সে যাহা হউক, এই নারীর নিন্দা হইতেই আমরা মৈথুন কাৰ্য্যের নিন্দা করিতে শিখিয়াছি। যে কাৰ্য্যের ফলে জীবসৃষ্টি হইবে, প্ৰজাবৃদ্ধি হইবে,–প্ৰজাবৃদ্ধি ও জীবসৃষ্টির জন্যই যাহার বিধান, তাহার নিন্দা করিতে নাই; উহাকে একটা গুপ্ত কাণ্ড বলিয়া উহার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিতে নাই। উহাকে চাপিলেই-লুকাইলেই লাম্পটার বৃদ্ধি হইবে, লোকে গুপ্ত পিশাচে পরিণত হইবে। কেবল তাহাই নহে, নরনারীর সঙ্গমটাকে জঘন্য ব্যাপার বলিয়া পরিচিত করিলেই, তাহার পর হইতে দুর্বল পুত্ৰ কন্যা উৎপন্ন হইবে, যথাশাস্ত্ৰ বংশরক্ষা দুষ্কর হইবে। জৰ্ম্মন মনীষিগণ এইটুকু বুঝিতে পারিয়াই গত কুড়ি বৎসর কাল জৰ্ম্মানির চিকিৎসকগণ মৈথুনের সায়ান্স-সম্মত পদ্ধতি প্ৰকাশ্যভাবেই ব্যাখ্যা করিতেছেন। অধ্যাপক শেঙ্ক ইহার প্রধান ব্যাখ্যাতা। চিকিৎসক ও তত্ত্বজ্ঞগণের পরামর্শ অনুসারে পরিচালিত হওয়ায় জৰ্ম্মন জাতির মধ্যে বন্ধ্যা নাই বলিলে অত্যুক্তি হইবে না; তাই আজ সংখ্যায় জৰ্ম্মান জাতি ইউরোপের শিরোমণি; কেবল তাঁহাই নহে, সুপুষ্ট সবলকায় পুত্র কন্যায় আজ জৰ্ম্মনি পূর্ণ। জৰ্ম্মনির বিদ্বজ্জনসমাজে জীবসৃষ্টির পদ্ধতির ব্যাখ্যা লজ্জাজনক নহে। আমাদের দেশে যখন তন্ত্রধৰ্ম্ম প্রবল ছিল, তখন মৈথুনটা গোপ্য, নিন্দনীয় ও জঘন্য ব্যাপার বলিয়া পরিচিত ছিল না। খ্ৰীষ্টানী বুদ্ধিতে এখন তন্ত্রের পঞ্চ মকারের নিন্দা করিলে চলিবে কেন? আবার মজা এই, যাঁহারা প্রকাশ্যে পঞ্চ মকারের নিন্দা করেন, তাঁহাদের অনেকে ভিতরে ভিতরে এক একজন মিথুন-মাস্টার। কাহারও পত্নী প্রতি একাদশ মাসের শেষে এক একটি নব কুমার বা কুমারী স্বামিচরণে উপঢৌকন দিতেছেন এবং বর্ষে বর্ষে এমনই উপঢৌকন দিতে দিতে শেষে ক্ষয়রোগে তনু ত্যাগ করিতেছেন। কেহ বা গুপ্তভাবে দুই তিনটি কামপত্নী রাখিয়াছেন; কেহ বা পরনারী দেখিলে নয়নপথে তাঁহাদের আড়ে গিলিতে চাহেন। তন্ত্রের দৃষ্টিতে এবম্প্রকারের লাম্পট্য অতিপাতক, মহাপাতক বলিয়া পরিচিত। বাহিরের লেপাফাদোরস্ত সাধুতা তন্ত্রের হিসাবে বেজায় দোষের—মহাপাপজ। তন্ত্র ভাবের ঘরে চুরি করিতে, প্রবৃত্তি লইয়া লুকাচুরি করিতে বার বার নিষেধ করিয়াছেন। তন্ত্র, প্ৰকাশ্য দুষ্ট নষ্ট নর নারীকে ক্ষমা করিতে পারেন, পরন্তু কপট শঠকে কখনই ক্ষমা করেন না। তন্ত্র বলেন, গুরুর কাছে হৃদয়ের কপাট খুলিয়া দেখাইবে, লজ্জাবোধ করিবে না। তাই তন্ত্র শিষ্যের কাছে—তন্ত্রপাঠকগণের কাছে কিছুই লুকাইয়া রাখেন নাই। ইহা দোষের নহে, বরং শ্লাঘার বিষয়।
অবশ্য ইহা স্বীকাৰ্য যে, তন্ত্রধৰ্ম্মের বেজায় অধঃপতন ঘটিয়াছিল। মানুষের ব্যবহারে ধৰ্ম্মমত উন্নত হয় বা অধঃপতিত হয়। মানুষ ভাল হইলে ধৰ্ম্ম ভাল হয়, মানুষ মন্দ হইলে ধৰ্ম্মকৰ্ম্মও মন্দ হইয়া যায়। মানুষের প্রকৃতি ও প্ৰবৃত্তির দোষে পৃথিবীর সকল প্ৰধান ধৰ্ম্মই নষ্ট হইয়াছে, মানুষের ব্যবহারের গুণে অনেক সামান্য ধৰ্ম্ম উন্নত হইয়াছে। জাতির অধঃপতন ধৰ্ম্মের দোষে ঘটে না। বিলাসে মানুষকে নষ্ট করে, হীন হেয় করিয়া তোলে; মন্দ লোকের প্রভাবে ধৰ্ম্ম ও কপটতার আশ্রয় হইয়া উঠে। ধৰ্ম্মের দোহাই দিয়া কত বিলাসী জাতি যে কত পাপ করিয়াছে, কত পশুত্বের প্রচার করিয়াছে, তাহা হিসাব করিয়া বলা যায় না। জাতি বিলাসী না হইলে ধৰ্ম্ম বিলাসের আশ্রয় হয় না। সুতরাং ধৰ্ম্মকে নিন্দা করিতে নাই; যেমন মানুষে যে ধৰ্ম্মের। যেমন ভাবে আচরণ করিবে, সেই ধৰ্ম্ম তেমনই ভাবে ফুটিয়া উঠিবে। মানুষের দোষে তন্ত্রধৰ্ম্ম নষ্ট হইয়াছে, মানুষের দোষে ভারতবর্ষের অন্য সকল ধৰ্ম্মও নষ্ট হইয়া গিয়াছে। তবে এখনও যেখানে সাধনা, যেখানে আরাধনা, সেইখানেই তন্ত্রের প্রভাব পরিস্ফুট। আত্মশক্তির উন্মেষ যিনিই করিতে চেষ্টা করিয়াছেন, তাঁহাকেই তন্ত্রের আশ্রয় গ্ৰহণ করিতে হইয়াছে। ইসলাম ধৰ্ম্মের সুফীগণ, খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্মের মঙ্কগণ-যাহারাই সাধনা করিয়াছেন, র্তাহাদিগকেই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তন্ত্রের আশ্রয় গ্ৰহণ করিতে হইয়াছে। অর্থাৎ সাধনার একটা পদ্ধতিই এখন পৃথিবীর সকল সভ্য দেশেই প্ৰচলিত আছে। সে পদ্ধতি আমাদের দেশে তন্ত্রপদ্ধতি বলিয়া। পরিচিত, অন্য সকল দেশে অন্য নামে পরিচিত; পরস্তু আসলে সকল দেশের সাধনাই একই রকমের। এই যে পঞ্চ তত্বের বা পঞ্চ মকারের সাধনা, ইহা তান্ত্রিকদিগের মধ্যে যেমন ভাবে প্ৰচলিত, অন্য সকল ধৰ্ম্মাবলম্বীদিগের মধ্যেও দেশভেদে ও রুচিভেদে কিঞ্চিৎ আকারান্তরিত হইয়া প্ৰচলিত আছে। কেহ বা মোটামুটি বাহিক হিসাবে করে, কেহ বা মানস পূজার হিসাবে করে, কেহ বা ষট্চক্ৰ ভেদের পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া করে। আবার তন্ত্রে পঞ্চ মকারের অনুকল্পের ব্যবস্থাও আছে। যথা-সুরার পরিবর্তে ডাবের জল, মিছরির সরবৎ, এমন কি, তাম্রাধারে জল পৰ্য্যন্ত অনুকল্প বিধান করা হইয়াছে। যাহার যেটা সহে, যাহার যেমন জীবন, যেমন রুচি প্ৰবৃত্তি, তাহার জন্য তেমনই ব্যবস্থা করা হইয়াছে। তন্ত্র বলেন-তোমার আত্মা যখন তোমার ইষ্ট, তখন আত্মতৃপ্তির জন্য তুমি যাহা করি, তাহাই ইষ্টদেবকে নিবেদন করিয়া করিবে। তুমি মদ্যপান নিয়মিত করিয়া থাক, মদ্যপানে বেশ আনন্দ বোধ করিয়া থাক, অথচ তুমি সুরা নিবেদন করিয়া পান কর না। যদি সত্যই বুঝিয়া থাক যে, মদ্যপান করিলে পাপ হয়, তাহা হইলে উহার পরিহার কৰ্ত্তব্য। তেমনই মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, যাহাঁই তুমি উপভোগ করিবে, তাহাই দেবতার প্রসাদ করিয়া খাও,–ইষ্টদেবীকে দিয়া আত্মতুষ্টি সাধন কর। দেবতাকে উপভোগ করাইয়া, অর্থাৎ দেবতাকে নিবেদন করিয়া, প্ৰসাদবোধে সকল সামগ্ৰী উপভোগ করিলে, উপভোগের মুখে একটা গণ্ডী পড়ে। মানুষের মধ্যে যে পশু আছে, সে পশু অবাধে প্ৰবৃত্তির পথে নাচিয়া খেলিয়া বেড়াইতে পারে না। তুমি তখন যেখানে সেখানে মদ্যপান করিয়া বেড়াইতে পরিবে না। যেখানে সেখানে মৎস্য, মাংস, মুদ্রার উপভোগ করিতে পারিবে না। সংযমের পক্ষে ইহা একটা প্রশস্ত উপায়। তন্ত্র বলিতেছেন, তোমার সঙ্গেই তোমার দেবতা ফিরিতেছেন, তোমার দেহাভ্যন্তরেই আছেন। তাঁহাকে তোমার সকল উপভোগ্য সামগ্ৰী নিবেদন করিতেই হইবে; কারণ, মায়ের ছেলেকে মায়ের প্রসাদ ছাড়া অন্য কিছু খাইতে নাই। যেমন করিয়া প্ৰসাদ করিতে হয়, তাহার পদ্ধতি তন্ত্রে লেখা আছে; সেই পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া তোমার উপভোগ্য সকল সামগ্ৰী প্ৰসাদ করিয়া লইবে। তন্ত্রের এই আদেশ মান্য করিয়া চলিলে, যেখানে সেখানে, যখন তখন মদ্যপান করা বা মৎস্য মাংস,মুদ্রার উপভোগ করা চলে না। মৈথুনেরও বেজায় বন্ধন আছে, সে সব জপ তপ করিয়া, মন্ত্র পাঠ করিয়া লতাসাধনা যে-সে মানুষের কৰ্ম্ম নহে।