ইহা ত গেল এক পক্ষের কথা। সাধনার হিসাবে, আত্মশক্তির উন্মেষের হিসাবে এই সকল সামগ্রীর একটা উপযোগিতা আছে। যে সাধনার পথে অগ্রসর হয় নাই, বস্তুতত্ত্বের খবর রাখে না, তাহদের সে উপযোগিতার কথা ভাষার সাহায্যে বুঝান যায় না। আত্মশক্তির উন্মেষ কেবল মনুষ্যদেহেই হয় না, জীব জন্তুর দেহেতেও আত্মার বিকাশ ঘটে, এক একটা অপূর্ব শক্তির উন্মেষ হয়। সাধকের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে সেই সকল শক্তির প্রয়োজন হইয়া থাকে। তখন সাধক বিশেষকে জীববিশেষের জীবন-সাধন করিতে হয়। যাঁহারা শিবাসাধনা করেন, তাহারা শৃগালের ন্যায় কিছু কাল অবস্থিতি করেন। ইহা অঘোরপন্থার কথা। কোথায়—কোন জীবে কোন আত্মশক্তি কেমন ভাবে ফুটিয়াছে, তাহা ত আমরা জানি না; যখন যেটা জানিতে পারি, তখন সেইটার সাধন করিয়া আয়ত্ত করিবার চেষ্টা করি। ঠিকমত, আয়ত্ত হইলে একটা সিদ্ধির লাভ হয়। এক একটি করিয়া সিদ্ধি সঞ্চয় করিয়া যখন বিশেষ ঐশ্বৰ্য্যশালী হওয়া যায়, তখনই তামসুদৰ্শন ঘটে, দেহগত আত্মার এবং বিশ্বব্যাপী আত্মার পরিচয় হয়। শক্তি সর্বত্র সমানভাবে ছড়ান আছে,–সর্ববস্তুতে, সর্বপদার্থে শক্তি আছেই। কোথায় সে শক্তির কেমন ক্রিয়া হইতেছে, তাহা কে বলিতে পারে? বিষ্ঠা মনুষ্যদেহে থাকিলে মহাবিষে পরিণত হয়, কিন্তু মাটিতে পড়িলে উহা শ্ৰেষ্ঠ সার, শূকরের উহা প্রধান ভোজ্য। তোমার পক্ষে যাহা হেয়, অন্যের পক্ষে তাহা শ্ৰেয়:। অতএব সংসারে হেয় শ্ৰেয়; কিছু নাই, পাপ পুণ্য কিছু নাই। অবস্থা গতিকে পাত্রের হিসাবে কোনটা কখন বা হেয়, কখন বা শ্ৰেয়ঃ, কখন বা পাপজ, কখন বা পুণ্যাত্মক। এই সংসারে তোমার আমার বুদ্ধির মাপকাঠিতে যাহা কিছু সদসৎ আছে, তাহদের মধ্যে যে শক্তি আছেন, তিনিই আৰ্দ্ধাশক্তি, তিনিই মহামায়া। তাঁহাকে যেখান হইতে পার, সেইখান হইতে টানিয়া বাহির করিতে হইবে। এই শক্তিসংহরণের নামই সাধনা। মাতাল না হইলে গোটকয়েক আত্মশক্তির বিকাশ হয় না-তা ভাবেই মাতাল হও, ভক্তিতেই মাতাল হও, কীৰ্ত্তনানন্দে মাতাল হও, তোমাকে মাতাল হইতে হইবে,–নইলে শক্তির বিকাশ ঘটিবে না। তন্ত্র এক সম্প্রদায়ের সাধকের জন্য সোজাসুজি মদের ব্যবস্থাই করিয়াছেন। রিরংস হইতে আর এক শ্রেণীর শক্তির বিকাশ হয়; এ কথাটা সকল সম্প্রদায়ই স্বীকার করেন। সহজিয়া, বৈষ্ণব, শৈব, কিশোরীভজা, কৰ্ত্তাভজা, পরকীয়া সাধনা—সবই রিরংসার উপর প্রতিষ্ঠাপিত। তন্ত্র উহার উপর ভাবের আবরণ রং চড়াইয়া, উহাকে মধুরতর না করিয়া, সোজাসুজি পঞ্চতত্ত্বে মৈথুনের ব্যবস্থা করিয়াছেন। ইঙ্গিতে যতটুকু পারিলামবলিলাম; ইহার অধিক আর বলা যায় না, বলিতে নাই। আবার বলিয়া রাখি, তন্ত্রের মধ্যে শক্তিসাধনার অসংখ্য ও অনন্ত পদ্ধতি নির্দিষ্ট আছে। যাহা তোমার ভাল লাগে, তাহা তোমার পক্ষে ভাল; যাহা আমার ভাল লাগে বা উপযোগী, তাহা আমার পক্ষে ভাল। তুমি নিজের পন্থার যশ কীৰ্ত্তন করিতে পার, আমি আমার পন্থার বিজয় ঘোষণা করিতে পারি; কিন্তু আসলে সব এক, সেই আত্মদর্শনচেষ্টা, ইষ্টের সাক্ষাৎকার।
(‘প্রবাহিণী’, ২৭ আষাঢ় ১৩২২)
প্ৰবাহিণী – আশা
কুল্ কুল্, কুল্ কুল্, কুল্ কুল্!–দুঃখ দারিদ্র্যের, হতাশা ও নৈরাশ্যের উপলখণ্ডময় আমার বন্ধুর জীবন-পথের উপর দিয়া চল প্ৰবাহিণী-তরল তরঙ্গে স্ফটিকস্বচ্ছ জলকণা বিকিরণ করিয়া, চল প্রবাহিণী–তোমার স্পর্শে, এ দগ্ধ জীবনের মরু-মারুত আশা-স্নেহের শীকর-সম্পউক্ত হউক! তোমার কোটিতরঙ্গ-কল্লোল-কোলাহলে জীবনের নীরব বেদনাসকল, মুখর হউক! চল প্রবাহিণী,–পৰ্ব্বত ভেদ করিয়া, স্থবিরকায় তুষাররাশিকে বিগলিত করিয়া, নৈরাশ্যের বালুক-বিস্তারকে স্নেহ-সেচনে কোমল ও সরস করিয়া, চল প্রবাহিণী,—আগে চল।
কুল্ কুল্, কুল্ কুল্, কুল্ কুল্! কোটি বীচি-বল্লরীর ঘাত-প্ৰতিঘাতে আশার রজতনিক্কণ শুনিতে শুনিতে আমার জীর্ণ দেহ তোমার তরঙ্গে ভাসিয়া চলুক। প্রবাহিণী, ভাসিয়া চল!—আগে চল! ঐ দেখ,–ঐ দূরে মহাশ্মশান-কোটি চিতার চটপটারবে নিত্য শব্দময় ঐ শ্মশানে রাবণের চিতা জ্বলিতেছে। কোটি কল্পের গৌরব-স্মৃতি, দশস্কন্ধ রাবণরূপে ঐখানে অহরহঃ জ্বলিতেছে! ঐখানেই সীতার অগ্নিপরীক্ষা হইয়াছিল,—লঙ্কার ঐ মহাশ্মশানেই ধরা-কন্যা নিষ্কলঙ্কা হইয়াছিলেন;-সনাতন কালের, সনাতনী কথার চন্দন-চুল্পী ঐখানেই জ্বলিতেছে! চল প্রবাহিণী, —ঐ ভীম। ভৈরব শ্মশানের তিন দিক বেড়িয়া আমরা উভয়ে ভাসিয়া যাই। চল, চল, আগে চল!
‘যমুনে! এই কি তুমি সেই যমুনা প্রবাহিণী–
যার বিমল তটে রূপের হাটে বিকাত নীলকান্ত মণি।’
কাল ও কালিন্দী–ভাই ও ভগ্নী। যম যমুনার সহোদর–কাল ভাবস্রোতে বিশ্বগতির ভিতর দিয়া ছুটিয়াছেন;–কালিন্দী রসের তরঙ্গে প্রেমের ব্ৰজমণ্ডল দ্বিখণ্ডিত করিয়া অনন্ত রস-সাগরের দিকে ছুটিয়াছেন। চল প্রবাহিণী-সেই রকম কুলু কুলু ধ্বনি করিয়া চল! যে ধ্বনি গোপীদিগের নূপুর-শিল্পনের প্রতিধ্বনি বলিয়া এখনও রসিকে মনে করেন! যমুনার সেই রস-তরঙ্গভঙ্গের অভিব্যঞ্জনা করিয়া গুপ্ত বৃন্দাবনের শ্যাম-শোভা দেখিতে দেখিতে, চল প্ৰবাহিণী—সেই সনাতন যামুন খাত বাহিয়া চল;–সেথায় রূপের হাট দেখিবে! তোমার গর্ভসঞ্চিত কোটি নীল জলকণাকে নয়নীরূপে পরিণত করিয়া,–চল প্ৰবাহিণী, রূপের হাট বাহিয়া আমরা চলিয়া যাই! তোমার চঞ্চল গতিতে আবার যমুনা উজান বহিবে। সেই নীলকান্ত মণির তনু-কান্তি-প্ৰতিচ্ছায়ায় তোমার অঙ্গ নীল বরণ ধারণ করবে। চল—চল—আগে চল!