অনেকে বলেন যে, কবির উক্তি আমাদের জ্ঞানের বাধাধরপ। যা চোখে দেখবার জিনিস, শোনা কথা নাকি সে জিনিসের ও চোখের ভিতর একটা পর্দা ফেলে দেয়। এ পৃথিবীতে সব জিনিসকেই নিজের চোখ দিয়ে দেখবার সংকপটা অতি সাধ! কিন্তু স্মৃতি যে প্রত্যক্ষের অন্তরায় এ কথাটা সত্য নয়। আমরা যা-কিছু প্রত্যক্ষ করি তার ভিতর অনেকখানি স্মৃতি আছে, এতখানি যে প্রত্যক্ষ করবার ভিতর চোখই কম ও মনই বেশি। এ কথা যাঁরা মানতে রাজি নন তাঁরা বের্গস’র Matter and Memory নামক গ্রন্থখানি পড়ে দেখলেই ইন্দ্রিয়গোচর বিষয়ের সঙ্গে স্মৃতিগত বিষয়ের অঙ্গাঙ্গিসম্বন্ধটা স্পষ্ট দেখতে পাবেন। সে যাই হোক, কবির হয়ে শুধু এই কথাটা আমি বলতে চাই যে, কবির উক্তি আমাদের অনেকেরই বোজা চোখকে খুলে দেয়, কারো ভোলা চোখকে বুজিয়ে দেয় না। কবিতা পড়তে পড়তে অনেকের অবশ্য চোখ ঢলে আসে, কিন্তু তার কারণ স্বতন্ত্র।
সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে যাঁর কিছুমাত্র পরিচয় আছে তিনিই জানেন যে ও-সাহিত্য বর্ষার কথায় মুখরিত। বর্ষা যে পর্ব-কবিদের এতদর প্রিয় ছিল তার কারণ সেকালেও বর্ষা দেখা দিত গ্রীষ্মের পিঠ পিঠ। ইংরেজ কবিরা যে শতমুখে বসতের গণগান করেন তার কারণ সে দেশে বসন্ত আসে শীতের পিঠ পিঠ। ফলে সে দেশে শীতে মিয়মাণ প্রকৃতি বসতে আবার নবজীবন লাভ করে। বিলেতি শীতের কঠোরতা যিনি রক্তমাংসে অনুভব করেছেন, যেমন আমি করেছি, তিনিই সে দেশে বসন্তঋতু-স্পর্শে প্রকৃতি কি আনন্দে বেঁচে ওঠে তা মর্মে মর্মে অনুভব করেছেন। সে দেশ ও ঋতু প্রকৃতির ফুলসজ্জা।
সংকৃত কবিরা যে দেশের লোক সে দেশে গ্রীষ্ম বিলেতি শীতের চাইতেও ভীষণ ও মারাত্মক। বাণভট্টের শ্রীহর্ষচরিতে গ্রামের একটি লম্বা বর্ণনা আছে। সে বর্ণনা পড়লেও আমাদের গায়ে জ্বর আসে। এ বর্ণনা প্রকৃতির ঘরে আগুন লাগবার বর্ণনা। যে ঋতুতে বাতাস আসে আগুনের হলকার মতো, যে ঋতুতে আলোক অগ্নির রূপ ধারণ করে, যে ঋতুতে পত্র পুষ্প সব জ্বলে পড়ে ছাই হয়ে যায়, আর বৃক্ষলতা সব কঙ্কালসার হয়ে ওঠে, সে ঋতুর অতে বর্ষার আগমন, প্রকৃতির ঘরে নবজীবনের আগমন। কালিদাস একটি লোকে সেকালের কবিদেব মনের আসল কথা বলে দিয়েছে–
বহুগুণরমণীয়ঃ কামিনীচিত্তহারী
তরুরিটপলতানাং বান্ধবো নির্বিকার।
জলদসময় এষ প্রাণিনাং প্রাণভূতো
দিশতু তব হিতানি প্রায়শো বাঞ্ছিতানি।।
পৃথিবীতে যে বস্তুই ‘প্রাণিনাং প্রাণভূতো’ সেই বস্তুই শুধু কামিনী-চিত্তহারী নয় কবি-চিত্তহারীও। আর কালিদাস যে বলেছেন ‘কামিনী-চিত্তহারী’ তার অর্থ–যা সর্বমানবের চিত্তহারী তা স্বীজাতিরও চিত্তহারী হবার কথা, কেননা শ্ৰীলোকও মানুষ। উপরন্তু শ্রীজাতির সঙ্গে প্রকৃতির সম্বন্ধ অতি ঘনিষ্ঠ। এত ঘনিষ্ঠ যে অনেকের ধারণা নারী ও প্রকৃতি একই বস্তু, ও-দুয়ের মধ্যে পুরুষ শুধু প্রক্ষিপ্ত।
৩.
আমাদের দেশে গ্রীষ্মের পরে বর্ষার আবির্ভাব প্রকৃতির একটা অপরূপ এবং অদ্ভুত বদল। গ্রীষ্ম অন্তত এ দেশে ধীরে ধীরে অলক্ষিতে বর্ষায় পরিণত হয় না। এ পরিবর্তন হ্রাসও নয় বৃদ্ধিও নয়, একেবারে বিপর্যয়। বর্ষা গ্রীষ্মের evolution নয়, আমূল revolution। সুতরাং বর্ষার আগমন কানারও চোখে পড়ে, কালারও কানে বাজে। কালিদাস বর্ষাঋতুর বর্ণনা এই বলে আরম্ভ করেছেন
সশীকরাম্ভোধরমত্তকুঞ্জর-
স্তড়িৎপতাকোহশনিশব্দমদলঃ।
সমাগতো রাজবদুদ্ধতদ্যুতি–
ঘর্নাগমঃ কামিজনপ্রিয়ঃ প্রিয়ে।।
বর্ষার এতাদৃশ রূপবর্ণনা ইউরোপীয় সাহিত্যে নেই। কারণ এ ঋতু ও-বেশে সে দেশে প্রবেশ করে না। ইংলন্ডে দেখেছি, সেখানে বৃষ্টি আছে কিন্তু বর্ষা নেই। বিলিতি প্রকৃতি সদাসর্বদা মুখ ভার করে থাকেন এবং যখন তখন কাঁদতে শুরু করেন, আর সে কান্না হচ্ছে নাকে-কান্না, তা দেখে প্রকৃতির উপর মায়া হয় না, রাগ ধরে। সে দেশে বিদ্যুৎ রণপতাকা নয়–পিদিমের সলতে, তার মুখের আলো প্রকৃতির অট্টহাস্য নয়—রোগীর মুখের কষ্টহাসি। আর সে দেশের মেঘের ডাক অশনিশব্দমর্দল নয়, গাব-চটা বাঁয়ার বকচাপা গ্যাঁঙরানি। এক কথায় বিলেতের বর্ষা থিয়েটারের বর্ষা। ও গোলাপপাশের বৃষ্টিতে কারো গা ভেজে না, ও টিনের বজ্ৰধ্বনিতে কারো কান কালা হয় না, ও মেকি বিদ্যতের আলোতে কারো চোখ কানা হয় না। বিলেতের বর্ষার ভিতর চমকও নেই চটকও নেই। ওরকম ধ্যানমঘনে প্যানপেনে জিনিস কবির মনকে স্পর্শ করে না, তাই বিলেতি সাহিত্যে বর্ষার কোনো রূপবর্ণনা নেই। যার রূপ নেই তার রূপবর্ণনা কতকটা যার মাথা নেই তার মাথাব্যথার মতো। শেলির মন অবশ্য পর্বতশঙ্গে মেঘলোকে বিচরণ করত। কিন্তু সে মেঘ হচ্ছে কুয়াশা, তার কোনো পরিচ্ছিন্ন মতি নেই। সুতরাং তাঁর আঁকা প্রকৃতির ছবি কোনো ফ্রেমে আঁটা যায় না, যেমন West Windকে বাঁশির ভিতর পোরা যায় না। ফ্রেম কথাটা শুনে সেই-সব লোক চমকে উঠবেন যাঁরা বলেন যে, অসীমকে নিয়েই কবির কারবার। অবশ্য তাই। জ্ঞানের অসীম সীমার বাইরে, কিন্তু আর্টের অসীম সীমার ভিতর।
৪.
বর্ষা যে রাজার মতো হাতিতে চড়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে নিশান উড়িয়ে ধুমধড়ক্কা ক’রে আসে, এ ঘটনা এ দেশে চিরপুরাতন ও চিরনবীন। সুতরাং যুগ যুগ ধরে কবিরা বর্ষার এই দিগবিজয়ী রাজরপ দেখে এসেছে এবং সে-রপ ভাষায় অকিত করে অপরের চোখের সম্মুখে ধরে দিয়েছে। আমাদের দেশে বর্ষার রূপের মতো আমাদের কাব্যসাহিত্যে তার বর্ণনাও চিরপুরাতন ও চিরনবীন। মানুষের পনেরক্তি প্রকৃতির পুনরুক্তির অনুবাদ মাত্র।