এই সৃষ্টিপ্ৰহেলিকার মধ্যে এক জ্ঞাত আমি; আমি ছাড়া আর যাহা কিছু, তাহা আমারই জ্ঞেয়; জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের সম্বন্ধ যাহার দ্বারা সাধিত হয়, তাহাই জ্ঞান। সুতরাং সৰ্ব্বাগ্রে জ্ঞাতাকে বুঝিতে হইবে। জ্ঞাতা আমি–দশোন্দ্ৰিয়সংযুক্ত, শ্রবণ-মনন-নির্দিধ্যাসনসমেত, একাদশ আসক্তিসমন্বিত দেহী আমিই জ্ঞাত। আমি কে? বলিতে পারিলাম না। আমি কে। তবে এইটুকু বুঝি যে, আমি সর্বময় ও সর্বব্যাপী। দর্শন, শ্রবণ, আস্বাদন, আত্মাণ প্ৰভৃতির সাহায্যে আমি যাহাদের বা যে সকল বিষয়ের অনুভূতি সাধন করিয়া থাকি, সে সকলই আমিময়, আমার আমিত্বে মাখা, আমার বৈশিষ্ট্যবিজড়িত। অম্ভণকন্যা বাক শ্রুতির অপূর্ব ভাষায় এই সিদ্ধান্তটি মানবসমাজকে এবং সাধকবর্গকে বুঝাইয়া দিয়াছেন। শ্ৰীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর যে প্ৰকার সরল ভাষায় দেবী সূক্তের ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা অপেক্ষা অধিকতর সরল ভাযায়। উহার ব্যাখ্যা সম্ভাবে না। বাহুল্যভয়ে আমি তাহার সন্দর্ভের পুনরুদ্ধার করিলাম না, এবং গত কার্ত্তিক মাসের ‘সাহিত্যে’ প্ৰকাশিত “উপাসনাতন্ত্ৰ” শীৰ্ষক আমার লিখিত সন্দর্ভের অংশবিশেষ উদ্ধার করিলাম না। সুধী পাঠক এই দুইটি সন্দর্ভ পড়িয়া লইলে, লেখকের পরিশ্রমের লাঘব হইবে। ঐ দুইটি সন্দর্ভের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করিয়া আমরা নাম ও রূপের আলোচনা করিব।
বলিয়াছি ত, নাম concept অর্থাৎ যাহা চিন্তার অভিজ্ঞান, যাহা নিজে বুঝি, পরকে নিজের মতন করিয়া বুঝাইতে পারি না,-যাহ ভিতরে ফুটিয়া উঠে, বাহিরে শব্দমাত্রে অভিব্যক্ত হয়,-যাহা অনেকটা মূকাস্বাদনবৎ, বোবার মিষ্টান্ন আস্বাদনের মতন, ভোজনান্তে যে আহিলাদের প্রকটন হয়, তাহা কদাচিৎ একটা চীৎকারে অভিব্যক্তি হইলেও হইতে পারে,-তাহাই নাম। শিশুকে দাম্পত্য রসের আস্বাদন দেওয়া যায় কি? যে জন্মমাত্রেই পিতৃহীন, তাহাকে পিতৃস্নেহের মৰ্ম্ম বুঝান যায় কি? সূৰ্য্যোদয়, সূৰ্য্যাস্ত প্রভৃতি নৈসৰ্গিক লীলা তুমি আমি সবাই দেখি-নয়ন ভরিয়া দেখি। পরন্তু সে রূপ দেখিয়া উভয়ের মনে যে ভাবোদয় হয়, তাহ কেহই কাহাকেও ঠিকমত বুঝাইতে পারি না। বুঝাইতে পারি না বটে, তবে বুঝাইবার চেষ্টায় ইঙ্গিত করিয়া থাকি। তুমি আমার ভাবের ভাবুক হইলে সে ইঙ্গিত কতকটা বুঝিলেও বুঝিতে পার। এই ইঙ্গিতই নাম। অন্তরঙ্গ ভাবের দ্যোতনাকেই নাম বলা যায়। তাই নাম বড়, রূপ তদপেক্ষা ছোট। তাই কৃষ্ণ অপেক্ষা কৃষ্ণনামের গুরুত্ব অধিক। রূপবিলাসিনী সত্যভামা এইটুকু বুঝিতে পারেন নাই,–কেবল রূপসাগরেই ডুবিয়াছিলেন, রূপের মহত্ত্বে বিমূঢ় ছিলেন ; দৰ্পহারী মধুসূদন অপুর্ব ছলে সত্যভামার সে ভ্রম অপসারণ করিয়াছিলেন। মহাভারতের পারিজাতহরণ এবং সত্যভামার দর্পচূৰ্ণ আখ্যায়িকা, নামের মাহাত্ম্যই, অর্থবাদের সাহায্যে বুঝাইয়াছেন।
রূপ–percept। যাহা রসগ্রাহ্য, তাহাই রূপ; যাহা অনুরাগ ও বিরাগের বিষয়ীভূত, তাহাই রূপ; যাহা অনুভবীর মানস পটে ফুটিয়া উঠে, যাহা ছায়া প্ৰতিচ্ছায়ার হিসাবে ভিতরে ও বাহিরে-বাহিত্যু প্ৰকৃতিতে এবং অন্তঃপ্রকৃতিতে প্রকট হয়, তাহাই রূপ। কেবল বাহ প্ৰকৃতি রূপ নহে, দশোন্দ্ৰিয়গ্ৰাহী যাহা, কেবল তাহাই রূপ নহে। প্রকৃতির আস্তরণে রসের বিকাশ হইলেই রূপ ফুটিয়া উঠে। রূপ ফুটে বটে, পরন্তু উহার উপভোগে তৃপ্তি নাই৷
“জনম অবধি হাম সে রূপ নেহারিনু
নয়ন না তিরপিত ভেল।“
তৃপ্তি হয় না, যত দেখি, তত আরও দেখিতে সাধ যায়,–নয়নময় হইয়া মীনের ন্যায় নির্নিমেষ নয়নে অনবরত দেখিতে থাকিলেও দেখার সাধ মিটে না। কেন না, অনুরাগাপিপাসার উপর দর্শন স্পৰ্শন আদি ক্রিয়ার প্ৰতিষ্ঠা। এই গতিশীল সৃষ্টিচাতুরীর মধ্যে স্থির কিছু নাই; সব চলিতেছে, ক্ষণে ক্ষণে সকলের পরিবর্তন হইতেছে। কাজেই যাহা দেখিতে সাধ যায়, নয়ন পালটিলে বা ক্ষণকাল অতিবাহিত হইলে তাহা ত আর থাকে না।–যে ছবি নিমেষের জন্য নয়নের উপর পাড়িয়াছিল, তাহা ত আর থাকে না-তাই দেখার সাধ আর মিটে না। অনুভূতিতে তৃপ্তি নাই। — রসের পিপাসা মিটে না। তাই রূপের সাগর-অনন্ত উৰ্ম্মিমালায় আন্দোলিত, কোটি বীচিবল্লৱীখচিত, তরঙ্গভঙ্গবাকুল রূপের সাগর। এ সাগরে স্থির থাকে কাহার সাধ্য! স্থির থাকে না, স্থির থাকা যায় না। বলিয়াই সাধ মিটে না। ‘লাখ লাখ যুগ’ সে রূপ হেরিলেও উহা নিতুই নূতন一ক্ষণে নূতন, পলে পলে নূতন। নবীনতার অসংখ্যা ও অব্যয় আন্দোলনে–প্ৰকম্পিনে–শিহরণে রূপের বিকাশ। ফলে সে রূপে তৃপ্তি নাই।
কিন্তু আছে—তুমি আমায় দেখ, আমি তোমায় দেখি-উভয়ের নবীনতা উভয়ের ভাবে ডুবিয়া যাউক—তাহা হইলেই রূপের তৃপ্তি নাই।
কিন্তু আছে—তুমি আমায় দেখ, আমি তোমায় দেখি—উভয়ের নবীনতা উভয়ের ভাবে ডুবিয়া যাউক—তাহা হইলেই তৃপ্তি সম্ভবপর হয়।
“তুয়া অপরূপ রূপ হেরি দূর সঞে,
লোচন মন দুঁহু ধাব।“
যখন লোচন ও মন-দু-ই রূপ দেখিবার জন্য ধাবিত হইবে, তখন প্ৰাণ হইতে ঝঙ্কার উঠিবে,
‘সজনি, ভাল করি পেখন না ভেল।
মেঘমালা সঞে তড়িতলতা জনু,
হৃদয়ে শেল দেই গেল।।“
এই অতৃপ্তি উভয়ের মনে জাগিয়া উঠিবে। যখন উঠিবে, তখন দেখিবে এবং বুঝিবে,–
‘যত রূপ তত বেশ ভাবিতে পাঁজর শেষ,
পাপ চিতে নিবারিতে নারি।“