তখন মনে মনে স্বতই এই ভাব জাগিয়া উঠিবে, —
‘দুঁহু মুখ সুন্দর কি দিব তুলনা।
কানু মরকত মণি, রাই কাঁচা সোনা ৷।”
তখনই রূপের তৃপ্তি। বিভোরতায়—বিহ্বলতায়—বিমূঢ়তায়—রূপসাগরে ডুবিয়া অতল তলে ডুবিয়া যাওয়ায় রূপের পরিতৃপ্তি। উপভোগ এবং আস্বাদনে নহে। একেবারে আত্মহারা হইয়া পাথরের মত ডুবিতে হইবে, তবে তৃপ্তি সম্ভবপর হইবে।
বিকাশে ও বিলাসে রূপ, সঙ্কোচে এবং কেন্দ্রীকরণে নাম। নাম–বংশীরব; রূপ–ব্ৰজবিলাস। নাম–অনাহত ধ্বনি; রূপ–ধ্যানগম্য বিকাশ। নাম—শ্ৰীরাধা; রূপ–শ্ৰীমতী। নামের আহ্বানে রূপের বিকাশ। প্রথমে বংশীধ্বনি, তবে অভিসার। আর কেমন করিয়া বুঝাইব—নাম ও রূপ কি ও কেমন? জানি তোমায় নামে; সেই নামের উপর রসের ঢেউ খেলিয়া রূপের কোটিবালেন্দুবিকাশ হয়। গায়ত্রীর ঝঙ্কারে জগজ্যোতির অপরূপ রূপ ফুটিয়া উঠে। সে রূপ দেখিয়া তবে ‘তৎসবিতুৰ্বরেণ্যং’কে খুঁজিবার সাধ হয়। শিশু মহাঘোরে মা বলিয়া–ক্ৰন্দনের নাম-রোলে ভূমিষ্ঠ হয়; তাহার পর ধীরে ধীরে বয়ঃপ্ৰাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে মাতৃরূপ দেখিতে পায়। নব বসন্তের সূচনার পূর্বেই ভিতরে ও বাহিরে কিসের ও কাহার ডঙ্কা বাজিয়াছে, কাহার কাড়া-নাকার পড়িয়াছে, তাই বৃক্ষচৰ্ম্ম ভেদ করিয়া নব কিশলয়সকল নবানুরাগে লোহিতাভ হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে, কোকিলের রবে পঞ্চমের শব্দমদিরা কে যেন ঢালিয়া দিতেছে,–আমি নয়নময় হইয়া তোমার নূতন রূপ দেখিতেছি। তুমিও আমায় দেখিতেছ। তোমার নবীনতার আপ্লাবনে আমিও ত নিতুই নৃতন; তুমি নবীন কিশোর, রসের সাগর; নবীনা কিশোরীর নবীনতার সুষম তুমিও ত দেখিবে! আমারই মতন নয়নময় হইয়া পলকহীন নয়নে তুমিও ত দেখিবে! আমি গাছভরা ফুলের আলোয় মুগ্ধ হইয়া,দেখিতে থাকি। ফুল কি আমায় দেখে না? নিশ্চয়ই দেখে; নহিলে আমি দেখিব কেন? আমি যাহাকে দেখিয়া পাগল হই, সে নিশ্চয়ই আমাকে দেখিয়া পাগল হয়। চাদ দেখে, সূৰ্য্য দেখে, তারকাগণ। দেখে,–গগনের কোটি শোভা কোটি নয়নে দেখে-তরু লতা পাতা, পুষ্প ফল কোরক,–আব্রহ্ম তৃণ পৰ্য্যন্ত সবাই দেখে। কেন না, আমি যে সকলকে দেখি-বিস্ময়বিস্মফারিত নেত্ৰে কেবলই দেখি। এই দেখাদেখিই রূপোল্লাস, এই নয়নে নয়নে মেশামিশিই রূপোল্লাস।
তুমি আমি দেখাদেখির ব্যাপারে মাতিয়া থাকিলে এ দেখাদেখির মাধুৰ্য্য উপভোগ করিবে কে? সাধকের সেইটুকুই লাভ। সাধক তৃতীয় ব্যক্তি হইয়া দূরে দাঁড়াইয়া কেবল দেখেন। এই মাধুৰ্য্য উপভোগ বৈষ্ণব ভক্তিশাস্ত্রের বিশিষ্টতা; এই তৃতীয়ের অবধারণই ভক্তিশাস্ত্রের মৌলিকতা। তৃতীয় ব্যক্তি না থাকিলে সাধনা যে দুষ্কর হইয়া পড়ে; বিশেষতঃ মধুর রসের সাধনা-প্রেমের উন্মেষ ঘটাইতে হইলে কিছু কালের জন্য তৃতীয় ব্যক্তি হইয়া দাঁড়াইতেই হইবে। দূতী না থাকিলে রসের বিকাশ ঘটবে কেমন করিয়া! ভক্তি এবং প্রেমের এই বিভিন্নতা বুঝিবার ও বুঝাইবার বিষয়। প্রয়োজন হইলে ইহার আলোচনা পরে করিব। আপাততঃ নাম ও রূপের বিবৃতি সংক্ষেপে দিয়া রূপোল্লাসের চিত্ৰ দেখাইলাম। বলিবার কথা বলা হইল না; যিনি বলাইবার মালিক, তিনি কুপা না করিলে বলা হইবে না।
“মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম।
যৎকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দমাধবম৷।“
(‘প্রবাহিণী, ১০ মাঘ ১৩২০)
০১. ভূমিকা ও জীবনকথা (পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়)
ভূমিকা
পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাবলী বহু দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রে বিক্ষিপ্ত হইয়া আছে। আমরা দুই খণ্ডে আমাদের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত নির্বাচন ও সঙ্কলন করিলাম। বহু প্ৰবন্ধ, নিবন্ধ ও রসরচনা এখনও অবশিষ্ট রহিল, কয়েকটি সাময়িক-পত্ৰ এখনও সংগ্ৰহ করিতে পারা যায় নাই। ভবিষ্যতে সেগুলি হইতে সঙ্কলন করিয়া তৃতীয় খণ্ড রচনাবলী প্ৰকাশ করিবার পথ খোলা রহিল।
আমরা বৰ্ত্তমান খণ্ডে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী যোজনা করিয়া দিলাম; বিস্তৃততর পরিচয় ‘সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা’র ৮২ সংখ্যক গ্রন্থে মিলিবে।
জীবনকথা
১৮৬৬ সনের ২০ এ ডিসেম্বর (৬ পৌষ ১৭৮৮ শক, বৃহস্পতিবার) ভাগলপুরে পাঁচকড়ির জন্ম হয়। তাঁহার পিতা হালিশহর-নিবাসী বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায় তখন ভাগলপুরে কালেক্টরী আপিসে ওয়ার্ডস ক্লার্ক ও বাটোয়ারী ক্লার্কের পদে নিযুক্ত ছিলেন।
পাঁচকড়ি ছিলেন পিতা-মাতার একমাত্র আদরের সন্তান; তাঁহার শিক্ষা-দীক্ষা পিতার সান্নিধ্যে ভাগলপুরেই সমাধা হয়। তিনি ১৮৮২ সনে ভাগলপুর জিলা-স্কুল হইতে প্ৰবেশিকা পরীক্ষা (১ম বিভাগ), এবং ১৮৮৫ ও ১৮৮৭ সনে পাটনা কলেজ হইতে এফ. এ. (২য় বিভাগ) ও বি. এ. (২য় বিভাগ, সংস্কৃত অনার্স) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
তরুণ বয়সে পাঁচকড়ি ধৰ্ম্মপ্রচারক শ্ৰীকৃষ্ণপ্ৰসন্ন সেনের দ্বারা বিলক্ষণ প্রভাবিত হইয়াছিলেন। শ্ৰীকৃষ্ণপ্ৰসন্নের ‘ভারতবর্ষীয় আৰ্য্যধৰ্ম্মপ্রচারিণী সভা’ ও ‘সুনীতিসঞ্চারিণী সভা’র জন্য এক সময়ে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়াছিলেন। কিছু দিন পরে মনের অকুশল ঘটায় তিনি শ্ৰীকৃষ্ণপ্ৰসন্নকে ছাড়িয়া পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণির সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট হন। পাঁচকড়ি লিখিয়াছেন :–’বি.এ. পাস করিয়া কলিকাতায় আসিয়াছিলাম; পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি মহাশয়ের হিন্দুধৰ্ম্ম প্রচারকার্য্যে লেখক ও বক্তারূপে সহায়তা করিতাম।…১৮৮৭ খ্ৰীঃ অব্দ হইতে ১৮৯১ খ্ৰীঃ অব্দ পৰ্য্যন্ত আমি কলিকাতায় আসিতাম যাইতাম, সাহিত্য-চৰ্চা করিতাম, মাসিক ও সাপ্তাহিকে লিখিতাম, তখন আমাদের একটা বড় দল ছিল, সে দলের আনুকূল্য লাভ করিবার জন্য অনেকে আমার আনুগত্য করিতে বাধ্য হইতেন।‘