কি নৈসর্গিক যোগাযোগ আছে তা আমি ভেবে পাই নে।
আমার বিশ্বাস, গপের অনকল ঋতু হচ্ছে শীত, বর্ষা নয়। কেননা গল্প লোকে রাত্তিরেই বলে। তাই পৃথিবীর অফুরন্ত গল্পরাশি একাধিক সহস্র রজনীতেই বলা হয়েছিল। শীতকাল যে গল্প বলার ও গল্প শোনার উপযুক্ত সময় তার কারণ শীতকালে রাত বড়ো দিন ছোটো। অপর পক্ষে আষাঢ়ের দিনরাতের হিসেব শীতের ঠিক উলটো; একালের দিন বড়ো, রাত ছোটো। দিনের আলোতে গল্পের আলাদিনের প্রদীপ জ্বালানো যায় না।