কুল্ কুল্, কুল্ কুল্, কুল্ কুল্! আর বিলম্ব সহে না! জীবনের পাড়ি প্রায় শেষ করিয়াছি। সন্ধ্যার ঘন তমিস্রা ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে, অজ্ঞাতসারে চারি দিকে আসিয়া যবনিকার মত ঝুলিয়া পড়িতেছে! সন্ধ্যার মঙ্গল-তারা ঐ দূরে চক্রবালের উপর, কাৰ্ত্তিকের নদী-প্রদীপের মত টিপি টিপি ফুটিয়া উঠিতেছে। অস্তমিত সূৰ্য্যের সপ্ত দীপ্তি ক্ৰমে অন্ধকারের ক্ৰোড়ে লুকাইল। এইবার গৃহস্থের সান্ধা মঙ্গলশঙ্খ বাজিয়া উঠিবে। আর বিলম্ব সহে না। চল প্রবাহিণী—আগে চল! এখনও যতটুকু সময় বাকী আছে, সেই সময়টুকুর মধ্যে তোমার কৃপায় যত দূর পারি, আগাইয়া যাই! জানি বটে, অনন্ত সাগরের অসীমতায় ডুবিবার অবসর হইবে। না।;-জানি বটে, ‘এবার বা আসা হয় বিফল।’ এবারকার যাত্রা, শুভ যাত্রা নহে। এ দুৰ্গম পথ হাটিয়া শেষ করিতে পারিব না। অনন্তের দেখা পাইব না। তবুও আশা ত ছাড়িতে ‘পারি না! তবুও মনে হয়, প্রদোষের এই মুহূৰ্ত্তকালের মধ্যে তোমার কুপাস্রোতের—করুণার তরল তরঙ্গের উপর গা ভাসাইয়া যাইতে পারিলে, হয়ত বা অনেকটা পথ আগাইয়া যাইব! সাগর-সঙ্গমে পৌঁছিতে না পারি। —মুক্ত-বেণীর মোহনাও ত দেখিতে পাইব! চল প্রবাহিণী–আগে চল। আর যে বিলম্ব সহে না।
মনে পড়ে কত কথা! একে একে স্মৃতির সরোবরবক্ষে কত ব্যথা বুদ্ধদের আকারে ফুটিয়া উঠিতেছে,–নৈরাশ্যের পবন-তাড়নে আবার তাহারা ফাটিয়া গালিয়া কোথায় বিলীন হইয়া যাইতেছে! এই নৈরাশ্যজাডো তুমি আশার গতি! তুমি চলিয়াছ বলিয়া আমিও চলিতে পারিব। তোমার গতি আছে বলিয়া আমার স্থিতির বিসৰ্পণ সম্ভবপর হইবে। আমার অতীতের কালরাত্ৰি অনাগতের উষার দু্যতিতে প্ৰফুল্ল হইয়া উঠিবো! চল, চল প্ৰবাহিণী! স্নেহময়ী-কোটি-আশাবলয়িত তরঙ্গিণী-চল! ভাবের জলরাশি শত উচ্ছাসে উচ্ছাসিত করিয়া তুমি আগে চল! আমার নিথর নিষ্কম্প নৈরাশ্য-সরোবরে গতির শত-তরঙ্গপ্ৰফুল্লিত আশা-মেখলা পরিস্ফুট হইয়া উঠক! চল, চল—আগে চল।
এই সাধ–এই বাসনা—এই আকাঙ্ক্ষা।
“আমি রূপ-সাগরে, পালের ভরে ভেসে যাব।
তরঙ্গ-তুফানে পড়ে ডুবিয়া মরিব।”
ডুবিয়া মরিব,–ভাসিব না! অতল তলে একেবারে মিশিয়া যাইব। আমার আছে নাম,–আর আছে রূপ! সে নাম স্মৃতির চিন্তা-চুল্লীতে অহরহঃ পুড়িতেছে! সে রূপ চিন্তা-অঙ্গের কোটি অগ্নি-জিহবার বেষ্টনে লোল তরঙ্গে ফুটিয়া উঠিতেছে! থাকিবে না কিছু। সব পুড়িয়া ভস্ম হইবে। সে ভস্ম শ্মশান-বায়ুবিতাড়নে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িলে আমি মরমে মরিব। কিন্তু সে ভস্ম, সে বিভূতি আনন্তের নীল অঙ্গে মিশাইয়া দিতে পারিলে কোটি জন্মের তপস্যা সিদ্ধ হইবে। চল চল প্রবাহিণী-ফেব্রুপালের হা-হা রবকে স্তব্ধ করিয়া, শুষ্ক বায়ুর স্বনানকে নিঃশব্দ করিয়া তোমার রসের তরল তরঙ্গের কোটিকণ্ঠে উল্লাস-গীতি গায়িতে গায়িতে—চল প্রবাহিণী-রূপ-সাগরের দিকে অগ্রসর হও! তোমার প্রত্যেক তরঙ্গাভিঘাতে নামের প্রতিধ্বনি জগন্ময় হইয়৷ উঠক! তোমার স্বচ্ছ সলিল বিস্তারে রূপের অমল ধবল সুন্দর রেখা-উদ্ধে ও নিয়ে যুগল ইন্দ্ৰধনুর ন্যায় ফুটিয়া উঠক! আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হউক! মিটবে না কি ? এ সাধ—এ বাসনা মিটবে না কি ? আশা মিটে না,–আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় না। গগনোেপাস্তরেখার মত-যত ধরিতে যাইবে, ততই ছুটিয়া পালাইবে ; কিন্তু চেষ্টায় যে সুখ আছে-ছুটাছুটিতে যে উন্মাদনা আছে—ধরি। ধরি করি ধরিতে নারি, এই প্রয়াসে যে তৃপ্তি আছে, তাহা ত জীবনে আর কিছুতে নাই! তাই বলি, চল প্রবাহিণী, আগে চল। কুল কুল, কুল কুল, কুল কুল,–রজতকিঙ্কিণীর এই নিকণে আমায় আশা-সুখে মুগ্ধ করিয়া চল প্রবাহিণী—আগে চল।
(প্রবাহিণী, ৩ মাঘ ১৩২০)
রূপোল্লাস
‘রসো বৈ সঃ’—শ্ৰীভগবান রসময় এবং রসগ্ৰাহ্য। এই রস নাম এবং রূপের সাহায্যে অনুভূতিগম্য। এই রসকে বুঝিতে পারিলে শ্ৰীভগবানকে বুঝা যায়। সুতরাং নাম ও রূপ না বুঝিলে ভগবৎ-অনুভূতি সম্ভবপর হয় না। ইংরেজীনবীস দার্শনিকগণকে দুইটি ইংরেজী প্রতিশব্দে নাম ও রূপের মৰ্ম্মের কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত করা সম্ভবপর হইতে পারে। ইংরেজী দার্শমিক ভাষায় নামকে Concept বলিয়া ভাষান্তরিত করিতে পারি; রূপের প্রতিশব্দ Percept বলিলেই বোধ হয়, পৰ্যাপ্ত হইতে পারে। Concept এবং Percept এই দুই বিষয়ে সমন্বয় সাধন করিতে পারিলে ভগবৎবিভূতির আংশিক অনুভূতি হইতে পারে।
বিষয়টা আরও একটু খুলিয়া বলিবার চেষ্টা পাইব। কেন না, ভক্তিশাস্ত্র এবং ভগবদ্যারাধনাপদ্ধতি এই নাম ও রূপের বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত। ভারতবর্ষের উপাসনাপদ্ধতি ঠিকমত বুঝিতে হইলে, নাম ও রূপের–অন্তর্নিহিত গুপ্ত কথা কিছু বুঝিতেই হইবে। অম্ভণকন্যা বাককথিত দেবীসুক্তের আত্মতত্ত্বের ব্যাখ্যা অবলম্বন করিয়া শাণ্ডিল্য ও নারদ ভক্তিসূত্র রচনা করিয়াছেন–সেই ব্যাখ্যার বিবৃতি মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে সম্যক ভাবে করা হইয়াছে। —তন্ত্রের সকল সিদ্ধান্তগ্রন্থেই ঐ ব্যাখ্যাই হেঁট মুণ্ডে গ্ৰহণ করা হইয়াছে;-বৈষ্ণব ভক্তিসাধনপদ্ধতিতে ঐ ব্যাখ্যা অগ্ৰাহ করা হয় নাই। দেবীসূক্ত না বুঝিলে ভক্তিশাস্ত্র বুঝা যায় না। মনীষী শ্ৰীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর ত্ৰিবেদী ‘কালস্রোত’ নামক একখানি পুস্তকের সূচনা লিখিতে যাইয়া দেবী সূক্তের ব্যাখ্যা করিতে প্ৰয়াস পাইয়াছেন। ‘সাহিত্য’ নামক মাসিক পত্রে গত দুই বার দুর্গোৎসব উপলক্ষ্যে এই সন্দর্ভলেখকও দেবী সূক্তের ব্যাখ্যা করিতে যত্নশীল হইয়াছেন। এই সকল গোড়ার কথার একটু পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন; কেন না, নাম ও রূপ বুঝিতে হইলে একটু গোড়ার কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক।